ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শিমুল


    অর্পণ (October 1, 2022)
     

    কাউকেই সামনে যেতে দিল না ওরা। সৈকত গাড়িতে বসে দেখতে থাকল একের পর এক সাদা প্লাস্টিকে মোড়া ‘বডি’ নামানো হচ্ছে। ফেরার পথে অনেকটা চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হল না জমিয়ে রাখা কান্নাগুলোর। গাড়ি চালাতে-চালাতে শুভ একবার ওকে দেখে নিয়ে আবার শুনশান রাস্তার দিকে ফিরে গেল।

    কিছুটা যাওয়ার পর নিজেকে বাগে এনে সৈকত অন্য ফোনটা বের করল। সব কিছুই অবাস্তব লাগছে। গাড়ি সাইড করতে বলল। পেচ্ছাপ করতে যাচ্ছে বলে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে বাবাকে ফোনটা করল। ওদিক থেকে গলা ভেসে এল। 

    ‘হ্যালো! বল বুবান। কী হয়েছে… বুবান?… হ্যালো! ছেলেটা যে কী করে না… বেশ রাখলাম…’ 

    ‘হ্যালো! হ্যালো! বাবা…’ এই অব্দি বলেই সৈকত আবার হারিয়ে গেল। অনেকদিন কাঁদার অভ্যেস নেই বলে শুধু চোখ ঝাপসা হয়ে গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ।

    ‘কাঁদছিস না কি রে তুই? হ্যাঁ রে? কী হয়েছে?’

    ‘শুভর বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। কাল রাতেই হঠাৎ হাসপাতাল থেকে জানাল ১০০% ভেন্টিলেশনে রাখছে আর আজ সকালে শেষ। আজকেই পিজিতে শিফ্‌ট করানোর কথা ছিল। শুয়োরের বাচ্চা হাসপাতাল ইচ্ছে করেই…’

    ‘আহ! এখন এসব বলে কী হবে? প্রাইভেট হাসপাতালে এই ক’টা দিন পেল, সেটাই বা কতজন পায়। কিন্তু তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেন? হ্যাঁ রে, রুমকি কোথায়? তুই কেঁদেছিস জানলে…’

    ‘রুমকির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’

    ‘অ্যাঁ! কী বলছিস? এখন কোথায়…’

    এই অব্দি শুনেই ফোন কেটে দিল সৈকত। মানুষের সময় খারাপ গেলে পর পর খারাপ জিনিসই হতে থাকে। সঙ্গে-সঙ্গে ফোনটা সুইচ অফ করে গাড়িতে ফিরে এল। সেদিন বাড়ি ফিরে রাতে একবার ওটা চালু করেছিল। করতেই পর পর ফোন আসতে থাকে।

    *

    সৈকতের সাথে রুমকির ছ’বছরের সম্পর্ক। ছাড়াছাড়ি হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই রুমকির বিয়ের খবর পায় সৈকত। সম্পর্কের শেষ কিছু মাস ভীষণ ঝামেলা হত ওদের মধ্যে। সৈকতের বরাবর আঁচ করার ক্ষমতা প্রবল। লকডাউনের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই খিটখিটে হয়ে আছে, এটা মনে হয়নি। তখন থেকেই এই ফোনটা ফ্লাইট মোডে করে দেয়। তারপর কোভিডের প্রথম ঢেউ চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে যায়।

    ওই ফোনের ‘শিমুল’ প্রজেক্টটা সৈকত নিছকই একদিন খেলার ছলে শুরু করেছিল। যত দিন এগিয়েছে, ততই শিমুল নিখুঁত হয়েছে আপনা থেকেই। সিমুলেটেড রিয়ালিটি যে আসলে একটা দানবিক ক্ষমতা, সেটা কিছুদিনের মধ্যেই টের পায় সৈকত। এই ফোনে যা করার কর কিন্তু আড়ালে শিমুল সব কিছু লক্ষ রাখবে এবং কন্টাক্ট-লিস্টের মানুষদের প্রায় হুবহু নকল তৈরি করবে— তাদের গলার স্বর, কথা বলার ধরন, টাইপ করার সময় বানান ভুল অব্দি। 

