একটা ঠিকানা লাগে, ফিরতে। কখনও-কখনও সেটা পাওয়া যায়। সরকারি রেকর্ডে, হাসপাতাল বা পুলিশ কেউ যদি তাড়াহুড়োয় নাম ভুল না করেন, পুরুষের জন্য মহিলা আর মহিলার জন্য পুরুষ নাম ধার্য না করেন, নিরুদ্দেশ মানুষটির পরিবারের ভুল বা অসম্পূর্ণ ঠিকানায় একটি পোস্টকার্ড ছেড়ে দিয়ে দায় না সারেন, তাহলে পৌঁছে যাওয়ার মতন একটা ঠিকানা কখনও-কখনও পাওয়া যায়।
কুড়ি বছরের দূরত্ব থেকে, তিন ঘণ্টার বেশি এই ফেরার পথটুকুতে মেয়েটি তার বাড়ির গল্প বলছিল। বয়সোচিত উচ্ছ্বাসে শৈশবের স্মৃতি আর কল্পনাকে জুড়ে নিচ্ছিল। যা হয়েছিল, আর ওর মতে যা হলে ভাল হত, সেগুলো মিশিয়ে অনর্গল বলে যাচ্ছিল তার বাড়ির কথা, যেখানে সে ফিরছে! অন্তত তখনও ও তাই জানত। বা, হতে পারে, ও সেরকমটাই ভাবছে বলে আমাদেরকে ভাবাতে চেয়েছিল।
বাড়ির দালানের সামনেটায় পৌঁছে, তার থমকানোটুকু কারোর নজর এড়ানো কঠিন ছিল।
না, ফেরা হয়নি। আমাদের সঙ্গেই ফের হাসপাতালে চলে এসেছিল মেয়েটি। একই রকম ভাবে অনর্গল কথা বলতে-বলতে, তারপরে সারাদিনের পরিশ্রম আর আবেগের ঝাপটার ক্লান্তিতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
হাসপাতালের ভেতরে ফিলামেন্ট বালবের আধো আবছায়ায় মেয়েটি যখন ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছিল, সারা শরীরে বোধহয় এক ধরনের নিশ্চিন্ততার ছাপ। নিজের চেনা ঠিকানায়, অভ্যস্ত জীবনে ফিরতে পারলে যেমন হয়, সেরকম। অথচ, আমাদের সুস্থ মনের ধারণায় এটা তো ফেরা নয়, ফিরতে না পারার গ্লানিটুকু মাত্র!
যে গিয়েছিল, সে ফেরে কি? সে-ই ফেরে? যেখান থেকে গিয়েছিল, স্বেচ্ছায় বা ভুলবশত, অসুখে, সেখানেই ফেরে কি? সেখানেই? এতগুলো ঘরে ফেরার সাক্ষী থাকার পরে, আমার মনে হয়, যে ফেরে, যাদের কাছে ফেরে, যেখানে ফেরে, এই সব ক’টাই এর মধ্যে বদলাতে থাকে। যে ছিল না, তার এক রকম যাপনের অভ্যাস তৈরি হয়। এই অভ্যস্ততা, যাদের কাছে ফিরতে হবে, তাদেরকে বাদ দিয়ে। বা, এই বাদ দেওয়ার প্রয়োজনটাই নতুন অভ্যাস তৈরি করে। তেমনই, যাদের কাছে ফেরার কথা তাদের জীবনেও এই মানুষটি ক্রমশ এক স্মৃতির অভ্যাস হয়ে ওঠেন। সেটা একটা ফ্রিজ্ড ফ্রেম আর সেখান থেকে পিছন হাঁটা ফ্ল্যাশব্যাক। মধ্যে হয়তো জীবনের প্রয়োজনে ঠিকানাও বদলায়, ভৌগোলিকভাবেই বা কালের নিয়মে। ফলে, যে-গাছতলাটায়, যে-পুকুরপাড়ে বা যে-জানলার সামনে দিয়ে, ভাঙা বাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঠিকানায় পৌঁছতে হত, সেটাও বদলে যায়।
ফেরাটা তাই আর ফেরা থাকে না। নতুন একটা গন্তব্য, নতুন সব মানুষ। আর তাদের পুরনো স্মৃতিগুলো, যেগুলো আর জ্যান্ত নেই।
বরং অনেক বেশি জ্যান্ত হাসপাতালের বিছানাটুকুতে পাতা সংসারটা। ম্যাট্রেসের তলায় জমানো চকচকে রাংতার সম্পত্তি, দু’দিনের জমানো পাঁউরুটি, পরের দিন নীলের উপোস ভেঙে কিছু খেতে হবে বলে, ইঁদুরের মুখ থেকে নিয়ে আসা বিস্কুট ভাগাভাগি করে খেয়ে পাশের বেডের অতিথি সৎকার– এগুলো অনেক বেশি জ্যান্ত। বাড়ি বলতে কারোর শুধু দুটো কাঁসার বাসন আর পিলসুজটা, কারোর কাছে জমানো গুলির হরলিক্সের বোতলটা, বা কখনও স্মৃতিতে থাকা সন্তান। বাড়ি বা সংসারের বোঝাপড়াটায় প্রায়শই মানুষ এবং অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর ব্যবহার্য দ্রব্যগুলো অনায়াসে একইসঙ্গে জায়গা করে নেয়। আমাদের চালু বন্দোবস্তে, মনোরোগ আর মনোরোগের তকমা– এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করার খুব যে উপায় আছে এমন নয়। ফলে চিহ্নিত ‘মনোরোগী’ যখন সুস্থ হয়ে উঠছেন, তাঁর পরিবারের ঠিকানায় পৌঁছে প্রায়শই দেখা যায়, তাঁর সম্পত্তিটুকু পরিবারের অন্যান্যরা দিব্যি ভোগদখল করছেন বা করার উদ্দেশ্যেই তাঁকে হাসপাতালে রেখে এসেছেন। আমাদের আইন এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থায় খুব যে কোনও বেগ পেতে হয়েছে এমন নয়। সেরে ওঠা মহিলা মনোরোগীদের ক্ষেত্রে শুধু সম্পত্তি নয়, স্বামীটি নতুন করে সংসার পেতেছেন, পাগল বউকে বিদায় করে। ‘ফেরা’ শব্দটি আদৌ প্রযোজ্য হয় কি এঁদের ক্ষেত্রে? বরং পরিত্যক্ততার নিষ্ঠুরতাকে আমরা নিজেরাই খানিক কোমল, সহনীয় করে নিই কি নিজেদের কাছে? ফেরার কথা বলে এই মানুষগুলোর কাছে নিরুপায় ও নিঃশর্ত সমর্পণের পরামর্শ দিই কি? শুধুই প্রতিষ্ঠান আর সমাজের কাজগুলোকে সহজ করার চেষ্টা করি, সহমর্মিতার মতন দেখতে এক রকমের নিষ্ঠুরতা নিয়ে!
এর খুব সহজ উত্তর নেই, জানি! কারণ উত্তর খোঁজার দায়টা যাঁদের হতে পারত, তাঁরাই ‘ফেরা’-টা সমাধান হিসেবে বলছেন। একটু পরিশ্রমসাধ্য, কিন্তু অনেক বেশি কার্যকর হতে পারত, নতুন কোনও গন্তব্য, নতুন অনুষঙ্গ যা তার অধিকারের লড়াইকে শক্তি জোগায়, তাঁকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু তার জন্য একটা সামাজিক যৌথতা দরকার। রাষ্ট্রের কাছে দাবিদাওয়ার জায়গায় একচুল ঢিলে না দিয়েও, সামাজিক আশ্রয় তৈরি করা সম্ভব, যেখানে একজন সেরে ওঠা মনোরোগী স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দমতন জীবন বেছে নিতে পারেন।
কিন্তু, মানসিক হাসপাতাল যে আশ্রম নয়, সমাজকে এটা বুঝতে বাধ্য করার জন্য তো তেমন কোনও ফান্ডিং নেই! বরং তিনটে পাড়া ঘুরে, বস্তা বেঁধে এক সময়ের পোষ্য কিন্তু এখন পরিত্যাজ্যকে বেপাড়ায় ছেড়ে দিয়ে আসার মতন হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে গেছে, কোনওদিন নিজের গ্রাম বা পাড়ার বাইরে একলা পা না রাখা মহিলাটি, ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকেছেন, এবং তাতেই তাঁর মনোরোগ সব্যস্ত হয়ে গেছে। আইন-কানুন কোথাও কোনও সমস্যা করেনি। মহিলাটি ক্রমশ সংসার গুছিয়ে নিয়েছেন হাসপাতালের বিছানায়। পর্দা টাঙানোর সুযোগের অভাবে একটা রংচঙে কাপড়ে বেঁধেছেন, খাটের রেলিং-এ। পড়শি বেডের মানুষটির পায়ের আঙুল ছুঁচোতে কেটে দিয়েছে জানতে পারার পর থেকে, রাতে আর ঘুমোতে চান না। ওষুধ বাড়ে তাঁকে নিস্তেজ করে রাখার জন্য। কারণ সুস্থতা মানে ঘুম। সেই সংজ্ঞায় ছুঁচোর ছোটাছুটিকে আঁটিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। ‘মনোরোগ’- এর সমস্ত লক্ষণ যথাযথ পরিস্ফুট ধরে নিয়ে চিকিৎসা চলে। তিনবেলা ওষুধ খেয়ে, মানুষটি রোজ চেষ্টা করেন নিজের কাছে ফিরতে। আর রোজই পুরোনো মানুষটা এই নতুন রোগীর কাছ থেকে একটু-একটু করে পিছলে যান। ফেরাটা ক্রমশ কঠিন হয় ওঠে।
আমরা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, সমাজ, রোজ ফিরে-ফিরে যাই, এই মানুষটির কাছে ফেরার দাবি নিয়ে।