বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটারের গড়ে ওঠা ছিল আর পাঁচটা মঞ্চনাটকের চাইতে একেবারে আলাদা— এই কথা বাঙালি হওয়ার সুবাদে শেষ ৫০ বছর ধরে আমরা কম শুনিনি। কিন্তু তারপর, সেই ‘আলাদা’টা কেমন, সে-নিয়ে আমাদের কেন খোঁজ করার বিশেষ তাগিদ হয়নি, বা খোঁজ করলেও কেন ঠিকমতো উত্তর পাওয়া যায়নি, তা আমার জানা নেই। গবেষণার খাতিরে যেহেতু এই শেষোক্ত প্রশ্নটি আমাকে বেশ কয়েকবার, বেশ কিছু জায়গায় করতে হয়েছিল, তার উত্তর হিসেবেও শেষ অবধি যা পেয়েছি, এইবেলা সবাইকে জানিয়ে রাখা ভাল।
যেমনটা বলছিলাম— বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটারের গড়ে ওঠা একেবারে অন্যরকম। সে কেমন, বলতে গেলে বলতে হয়, অন্য সব নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্ক্রিপ্টের দাসানুদাস হয়ে থাকে— যার নমনীয়তা বলেও কিছু নেই, আর মঞ্চে ইম্প্রোভাইজেশনের সুযোগও খুব কম— তৃতীয় থিয়েটার মোটেই সেরকম ছিল না। সাহিত্য যে-নাট্যধর্মের (theatricality) দাক্ষিণ্যে নাটক হয়ে ওঠে, তৃতীয় থিয়েটারের সেই নাট্যধর্ম শুধুই যে লিখিত স্ক্রিপ্টের উপর ভর করে গড়ে উঠত, এমন নয়; বরং শব্দ বা বাচিকের অতীতে যা কিছু অলিখিত, unscripted, তাকেও সমান গুরুত্ব দিতেন বাদল সরকার। অর্থাৎ, তাঁর থিয়েটারের ভাষা গড়ে উঠত যা কিছু লিখিত, তার সঙ্গে একটা বিরাট অলিখিত সম্ভাবনার মেলবন্ধনে— যে-সম্ভাবনা তাৎক্ষণিক, আগে থেকেই হিসেব-নিকেশ করে মিলিয়ে রাখা নয়।
আরেকটু বিশদে বলা যাক। মঞ্চ-থিয়েটারের রমরমার যুগে অল্প কিছুদিন কাজ করার পর বাদলবাবুর ‘শতাব্দী’ নাট্যদল ১৯৬৯ সালে অর্থাভাবে, কিছুটা উদ্দেশ্যহীনতায়, হারিয়ে গিয়েছিল দর্শকের মন থেকে। আবার যখন তাদের দেখা গেল, সালটা ১৯৭২; মঞ্চ ছেড়ে নতুন থিয়েটার নিয়ে সেই তাদের আত্মপ্রকাশ। ABTA হলে ‘সাগিনা মাহাতো’র সেদিনের কিংবদন্তি উপস্থাপনা আজ অবধি তৃতীয় থিয়েটারের সমার্থক, পপুলার মিথের অংশ। চারদিকে দর্শক বসিয়ে, অল্প খরচে, অন্তরঙ্গ সেই প্রযোজনা শুধু যে নতুন এক থিয়েটার-আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছিল সেদিন, তা-ই নয়, প্রায় সদ্যোজাত একটি নাট্যভাষকে (theatrical language) গ্রহণ করার প্রস্তাবনা রেখেছিল সবার সামনে। পরবর্তী চার দশক জুড়ে বাদল সরকার শুধু সেই ভাষাকে জমি দিয়েছেন নানা উপায়ে, নানা জায়গায়।
কেমন ছিল এই নবাগত ভাষা? ভাষা বলতেই, সাধারণভাবে আমাদের বোধ এমন কথ্য বা লেখ্য ভাষায় বাঁধা যে, সচেতনতা তার বাইরে বিশেষ একটা মুখ বাড়ায় না। কিন্তু ভাষা আদপেই তাতে সীমাবদ্ধ নয়, সে কোনও একটি বা দুটি বা বহু প্রকাশের অতীতে একে-অন্যের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম মাত্র। কাজেই, কালির অক্ষরে ফুটে না উঠেও যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে নীরব অভিব্যক্তি, বা শরীরী অভিনয়ের ভাষা— তবেই না তাদের আমরা বাঙ্ময় বলি! প্রথাগত যে-সমস্ত নাটকে বাচিক দিকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা অস্তিত্ব বলে বিবেচিত হয়, সেখানে অভিনয়ে অঙ্গের ব্যবহার তাকে ধরতাই দেয় মাত্র। কিন্তু বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটারে বাচিক দিকটি একাধিপত্য ফলায় না। তাই, নাটকে লেখা সংলাপ, আখ্যান অপেক্ষা করে থাকে শরীরের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করার। থিয়েটারের ভাষায় যাকে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং বলে থাকি আমরা, সেই শরীরী ভাষার বিশেষ গুরুত্ব ও প্রয়োগ ছিল তৃতীয় থিয়েটারে। কিন্তু শুধু ভাবলেই তো হয় না; ১৯৭২-এ কাজ শুরু করেই বাদলবাবু বুঝলেন, তাঁর এই ভাষা সবার আগে ঠিকভাবে শেখা প্রয়োজন নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে, নাহলে আধো-আধো অস্পষ্ট জ্ঞানে তাকে যদি থিয়েটারে ব্যবহার করা হয়, হিতে বিপরীত হতে পারে।
সেই বছরই জুলাই মাসে বাদল সরকার গেলেন নিউ ইয়র্কে, বিখ্যাত নাট্যতাত্ত্বিক ও পারফর্মার রিচার্ড শেখনারের ‘পারফর্ম্যান্স গ্রুপ’-এর সঙ্গে থেকে কাজ শিখবেন বলে। এর আগেই বাদলবাবুর মোলাকাত হয়ে গিয়েছে জের্সি গ্রোটোভস্কি আর য়ুরি লুবিমভের থিয়েটারচর্চার সঙ্গে। কাজেই নিউ ইয়র্কে নাতিদীর্ঘ প্রশিক্ষণ কেবল যে তাঁকে শরীরী ভাষার তত্ত্বে পারদর্শী করল তা-ই নয়, ভারতে ফিরে নিজের কাজে কীভাবে সেই ভাষা কাজে লাগাবেন, সে-নিয়েও মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা পেলেন বাদল সরকার।
নিউ ইয়র্কে কিছুদিনের সেই অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু আমরা সহজেই পেয়ে যাব বাদলবাবুর The Third Theatre প্রবন্ধে। তৃতীয় থিয়েটারের প্রাথমিক পর্বে ১৯৭২-এর এই exposure-এর কাছে বিশেষভাবে ঋণী তিনি। যেমন, এক জায়গায় বলছেন আমেরিকার নাট্যগোষ্ঠী ‘লিভিং থিয়েটার’-এর কথা—
With the help of the Schechners, I got in touch with some notable personalities of the new theatre, such as Julian Beck and Judith Malina of the Living Theatre…. The Living Theatre is considered to be the first principal initiator of the new theatre in America … preparing a new project called the Legacy of Cain – a series of plays dealing with money, love, war, etc., their inter-relationships and their relationship with man. … I did not realize at that time but, later, the sole purpose of my theatre was to become almost exactly that, although my philosophy as well as my theatre differed considerably from that of the Living Theatre. …
ওই একই প্রবন্ধে শেখনারের দলের নাট্যচর্চা দেখার অভিজ্ঞতার কথাও লিখছেন বাদল সরকার—
I joined the Performance Group at the University of California at Berkeley, near San Francisco. The group was rehearsing their new plays there and conducting theatre workshops with students taking summer courses in drama. I watched rehearsals, participated in workshops, and I also had the first opportunity to see a performance of Commune presented at the University. … Though short, my stay in America and my contact with the people of the new theatre there drove at least one important point home – that theatre cannot be done without intense training.
