আঁতেল আপত্তি
কাতারের এক ফুটবল-কত্তা (বিশ্বকাপ-দূত) বলেছেন, সমকাম ভাল না। জার্মান একটি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ভদ্রলোক (কাতারের জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন এক সময়) বলেছেন, সমকাম হচ্ছে ‘হারাম’, এবং ছোট ছেলেমেয়েরা সমকামীদের দেখতে পেলে, মহা সমস্যা। তাঁর মতে, সমকাম একটা ‘damage in the mind’, মানসিক বিকৃতি। তাঁর বক্তব্য, আমরা মেনে নিচ্ছি, (বিশ্বকাপ উপলক্ষে) সবরকম লোক এদেশে আসবে, কিন্তু সবরকম লোককেও এদেশের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। হয়তো বোঝাতে চাইছেন, এদেশে সমকামীরা আসতে পারেন, কিন্তু এখানে থাকাকালীন সমকাম যেন না করে ফেলেন। স্বাভাবিক ভাবেই হইহই পড়ে গেছে, জার্মানির এক মন্ত্রীও প্রতিবাদ করেছেন, আবার এই সময়েই সেপ ব্লাটার (১২ বছর আগে কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি দেওয়ার সময় ফিফা-র প্রেসিডেন্ট) বলেছেন, কাতারকে দায়িত্ব দেওয়া একেবারে ভুল হয়েছে, অমন ছোট দেশ, ওর চেয়ে বিশ্বকাপ ও ফুটবল দুই-ই অনেক বড়। হয়তো এর ভাবসম্প্রসারণ করলে বেরোবে: আকৃতির মতোই, কাতারের হৃদয়ও যথেষ্ট প্রসারিত নয়। কিন্তু কথা হল, কাতার তো নতুন করে এসব বুলি আওড়াচ্ছে না। রাষ্ট্র হিসেবে কাতার কেমন, কারও অজানা নয়। সেখানে মানবাধিকার দলন নিয়েও বহুদিনই বহু গোষ্ঠী সরব। আমি একটা মস্তানকে রবীন্দ্রজয়ন্তীর দায়িত্ব দেব, তারপর স্টেজ বাঁধাছাঁদা হয়ে যাওয়ার পর আচমকা তার চাঁদা তোলার প্রক্রিয়া নিয়ে শোর মচাব, এ খুব উদ্ভট। যে-দেশটা মনে করে সমকাম খারাপ, সে কি একটা বড়সড় ইভেন্টের আয়োজন করছে বলে রাতারাতি নীতি ও মূল্যবোধ বদলে ফেলবে? যে সারাজীবন মনে করে এল সমকাম ‘হারাম’, সে এবার, পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের মনপসন্দ হওয়ার জন্য ঘোষণা করবে, সমকাম দিব্যি চমৎকার, এবং এদেশে সমকাম ছলকালে কোনও সমস্যা নেই? বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর বহু মানুষ কাতারে আসবেন, নির্ঘাত কিছু বেয়াড়া রিপোর্টার ওখানে লোকজনের বাক্স্বাধীনতা বা আচার-আচরণের স্বাধীনতা নিয়ে কয়েক কিস্তি লিখবেন (বা ক্যামেরায় দুরবস্থা দেখাতে চাইবেন)। কাতারের কর্তারা বুদ্ধিমান হলে বিষয়গুলো নিয়ে কিচ্ছু না বলে ঠোঁট বন্ধ করে থাকবেন, প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবেন, কিংবা ধোঁয়াটে ফুলেল বিবৃতি বাগিয়ে ধামাচাপা দেবেন। তা-ই তো নিয়ম।
কাতারে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি ব্যবহার নিয়েও গুচ্ছের নালিশ রয়েছে, কেউ বলেছেন এই বিশ্বকাপেরই পরিকাঠামো গড়ার জন্য যে বিশালসংখ্যক শ্রমিক মোতায়েন করা হয়েছে, তাঁদের বিপুল দুরবস্থা। ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর সমীক্ষা (ফেব্রুয়ারি ২০২১) অনুযায়ী, বিশ্বকাপের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তখনও অবধি কাতারে ৬৫০০ শ্রমিক মারা গেছেন। কাতার বলেছে, এ-হিসেবে গরমিল আছে, কেউ জরা বা অন্য অসুখের কারণে মারা গেলেও সেগুলোকে শ্রমস্থলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে কিংবা অতিরিক্ত খাটুনির ফলে মৃত্যু ধরে নেওয়া হচ্ছে। এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর বক্তব্য, কাতারে নিয়মিত জোর করে শ্রমিকদের খাটানো হয়, বিচ্ছিরি পরিবেশে বাস করতে বাধ্য করা হয়, মাঝে মাঝেই মাইনে ও পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়। এমনকী কেউ কাজ ছেড়ে দিতে চাইলে, অন্য কাজে যোগ দিতে চাইলে, বা দেশ ছেড়ে চলে যেতে (বা নিজের দেশে ফিরে যেতে ) চাইলেও সমস্যা আছে, কারণ মালিকের অনুমতি ছাড়া তিনি তা করতে পারেন না। এ এক ধরনের ক্রীতদাস প্রথাই, যা কাতার বাতিল করবে বলেছে, চুক্তি সইও করেছে, কিন্তু অনেকের মতেই, সে কাগজ-সইয়ের প্রভাব বাস্তবে তেমন পড়েনি। বহুদিন মাইনে দেব না এবং সেই মাইনে চাইতে এলে গালাগাল ও হুমকি দেব— কাতারে এ-ব্যাপার বিরল নয়, ২০১৫ সাল নেপালি শ্রমিকেরা যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি চেয়েছিলেন (নেপালে সাংঘাতিক ভূমিকম্প হয়েছিল), তা মঞ্জুর করা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হল, তাতে কী হবে? মেসি আর রোনাল্ডো বলবেন, ওখানে খেলব না? বড়জোর হ্যারি কেন (এবং আরও কয়েকজন) রঙিন আর্মব্যান্ড পরে খেলবেন, যা ভালবাসার বার্তা দেবে : ‘সবাই সমান’ কিংবা ‘ঘৃণা কোরো না প্রেম করো’। এর আগে রাশিয়ায় সোচি উইন্টার অলিম্পিক্সের সময় (২০১৪) পুতিন সমকামীদের সম্পর্কে বলেছিলেন তাঁরা এলে কোনও সমস্যা নেই কিন্তু তাঁরা যেন রুশ শিশুদের থেকে দূরে থাকেন, রাশিয়ার মানবাধিকার-পীড়ন নিয়ে প্রভূত প্রতিবাদ হয়েছিল, ওই অলিম্পিক্সের কিছুদিন আগে পর্যন্ত ‘পুসি রায়ট’-এর গায়িকারা জেলে ছিলেন, বহু পরিবেশকর্মী ও মানবাধিকার-আন্দোলনকারীদেরও প্রায়ই গ্রেফতার করা হচ্ছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার নিয়ে তখনও কথা উঠেছিল। বেইজিং উইন্টার অলিম্পিক্সের সময় (২০২২) চিনে বিশেষত উইঘুরদের ওপর প্রবল অত্যাচার নিয়ে (এবং চিনা মহিলা টেনিস খেলোয়াড় পেং শিউয়াইয়ের ঘটনা নিয়ে, যিনি চিনের এক রাজনৈতিক পান্ডার নামে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আনার পরেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান— নিন্দুকদের মতে, হাপিস করে দেওয়া হয়— এবং কিছুদিন পরে ফিরে এসে বলতে থাকেন তাঁর অভিযোগ মিথ্যে ছিল) বিরাট হইহই হয়, অনেক দেশ খেলোয়াড় পাঠালেও কূটনীতিক ও প্রতিনিধি না পাঠিয়ে প্রতীকী ‘বয়কট’ করে। প্রায় সমস্ত দেশেই যখন বড় কোনও আসর বসে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সে-দেশের নানা অন্যায় নিয়ে সরব হন, বাকিরা মুখ ঘুরিয়ে না-শোনার ভান করেন। এমন কথাও কেউ বলতে পারে, পৃথিবীর যে-কোনও দেশেই, খতিয়ে দেখা গেলে, এতগুলো প্রকাণ্ড প্রখর অন্যায় ও নিষ্পেষণ ঘটে, এতগুলো মানুষ-বিরোধী কাজ নিরন্তর হয় বা সহ্য করা হয়, যদি কেউ সিদ্ধান্ত নেয় ‘আমি ভালমানুষ দেশ ছাড়া খেলাধুলো করতে যাব না’, তাহলে তাকে হাত গুটিয়ে ঘরেই বসে থাকতে হবে। এই তো ভারতে পরের বছর ক্রিকেট বিশ্বকাপ হবে, তখন কেউ যদি এদেশে বাক্স্বাধীনতার খতিয়ান খুলে বসে, কিংবা জনজাতির কত মানুষকে বিনা অপরাধে কয়েদ করে রাখা হয়েছে সেই সংখ্যা বাতলায়, বা জিজ্ঞেস করে কোন সভ্য দেশে ধর্ষকদের মালা পরানো হয় এবং বলা হয় ‘হিন্দুরা ধর্ষণ করে না’, অথবা প্রশ্ন করে যুদ্ধবাজ রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল পাচ্ছিল বলে নাগাড়ে তা কিনে ভারত আবার শান্তির সংলাপ আওড়ায় কোন আস্পদ্দায়, তাহলে বিরাট মুশকিল ঘটবে। কিন্তু আমরা জানি, সে-কথাগুলোকে শয়তান ও শত্রুদের চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া হবে, বড়-বড় কোটেশন আওড়ানো হবে, এবং ঘটা করে ক্রিকেট চলবে, আর আমরা প্রায় সব্বাই তাতে গর্বিত ও পুলকিতও হব। তাই কাতারকে ধাঁ করে একলা-ভিলেন সাজিয়ে লাভ নেই।
সভ্যতায় এ-কথা শিখে নিতেই হবে : কাজ করার সময় খোপ খোপ ভাগ করে নাও। যার সঙ্গে সিনেমা করছ, সে হয়তো বাড়িতে বেড়াল মারে। যার কাছ থেকে চিনি কিনছ, সে হয়তো বউ পেটায়। যাকে চুমু খাচ্ছ, সে হয়তো লোকের চাকরি খায়। বিজ্ঞাপনের মডেল হচ্ছ, খোঁজখবর নিলে হয়তো দেখবে ওই কোম্পানি আলবানিয়ায় শিশু-শ্রমিক ব্যবহার করে। যে-পুলিশ তোমাকে প্রাণপণ সাহায্য করছে, সে হয়তো টেবিলের তলায় একটা আসামিকে বুট দিয়ে পিষছে। যে-দেশে পড়াশোনা করতে যাচ্ছ, তারা হয়তো অন্য দেশে ইস্কুলের ওপর বোমা ফেলছে। যে-বন্ধু শ্মশানে অবধি সঙ্গে যাচ্ছে, সে বেনিয়ার পা চেটে নির্লজ্জ ধান্দাবাজি করে প্রোজেক্ট খাবলাচ্ছে। সমস্ত সমগ্র সমুদয় সিনারি পবিত্র হলে তবে তুমি জলকে নামবে, এ-কথা ভাবলে জীবন রুদ্ধ। সব কথা জানাও যায় না, আর সব জানলে পুরোটার ভিত্তিতে কাউকে পাশ-নম্বর দেওয়াও যায় না। দেখতে হবে তোমার কাজ চলছে কি না, আর অন্য ক্ষেত্রগুলোয় মোটামুটি এড়িয়ে-পেরিয়ে সরে-সরে থাকতে পারছ কি না। যে-কুমির তোমায় প্রত্যক্ষ খেতে আসছে সে-ই একমাত্র একমাত্রিক একমেটে আলকাতরা-ছোপানো তঞ্চক, জীবন এতটা পাতি সিনেমা নয়। প্রচুর উপ-কুমির আছে, তারা কেউ কেউ তোমার সমর্থক ও বড়কুমির-বিরোধী, তাদের হাত (থাবা) না ধরলে তুমি ডুবে যাবে। এমনকী আয়নায় চোখা নজর চালালে বহু নখ-ঋদ্ধ বেগড়বাঁই ভেসে উঠবে। বিশ্বকাপে দেখতে হবে দেশটা সাজিয়েছে কেমন, স্টেডিয়াম খানাপিনা নিয়মশৃঙ্খলা হোটেল রাস্তাঘাট কেমন, রেলগাড়ির রং কী। ওই ক’দিন কোনও প্রকট অনাচার না ঘটলেই মিটে গেল। মেথররা কেমন কুঠুরিতে থাকে, এ নিয়ে উঁকিঝুঁকি একটু বাড়তি আঁতলেমি। জার্মানি কেমন খেলছে, এপমাপে নেইমারের চেয়ে বড় কি না, কবে আফ্রিকান দেশ বিশ্বকাপ পাবে— এ নিয়ে হইহুল্লোড় হোক না বাবা। গোল হলে ট্যাটু লাগাও, নেচেকুঁদে ভেঁপু বাজাও, কত সস্তায় ১০ নম্বর জার্সি বিক্কিরি হচ্ছে দ্যাখো। হিস্টিরিয়ার চোটে গ্যালারিতে সমকামীরা ছপাস-ছপাস চুমু খেয়ে না দিলেই হল।