    সৈকতের খুব বিরক্ত লাগত রুমকি কাজে ব্যস্ত থাকলে। তখন ও শিমুলের মাধ্যমে রুমকির সাথে গল্প করত। যেহেতু ইন্টারনেটের সাথে যোগাযোগ ছিল, তাই আসল রুমকিকে কিছু বললে এই রুমকি সেটা জেনে যেত। এটা ভেবেই রুমকির সাথে ঝামেলা শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ও ফ্লাইট মোড করে দেয়। সৈকত যতটুক বলে, সেইমতো কথা এগোতে থাকে।

    সৈকতের খুব বিরক্ত লাগত রুমকি কাজে ব্যস্ত থাকলে। তখন ও শিমুলের মাধ্যমে রুমকির সাথে গল্প করত। যেহেতু ইন্টারনেটের সাথে যোগাযোগ ছিল, তাই আসল রুমকিকে কিছু বললে এই রুমকি সেটা জেনে যেত। এটা ভেবেই রুমকির সাথে ঝামেলা শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ও ফ্লাইট মোড করে দেয়। সৈকত যতটুক বলে, সেইমতো কথা এগোতে থাকে।

    জানার মধ্যে শুভ কিছুটা জানত। সব শুনে সৈকতকে একরকম জেরা করে বসে।

    ‘হ্যাঁ রে, সত্যি? মানে অজ্জিনাল রুমকির মতো গলা? সেম টু সেম? রুমকি জানে?’

    ‘ওকে বলতে যাব কেন? আর হ্যাঁ, শুরুর দিকে গলার আওয়াজ কেমন জড়িয়ে-জড়িয়ে আসত, কারণ এ.আই. নিজের মতো উচ্চারণ বসিয়ে দিত। কিন্তু বেশি কথা বলে বলে এখন রুমকি, তোদের আর বাবা-মা’র গলা প্রায় হুবহু। রুমকির সাথে ব্রেক-আপ হওয়ার পর কী অবস্থা হয়েছিল তুই তো জানিসই। এখন এভাবে কথা হয়। ঠিক ওর সাথে না, আবার ওর সাথেই!’

    ‘উফ, ব্রেক-আপ তো না, যেন ব্রেক-ডাউন! যাক গে, রুমকিকে একদিন অন্য রুমকির গলা পাঠিয়ে দে দেখি!’

    ‘ও আমায় ব্লক করে রেখেছে। ওর চ্যাটটা তাই আমার অন্য কাজে লাগে। দিব্যি ওখানে বাজারের ফর্দ, টুকিটাকি নোট লিখে রাখি। হে হে।’

    ‘তা আমার নোট-লিখিয়ে চাঁদু, তুমি যা পারভার্ট, অন্য রুমকির সাথে এখন নির্ঘাত চুটিয়ে ফোন-সেক্স করছিস বল? ইশ! রুমকি জানতে পারলে না!’

    ‘বাল! যেটুকু স্বাভাবিক ভাবে হওয়ার সেটুকুই। আর জানিস, আগে দুই রুমকিকে প্রায় পর পরই ফোন করতাম ঝগড়া হলে। আমি আগেভাগে এই রুমকিকে কিছু বলে দেখতাম কী রিঅ্যাকশন দেবে, তারপর আসল রুমকিকে বলতাম। মাঝেমধ্যেই মিলে যেত!’

    ‘আচ্ছা একদিন হারবার্ট-হারবার্ট খেলবি? মৃতের সহিত কথোপকথন! আরিস্‌সালা! কী আইডিয়া দিলাম, বল?’

