দ্বিতীয়বার বেলটা বাজতেই সুদীপ ধড়ফড় করে উঠল। কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে দরজা খুলতে বেঁটে চেহারার নেপালি টুপি পরা ছেলেটা বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার!’
চা এসে গেছে। সাদা রঙের ট্রে-তে একটা কেটলি, দুটো কাপ, ছোট বাটিতে চিনি, একটা চিনি গোলার চামচ আর একপাশে ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশনের বিবরণ দেওয়া চারপাতার কার্ড। ট্রে-টা টেবিলের ওপর রেখে ছেলেটা বগলের তলা থেকে খবরের কাগজ এগিয়ে দিল। এ-ব্যাপারে আগে থেকেই বলে রেখেছিল সুদীপ। চায়ের সাথে খবরের কাগজ না হলে সকালটা তার চলে না। বিশেষত শীতের সকালগুলোতে টাটকা ধোঁয়া-ওঠা খবরের সংস্পর্শে এসেই তার চোখের পাতা থেকে জমা ঠান্ডা গলে-গলে পড়ে। তবেই তো সারাদিনের খাটাখাটনি, দৌড়ঝাঁপের জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়!
খবরের কাগজটা হাতে নিতেই হেডলাইনটা চোখে পড়ে গেল— ‘নেপালের হোটেলে দু’বছরের শিশুকে কুপিয়ে খুন মায়ের’। এরকম একটা খবর প্রথম পাতায় জায়গা পায় কী করে? প্রথম পাতায় থাকার কথা রাজনীতি, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো। পার্লামেন্টের বিতর্কগুলো আসতে পারে, মুদ্রাস্ফীতির খবর আসতে পারে, বন্যা-খরা বা আলুচাষির আত্মহত্যার খবর আসতে পারে, এমনকী বড় ম্যাচট্যাচ থাকলে স্পোর্টসের খবরও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এসব ন্যাশানাল খবরাখবরেও মানুষের উৎসাহ কমে যাচ্ছে আজকাল! যূথবদ্ধ উত্তেজনার দিন বোধহয় শেষ। পাবলিক অ্যাংগার খুঁচিয়েও খবরের কাগজগুলো লাভ করতে পারছে না। শেষমেশ মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের হাতে সন্তান খুনের ঘটনাকেই নিয়ে আসতে হচ্ছে প্রথম পাতায়। ‘ছিঃ’, মনে-মনে বলল সুদীপ। ইনসেনসিটিভ হতে হতে মানুষ দিনে দিনে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এসব ভাবতে-ভাবতে সুদীপ খেয়াল করে নেপালি টুপি পরা ছেলেটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দিনেই কি টিপস চায় না কি? সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ‘ক’টায় গাড়ি লাগবে স্যার?’
সুদীপ একবার হাঁই তুলে বলল, ‘সাড়ে আটটা নাগাদ আসতে বলো।’
জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ছে ঘরের মধ্যে। আকাশ পরিষ্কার। এদিকের ঘরটা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে নেমে গিয়ে পেছনের চাতালে দাঁড়াতে হবে। সব টুরিস্ট ওখানেই জড়ো হয়। কেউ-কেউ চা বা কফির কাপ হাতে নিয়েই চলে আসে। কিন্তু অত ঠান্ডার মধ্যে সুদীপের চা খেতে ইচ্ছে করে না। ফস করে ঠান্ডা হয়ে যাবে যে! কাগজটা উলটেপালটে দেখতে গেলে যেটুকু সময় লাগে অন্তত ততটা সময় চা গরম থাকা উচিত। ইন্টারেস্টিং খবরের মাঝখানে চা ঠান্ডা হলে মাথাটা তার গরম হয়ে ওঠে। আসার আগের দিনই তো চা যথেষ্ট গরম না হওয়ার জন্য তৃণা তার কাছে বকা খেল!
তৃণা এখন বিছানার একধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। এই এক রোগ! কোথাও বেড়াতে এলেই মেয়েটার ঘাড়ে যেন কুম্ভকর্ণ ভর করে! ঘুমিয়েই যাবে ঘুমিয়েই যাবে! কোত্থাও কিছু না ঘুরে সারাদিন ঘুমোতে বললেও যেন তার কোনো আক্ষেপ নেই! কাল রাত্তিরে খাওয়ার পরই সুদীপ বলেছিল, ‘চলো, নেইবারহুডটা একটু দেখে আসি।’ তৃণা কম্বল টেনে নিয়ে বলেছে, ‘তুমি যাও। আমার যে কী শীত করছে!’ এই সময়গুলোতে সুদীপের ইচ্ছা করে তৃণার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়… এই মানুষগুলো আলসেমির মধ্যে কী যে পায় ভগবান জানে! যেসব জিনিস সুদীপের দু’চক্ষের বিষ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হল এই কুঁড়েমি আর আতুলেপনা। দুটোই তৃণাকে পুরোপুরি ডুবিয়ে রেখেছে। এমন একপিস বউ কী করে যে এসে তার কপালেই জুটল!
