মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বিলেত থেকে ফিরলেন ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর উদ্যাপিত গ্রন্থগুলি, ততদিনে প্রায় সবই প্রকাশিত হয়ে গেছে। ঢাকায় সংবর্ধিত হবেন তিনি। ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সভায় এক ব্যক্তি অভিযোগ করলেন, মধুসূদনের তিনি অনুরাগী হলেও মানতে পারেন না, কবি ‘ইংরেজ হয়ে গিয়েছেন’। তাঁর কাছে এ এক হৃদয়বিদারী দুঃখের কথা। উত্তরে মধুসূদন বলেছিলেন, ‘আমি আমার বসবার আর শয়ন করার ঘরে একেকখানি আরশি রেখে দিয়েছি। আমার মনে সাহেব হওয়ার ইচ্ছা যেমনি বলবৎ হয় অমনি আরশিতে মুখ দেখি। আরও, আমি সুদ্ধ বাঙালী নহি, আমি বাঙাল, আমার বাটী যশোহর।’
এই সেই মাইকেল, প্রথম যৌবনে যিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন ইউরোপের স্বপ্নিল ভূমিতে পাড়ি জমানোর অপেক্ষায়, এই সেই মাইকেল যিনি নস্যাৎ করতেন ভারতীয় তথা বাঙালি পরিচয়ের যে-কোনও চিহ্ন। এই সেই মাইকেল, আগামী ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, শুরু হবে তাঁর দ্বিশতবার্ষিকী! দু-দুটো শতাব্দী পার হয়ে ফিরে এল সেই তারিখ। অকালমৃত কবি প্রবীর দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘যে মানুষ চলে গেছো ভিন্ন শহরে গ্রামে,/ আমি তার ফেরার কাহিনী…’। শুধু যাওয়া-আসা, শুধু স্রোতে ভাসা নয়। ফেরা। ফিরে আসার মাহাত্ম্যে মিশে যান দুশো বছরের মাইকেল।
ফেরা মানে প্রত্যাবর্তন। সেখানে বড় হয়ে আছে আবর্তন। আবর্তন মানে গতিময় ঘূর্ণন। দুই বলের টানা-পড়েন। এক বল টানে কেন্দ্র অভিমুখে, ঘরের দিকে; কেন্দ্রাভিগ সেই আকর্ষণের উলটোদিকে থাকে কেন্দ্রাতিগ বল, নিয়ে যায় বহির্মুখে। মানবজীবন এই দুই শক্তিতে বহুলাংশে স্পন্দমান। বিশেষত প্রতিভাবানদের আয়ু প্রবাহিত হয় এরকম এক জোয়ার-ভাঁটায়। মাইকেল মধুসূদন তার সর্বোত্তম উদাহরণ। তবে, যুগে-যুগে, কালে-কালে, রবীন্দ্রপূর্ব থেকে রবীন্দ্রোত্তর কালে এ-সংকট লেখক-কবি-শিল্পীর যাপিত জীবৎকালকে অনবরত আলোড়িত করেছে। ‘পরবাস’। এই শব্দটি কত বহুস্তরিক অভিঘাতে স্রষ্টার জীবনে ক্রিয়াশীল, স্বদেশ বা বিদেশের অভিজ্ঞতায় তার আদি-অন্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। অ্যারিস্টটল থেকে আজকের জীবিত শতবর্ষীয়ান ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহু— আরও শতসহস্র দৃষ্টান্ত-সহ এই পরবাসের কাহিনি। জন্মস্থান থেকে কর্মস্থান, ক্রমাগত আসা-যাওয়ার পরিক্রমায় অনন্ত সম্ভাবনার গর্ভগৃহ।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে তাঁর বহু প্রবাসগমন, বহু দেশবিদেশ ভ্রমণের যাত্রাশেষে নিষ্কম্প অগ্নিশিখার মতো দীপ্যমান থাকে জোড়াসাঁকো-শান্তিনিকেতনের নিবাসবাটী। অনন্ত পথের শেষে গৃহমুখী অভিযাত্রাতেই তাঁর শিকড়ের ডানা। অবনীন্দ্রনাথ আবার বিচরণ-বিরোধী। জোড়াসাঁকোর ধারে দক্ষিণের বারান্দায় বসে থাকতেই তাঁর পরম সুখ। ১৯৩৯ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের প্রথম কলিটি লক্ষ করুন। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা,/ মনে মনে।’ কে জানে, অবনীন্দ্রনাথকে দেখেই এ-গান রচিত হয়েছিল কি না! ‘মনে মনে’ ভ্রামণিক স্বগৃহে সানন্দে স্থিতু অবনীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ-ঘনিষ্ঠ, তাঁর একদা সচিব, কবি অমিয় চক্রবর্তীর জীবন কিন্তু অন্যরকম। তাঁর জন্ম শ্রীরামপুরে। কিন্তু পথে-প্রবাসে তাঁর নিয়তির হাতছানি। তাঁর চিরন্তন অভিপ্রায় স্বদেশস্পর্শ, তাঁর জীবনস্রোত ক্রমাগত ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভুবনের নানা প্রান্তে। পরিভ্রমণেই তাঁর জীবন যাপিত, ফেরার আশায়, ফেরার স্বপ্নে উন্মুখ সেই জীবন। কাব্যগ্রন্থের নাম সেজন্য হয়তো ‘পারাপার’ কিংবা ‘ঘরে ফেরার দিন’, গদ্যগ্রন্থের নাম ‘চলো যাই’ অথবা ‘পথ অন্তহীন’। রবীন্দ্রনাথ আর অমিয় চক্রবর্তীর বিপরীতমুখী বিধিলিপি। ঘর আর পথের দু-রকম টান। একজন কেন্দ্রাভিগ ‘যাত্রী আমি’ আর অন্যজন কেন্দ্রাতিগ ‘পথের সংসারে’ স্বপ্ন দেখেন ঘরে ফেরার। অমিয় চক্রবর্তীর দুটি কবিতাংশ শুনিয়ে দিই। ‘পৌঁছতে হবেই বাড়ি/ কেনাবেচা শোধ করে/ গান কণ্ঠে ভরে/ ঘরে ফেরা দিনক্ষণে/ দিয়ো পাড়ি/ দীপ জ্বলে ঘরের আঙনে॥’ (‘কংগো নদীর ধারে’) আর ‘যেতে-যেতে/ ঘরের দেয়াল রাঙা আলোয় জড়িয়ে ধরে…’ (‘দিনান্ত’)।
২.
‘ঘরে ফেরার দিন’— এই নামকরণটি বেশ মায়াময়। প্রবাস যেমন সমৃদ্ধ করে, প্রাণিত করে, স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন করে। স্বদেশ-স্বজন-স্বসংসংস্কৃতির প্রতি আলাদা এক কাতরতা তৈরি হয়। প্রত্যাবর্তিত অনেকাংশে সঞ্জীবিত হয় নতুন সংকল্পে, নতুন উদ্যমে। বিচ্ছেদবেদনা যেন নতুন অঙ্গীকারের জ্বালানি হয়ে দেখা দেয়। স্বদেশের মূর্তি, আত্মপরিচয়ের অবয়ব আর ভাষা-সংস্কৃতির চিহ্নাবলি কবি-সাহিত্যিককে জাগিয়ে তোলে। ১৮৯০ সালে এক তরুণ বিলেতে শিক্ষাপ্রাপ্তির জন্য কালাতিপাত করছিল। তার ডায়রিতে কী লিখছিল সে?
‘এখানে আমাদের প্রবাসের সময় উত্তীর্ণ হয় নি, কিন্তু আমি আর এখানে পেরে উঠছি না। বলতে লজ্জা বোধ হয়, আমার এখানে ভালো লাগছে না। সেটা গর্বের বিষয় নয়, লজ্জার বিষয়— সেটা আমার স্বভাবের ত্রুটি। … আচ্ছা ভালো রে বাপু, আমি মেনে নিচ্ছি তুমি মস্ত শহর, মস্ত দেশ, তোমার ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের সীমা নেই। অধিক প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। এখন আমি বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি। সেখানে আমি সকলকে চিনি, সকলকে বুঝি… সহজে উপভোগ করতে পারি, সহজে চিন্তা করতে পারি, সহজে ভালোবাসতে পারি।’ এই তরুণের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারিখ ৬ অক্টোবর। গ্রন্থের নাম ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’।
দুনিয়া-কাঁপানো আরেকটি বইয়ে ভিন্ন মনোভঙ্গিতে উৎসারিত হয়েছিল এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি। সে-কণ্ঠে ছিল ক্রোধ, গর্জন, হাহাকার আর প্রতিরোধ। উপনিবেশের শ্বেতাঙ্গ লুঠেরা-প্রভুদের প্রতি আক্রমণ আর স্বজাতি-স্বজনের প্রতি অপার মমতা। বইয়ের নামেই তার পরিচয়। ‘দেশে ফেরার খাতা’। দীর্ঘ একটিই কবিতা বইজুড়ে। কবির নাম এমে সেজ্যার। সেজ্যার এই কবিতাটি লেখেন ১৯৩৯ সালে, ফরাসি ভাষায়, প্যারিস থেকে শিক্ষান্তে তাঁর স্বদেশ মার্তিনিকে ফেরার উপলক্ষ্যে। এই কবিতাকে সংবর্ধিত করেন আঁদ্রে ব্রেতঁ। বিশ্বজোড়া কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে একে মর্যাদা দেওয়া হয়। মাইকেল আর রবীন্দ্রনাথ লিখতে পেরেছিলেন বাংলায়, কিন্তু সেজ্যার লিখেছিলেন প্রভুদের ভাষা ফরাসিতেই।
সেজ্যারের ছাত্র ছিলেন আর এক সুবিখ্যাত লেখক ফ্রানৎজ ফানঁ। সেজ্যার গিয়েছিলেন প্যারিসে, উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। সেখানে দেখা হয় আরও দুই কৃষ্ণাঙ্গ কবি-লেখকের সঙ্গে। গেছিলেন, লিওপোল্ড সেঙ্ঘর আফ্রিকার সেনেগাল থেকে আর লিওন দামাস ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে। এই তিনজন পারস্পরিকতায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এক নিজস্ব নন্দনদৃষ্টি নির্মাণ করেছিলেন। তারই তীব্র প্রকাশ ছিল এই দীর্ঘ কবিতায়—
‘আর আমি আমার দেশের জন্যে খুঁজে বেড়াই না
খেজুরের হৃদয়, বরং খুজি মানুষেরই হৃৎপিণ্ড, যেখানে
পৌরুষেভরা রক্ত নাচে, যাতে তারা যেতে পারে
সেই বিশাল অসমান্তরাল বাহুওলা দরজা দিয়ে
রুপোলি সব নগরে…’
(তরজমা : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবলীনা ঘোষ)
‘দেশে ফেরার খাতা’-র এই উচ্চারণে কি মিলে যান রবীন্দ্রনাথও? প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই তিনি খুঁজেছিলেন স্বদেশবাসীর হৃদয়। ফিরেছিলেন জন্মভূমির আঙিনায়। বাংলাভাষার সান্নিধ্যে।
৩.
মাইকেল মধুসূদনও প্রবাসের শেষে আবিষ্কার করলেন বঙ্গভূমির রূপসী অবয়ব। ‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন,— / তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,/ পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’ (‘বঙ্গভাষা’)
মধুসূদনের প্রবাস দু-বার। প্রথমবার চলে গেলেন মাদ্রাজ। প্রবাসজীবন আট বছরের। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬। মাদ্রাজ যাবার আগে মাইকেল সম্পূর্ণ ইউরোপমুখী, ইউরোপ আচ্ছন্ন। ১৭ বছর বয়সে লিখলেন কবিতা। ইংরেজি ভাষায়। ইংল্যান্ডের আর এক নাম অ্যালবিয়ন। সেই অ্যালবিয়নের তটে পৌঁছবার উদগ্র বাসনা ধ্বনিত হল সেই কবিতায়। নিজেকে চোস্ত সাহেবিয়ানায় তিনি ক্রমাগত অভ্যস্ত করে তুললেন। হিন্দু কলেজ, বিশপ্স কলেজে চলল তাঁর ইউরোকেন্দ্রিক সারস্বত সাধনা। মহাকবি হবেন তিনি। সেজন্য পৌঁছতে হবে ইংল্যান্ডে। ছাত্রাবস্থাতেই মদ্যপায়ী। বাবার পছন্দ করা বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করবেন না কিছুতেই— কেননা তিনি কবিতা লেখেন, যে-প্রিয়া সুদূরবর্তিনী, নীল-নয়না— ‘My Fond Sweet Blue-Eyed Maid.’ ১৮৪৩ সালে ধর্মান্তরিত হলেন। হলেন মাইকেল মধুসূদন। বিশপ্স কলেজে খুব মন দিয়ে শিখলেন গ্রিক, ল্যাটিন আর সংস্কৃত। তারপর পাড়ি জমালেন মাদ্রাজে। তাঁর প্রথম পরবাস।
মাদ্রাজে শিক্ষকতা করলেন, সম্পাদকের পদেও বৃত্ত হলেন। বিবাহ করলেন এক ইংরেজ তনয়া মেরি রেবেকা ম্যাকটাভিসকে। চারটি সন্তান হল তাঁদের। লিখলেন পৃথ্বীরাজ আর সংযুক্তার প্রেমকাহিনি নিয়ে ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘দি ক্যাপটিভ লেডি’ (১৮৫৪)। লিখলেন ‘ভিশন্স অফ দ্য পাস্ট’ নামে একটি কবিতা, যেখানে বাংলার ‘উষ্ণ আর্দ্র প্রান্তর’ আর ‘বটের ছায়া’ ঢুকে পড়ল। মধু বহন করছিলেন তাঁর জন্মভূমির বর্ণপরিচয়। বেথুন সাহেব ‘দি ক্যাপটিভ লেডি’ পড়ে উপদেশ দিলেন বাংলাভাষায় কাব্যচর্চা করতে। ওদিকে মধুসূদন বন্ধু গৌরদাস বসাকের কাছে চেয়ে পাঠালেন বাংলা ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’। চিঠিতে লিখলেন, ‘তুমি বোধ হয় জানো না আমি এখন রোজ কয়েক ঘণ্টা তামিল চর্চা করি।… এই দেখো আমার রুটিন : সকাল ছটা থেকে আটটা হিব্রু, আটটা থেকে বারোটা স্কুলে পড়াতে যাই, বারোটা থেকে দুটো গ্রিক, দুটো থেকে পাঁচটা তেলুগু আর সংস্কৃত, পাঁচ থেকে সাতটা ইংরেজি। আমাদের নিজের ভাষাকে সুন্দর করে সাজাব, তার জন্য কি তৈরি হচ্ছি না?’
মহাপ্রতিভাধর মাইকেল ভিতরে ভিতরে পালটাচ্ছিলেন নিজেকে। সেই নতুন মধুসূদন বিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়লেন বঙ্গদেশে। বাবা রাজনারায়ণ প্রয়াত হয়েছেন ১৮৫৫ সালে। বিবাহবিচ্ছেদ হল রেবেকার সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনী হিসাবে এলেন ফরাসি সুন্দরী অঁরিয়েৎ। তিনি এলেন মধুর সঙ্গে কলকাতায়। তখন নতুন এক মানুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাদ্রাজে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন মাইকেল। শিরোনাম ছিল ‘অ্যাংলো স্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দু’। তার গোড়ায় ভার্জিল থেকে ল্যাটিন ভাষায় একটি উদ্ধৃতি ছিল, যার বাংলা হল— ‘আমাদের মাঝখানে কে এই অজানা’।
৪.
সত্যিই এই ফেরা অমিতপরাক্রমী এক কবির নবজন্ম। কে এই অজানা!