    ‘যেই জানবে কেউ মারা গেছে, তার কন্টাক্টও ডেড হওয়ার কথা হিসেবমতো। করে দেখা হয়নি। ফ্লাইট মোড থাকা অবস্থায় তুই মরলে দেখতে পারি।’

    সেদিনের পরেই মাথায় বুদ্ধিটা খেলে যায়। তবে বাবা মারা যাবে সেটা আশা করেনি সৈকত। বাবার কোভিড হওয়ার আগে থেকেই যেহেতু ফ্লাইট মোড ছিল, অন্য বাবা কিছুই টের পায়নি। তারপর ওই বাবার থেকেই সাহায্য নিত ওর আসল বাবাকে সারিয়ে তুলতে। বলেছিল শুভর বাবার কোভিড। সেইমতো বাবা ওকে অনেক রকম লোকের খোঁজ দিতে থাকে।

    যে দু’সপ্তাহ বাবা ভেন্টিলেশনে ছিল, সৈকত একবার রুমকি আর একবার বাবার সাথে এভাবেই কথা চালিয়ে নিজেকে শান্ত রেখেছিল। সারাদিন মনে হত, ইশ! যদি বাবা একটু বিচক্ষণ হত, তাহলে হয়তো…

    ‘আমার কপাল অত খারাপ না যে কোভিড হয়ে যাবে। ডেসটিনি বলে একটা জিনিস আছে!’

    ‘ডেসটিনিতে ভরসা নেই। প্রবাবিলিটিতে আছে তাই বলছি।’

    সৈকতের বাবা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত পকেটে মাস্ক ভাঁজ করে নিয়ে খানিকটা মাদুলির মতো।

    *

    বাবা যেদিন মারা যায়, সেই রাতে ফের অন করতেই পর পর ফোন আসতে থাকে রুমকির। সকাল অব্দি যে-রুমকির সাথে কথা বলল, এ যেন অন্য কেউ। 

    ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আর তুই কোন সাহসে এখনও সবাইকে বলে বেড়াস যে তোর সাথে আছি?’

    সৈকত কোনও কথার উত্তর না দিয়েই ফোন রেখে দেয়। বাবাকে ফোন করে। আসল রুমকি যা যা বলেছিল সাত-আট মাস আগে, সব ঘটনা জানায়। বাবা সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৈকতকে আরেকবার রুমকিকে বোঝানোর কথা বলে। বাবা, যাকে আজ সকালেই দাহ করে এল, সে কিন্তু রুমকির বিয়ের খবর শুনে অন্য রকম কথা বলেছিল সৈকতকে তখন।

    কিন্তু সেদিন আর উপায় নেই দেখে সৈকত রুমকিকে রাতেই আবার ফোন করে আসল রুমকিকে যা যা বলেছিল, একই কথা বলে গেল। এই রুমকি প্রায় আসল রুমকির মতোই উত্তর দিতে থাকলে এক সময় আর সামলাতে না পেরে সৈকত কেঁদে ফেলে। আসল ঘটনার সময় সৈকতকে আরও খারাপ কথা শুনতে হয়েছিল রুমকির থেকে কিন্তু তখন এরকম হয়নি। 

    ‘কী হয়েছে তোর? শরীর ঠিক আছে? কাল কথা বলি?’

    ‘আমি ঠিক আছি… তুই আবার ছেড়ে যাস না…’

    ‘দেখ তোকে আমি খারাপ ভাবে বলতে চাইনি। আমাদের যেটুকু ছিল খুব ভাল…’

    ‘আমি আর পারছি না… দুটো বাবা, দুটো তুই… বাবাও আর নেই… আজ সকালেই শ্মশান… তুইও চলে যাবি আবার!’

    কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ।

    ‘কাকু? তুই তো শুভর বাবার কথা বলছিলি… হঠাৎ… কই রে…’

    আর কিছুই সৈকতের কানে ঢুকছিল না। যে-ভয়টা পেয়েছিল, সেটাই হয়ে গেল। ফোন রেখে সঙ্গে-সঙ্গে আবার বাবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে গেল।

    খুব দেরি হয়ে গেছে। বাবার কন্টাক্ট আস্তে-আস্তে আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল।

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিত সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook