কবে বিয়ে করবেন/ করবে/ করবি?’ হ্যাঁ, এক প্রশ্ন। গত পাঁচ বছর ধরে তিন প্রজন্ম নির্বিশেষে এই গতে বাঁধা প্রশ্নেই জর্জরিত আমি। সত্যি বলতে, প্রথম-প্রথম বিরক্তই হতাম বেশ। আজকাল আর পাত্তা দিই না সেসব। মৃদু হেসে উড়িয়ে দিই কেবল। তবে চেনাপরিচিতদের থেকে আগত এহেন প্রশ্নমালায় জর্জরিত হওয়া নতুন কিছু নয়। সেই স্কুলে থাকতেই রেজাল্ট নিয়ে বিস্তর আগ্রহ ছিল তাদের। স্কুল ডিঙোলে কলেজের রেজাল্ট নিয়ে শুরু হল কৌতূহল। কলেজ পেরোতে-না-পেরোতেই ছুটে আসা শুরু হল পেশাগত বিষয়ের প্রশ্নভাণ্ডার। সে-এপিসোডে যবনিকা পাত ঘটতেই প্রশ্নের মোড় ঘুরেছে বিয়ের খবরে। মাঝে মাঝে মনে হয় দিই কষিয়ে উত্তর। আচ্ছা, প্রশ্নকর্তাদের কি ব্যক্তিগত বিষয়ে আগ্রহ না দেখালেই নয়! তা ছাড়া বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার মানে যে ইহজীবনের যাবতীয় অবাধ্যপনার অবসান ঘটানোর, সে সহজ সত্যটাই বা কেন বোঝে না ওরা!
এতদ্সত্ত্বেও আজকাল প্রবল ব্যতিক্রমধর্মী এক ভাবনা ঢুকেছে মাথায়। বিষয়টি অবিশ্যি মাথায় দিয়েছেন জননীই। মাস কয়েক আগে ডিনার টেবিলে হঠাৎই কথাটি পারেন তিনি।
‘বাবু, আর কতদিন?’
‘কী মা?’ অবুঝ সাজার চেষ্টা করেছিলাম আমি।
‘সে কী রে!’ মা স্ট্রেট ব্যাট ধরেছিলেন এরপর। ‘বলি সিঙ্গল তো থাকলে আটত্রিশ বছর। বিয়ে করে ব্যাচ-ব্যাচ লোক খাইয়ে ব্যাচেলর তকমাটা মোছ এবার। সারাজীবন তো আমি বেঁচে থাকব না। শেষ জীবনে কে দেখবে তোকে?’
কথাটা কিছু মন্দ বলেননি মা। এমনিতেই বাবা চলে যাওয়ার পর মাথার উপরের ছাদটাই সরে গেছে মনে হয়। মা চলে গেলে তো ধরণীটুকুও…। কিন্তু সে-কথা প্রকাশ করা অনুচিত বলে মনে হল আমার। তাই মজা করে বললাম, ‘শেষ জীবনে তোমরাই দেখবে। স্বর্গ থেকে।’
‘ইয়ার্কি মারিস না।’ মায়ের স্বর রাগত শোনায় এবার, ‘দেখ, ভুঁড়িটা তরমুজের মতো হলেও এখনও বয়স আছে তোর। আর দেরি করলে কিন্তু মেয়েরাই পত্রপাঠ বিদায় জানাবে তোকে।’
এ কী বললেন মা? মায়ের শেষ বলা কথাটা শোনার পরেই পরজীবী এক চিন্তা জন্ম নেয় আমার মননে। আসলে ভুল তো কিছু বলেননি মা! বছর কয়েক আগেও বত্রিশের প্যান্টগুলো পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতে কোমরটাকে। আর এখন? আটত্রিশের প্যান্টও আঁটোসাঁটো লাগে কীরকম। আচ্ছা, কোমরের মাপটাও কি বয়সের সমানুপাতিক হারে বাড়ছে আমার! তবে তো দু’বছর পর চল্লিশ, চার বছর পর বিয়াল্লিশ। ভাবতেই আঁতকে উঠি আমি। না, ওজনটা আয়ত্তে থাকতে-থাকতেই বিয়েটা করে নিতে হবে এবার। নাহলে ওই মায়ের কথাই সত্যি হবে শেষে।
শেষ কয়েকটা হপ্তা রোববারের কাগজের ম্যাট্রিমনিয়াল বিজ্ঞাপনগুলো একটু বেশিই সম্ভ্রমের চোখে ঘেঁটেছি আমি। কাজও দিয়েছে তাতে। কিন্তু প্রথমটায় সেখানেও ঘটে বিপত্তি। বিজ্ঞাপনে দেওয়া এক নম্বরে ফোন করতেই শুনি মহিলাকণ্ঠ, ‘কে বলছেন?’
‘আমি… মানে সৃজন সেন। ওই পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে…’
কথা শেষ করার আগেই গর্জে ওঠে অপরপ্রান্ত। ‘বয়স কত? বাসা কোথায়? কী করা হয় আপনার?’
কথা শুনে মনে হল পাত্রীর জননী নির্ঘাত! শঙ্কিত মনেই জানালাম তাই। ‘বয়স আটত্রিশ, নিবাস আটঘড়া, পেশা আটা-ময়দা-তেল-নুনের দোকান।’
‘ও-ও-ও-ও, মুদি দোকান!’
‘ইয়ে, মানে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স।’ বোঝানোর মরিয়া চেষ্টা ছিল আমার গলায়।
‘বুঝলাম।’
অপরপ্রান্ত মিনিটদুয়েক নিরুত্তর। অতঃপর সীমাহীন অসহ্যপনায় জর্জরিত আমি আচমকাই বলে বসেছিলাম, ‘মাসিমা, শুনতে পাচ্ছেন?’
ঠিক তখনই ফুটন্ত তেলে সর্ষে-ফোড়নের মতো ঝাঁঝিয়ে ওঠে ও-প্রান্ত, ‘এই যে মশাই, মাসিমা কে? আটত্রিশের পাত্র হয়ে বত্রিশের মহিলাকে মাসিমা বলতে কুণ্ঠা বোধ হয় না আপনার?’
এই রে! বুঝলাম কেস ঘেঁটে ঘঁ। ম্যানেজ করতে বললাম, ‘সেরকম কোনও অভিপ্রায় ছিল না ম্যাডাম। আসলে জলদগম্ভীর স্বর শুনে ভ্রম হয়েছিল খানিক।’
ঝাঁঝ কমেছিল ও-প্রান্তের, ‘মশাই আসলে আমি পেশায় শিক্ষিকা তো! স্কুলের বেয়াড়া বাচ্চাগুলোকে বকাঝকা করতে গিয়ে ভোকালকর্ডটা গেছে পুরো।’
বুঝলাম ফোন ধরেছেন পাত্রী স্বয়ং। মাখনপ্রলেপ কণ্ঠে বললাম, ‘ম্যাডাম বিজ্ঞাপনে দেওয়া নম্বরটি কি তবে আপনার?’
‘না, না। বাবার নম্বর। আসলে ফোনটা বাড়িতে ফেলে গেছেন বাবা, তাই। বাই দ্য ওয়ে, আমি সৃজা।’
সৃজন-সৃজা! বাপরে, এ তো রাজযোটক! মাঝমাঠের ছোট মাপা পাসের মতো কথা বলতে লাগলাম এরপর। সামান্য ব্যবধানেই সৃজার কণ্ঠে ফিরে এল মিষ্টতা। ব্যস, কালবিলম্ব না করে অতিসাহসী হলাম ঈষৎ। চেয়েই ফেললাম নম্বরটা। হ্যাঁ, পার্সোনাল ফোন নম্বর। সোমবার হলেও বৃহস্পতি সেদিন তুঙ্গে ছিল আমার। না হলে কি একবার চাইতেই করায়ত্ত হয় সে-নম্বর!
২.
