বছরকয়েক আগের কথা। এই নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ। রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলে ভিড় জমে গিয়েছিল পাখিপ্রেমীদের। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছিলেন তাঁরা। পাঠক হয়তো বিশ্বাস করবেন না, ব্যাঙ্গালোর এবং মুম্বই থেকে উড়ে এসেছিলেন জনাকয়েক। কারণ, ক্রো-বিলড ড্রঙ্গো বলে এক বিরল পাখির উপস্থিতি। দেখতে নিছক সাধারণ। কিন্তু ফিঙে প্রজাতির এই প্রাণীটির দেখা মেলে শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতের নিতান্তই হাতেগোনা কিছু জায়গায়।
ক’দিন ধরে, লোকমুখে ‘লেক’ বলে পরিচিত দক্ষিণ কলকাতার এই জলাশয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে ঠিক রথ-দোল দেখার মতো না হলেও, মানুষের ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্রো-বিলড ড্রঙ্গো প্রায় কাউকেই নিরাশ করেনি। এ-ডাল থেকে সে-ডাল, মুখে কখনও পোকা বা মথ, যারা পাখির ছবি তুলতে বা পাখি দেখতে ভালোবাসেন, তাঁদের সে মাতিয়ে রেখেছিল। তারপর প্রায় প্রত্যেক বছর, ঠিক একই জায়গায় তার দেখা মিলছে। এই বছরও ব্যতিক্রম হয়নি।
লেক, অর্থাৎ রবীন্দ্র সরোবর, পাখি ও পাখিপ্রেমীদের স্বর্গ। ভারতবর্ষে দেখা যায় ১,৩০০-র থেকে কিছু বেশি সংখ্যক প্রজাতি। বিশ্বাস করা কঠিন, শুধু লেকেই খোঁজ মিলেছে ১৩০-১৩৫ ধরনের। গোটা দেশে দৃশ্যমান প্রজাতির প্রায় ১০%! শহরের প্রাণকেন্দ্রে, সাকুল্যে তিন বর্গ কিলোমিটার বা তারও কম জায়গায়, এই সংখ্যা অকল্পনীয়। লেকে সাধারণত ভিড় জমান মর্নিং-ওয়াকারেরা। বহু দশক ধরে। সকালবেলায় বেশি। বিকেলেও কম নয়। আজকাল যদি লেকে যান, দেখবেন লম্বা লেন্স, বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা ও দূরবীন নিয়ে পাখির খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
লেকে দেখা মিলেছে যতগুলো প্রজাতির, তারা সকলেই যে সারা বছর এখানে থাকে এমন নয়। প্রায় গোটা ৫০ আসে মূলত শীতকালে। যখন উত্তরবঙ্গে বা উত্তর-পূর্ব ভারতে ঠাণ্ডা তুঙ্গে, তুলনায় গরম জায়গার খোঁজে নেমে আসে এরা। থাকে মাসদুয়েক বা তার বেশি। এরপর ফিরে যায় নিজেদের ভিটেয়। এর পোশাকি নাম ‘উইন্টার মাইগ্রেশন’। লেক অঞ্চলে গাছগাছালি প্রচুর এবং একাধিক জলাশয় আছে বলে, ওয়াকিবহাল মানুষেরা মনে করেন এইখানে এই পাখিদের দেখা মেলে বেশি। আজকাল এদের দেখতে ভিড় চোখে পড়ার মতো।
এই বছর আসর জমিয়ে দিয়েছিল স্মল নিলটাভা এবং টিকল’স ব্লু ফ্লাইক্যাচার। কয়েক সপ্তাহ আগে। প্রথমটা বিরল। দেখা যায় শুধু উত্তর-পূর্ব ভারত এবং হিমালয়ের সামান্য কিছু জায়গায়। গাঢ় নীল গায়ের রঙ। ছোট সাইজ, চোখে পড়ার মত জিনিস। কলকাতায় হাতের কাছে তার দেখা পেয়ে বিহ্বল হয়ে উঠেছিলেন পাখিপ্রেমীরা। স্মল নিলটাভা এর আগে এইখানে দেখা গিয়েছে, কেউ মনে করতে পারছেন না। যথারীতি একে দেখতে ভালোই ভিড় হয়েছিল। যথেষ্ট ভালো ছবি তুলেছিলেন অনেকে। খুব সম্প্রতিও সে এখানে ছিল। টিকল’স ব্লু ফ্লাইক্যাচার দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের অনেক জায়গায় দেখা গেলেও, লেক অঞ্চলে তার আগমন প্রথম বলেই মনে করেন স্থানীয় পাখি অনুরাগীরা। এটাও যথেষ্ট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। ছবিও ভালোই উঠেছিল।
এই প্রসঙ্গে, পাখির ছবি তুলতে বা পাখি দেখতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের কথা বলা দরকার। কথ্য ভাষায়, এঁদের বলা হয় ‘বার্ডার’। এরা শুধু পাখির প্রতি আকৃষ্ট। দূর-দূর চলে যান কাঠখড় পুড়িয়ে, গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে। ক্যামেরা ও লেন্সের পিছনে খরচও কম হয় না। তবুও তাঁদের দমিয়ে রাখা যায় না। পরিবার হয়তো চায় ছুটিতে তাজমহল বা সোনার কেল্লা দেখতে। বার্ডাররা সেই সবের তোয়াক্কা না করে, ছোটেন উত্তরাখণ্ডের সত্তাল, রাজস্থানের ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক, গুজরাতের রান অফ কচ্ছ, অরুণাচল প্রদেশের মত জায়গায়। উত্তরবঙ্গের বেশকিছু জায়গাও এঁদের ঘোরতর পছন্দের। রিজার্ভ ফরেস্টের মতো জায়গায় গেলে, বাঘের থেকে বেশি এঁদের নজর থাকে পাখির দিকে। ডিজিটাল ক্যামেরার প্রচলন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, এঁদের সংখ্যা বেড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার চল বেড়েছে বলে, ছড়িয়ে পড়ছে এঁদের ছবি। অধিকাংশের জীবিকা অন্য কিছু। পাখির পিছনে ছোটেন স্রেফ ভালোলাগার টানে।
লেকে এত ধরনের প্রজাতির দেখা পাওয়া মানে, বার্ডারদের পোয়াবারো। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত এবং শহরতলী থেকে এঁরা আসেন। বিশেষ করে শীতকালে এঁদের আনাগোনা বেড়ে যায়। রবীন্দ্র সরোবর সাধারণত কাউকে নিরাশ করে না। তবে ব্যাপারটা খাটনি, খরচা এবং সময়সাপেক্ষ। ভারি লেন্স হাতে ঘুরে বেড়াতে হয় কয়েক ঘণ্টা। নজর রাখতে হয় কোথায় কী লুকিয়ে বা বসে আছে। খেয়াল রাখতে হয় পাখির ডাকের দিকে। চোখ রাখতে হয় গাছের পাতার মধ্যে নড়াচড়া হচ্ছে কি না। তারপর আসে ধৈর্য ধরে মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পালা। লাইট, ব্যাকগ্রাউন্ড সব ঠিকঠাক থাকলে, তবেই না উঠবে ঠিকঠাক ছবি! অনেকেই বেশ ভাল তোলেন, অপেশাদার হয়েও। এঁদের অধ্যাবসায়ের প্রশংসা করতে হয়।
যে প্রজাতিগুলোর নাম বলা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া ব্ল্যাক নেপড মনার্ক, ফেরুজিনাস ফ্লাইক্যাচার, ইন্ডিয়ান ব্লু রবিন, হোয়াইট টেইল্ড রবিন, ব্লু থ্রোটেড ব্লু ফ্লাইক্যাচার, ভারডিটার ফ্লাইক্যাচার, লেসার র্যাকেট টেইলড ড্রঙ্গো, কয়েকধরনের থ্রাশ পড়ে বিশেষ আকর্ষণগুলোর মধ্যে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মাইগ্রেটরি। বেশ বাহারি পাখি। গায়ের রং চোখে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। ‘বার্ডস অফ প্রে’ বা শিকারি পাখিদের মধ্যে দেখা মিলেছে বুটেড ঈগল এবং চেঞ্জেবল হক ঈগলের। দেখা গিয়েছে ইন্ডিয়ান পিটা ও ব্ল্যাক-হুডেড পিটার মতো ছোট্ট, অপূর্ব সুন্দর এবং বিরল প্রজাতি। শহরের বুকে এদের দেখতে পাওয়া রীতিমত চাঞ্চল্যকর ব্যাপার। এছাড়া, লম্বা লেজওয়ালা ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার কিছুদিনের জন্য লেকের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। সারাবছর দেখা মেলে এমন পাখিদের মধ্যে রয়েছে ব্ল্যাক-হুডেড ওরিওল, তিন ধরনের বারবেট, তিন ধরনের কিং-ফিশার ও আরও অনেক।
