মতি নন্দী-কে
হেল্পলাইন
দুঃস্বপ্ন দেখে ভেঙে যাচ্ছে ঘুম, এ ওকে ফোন করে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে, ও তাকে ফোন করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে, কেউ বলছে, ‘জানিস তো আমি এটা দেখলাম’, কেউ বলছে ‘জানিস তো আমি ওটা’, সকলেই টেনস্ড, ঘন ঘন রিং হচ্ছে ফোনের, কারো কলার টিউনে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে, কারো বা স্ট্রবেরি হিল্স, আবার কারো এমনিই, কিড়িং কিড়িং কিড়িং, একজন তার স্বপ্নের কথা বলছে আতঙ্কিতভাবে : ‘আমি দেখলাম আমার মুখটা কে যেন চেপে ধরল গ্যাস ওভেনে’, একজন তার স্বপ্নের কথা বলছে নৈর্ব্যক্তিকভাবে, ‘আমি দেখলাম অনেকক্ষণ নড়ছে দাঁতটা, হঠাৎ খুলে পড়ে গ্যালো’, একজন তার স্বপ্ন ভাল মনে করতেই পারছে না, শুধু ভয়টুকু থেকে গ্যাছে, একজন তার স্বপ্নের এত ভাল ও নিখুঁত বিবরণ দিচ্ছে যে মনে হবে ক্রোনেনবার্গের ছবি, প্রত্যেকে প্রত্যেকের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করছে, প্রত্যেকে প্রত্যেককে বলছে, ‘কিছু হয়নি এবার ঘুমিয়ে পড়’, কিন্তু আজকের রাত্রিটা বোধহয় জেগে থাকবারই, কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ‘হ্যালো শুনতে পাচ্ছিস’, ‘হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন’, ‘হ্যালো শুনতে পাচ্ছ’, আর সমস্ত বিশ্বে তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটা অপূর্ব জাল, একটা কাটাকুটি নকশা, একটা হাতে-হাত-রাখা ব্যারিকেড, আর টেলিফোনে ভেজা গাল চেপে মুগ্ধ চোখে এখন দৃশ্যটা দেখছি আমি।
স্যাডোম্যাচোকসমো
সূর্যের সঙ্গে বনিবনা হল না বলেই তো
রাত্রি আমার প্রিয় হয়ে উঠল, একাধারে
সে প্রেমিকা, জল্লাদ, অপমানিতা— হামা দিয়ে
কাছে এগিয়ে আসে, হাঁটু ঘষে মেঝেয়
আর প্রার্থনা করে— ‘আরও চাবুক, প্রিয়তম’,
আমাকেও মাঝে মাঝে বেঁধে রাখে, উফ,
পায়ের নরম আঙুলগুলো চোষায়, মুখ থেকে থুতু
ফেলে আমার মুখে আর যথেষ্ট থুতুময়
নেশা আমার রক্তে মিশবে কি— এই প্রশ্নে
দুয়ো দিয়ে চামচিকে উড়ে যায়, শার্সিতে ধাক্কা
দেয় হাওয়া, নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আমি কত
দূরে আছি, অসম্ভব নিঃসঙ্গ একটি যে বিন্দু—
(এক ফোঁটা জমাট রক্তের উপমা ভেবে নাও)
ভালো কথা— রাত্রির স্বামী পরশু ফোন ক’রে বলেছে
‘আমাকে চিনিস না, যেদিন লালবাজারে
ঢুকিয়ে প্যাঁদাব বাপের নাম খগেন করে ছাড়ব।’
মেঘমুক্ত আকাশের তলায় ভ্রমণ
মাথা তুলেই অনেক ক’টি নক্ষত্র দেখতে পেলাম। মনে পড়ছে… মহাজাগতিক বাগানের সাথে কখনও এর তুলনা করেছেন কেউ! ঝলমল করছে প্রতিটি নক্ষত্রই। অন্ধকারের মধ্যে দীর্ঘতম সেলাই-ফোঁড়াই চলে আর আমি হাঁটতে থাকি আর হাঁটতে থাকি। আস্তে আস্তে হালকা হয়ে উঠছি বুঝতে পারি।
