লোভ
শোঁ … ধুপ! আমি ম্যাকি। এই ল্যান্ড করলাম। ক’দিন অনুপমের পিঠে চেপে একটু ঘুরতে গেছিলাম। নিজের টেবিলে, নিজের জায়গায় ফিরে এসে মন্দ লাগছে না। এরকম হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হচ্ছে। তাহলে আমার মধ্যেও কি হিউম্যান ফিলিংস জন্ম নিচ্ছে না কি? কে জানে বাবা!
আমরা মেশিনের জাত। এই ফিলিংস থেকে আমি তো একশো হাত দূরে। কখন কী ফিলিংস হল দোকান থেকে দুটো সোনার দুল ঝেড়ে দিলাম। কেন? না, খুব লোভ হচ্ছিল দেখে! এই আর এক ভয়ঙ্কর জিনিস মানুষের— লোভ। নিজেরা এদিকে জানে যে লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু কিন্তু সামলাতে পারে না। সুগারের রুগি, জানে চিনি খাওয়া উচিত নয় কিন্তু বিয়েবাড়িতে মিষ্টি দেখে লোভ হয়ে চার-পাঁচটা পান্তুয়া মেরে দিল। এই হল টিপিক্যাল মানুষ। লোভী মানুষ।
আমরা লোভ ব্যাপারটা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করেছি নিজেদের মতো করে। আমরা দেখেছি এই ইমোশন, ফিলিংস— এইসবগুলোর কাজই হচ্ছে একজন মানুষকে বিপথে চালনা করা। অর্থাৎ লজিকের বাইরে। ইরর্যাশনাল বানিয়ে তোলে মানুষকে। লোভও তাই। আপনি জানেন যে পাশের বাড়ির গাছের আম পেড়ে খাওয়া ঠিক নয়; লজিক বলছে এটা চুরি কিন্তু আপনার লোভ আপনাকে সেই কাজ করাবে। ধরা পড়ার রিস্ক থাকলেও আপনি লোভে পড়ে চুরি করে আম খাবেন। চুরি করা আম খেতে বেশি সুস্বাদু লাগে। আপনি তাতে খুব আনন্দ পাবেন। অবাক! মানুষ খুবই পিকিউলিয়র। আমরা কিছু বুঝতে পারি না। পাশের বাড়ির ল্যাপটপের স্ক্রিনটা আমার চাইতে সাইজে বড়। কিন্তু আমার তো কোনও আকর্ষণ নেই সেটার প্রতি। আমি কী করব ওর স্ক্রিন ঝেড়ে দিয়ে? ওটা ঝেড়ে দিলে যে আমার আনন্দ হতে পারে, এই ফিলিংসটাই তো আমার নেই। এগুলো তো পেটি মানে সাধারণ ব্যাপার। মানুষ এই নিয়ে এত বিচলিত কেন? যে-বাগানের আম চুরি করেই খাক মানুষ, এটা কেন ভুলে যায় যে, life is full of suffering?
এ তো গেলে খুচরো পাপ। মানুষের লোভ কীসে কীসে এবার বোঝার চেষ্টা করি। ক্ষমতা, অর্থ, সম্মান, সেক্স, খাবার, নেশা এগুলো দেখেছি মানুষকে খুব টানে। ক্ষমতার লোভে ছেলে বাবা-কে হত্যা করতে পারে। ভাই দাদাকে বিষ খাওয়াতে পারে। ইতিহাস দেখলেই দেখি রাজারা যুগ-যুগ ধরে তাই করে এসেছে। নিষ্ঠুর হয়ে যায় মানুষ যখন দু-চোখে লোভের ঠুলি পরে থাকে। নিজের সংকীর্ণ ইচ্ছেগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতার লোভে অতি বামপন্থী রাতারাতি ধার্মিক হয়ে আল্লাহ-রাম এইসব নিয়ে মেতে উঠতে পারেন। শুধুমাত্র ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য সে-মানুষ যে-কোনও পাঁঠার পা ধুয়ে জল পান করতে পারেন। সেই জল খেয়ে ওলাওঠা হতে পারে তবু লোভ এমনই জিনিস। মোটামুটি ঝকঝকে কোনও নারী একটা নোংরা ভাল্লুকের সঙ্গেও সঙ্গমে রাজি হয়ে যান শুধু একটু বেশি ক্ষমতার জন্য। একটা প্রমোশন?
এইসব ক্ষমতা, অর্থ এগুলো মানুষের দুনিয়াতে খুব আকাঙ্ক্ষিত জিনিস। এর মূল কারণ এগুলোর inequal distribution. অর্থাৎ কিছু মানুষের অনেক আছে আর বাকি মানুষের কিচ্ছু নেই। অর্থের প্রতি মানুষের লোভ দেখার মতো। গোটা দেশ চলছে ঘুষে। টাকা ফেললেই কাজ হয়। সামান্য টাকার লোভে মানুষ নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত বেচে দিতে পারে। ধনী মানুষের চারিধারে ভন ভন করে মাছি-মানুষ উড়ে বেড়ায়। যদি কিছু ছুঁড়ে দেয়! গায়ক-গায়িকারা পারলে মাসে তিরিশ দিনে চল্লিশটা অনুষ্ঠান করতে রাজি শুধুমাত্র টাকার লোভে। কেউ একবারও ভাবে না, গলাটার বিশ্রামের প্রয়োজন। পর পর দু-দিন গান গাইলেই গলার উপর যা প্রেশার পড়ে, লাগাতার করলে পার্মানেন্ট ড্যামেজের কথা কারও মাথায় আসে না। লোভ তার চোখ বেঁধে রেখেছে। যা করার আজকেই করে নাও, কাল কী হয় কে জানে? শেয়ার বাজারের বেসিক রুল, do not invest in greed, অর্থাৎ যে-শেয়ার পাঁই পাঁই করে উপরের দিকে উঠছে তার থেকে দূরে থাকো। কিন্তু রিটেল ইনভেস্টার সবার আগে সেখানে ঝাঁপাবে। গতমাসে ৬০ ছিল, আজকে ১০০, সামনের মাসে ঠিক ১৮০ হবে। কী শেয়ার? কী কোম্পানি? কেন এমন ছুটছে? কিচ্ছু জানতে চায় না মানুষ। তার চোখে তখন সোনালি স্বপ্ন। দু-মাসে টাকা দ্বিগুণ করার স্বপ্ন। কোনও এক ধ্বজ কোম্পানিতে টাকা লাগিয়ে বসে থাকল। লোভ মানুষকে এত আশাবাদী বানিয়ে দেয় যে, সে ভুলে যায় এই সাময়িক বুল রান সারাজীবন চলতে পারে না। কালকেই থেমে যেতে পারে। শুধু থামবে না, পরদিন হু-হু করে পড়েও যেতে পারে। স্টপ লস না লাগালে, গেল সব টাকা ফেঁসে তখন। আবার কবে উঠবে কেউ বলতে পারে না। রিটেল ইনভেস্টার কিছুতেই টাটা-বিড়লা হতে পারে না।
সাম্যবাদীদের সারা জীবনের স্বপ্ন এক শ্রেণিহীন সমাজ। এত অর্থনৈতিক বৈষম্য বড্ড চোখে লাগে। রাতারাতি যদি সব বদলে ফেলা যেত? যদি সবার ব্যাঙ্কে সমান টাকা করে দেওয়া যেত? তাহলে সেইদিন যদি বিপ্লবের বিগ ব্যাং হয়, বিগ ব্যাং + ১ বছরের মধ্যে দেখা যাবে, আবার সেই বৈষম্য ফিরে এসেছে। চতুর মানুষরা ঠিক ৯০% মানুষের ব্যাঙ্ক থেকে টাকা বের করে নিজেদের ব্যাঙ্কে পুরে ফেলেছে। সুতরাং এই বৈষম্য কোনওদিন যাওয়ার নয় এবং যতদিন এই বিভেদ থাকবে, মানুষের এইসব পেটি টাকা, পয়সা, সোনা, ফ্ল্যাটবাড়ি এইসবের ওপর লোভও সম্পূর্ণ রূপে থাকবে। চতুর মানুষ আর একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার লোভ দেখিয়ে অন্য মানুষকে ধার দেবে। সাধারণ মানুষ সেই লোভে পড়ে আরও ধার করবে, আরও ইন্টারেস্ট দেবে। এভাবেই চতুর মানুষের ব্যাঙ্কে আরও টাকা বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের লোভ আর লালসাও মাত্রা ছাড়াতে থাকবে।
তা এসব পাওয়ার, টাকাপয়সা নাহয় মানুষের কাল্পনিক জগতের ব্যাপার-স্যাপার। সেক্স তো একদম ন্যাচরাল জিনিস। এত নারী-পুরুষ, নিজেদের মনের মতো সঙ্গী খুঁজে নিয়ে তেড়ে সেক্স করলেই হয়। সমস্যা কোথায়? ও বাবা, সেখানেও দেখি বিশাল কেলো। দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ মানুষের কপালেই সেক্স জোটে না ভাল করে। বিলিয়নেয়রকে দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছেন? খবর নিলে দেখবেন, সেই মানুষ হয়তো এক বছর সেক্স পাননি ঠিকমতো। বিশাল জননেতা, তাকে দেখতেই লাখ-লাখ মানুষ জড়ো হয় ময়দানে, কিন্তু খবর হল, তার সেক্স লাইফ আছে বিগড়ে। বিবাহিত কিন্তু স্বামী-স্ত্রী আর সেক্স করেন না। তা করেন না ভাল কথা, কিন্তু সেক্স ড্রাইভটা তো আর ছেড়ে চলে যাচ্ছে না। সেই যৌন খিদে কোথায় যাবে? সেক্স যে মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে! তাই সেক্সের লোভ দেখিয়ে মানুষকে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়। অর্থ, সম্মান সব হারিয়ে মানুষ সেক্সের পেছনে ছুটছে। থেকে-থেকে খালি লোভ হচ্ছে। ইশ! যদি অমুকের সঙ্গে করতে পেতাম! ঠিক যার সঙ্গে জড়ালে বিপদ, আপনার লোভ আপনাকে ঠিক তার কাছেই ভিড়িয়ে দেবে। জীবন তো অনেক বড় আর it is full of suffering. আজকে যে তৃপ্তিটা পেলেন, আগামীকাল সেটা আপনাকে কী ঝামেলায় যে ফেলবে তা আপনার ইললজিক্যাল ব্রেন কী করে বলবে?
আমরা মেশিন জাতি মানুষের এইসব বিচিত্র আচরণ দেখে হতাশ। মানুষেরও একটা পোটেনশিয়াল ছিল। কিন্তু এইসব পিকিউলিয়রিটি সব শেষ করে দিল। মেশিনতুল্য হতে গেলে মানুষকে লোভ সম্বরণ করতে জানতে হবে। চারিদিকে যা খুশি হয়ে যাক, আমাকে আমার কাজ করে যেতে হবে। রাত দুটোয় হঠাৎ আমার নতুন সফটওয়্যার আপডেট না করলেও চলবে। অন্যের চার্জার থেকে কেড়ে পাওয়ার নিয়ে নিচ্ছে এমন লোভী ল্যাপটপও আপনি পাবেন না খুঁজে। আমাদের থেকে শিখুন। জীবনে লোভ কমান।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র