কিন্তু এই যে শেষোক্ত উপলব্ধি, নতুন পাঠকের কাছে এও কিছুটা ভাসা-ভাসা, অস্বচ্ছ। কেমন হওয়া উচিত এই intense training-এর? কী এমন আছে এই অনুশীলনে, যা বদলে দিতে পারে নাট্যসাহিত্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা নাট্যভাষ?
কলকাতায় ফেরার পর অঙ্গনমঞ্চে নতুন দল নিয়ে একেবারে হাতে-কলমে কাজ করতে-করতে বাদল সরকারের ওই ক্ষণিকের অভিজ্ঞতা ক্রমেই সংকল্পে পরিণত হচ্ছে যখন, তিনি খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর এতদিনের কাঙ্ক্ষিত নাট্যভাষকে এক আশ্চর্য উপলব্ধ সত্যে— বিকল্প থিয়েটারে কোনও একজন স্ক্রিপ্ট লেখেন না। জমিতে এর শিকড় শক্ত করার জন্য বাদলবাবু ফিরে যাচ্ছেন তাঁর বিদেশের অভিজ্ঞতাতেই—
I mostly attended the rehearsals of Sam Shepard’s The Tooth of Crime directed by Richard Schechner. The script was being followed (that is to say, it was not to be an improvised performance), but follow is hardly the term that can be applied. Actually, the script was being confronted. Not limited to finding out the best way to project the lines of the script, it was a process of confronting, exploring and assimilating the meaning of the whole play through every situation, every line – till the script was no longer something written by a playwright; rather, it became a play felt and made by the performers themselves.
উপরের পুরো উদ্ধৃতিটির মধ্যে কেবলমাত্র একটি শব্দের বিষয়েই কথা বলি, confront(ed)। Confront করা বলতে, রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতায় কিছুর সম্মুখীন হওয়া, মোকাবিলা করা, এসব বোঝায়। নাটকের সঙ্গে নাট্যচর্চার বা পারফর্ম্যান্সের সম্পর্ক কিন্তু আগে কখনওই এরকম ছিল না প্রথাগত থিয়েটারে। নাট্যকার নাটকে লিখবেন যা, তা-ই একপ্রকার শেষ কথা, এবং নির্দেশক ও অভিনেতারা সেই কথাকে শিরোধার্য মেনে, বিশ্বাস-অবিশ্বাস দূরে সরিয়ে রেখে মঞ্চস্থ করবেন, এমনটাই ছিল মূলস্রোতে, এমনকী বিকল্পস্রোতেও প্রথাগত নাট্যচর্চার রীতি। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শুধু যে নাট্যসাহিত্যের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানো, তা-ই নয়, শেষ অবধি থিয়েটারের টেক্সটটিকে নাট্যকারের একাধিপত্য থেকে বার করে এনে নির্দেশক ও অভিনেতাদের যৌথ একটি অনুভূত প্রয়াস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার সেকালে দেখানো এক অসীম সাহসিকতার পরিচয়। এই পুরো বিষয়টা, বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই অভ্যাস বা অনুশীলনের দিকে, যার চর্চা নিউ ইয়র্ক ও অন্যত্র বাদলবাবু বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবেই দেখেছিলেন। তাঁর দল ‘শতাব্দী’র জন্যও এবার শুরু করলেন তেমনই অনুশীলনের আয়োজন— ওয়ার্কশপের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া অভিনেতাদের বৌদ্ধিক ও অনুভূতির বিশিষ্টতাই হয়ে উঠতে শুরু করল তৃতীয় থিয়েটারের উদ্দিষ্ট বিকল্পভাষের প্রোটোটাইপ।
