মেসি মেসি মেসি
আমরা ইদানীংকালে যেমন বলি না সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে— এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট। ঠিক সে রকমই, এ বছরের বিশ্বকাপে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে— মেসি, মেসি, মেসি। একটা ঘোর চলছে যেন। কেবল আর্জেন্তিনার ভক্তদের মধ্যে নয়। আরও অনেক দেশ থেকে আসা ফুটবল ভক্তদের হৃদয়,মন জুড়ে রয়েছেন লিও মেসি। আর আছে ভক্তদের প্রার্থনা— ঈশ্বর! এ বার বিশ্বকাপটা যেন মেসি পায়।
আর্জেন্তিনা-ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনাল— এটাই ছিল বিশ্বকাপে আমাদের শেষ ম্য়াচ। সুতরাং, মেসির অলৌকিক খেলা দেখার আরও একটা সুযোগ।
সেদিন সকাল থেকে ঘোরাঘুরি করলাম, আফগান রেস্তোঁরায় খাওয়া বাকি ছিল, সেখানে খুব ভালো খেলাম, খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুরে হোটেল ফিরে তাস খেলে ম্যাচ দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।
মেট্রো করেই স্টেডিয়ামে পৌঁছলাম আমরা, সেই মেট্রো জার্নির অভিজ্ঞতা খুবই আনন্দের, স্পেশাল। আমি দেখলাম আর্জেন্তিনার সমর্থক সবথেকে বেশি, এবং এই বহু সংখ্যক ফ্যানদের মধ্যে সবাই শুধু যে আর্জেন্তিনীয়, তা নয়; মূলত মেসির জন্যই সারা বিশ্ব জুড়ে ফ্যানেরা অনেকেই এসেছেন খেলা দেখতে। মেট্রো ভর্তি আর্জেন্তিনা সাপোর্টার, তারা গান গাইছে, উচ্ছ্বাস করছে, নিজের টিমের প্রতি ভালোবাসা জানাচ্ছে। আমরা যেন একটা কার্নিভালের মধ্যে ঢুকে পড়লাম, এবং ভেসে গিয়ে পৌঁছে গেলাম লুসেইল স্টেডিয়ামে
লুসেইল-এ ৮৯,০০০ লোক ধরে; আমাদের সল্ট লেক স্টেডিয়ামের প্রায় সমানই। সেখানে আবার হেঁটে-হেঁটে যাওয়া,বিশ্বকাপ কার্নিভালের পরিবেশটা উপভোগ করার যে আনন্দ বুকের কোনায় জমা হয়ে থাকল, সেটা সত্যিই অমূল্য, আশ্চর্য এক ঝিলমিল হয়ে থেকে যাবে আর মাঝে মাঝে মনে ঝিকিয়ে উঠবে।
কিছু ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকও দেখতে পেলাম। ক্রোয়েশিয়ার ফ্ল্যাগ, আর্জেন্তিনার ফ্ল্যাগের মধ্যে দিয়ে স্টেডিয়ামে ঢোকা— এবং এটাই আমার কাছে ওয়ার্ল্ড কাপ এক্সপিরিয়েন্স হিসাবে সবথেকে বড় পাওয়া। হেঁটে ওঠা ইত্যাদি সাধারণ, কিন্তু যেই মুহুর্তে গ্যালারিতে ঢোকা, বুকে ধক করে লাগল! অত বড় একটা স্টেডিয়াম চোখের সামনে খোলা পড়ে আছে, কিছুক্ষণ পরেই সেখানে সেমি-ফাইনাল ম্যাচ শুরু হবে, লোকজন যেন নিজের মধ্যে নেই, এটা যেন বাস্তব নয়! আমার অন্তত বার বার সেটাই মনে হচ্ছিল। এই অভিজ্ঞতাটার তুলনা হয় না! শুধু এই মোমেন্টটার জন্য বার-বার খেলা দেখতে যাওয়া যায়— সিঁড়ি ভেঙে উঠে প্রথমবার মাঠের সামনে দাঁড়ানো! আমি বার বার দাঁড়াতে চাই, ওই বৃহতের সামনে, যেখানে আমার নিজের কোনও স্বার্থ নেই, কোনও ম্যাচের হারাজেতার ওপর আমার কিচ্ছু নির্ভর করে না। সুতরাং সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে এক বিশালের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আশ্চর্য অনুভূতি!