দীর্ঘদিন ধরে লেকে পাখি দেখছেন ও ছবি তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দা সুদীপ ঘোষ। পাখির টানে পাড়ি দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মজার ব্যাপার, লেকে দেখা যায় এমন পাখিদের মধ্যে, সিংহভাগের আনাগোনা সাফারি পার্ক নামে পরিচিত এক জায়গায়, যার মাপ মেরেকেটে দুই বর্গ কিলোমিটার। মর্নিং ও ইভনিং-ওয়াকারদের ডেরা। খোলা থাকে সকালে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। বিকেলে ঘণ্টা দুয়েক। সুদীপের মত, যেহেতু সাফারি পার্ক দিনের বেশিরভাগ সময়ে বন্ধ থাকে, পাখিরা এখানে নিরাপদ বোধ করে। সেই জন্য, প্রায় সমস্ত বিরল পাখিদের দেখা যায় এইখানে। সকাল ও বিকেলে হয় ক্যামেরাধারীদের জটলা। বেসরকারি সংস্থার কর্মী, সুদীপ প্রায় নিজের উদ্যোগে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছেন, পাখিদের আনাগোনা বজায় রাখতে গেলে, সব জায়গা সাজানোগোছানো রাখা যাবে না। কিছু জায়গা রাখতে হবে জঙ্গলের মতো। পরিষ্কার না করে। তাঁর পরামর্শের সুফল ভোগ করছেন শহরের পাখিপ্রেমীদের ঝাঁক।
সুদীপ মনে করেন, এই অঞ্চলে এত ধরনের পাখি দেখতে পাওয়ার কারণ, তাদের কাছে এইটা ‘উইন্টার মাইগ্রেশনের’ যাত্রাপথ। উত্তর থেকে আরও দক্ষিণে যাওয়ার রাস্তা। “এত গাছ ও জলাশয় থাকার জন্য বেশ জায়গা। খাবার-দাবার ইত্যাদিও নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত। সেই কারণেই এদের এইখানে দেখা যায়। এ ছাড়া, এদের জন্য কিছু জায়গাও তৈরি করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। গাছপালা না কেটে। একটু জংলা পরিবেশ তৈরি করে। সেই কারণেই প্রায় ৮০% প্রজাতির দেখা মেলে শুধু সাফারি পার্কের মধ্যে। পাখিরা এইখানে নিরাপদ বোধ করে।”
এর পাশাপাশি, সুদীপ খানিক শঙ্কিতও। তাঁর মতে, বিভিন্ন ধরনের পাখির দেখা মিললেও, তাদের ঠিক বিশাল সংখ্যায় দেখা যায় না। অধিকাংশ বিরল প্রজাতির মাত্র একটা বা দুটো লেকে আসে। “এবং তারা কেউ এখানে অনেকদিনের জন্য থাকে না। সেটা যদি মাইগ্রেশন প্যাটারনের জন্য হয়, আমাদের কিছু বলার নেই। সেরকম হলে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যদি ভয়ে বা খাবারের অভাবের জন্য এরা চলে যেতে বাধ্য হয়, সেটা হবে চিন্তার বিষয়। লেক অঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যারা আছেন, তাঁদের আমরা বলেছি সমস্ত জায়গায় ঘাস কেটে ফেলা বা ঝরে পড়া পাতা ও ডালপালা তুলে ফেলা ঠিক হবে না। এই কারণে, যে সব পাখি মাটি থেকে খাবার সংগ্রহ করে, তাদের সংখ্যা কমতে আরম্ভ করেছে বলে আমাদের ধারণা। কিছু জায়গায় খানিকটা জঙ্গুলে পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি।”
তবে এই কারণে পাখিপ্রেমীদের উৎসাহে ভাঁটা বিশেষ পড়েনি। এখনো প্রায় রোজ তাঁরা ভিড় জমাচ্ছেন। সৌভাগ্যবশত, পাখিদের আসাযাওয়াতেও ভীষণ চোখে পড়ার মতো ঘাটতি চোখে পড়েনি। এটার পাশাপাশি সুদীপের আশংকার কথাও মনে রাখা উচিৎ। পরিবেশ সম্বন্ধে খানিকটা সচেতন হলে এবং পাখিদের গতিবিধি, অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ সম্বন্ধে কিছুটা খোঁজখবর রাখলে, রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চল অনায়াসে এক অতুলনীয় জায়গা হয়ে থাকতে পারে। কোন শহরের প্রাণকেন্দ্রে, এত সংকীর্ণ পরিসরে দেখা যায় পাখিদের এই বিপুল সমারোহ? এটা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সার্বজনিক সচেতনতা। তবেই না বার্ডাররা বাড়ির কাছেই পাবেন ভিন রাজ্যে পাড়ি লাগানোর স্বাদ।
কভারের ছবি: ব্লু থ্রোটেড ব্লু ফ্লাইক্যাচার; ছবি তুলেছেন লেখক
ছবি ঋণ: ‘বায়োডাইভার্সিটি অফ রবীন্দ্র সরোবর’ ফেসবুক পেজ