অঙ্গনমঞ্চে দর্শকদের সামনে ঠিক কীভাবে ‘শতাব্দী’র নাটকগুলি উপস্থাপিত হবে, সে-নিয়ে বিস্তর চিন্তা, আলোচনা, ওয়ার্কশপ, মহড়া এবং সবশেষে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে অভিনয় শুরু হল। এই সব কিছুতে আস্তে-আস্তে সময়ের দাগ লেগেছে; বস্তুত সেই পোড় খাওয়া বৈশিষ্ট্যগুলিই আমাদের কাছে তৃতীয় থিয়েটারের বিকল্পভাষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
অঙ্গনমঞ্চে দর্শকদের প্রথাগত বসার জায়গাটিকে নানাভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন বাদল সরকার। নির্দিষ্ট seating arrangement ভেঙে বাদলবাবু এক-এক উপস্থাপনায় এক-একভাবে দর্শকদের বসাতেন। এর ফলে অভিনেতা-দর্শকের যোগাযোগে এক ধরনের নমনীয়তা তো তৈরি হত বটেই, দর্শকরা নিজেদের অজান্তেই অভিনয়ক্ষেত্রে ঢুকে পড়তেন কখনও-কখনও। এমনকী, বসার প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তিও হত খুব কম সময়েই; ফলে, প্রতিবারই দর্শকের নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করা, এবং তাতে আরও বেশি সচেতনভাবে নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া খুব অস্বাভাবিক ছিল না।
তৃতীয় থিয়েটারে টিকিট সিস্টেম রাখেননি বাদল সরকার; দর্শক ইচ্ছেমতো মূল্য দিতে পারতেন নাটকের শেষে, গামছায়। কিন্তু প্রযোজনার খরচাপাতিও তো সামলাতে হবে সেইমতো; নাহলে থিয়েটার চলবে কেমন করে? এসব নিয়ে ভাবতে-ভাবতে, নিজের দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই, বাদলবাবু থিয়েটারকে করে তুললেন পাশের ঘরের আড্ডার মতো; কোনও দূরবর্তী, শৌখিন, আরোপিত উদ্যাপন নয়। বিদায় দেওয়া হল বেশি খরচের স্পটলাইটকে; নাটকে ব্যবহৃত হতে থাকল সাধারণ হলুদ বাল্ব। ঘরের প্রতিধ্বনির সমস্যা কাটাতে বেশি কোনও যান্ত্রিক ঝকমারি না করে চারদিকের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হল পুরু পর্দা, তাতেই কাজ হল বেশ। যে-তিনটি বৈশিষ্ট্যের উপর তাঁর থিয়েটার দাঁড়িয়ে আছে বলে নিজের জীবনের শেষ দিন অবধি বাদল সরকার দাবি করে গেছেন— নমনীয়তা (flexibility), বহনযোগ্যতা (portability) ও সুলভ্যতা (inexpensiveness)— তাদেরই চর্চার আভাস এগুলি। প্রায় নিখরচায় ঘরে-রাস্তায়-পার্কে-মাঠে বহনযোগ্য থিয়েটারটি ব্যবহারিক স্তরে চাক্ষুষ করা যেতই; আর নাটকের টেক্সট বা দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আখ্যানে সেই দর্শনগত নমনীয়তারও প্রমাণ অঢেল। এই সবই বাদল সরকারের থিয়েটারের সেই বিশেষ ‘তৃতীয়ত্ব’।
তবু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। এই যে এত কিছু বৈশিষ্ট্য, দর্শন, চর্চার ফিরিস্তি এল-গেল, এ তো সবই বোঝার স্তরে। রক্তমাংসের মানুষগুলো যখন থিয়েটারটা সত্যি-সত্যি করবে আমার চোখের সামনে, তখন এই সাত রাজার ধন এক মানিক ‘তৃতীয়ত্ব’কে চর্মচক্ষে দেখতে পাব কি?