এর পর তো মাঠের চেঁচামেচি আওয়াজ আছেই। এক দিকে মড্রিচরা মাঠে নামছে, অন্যদিকে মেসি এবং বাকি আর্জেন্তিনা দল প্র্যাকটিস করছে। মেসির জন্য ডেফিনিটলি স্পেশাল, কেননা মেসি যে পরিমাণ হাততালি, চিয়ার পায়, সেটা আর অন্য কোনো প্লেয়ার পায় না। সেটাতে মেসির উপর একটা অবিশ্বাস্য চাপও থাকে।
বাঁশি বাজলো, খেলা শুরু হল— অন্য দিনের তুলনায় আমরা খুব ভালো সিট পেয়েছিলাম, একদম কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে, মাঠের কাছেই ছিলাম।
খেলা সবাই দেখেছে, খুবই ওয়ান-সাইডেড খেলা হয়েছে। আর্জেন্তিনা যে-কটি চান্স তৈরি করতে পেরেছে, তা খুবই লিথাল এবং ফিনিশিং খুবই ক্লিনিকাল। বড় ম্যাচের ক্ষেত্রে যা ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে দাঁড়ায়, মিস করা চলবে না, আর্জেন্তিনা এ-দিন তাই করে। একটা ম্যাচে নরম্যালি ৮-৯টা চান্স তৈরি হয়, সেখানে থেকে গোল দিতে না পারলে একটা টিম জিততে পারে না।
আর্জেন্তিনা বরং বল ক্রোয়েশিয়াকেই দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কোনো অ্যাটাকিং থ্রেট নেই, তা বোঝা যাচ্ছিল। ক্রোয়েশিয়া ফাইনাল থার্ডে খেলতে পারে না; ওদের মূল খেলাটা মিডফিল্ডে এবং সেটা ভালো খেলে।
এই দিন যেটা আর্জেন্তিনার প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ালো সেটা হচ্ছে ক্রোয়েশিয়াকে খেলতে দিয়ে যতবার আর্জেন্তিনা এগোচ্ছে, ক্রোয়েশিয়া আটকাতে পারছে না। মেসির গোল দেখলাম; ওয়ান অফ হিজ ফাইনেস্ট ডিসপ্লেজ— চোখের সামনে দেখলাম, সেটা সারা জীবন মনে থাকবে। তারপর ম্যাচ জেতার আনন্দে সবাই হই-হই করতে করতে ফেরা তো আছেই।
আমি অবজার্ভ করছিলাম আর্জেন্তিনার সাপোর্টারদের— তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রাণ আছে; গান-বাজনা সবকিছুর মধ্যে দিয়ে সবাই সেলিব্রেট করছে, এবং সবাই অপেক্ষা করছে মেসির হাতে বিশ্বকাপ ওঠার জন্য, যাতে শেষ বারের জন্য প্রমাণ হয়ে যায় যে মেসিই এ-কালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার। এই অপেক্ষা করার প্রকাশটা খুব তীব্র, খুব ঐকান্তিক।
এ বছরের মতো মাঠে বিশ্বকাপ দেখা শেষ। অভিজ্ঞতা অনেক রকম হল, সে সব আপনাদের সঙ্গে ভাগ করেও নিলাম, কিন্তু সত্যি সত্যি কী পেলাম, কী মনের ভেতর গেঁথে গেল, সেটা এখনি বলতে বা প্রকাশ করতে পারব না। সেটার জন্য কিছুটা সময় লাগবে। সেই অলোকিক মুহূর্তগুলোর সঙ্গে আমি যখন একলা সময় কাটাব, তখন আবার তৈরি হবে আরও অনেক দুর্দান্ত অনুভূতি, যেগুলো আমার মধ্যেই ছিল, কিন্তু তখন আলাদা করে চিনতে পারিনি। সে সব অনুভূতি আরও থিতোবে, চার বছর ধরে জারিয়ে নেব আমার মধ্য়ে। পরের বিশ্বকাপের আগে অবধি! ততদিন এরাই সেরা হয়ে থাক।