পরের বছরগুলিতে বাংলা ভাষায় আবির্ভূত হলেন মাইকেল, স্রোতের মতো একটির পর একটি গ্রন্থে তিনি উচ্চ থেকে উচ্চতর কীর্তিকে স্পর্শ করে চললেন অনায়াসে। যিনি একবর্ণ বাংলা জানতেন না, বাংলা সাহিত্যচর্চায় ছিলেন বিতৃষ্ণ, বিমুখ, তিনি লিখে চললেন চিরস্থায়ী বাংলা সাহিত্য। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর ভাষা তো আরও এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এমন ওজস্বী, দ্রুতিময় আর দ্যুতিময় বাংলা উনিশ শতকে কারো হদিশেই ছিল না। এ যেন এক দৈবী ঘটনা। জাদুবিদ্যার মতো।
কত কী যে লিখলেন তিনি! ‘শর্মিষ্ঠা’ (নাটক/১৮৫৯), ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (প্রহসন/১৮৬০), ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০), ‘পদ্মাবতী’ (নাটক/১৮৬০), ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০), ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১), ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২)।
১৮৬২ সালে আবার তিনি যাবেন ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স। তাঁর এক পুত্র, এক কন্যা আর সঙ্গিনী অঁরিয়েৎকে রেখে কলকাতায়। পরে ১৮৬৭ সালে ফ্রান্সে জন্মাবে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র। সে-বছরই কলকাতায় দ্বিতীয় প্রবাস থেকে প্রত্যাবর্তন। বিদেশে লিখবেন চতুর্দশপদী কবিতাবলি (১৮৬৬)। স্বদেশে ফিরে ‘ইলিয়াড’ অবলম্বনে গদ্যানুবাদ ‘হেক্টর বধ’ (১৮৭১), মৃত্যুর পর প্রকাশিত হল ‘মায়া-কানন’। ১৮৭৩ সালে মারা গেলেন অঁরিয়েৎ। ২৬ জুন। ঠিক দু’দিন পরে ২৯ জুন মাইকেল মধুসূদন প্রয়াত হলেন। কপর্দকহীন। গরিমাহীন। সর্বস্বান্ত। পুত্র-কন্যার দায়িত্ব নিলেন বন্ধু মনোমোহন ঘোষ। কবির মৃত্যু হল, রয়ে গেল তাঁর অমৃত-স্বর্ণদীপ্তিময় রচনাবলি।
৫.
মধুসূদন বেঁচেছিলেন উনপঞ্চাশ বছর। তাঁর বাংলা সাহিত্যচর্চার বয়স তো আরও স্বল্পায়ু। গ্রন্থপ্রকাশের নিরিখে মাত্র চোদ্দো বছর। তার মধ্যে বিষয়ে এবং আঙ্গিকে তিনি অবিনশ্বর সব বিদ্যুৎকীর্তি বাংলা সাহিত্যে সংবহন করে গেলেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ আমদানি করলেন বাংলায়, ছেদ থেকে যতি মুক্ত হল; তৈরি হল সুগম্ভীর, গতিময়, ঝংকৃত এক ধ্বনিসুষমা। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ ভেঙে দিলেন সিদ্ধরস। কে জানে, মাদ্রাজে কোনও ভিন্ন কাহিনির দ্রাবিড়পাঠের ‘রামায়ণ’ তিনি পড়েছিলেন কি না, যেখানে রাবণ নায়ক, রাম বহিঃশত্রু। কে জানে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের অভিঘাতে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ সাগরবাহিত রামচন্দ্রের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় কি না। বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গে একীভূত হন কি না রাবণ, প্রমীলায় লক্ষ্মীবাই। টাস্সো, ভার্জিল, দান্তে বা হোমারের ছায়া খুঁজি আমরা মাইকেলের কাব্যে, কিন্তু দেশীয়তার হরেক চিহ্ন কি তেমনভাবে লক্ষ করি না? ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ জুড়ে নয়টি সর্গে দু-রাত একদিনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বিচিত্র কৌশলে সেই বিবরণ অত্যাশ্চর্য বিস্তার পেয়েছে। কবি পাঠককে নিয়ে গেছেন স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল অর্থাৎ ত্রিলোকে। আবার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ জুড়ে-জুড়ে তৈরি করেছেন সময়ের বিপুল অবয়ব। অশোকবনে, পর্বতশৃঙ্গে, সমুদ্রতলে তার নানা মুহূর্ত বিচ্ছুরিত হয়েছে। ঘটনার পর ঘটনার নাটকীয়তায় বিহ্বল হয়েছেন পাঠক। কল্পনার চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়েছেন।
আবার, গ্রিক পুরাণের গল্প থেকে বঙ্গীকরণ করেছেন ‘পদ্মাবতী’ নাটক। দুটি প্রহসনে বাংলা ভাষার শহুরে গ্রামীণ ব্যবহারের মৌখিক বহুরূপতাকে মেলে ধরেছেন। প্রবাসের দ্বিতীয় পর্বে সনেট রূপকল্পকে ইতালি থেকে এনেছেন বাংলায়। বিষয়ে ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘কজাগর-লক্ষ্মীপূজা’, ‘কমলে-কামিনী’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শ্যামা পক্ষী’, ‘বউ কথা কও’— বাংলার যাবতীয় উপাদান বুকে করে রেখেছেন। এ যেন জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’র আদিকল্প।
প্রবাসে, হয়তো একটা প্রস্ততিপর্ব ছিল। কেননা, সেখানে দূরত্বের প্রেক্ষাপটে উপলব্ধ হয়েছিল গভীর সম্পর্ক। মাতৃভূমির সঙ্গে। মাতৃভাষার সঙ্গে। প্রত্যাবর্তনের প্রত্যক্ষ অভিঘাত মাইকেলকে নতুন এক উজ্জীবনের অভিমুখে হয়তো নবারুণ রাগে আলোকিত করেছিল। অঁরিয়েৎ-এর মৃত্যুসংবাদ শুনে মাইকেল আবৃত্তি করেছিলেন লেডি ম্যাকবেথের প্রয়াণের পর ম্যাকবেথের একোক্তি— ‘Life’s but a walking shadow…’
তাঁর পরিণতি বেদনাবিধুর। তাঁর মহাকাব্যিক প্রতিভা অনশ্বর। অবিস্মরণীয়। তিনিই প্রথম বাংলার ‘আধুনিক’ কবি। বাংলা সাহিত্যিক মহাকাব্যের একমাত্র স্রষ্টা। প্রবাসে নয়, স্বভাবেই তাঁর মহাকায় সত্তা। প্রত্যাবর্তনেই তাঁর নিয়তি। যাত্রা নয়, ফেরা। বেথুন সাহেবের কথা মধুসূদনের কানে তুলেছিলেন বন্ধু গৌরদাস বসাক। ‘এখন দেখো সাহেব কী বলছে! ইংরেজি সাহিত্যে আর একটা বায়রন আর একটা শেলি চাই না। কিন্তু বাংলায় যে একজনও নেই।’
ভাগ্যিস ফিরেছিলেন মধুসূদন! তাঁকে ছাড়া বাংলা সাহিত্য রক্তাল্পতায় ভরা এক ফ্যাকাশে, দাপটহীন শিশু। বাংলা কবিতার যৌবনে তিনিই তো স্পর্ধা আর রাজকীয় প্রতাপ এনে দিলেন। র্যাঁবো যেমন বলেছিলেন বোদলেয়র সম্পর্কে, আমরাও একই কথা বলি তাঁর সম্পর্কে— ‘প্রথম দ্রষ্টা তিনি, কবিদের রাজা, এক সত্য দেবতা।’ রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ‘I despise Ram and his rabble; but the idea of Ravana kindles my imagination; he was a grand fellow.’ জানি না, এই অপরাধে হিন্দুত্ববাদী বর্তমান ভারতীয় শাসকদল তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করবে কি না, অথবা এ-কাব্য নিষিদ্ধ করবে কি না। এখন মনে হয় সবই সম্ভব। যেন না ভুলি, আমরা, আজকের বাংলা ভাষার কবিরা, সবাই তাঁর সন্তান।