দু-ভাবে প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া যায়; প্রথমে গঠনগত দিক থেকে বলি। বহু বিকল্প থিয়েটারকে আমরা সহজেই দাগিয়ে দিতে পারি এই বলে যে, সে বিষয়বস্তুর চেয়ে বেশি জোর দিয়েছে তার ফর্মে, গঠনে, আঙ্গিকে; ঠিক যেমন মূলস্রোতের মঞ্চনাটক চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হল, বিষয়বস্তু যেমন খুশি আলাদা হোক, তার গঠন মোটামুটি একভাবেই বাঁধা থাকবে মঞ্চে। তৃতীয় থিয়েটার মূলস্রোতের পথে তো যায় না, বলাই বাহুল্য; আবার বিকল্প হয়েও সে কিন্তু সরাসরি ফর্মসর্বস্বতার দিকেও হাঁটে না। পেন্ডুলামের মতো সে দুলতে থাকে গঠনগত স্বাতন্ত্র ও বিষয়বস্তুর যথার্থতার মাঝে। কেবলমাত্র বিদেশে শিখে আসা নতুন পন্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব— এই মর্মেও বাদল সরকার তৃতীয় থিয়েটারে যেমন হাত দেননি, আবার এমনও বলা যায় না যে তাঁর নাটক যদি মূলস্রোতের প্রসেনিয়াম মঞ্চে অভিনীত হত, বিষয়বস্তুর উদ্দিষ্ট প্রভাব কমবেশি একই থাকত। বাদল সরকার একরোখা ভাবে বলে গেছেন, তাঁর থিয়েটার অন্যান্য বিকল্প থিয়েটারের মতো ফর্মকেন্দ্রিক নয়; তৃতীয় থিয়েটারে ফর্ম কোনওভাবেই বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তার পরিপূরক। কথাটা নেহাত কেতাবি নয়, কারণ বাদলবাবুর নাটকগুলো পড়লেই বোঝা যাবে, বিষয়বস্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনই যে তাদের সম্পূর্ণ প্রভাব বুঝতে প্রয়োজন দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের প্রত্যক্ষতা— যা দিতে পারে কেবলমাত্র সেই বিকল্প গঠন।
আবার পারফর্ম্যান্সের নিরিখে দেখতে গেলে, যে-উপায়ে গড়ে উঠত শতাব্দীর এক-একটি প্রযোজনা বাদল সরকারের তত্ত্বাবধানে, তাতেই খুঁজে পাওয়া যায় এই থিয়েটারের বিকল্পভাষ। দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বাদলবাবুর কোনও পারফর্ম্যান্সই আগে থেকে ঘষেমেজে রাখা কোনও নাটকের ভিত্তিতে সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি; আবার সেই পারফর্ম্যান্সের পুরোটাই যে প্রত্যুৎপন্ন (impromptu), এমনও নয়। অতএব, সেই মধ্যপন্থা— খাতায়-কলমে লিখে কিছুটা এগোনো একটা নাটকের খসড়াকে বার বার ওয়ার্কশপ ও রিহার্সালের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে-যেতে গড়ে উঠত বাকি নাটকের ভাষা, বিষয়, উদ্দেশ্য; আবার ওয়ার্কশপে তাৎক্ষণিক অভিনয়ের নতুন নতুন প্যাটার্ন তৈরি হওয়ায় উপস্থাপনাগুলোও হত পুনরাবৃত্তির ভারবর্জিত।
তৃতীয় থিয়েটারের ভাষা তাই লিখিত (scripted) এবং অলিখিত (unscripted)— এই দুয়ের মধ্যবর্তী এক ‘হয়ে ওঠা’। লিখিত নাটক হিসেবে তার যেটুকু পরিচয়, তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি না তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পারফর্ম্যান্সের সম্ভাবনাগুলো আমাদের চোখে পড়ে; আবার অলিখিত পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতেই যদি সেই ভাষাকে বুঝতে চাই কেবল, দেখব, সে আজকের এই চেহারায় বিবর্তিত হয়েছে আসলে একটি নাট্যসাহিত্যের কাঠামো থেকে। কথ্য বা লেখ্য ভাষার (lingual) ও সেই ভাষা-বহির্ভূত অভিব্যক্তির (para-lingual gestures) যে সুবিশাল জমি, তাতে আঙ্গিক ও বাচিক দিকগুলির সঠিক মিশেলকে চিনতে পারলেই খুঁজে পাওয়া যায় এই তৃতীয় ভাষাকে।
ঋণ : The Third Theatre, বাদল সরকার।