আমার ভেতরে কেউ কথা বলে, বাতাসের সুরে বলছে আমার মনে হয়, ‘ওদের থেকে তুমি খুব দূরে নেই!’ আমি চোখের পাতা বন্ধ করি, বন্ধ করেই থাকি… খুলে দিই। হয়তো… আমি ভাবি যে একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখা যাবে সব ঠিকঠাক আছে। শূন্য থেকে উবুড় হয়ে থাকে নক্ষত্রগুলো, তাদের উজ্জ্বল হাসিই বলে দিচ্ছে তাদের ঝরে যাওয়ার ভয় নেই।
এবং তারা চুপ… অথচ তারা সবসময়েই ডাকে আমি বুঝতে পারি। এমন কখনওই হয়নি যে আমি ওদের ডেকেছি নিজের কাছে। লম্বাটে ছায়া তেরছা হয়ে পড়েছে রাস্তায়… আমার ও সবসময়ের বিষণ্ণ বন্ধু। ভাবি, আমার ছায়া হয়তো আমার চেয়েও নিঃসঙ্গ, পরিণতিহীন। এখন ঝিঁঝিঁরাও ডাকছে আর রাত্রি আরও জমে উঠতে আমার সহসা মনে হল, এর কোনো শেষ নেই এবং এ সবসময়ের জন্যেই থেমে আছে।
বাধা কেবল এই দেহটা; এই হলুদ আলোয় ফ্যাকাশে, নিষ্পত্র কাঠামো। একে তখন দুরূহ বোঝা, উটকো বিপত্তি মনে হয়। বাতাসের সুরে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে যায়, ‘নক্ষত্রদের থেকে তুমি খুব দূরে নেই’… হয়তো ভুল, যে-স্বপ্নটা দেখছি সেটা ভেঙে যাবে একটু পরেই। আবার ঠিকঠাক দেখা শুরু লম্বা ঘুমের শেষে। ‘কিন্তু এ-সমস্তের মানে কী? এসব কী হচ্ছে?’ আমি ধৈর্য হারিয়ে শুধোই। চিৎকার করতে গেলে দেখি আমার ভেতর থেকে কেউ আমাকে টেনে ধরে, শক্ত থাবায় মুখটা চেপে দেয়।
আমি হতাশ হয়ে পড়ি, কাতর হয়ে পড়ি, আচ্ছন্ন হয়ে… নক্ষত্রগুলো কাঁধের ওপর ঘন হয়ে ঝুঁকে পড়ে, চড়তে থাকে ঝিঁঝিদের কনসার্ট… আর তখনই, ঠিক একপলকের জন্য সে দেখায় তার মুখ। মুখ? হ্যাঁ, মুখই তো… মড়ার চাহনির মতোই পাঁশুটে, সর্বজ্ঞ, আতঙ্ককর কিছু! … এবং, ভালোভাবে ঠাহর করার আগেই সে নিজেকে অতিদ্রুত কিনারে টেনে নিয়ে যায় এবং লুকিয়ে ফ্যালে আঁধারের গরম রক্তমাংসে।
আস্তে লাট্টু
আবর্তনশীল পৃথিবীতে বসে থেকে আমি
দেখি, বিকেল প’ড়ে গিয়ে কখন সন্ধে
নেমে এল, বাড়িতে বাড়িতে বেজে উঠল
শাঁখ, কোথাও হিন্দি গান হচ্ছে, আবছা
ভাবে দুটো কথা কানে আসে ‘দিও-
-য়ানা’ আর ‘ইশক’ ব’লে, আমি চুপচাপ
বসে মশার কামড় খাচ্ছি, অল আউট
জ্বালানোর ইচ্ছেই হয় না, আরো একটা
বাড়িতে শাঁখ বাজছে, আস্তে আস্তে দেখছি
বাইরেটা কালো হয়ে এল, এর মানে
সব কিছু ঠিকঠাক, পৃথিবী আরেকবার ঘুরে
গিয়েছে, আমার বয়স এবার ঠিক ছাব্বিশ
হবে এবং আমি জানি এই অবাধ্য মশাদের
মতো আমিও আবর্তনশীল গ্রহটিতে চির-
-কাল থাকার সুযোগ পাব না, সূর্য এখন
পশ্চিম গোলার্ধে, আর আমার কাব্যপ্রতিভা
ইদানীং ঈর্ষণীয়, দেখছি এই লেখাটাও
আমি বেশ দ্রুতই শেষ করে ফেললাম।