মা বলেছিল, এমন লক্ষী মেয়ে দুটো হয় না! এরকম সম্বন্ধ আর কি পাব? সত্যি বলতে সুদীপও তৃণার রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। চোখ, ঠোঁট, নাক, চিবুক— সুন্দর অথচ ধারালো নয়। বেশি চোখা, ধারালো মেয়ে সুদীপের পছন্দ নয়। তাই তৃনাকে দেখে তারও পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর পরই গোলমালটা ধরা পড়ে। ব্যস, একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু করা যায়? না যায় গেলা, না যায় ফেলা!
‘তৃণা ওঠো ওঠো ওঠো, গেট আপ!’
তৃণা কম্বলের মধ্যে স্থানাঙ্ক পরিবর্তন করে বলল, ‘উঁ!’
‘গেট আপ!’ রাগ সংবরণ না করে এবার প্রায় চেঁচিয়ে বলেছে সুদীপ। সাথে-সাথে ধড়ফড় করে উঠে বসে তৃণা। মুখ দিয়ে গোঙানি টাইপের একরকম শব্দ করে। মনে হয় কেউ যেন তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসছে ঘুমের দেশ থেকে। ফলে ধাতস্থ হতে খানিক সময় লাগে তার। আর সেই সময়টুকু খাঁচায় আটকানো বাঘের মতো সুদীপ নিজেরই ধৈর্যের দেওয়াল আঁচড়াতে থাকে। এই উত্তেজনা ও বিরক্তিতে খবরের কাগজটাও ভালমতো দেখা হয় না। দু’কাপ চা ঠান্ডা হয়ে এক জোড়া খয়েরি ঘোলাটে চোখের মতো সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে চাতালে নেমে আসে সুদীপ।
চাতালের বেশ কিছু জায়গায় বরফ জমে আছে এখনও। তবে বেশির ভাগ জায়গাতেই গলে মাটির সাথে মিশে কিছুটা কাদা কাদা হয়ে রয়েছে। অবশ্য একেবারে বর্ষার সময়ের মতো ক্যাতক্যাতে নয়, এখানে এত ঠান্ডা যে কাদাও জমে ডেলা হয়ে থাকে। এই জমাট নির্দিষ্ট ফর্মহীন ডেলাগুলোর মতোই শক্ত ও নরমের মাঝামাঝি ঝুলে, অবিন্যস্ত হয়ে আছে তার জীবন। সামান্য পায়ের চাপেই ভেঙে পড়ছে। সুদীপ কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকায়। সে তো ওইভাবে অবিকল স্থানু হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। উঁচু হয়ে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল অন্যান্য মানুষ, পরিবার ও প্রতিবেশীদের। শুরুতে হচ্ছিলও সব ঠিকঠাক। সিঁড়ির ধাপগুলো টপকে-টপকে কত কম বয়সেই কোম্পানির ভাইসপ্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছিল সে! দু’হাতে খরচ করেও তার টাকা শেষ হত না। এই সময় আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের যা হয় সুদীপেরও তাই হল। বিবাহ। পাত্রী সুলক্ষণা। পাত্রী সুন্দরী। গৃহকর্মে নিপুণা। সুদীপ ভাবল, করতেই যখন হবে, তখন আর দেরি করে কী লাভ? সুদীপ কি ভাবল, না কি স্বয়ং শয়তান এসে ফুসলিয়ে ভাবাল তাকে? এসব জটিল ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই তার বিয়ে হয়ে গেল স্যাট করে। চারিদিকে শপিং মলের মতো আলো ঝলমল করতে লাগল, সেও নিজের সৌভাগ্য, ভবিষ্যতের সাফল্য, পিসার টাওয়ারের মতো স্লাইটলি হেলানো প্রত্যাশা— সব নেড়েচেড়ে উইন্ডোশপিং করে বেড়াতে লাগল। ফুলশয্যার রাত পেরিয়ে, হানিমুন পেরিয়ে এসে বুঝল সে ভুল এস্কেলেটরে উঠে পড়েছে। সে তখন যতই জোরে ছুটুক না কেন, সিঁড়ি নীচে নামতে থাকল হু হু করে! একটু-একটু করে শপিং মল শুকিয়ে হল এক পরিত্যক্ত দালান।