জীবনে একটা জিনিস বুঝেছি, আত্মবিশ্বাস জিনিসটা কেবল পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেলেই বাড়ে না, প্রথম আলাপে অচেনা কোনও মহিলার ফোন নম্বর পেলেও বাড়ে। সে-আত্মবিশ্বাসে ভর করেই শুরু করেছিলাম ফোনালাপ। সেসব পেরিয়ে আজ এক রেস্তরাঁতে দেখাও করলাম দুজনে। দু’বাড়ির অভিভাবকদের অজান্তেই।
দেখতে আহামরি কিছু না হলেও বেশ দৃঢ় একটা ব্যক্তিত্ব আছে সৃজার। সেই ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়েই দু’ঘণ্টা কাটালাম লাঞ্চে। আচ্ছা, সৃজার কেমন লেগেছে আমায়? মন্দ নয় নিশ্চয়। লাগলে কি দু’ঘণ্টা অনর্গল বকেও বাসস্ট্যান্ডে যেত একসাথে? তবে ভুল একটা করেছি আমি। প্রথম সাক্ষাতেই বিগলিত হয়ে বদভ্যাসগুলো উগড়েছি সব। ইশ! পানঘটিত বিষয়গুলো না জানালেই ভাল হত বোধ হয়। সপ্তাহান্তে কিঞ্চিৎ সুরাপান আর রোজ রাতে সুপুরি-চুন সহযোগে একটি করে মিঠাপান। এ কি চূড়ান্ত বদভ্যাসের লক্ষণ? কে জানে? তবে লক্ষ করেছি, আমার এহেন পানাভ্যাস শুনে ধূসররঙে রাঙিয়েছিল সৃজা।
মনের মাঝে সৃষ্ট এতক্ষণের ভাবনাগুলোয় আচমকাই ধাক্কা দেয় রিংটোনটা। কে আবার রোববারের সন্ধ্যায়! আরে এ তো সৃজার বাবার নম্বর! তবে কি সৃজা বাবার নম্বর থেকে…?
‘হ্যালো!’
ফোনের অপরপ্রান্তে আচমকাই ভেসে আসে নাম-না-জানা সাইক্লোনের তেজ, ‘এত সাহস আপনার! আমার মেয়েকে নিয়ে লাঞ্চে গেছেন?’
জীবনে ধরা কেবল একবারই পড়েছিলাম, পরীক্ষাহলে; টুকতে গিয়ে। ফিজিক্স টিচার অতুলবাবুর সাফল্য ছিল সেটা। সৃজা বলেছিল তার বাবাও নাকি ফিজিক্সের টিচার। বাঃ! জীবনে আরও একবার ফিজিক্স টিচারের হাতেই…! যাই হোক, ঢোক গিলে বললাম, ‘মেসোমশাই, আমি তো আপনার মেয়ের সম্মতি নিয়েই…’
‘সম্মতি! বার করছি সম্মতি। এক্ষুনি দেখা করুন আমার সাথে, না হলে কপালে দুঃখ আছে আপনার।’
ঘাবড়ানো গলায় বললাম, ‘ক-খ-খ-ন আ-র-র কো-ও-ও-ও… থা-থা-য়…?’
ধমকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হল আমায়, ‘রাত আটটায়, বন্ধুবর ক্যাফেতে। খুশিপুর বাসস্ট্যান্ড, ওখান থেকে দু’মিনিটের হাঁটা পথ।’
৩.
একটু আগেই খুশিপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি ফেরার বাস ধরলাম আমি। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিযোগে মনটা ভারি খুশি আজ। ফাঁকা বাসে বসেই পুনঃরোমন্থন করলাম খানিক আগে শোনা সৃজার পিতৃদেবের কথা। ‘রাতে ডেকেছি বলে মনে কিছু করবেন না। আসলে মেয়েটা আমায় বড্ড ভালবাসে। তাই লুকিয়ে দেখা করেও বাড়িতে এসে বলে দিল সব। এও জানাল আপনার মধ্যে নাকি বিরল রকমের এক ট্রান্সপারেন্সি খুঁজে পেয়েছে কন্যে। তাতে ভীষণ রকম মুগ্ধও সে। তবে এই মুগ্ধতা যদি নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে চলে তবে আপনার অভিভাবকের সাথে কথা বলতে এতটুকু জড়তা কাজ করবে না আমার।’
কথাগুলো মনে করার শেষে হঠাৎই আমার চোখ গিয়ে পড়ে ডান হাতের উপরে। কী আশ্চর্য! রঙিন এক প্রজাপতি যে বহাল তবিয়তে রাজ করছে সেখানে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র