তৃণা যে অপয়া তা সুদীপ বুঝেছিল বিয়ের দিনই। পানপাতা দু’দিকে সরিয়ে যখন শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হল তখন তার দুটো চোখ কটকট করছিল খালি। প্রথমে সে ভেবেছিল তৃণার রূপ তার অনভিজ্ঞ বালক চোখে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারপর যজ্ঞের সময় বসে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে-পড়তে হঠাৎ যখন মাথাটা ঘুরে উঠল বাঁই করে, সে ভাবল অত্যধিক গরমে তার ডিহাইড্রেশন হল বুঝি। কিন্তু রাত্রিবেলা বালিশে মাথা ফেলতেই সে যে স্বপ্নটা দেখতে শুরু করল তারপরে আর কোনো সন্দেহ রইল না। স্বপ্ন সে দেখে না কখনও। বিয়ের আগের দশ বছর কোনো স্বপ্ন দেখেছে বলে তার মনেও পড়ে না। কিন্তু সেদিন দেখল। দেখল বিছানার চারদিক থেকে শয়ে-শয়ে উজ্জ্বল সবুজ রঙের সাপ তাকে ঘিরে ফেলছে। ক্রমশ খাটের পায়া বেয়ে উঠছে তারা! এমনকী তাদের চেরাজিভের হিসহিস শব্দও সে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল। ভয়ে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সুদীপের। বিছানার চাদরটা খামচে ধরে সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘মা, মা, মা!’
২
সাড়ে আটটা বেজে গেল। তবু তৃণা তৈরি হতে পারল না। স্নানের ঘরে সে একটা বাথটবে অনেকক্ষণ ধরে বসে রইল। বাইরে থেকে সুদীপের গলার স্বর শোনা গেল, ‘আর কতক্ষণ লাগবে?’ উত্তর দেওয়ার বদলে বাথটবের গরম জলের মধ্যে ডুবে গেল সে, যেন সুদীপের কণ্ঠস্বরের হাত থেকে বাঁচতেই শরীর মুড়ে জলের তলায় ঢুকে গেল। মিনিটখানেক পর আবার যখন দুম দুম করে দরজা ধাক্কাচ্ছে সুদীপ, তখন হঠাৎ অনেকটা জল চারিদিকে ছিটিয়ে, প্রচণ্ড হাঁপাতে-হাঁপাতে সে জলের ওপর মাথা তোলে। হাঁপানি আর কাশিতে তার বুক যেন ফেটে পড়ছে।
‘তৃণা, তৃণা, কী হল কী? কখন থেকে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে!’
তৃণা নিজেকে সামলে কোনোরকমে বলে, ‘যাই!’
বললেও সে তখনই জল ছেড়ে ওঠে না। বরং বাথটবকে পুকুর মনে করে দু’হাত দিয়ে জল কাটতে থাকে। মুখ দিয়ে খুব আস্তে আস্তে শব্দ করে, ‘প্যাঁক প্যাঁক, প্যাঁক প্যাকঁ…’
শাড়িটা পরে বেরোতেই সুদীপ বিরক্তিসূচক শব্দ করে মুখ দিয়ে। তৃণা বলে, ‘দেরি হয়ে গেল না? সরি।’ অথচ দুঃখিত হওয়ার চিহ্নস্বরূপ পরবর্তী কাজগুলো সে মোটেই খুব তাড়াতাড়ি করে না। চুল আঁচড়ায় পরিপাটি করে, আয়নার অনেকটা কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কপালের ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেয় লাল টিপ। সিঁদুর দেয়। তারপর সুটকেস থেকে বার করে ছোট হাতব্যাগটার মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় একটা কবিতার বই। আরও কিছু করত কি না নিশ্চিতভাবে বলা যায় না; সুদীপ প্রায় তাকে জোর করেই বার করে আনে।
সুদীপের এই বিরক্তি মাঝে মাঝে তার ব্যথার ওপর ব্যথা বুলিয়ে যায়। মাঝে মাঝে উদাসীনতার ওপর উদাসীনতা বুলিয়ে যায়, আবার মাঝে মাঝে ব্যথা বা উদাসীনতার ওপর কৌতুক বুলিয়ে যায়। বিয়ের সাত দিনের মাথায় শাশুড়ি মা মারা গেলে সুদীপ যখন বুক চাপড়ে কাঁদল, সেদিনও চাপা দুঃখের ওপর হঠাৎ এমনই কৌতুক খেলে গিয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে যদিও শাশুড়ি মা’র কোনও যোগ নেই। তাহলে সে-যোগ ঠিক কীসের সাথে ছিল বলা যায়?
বলা যেতে পারে তার শৈশবের ও কৈশোরের দেশ, মেঘের মতো সন্তরণশীল চেতনার শরীর, উলকাঁটায় বুনে চলা কবিতার শরীর, মাঠ, ঘাড় কাত করা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় টিউশনি করতে যাবার পথ— এসব কিছুর নীচে ভূগর্ভে ছিল যে-দুটো গোঁয়ার টেকটনিক প্লেট— একটি জীবনযাপনের, আরেকটি জীবনধারণার— তাদের হঠাৎ হেড টু হেড সংঘর্ষে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল হিমালয়ের মতো এক পর্বত, যাকে পেরোনো যায় না, যাকে জয় করা কঠিন, সেই পর্বতের ঠান্ডায়, বরফে তৃণার জীবন সম্পর্কে ধারণাগুলো সব ফ্রিজ করে গেল। বিয়ে হয়ে গেল তৃণার। মনে হয় সেই সময়েই কোনো হিমবাহ থেকে বইতে শুরু করল একটা নদী; কষ্টের নদী; সেই থেকে এখনও চলছে। যত পলি ফেলছে সেই নদী, তত হাওয়ার পিঠে চড়ে পালাতে চাইছে সে। তার মতো মেয়ের হাওয়া মানে হল ঘুম, বার বার স্নান আর সুদীপ বেরিয়ে গেলে খালি ঘরে অনেকক্ষণ ঘুড়পাক খেয়ে নাচা। চোখের নীচে অনেকটা কাজল লেপটে পিশাচের মতো, উন্মাদের মতো নাচ… যতক্ষণ না বনবন করে তার মাথা ঘুরতে থাকে, যতক্ষণ না সে ছিটকে পড়ে যায়, যতক্ষণ না সে বমি করে…
গাড়ি চলেছে। দুজনে বসে আছে দু’দিকে তাকিয়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে যত উঠছে তারা ততই খাদ গভীর হচ্ছে। সুদীপ জিজ্ঞেস করল, ‘খাদের দিকে তাকাতে তোমার ভয় করছে না কি?’
‘না তো’
‘আচ্ছা।’
‘তোমার করছে না কি?’
‘আমার কেন করবে?’ সুদীপ বিরক্ত হয়ে বলে। তৃণা মুখ টিপে হাসে। এই মুহূর্তে আবার কষ্টের ওপর কৌতুক পড়ল এক ছোপ। সে জানে সুদীপের ভয় করছে। চোয়াল শক্ত করে, ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে শক্ত করে নিজের হাঁটুখানা খামচে ধরে আছে সুদীপ। কিন্তু মুখে স্বীকার করবে না! তৃণা দুষ্টুমি করে বলে, ‘দেখো দেখো খাদের নীচে ওটা কী গো?’
সুদীপ আড়চোখে একবার খাদের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল, ‘কী আবার, ও কিছু নয়।’
‘না না কিছু একটা আছে, ওই যে ওই যে ওইটা!’ তৃণা আঙুল তুলে দেখায়।
‘না না, ওটা কিছু না বললাম তো!’
‘আরে ওই যে, ওটা কি শিবমন্দির না কি গো?’
সুদীপের মা ছিলেন শিবের ভক্ত। দেওয়ালজুড়ে শিবের নানা রকম ছবি ঝোলানো থাকত তাঁর ঘরে। সেই কারণে এই উশৃঙ্খল ঠাকুরটির প্রতি সুদীপেরও একটু টান আছে। শিবমন্দিরের কথায় তাকে তাকাতেই হল। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঘুরে উঠল বাঁই করে। সে চোখ বন্ধ করে, মুখ ভেটকে বলে উঠল, ‘মা গো!’
খিলখিল করে বাচ্চা মেয়ের মতো হেসে উঠল তৃণা। ‘কী গো, ভয় পাচ্ছ না কি?’
হাসির শব্দে সুদীপ দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, ‘ভয় পাব না? গাড়িটা একেবারে খাদের ধারে চলে এসেছিল। তুমি তো এসব বোঝো না! প্রথমে এতটা দেরি করলে স্নান করতে! এত দেরি করলে চলে? ঘোরাটাই মাটি হয়ে গেল! আসল দেখার জায়গাগুলোই আর দেখা হবে না। তার মধ্যে তুমি খাদ দেখাচ্ছ!’
‘তোমার কি ভার্টিগো আছে?’
‘তোমার আছে ভার্টিগো?’
‘আমার নেই।’
‘আমারও নেই। আর কিছু কথা বোলো না তো! একটু মেডিটেট করতে দাও। সকালবেলা মেডিটেড করা হেল্দি।’
সুদীপ চোখ বন্ধ করে বড়-বড় শ্বাস নিতে লাগল। গাড়ি পাহাড়ের গা বেয়ে-বেয়ে ঘুরে ঘুরে উঠছে, আর প্রতিটা বাঁকের মুখে চোখ-বন্ধ-সুদীপ একদিকে কাত হয়ে পড়ছে। একে মেডিটেশন বলা যায় কি? সেই কূটতর্ক সুদীপকে আঘাত করার আগেই তারা ধুংফা মঠে এসে পৌঁছোল।
শুনেছিল এই মঠে বেশি লোক আসে না। তার কারণও আছে। মঠটাকে ঠিক দর্শনীয় বলা যায় না। ছ’সাত কাঠা জমির ওপর মঠ। তিনদিকে বেড়া। একদিকে শুধু পাঁচিল। কিছু পাহাড়ি ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। মূল ফটকের বেশ কিছুটা আগে একটা ছোট ঘর। সেখানে জুতো খুলে রাখতে হবে।
জুতো খুলে রাখতে গিয়ে সুদীপ বলল, ‘আরে! বালবের মধ্যে একটা প্রজাপতি!’
জুতো রাখার বারান্দার ছাদ থেকে একটা বালব ঝোলানো। সেখানে কী করে যেন একটা প্রজাপতি আটকে পড়েছে! সুদীপ মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত না? কী করে বালবের ভেতরে ঢুকল প্রজাপতিটা? বালবটা তো ভাঙা নয়! আশ্চর্য! বেঁচে আছে? হ্যাঁ, নড়ছে! কী অদ্ভুত!’
উপাসনা শেষ হয়ে গেছে। হলের মাটিতে বসে বেশ কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এখনও ধ্যান করছে। সুদীপও মহা উৎসাহে বসে গেল পদ্মাসনে। মেরুদণ্ড টানটান করে, মাথা সোজা করে ধ্যান শুরু করল। তৃণা ধ্যান করতে পারে না। ধ্যান করতে বসলেই তার ঘুম পায়। ঘুমের মধ্যে সে অল্প-অল্প নাকও ডাকে। উপাসনালয়ে নাক ডাকা ঠিক হবে না ভেবে সে কবিতার বইটা খুলে বসল। কবিতা পড়াও তো এক প্রকার ধ্যানই বটে। মনোসংযোগ করতে হয়, সমর্পণ করতে হয়, মনন-মস্তিষ্ক-অভিরুচি শুদ্ধ করতে হয়, তবে না কবিতা পড়া যায়!
কিন্তু কবিতা পড়া যাচ্ছে না। উপাসনালয়ের মধ্যে বড় অন্ধকার। এত অন্ধকার যে, প্রতিটা অক্ষর চিনে নিতেই বইটা চোখের খুব কাছে নিয়ে আসতে হচ্ছে। তৃণা বাইরে বেরিয়ে এল। শীতের মধ্যে অন্ধকার থেকে মেদুর আলোয় এলে সারা গায়ে আনন্দ ফুটে ওঠে, এই আনন্দেই ঠেস দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। রোদও আছে, মৃদু হাওয়াও আছে। টকঝাল লজেন্সের মতো এই দুই স্বাদের স্পর্শে তার রোমকূপগুলো খাঁড়া হয়ে ওঠে। তখনই দেখতে পায় চটিঘরের বালবটা হাওয়ায় একটু-একটু দুলছে। প্রজাপতি সমেত।
তৃণা ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল জুতোঘরের দিকে। বালবের সামনে আসামাত্র প্রজাপতিটা হঠাৎ ছটফটিয়ে উঠল। প্রজাপতি কি তাকে কিছু বলতে চায়? ছাড়া পেতে চায়?
একটা পাথর তুলে ছুঁড়ে মারতেই বালবটা শব্দ করে ভেঙে গেল। কাচ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। আর প্রজাপতিটা খোলা হাওয়ায় উড়ে বেড়াতে লাগল। সেই উড়ানের দিকে তাকিয়ে সে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। তারপরই খেয়াল হয় চটির কথা। চারিদিকে যে কাচ ছড়িয়ে পড়েছে! এবার চটিজোড়া সে নিয়ে আসবে কী করে?
(ক্রমশ)
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র