ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • গাছ পোষা


    নীলার্ণব চক্রবর্তী (October 1, 2022)
     

    দ্বিতীয় জবা গাছটা কিন্তু বেঁচে গেল। এর ফলে সে দারুণ খুশিও থাকে এখন। সে মানে সৌমেন সান্যাল, ডাকনাম সিন্টু। 

    বাজার লাগোয়া গাছের দোকান। যে-ভদ্রলোক গাছ বিক্রি করেন, তাঁর নাম শ্যামল। বছর পঞ্চাশের কোঠায়। বড়-বড় দাড়ি, চুলও ঘাড় ছাপিয়ে নীচে নেমে এসেছে। দোকান মানে রাস্তার পাশে চারাগাছের যেন একটা জঙ্গল। তার মধ্যে শ্যামলদা বসে থাকেন। সিন্টু কিছুই বোঝে না গাছের। কিন্তু তার ভাল লাগে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গাছ দেখতে। নানা রকমের চারাগাছ। কী নেই সেখানে! জবা, গাঁদা, গোলাপ, রঙ্গন, বোগেনভিলিয়া, বেলি, টগর, জুঁই, গন্ধরাজ, টিকোমা, জারবেরা, আম, পেয়ারা, বারোমাসি লেবু, মাল্টা, কমলা, থাই বাতাবি, কুল, ডালিম, আতা, সফেদা, আমলকী, বারোমাসি আমড়া, জামরুল, অরবরই, বিলিম্বি, করমচা, ড্রাগন ফ্রুট…। গাছের দোকানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বাজারে দেরি হয়ে যায়। বাড়ি থেকে বউয়ের ফোন আসে। গালাগালি বর্ষিত হতে থাকে। বাছা-বাছা গালি। তাদের বাড়িতে কাজ করত যে-মেয়েটি, সিন্টু তাকে বিয়ে করেছে বছর পাঁচ হল। তার বউয়ের নাম আনন্দী। বয়স বছর আঠাশ। আর তার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। সারাদিন আনন্দীর তর্জনগর্জনের মধ্যে থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে তার উপর হাতও চালিয়েছে বউ। অনেকে বলেছে, অত্যাচারিত স্বামীদের নিয়ে একটি সংস্থা রয়েছে তার দরজা খটখটাতে, যাব-যাব করে আর হয়ে ওঠেনি। যদি ভাবেন গৃহ-অশান্তি অভাবের ফল, তা হলে ভুল ভাববেন। বালিগঞ্জে সিন্টুর জামাকাপড়ের দোকান। খুব ভাল চলে সেটা। তা ছাড়া বাবাও অনেক টাকাকড়ি রেখে গিয়েছেন। মা-বাবা দুজনেই অবশ্য এখন স্বর্গে; বাবা দু’বছর হল গত, আর মা তিন। এখানে বলে নিতে হবে, সিন্টুর বাবা সত্যব্রতবাবু ছিলেন পলিটিকাল লিডার, এলাকায় ছিল হেবি দাপট। 

    কিন্তু কেন বাড়ির কাজের মেয়েকে সিন্টু বিয়ে করতে গেল?

    কারণটা কিছুই নয়। একদিন কেউ ছিল না বাড়িতে। আনন্দী কাজ করতে এসেছিল। আঁচল নীচে পড়ে যাচ্ছিল। বার বার। ঘর মুছতে-মুছতে। এইসব দেখে সিন্টু নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তারপর আনন্দী প্রেগন্যান্ট। সিন্টু বিয়ে করতে রাজি হয়নি প্রথমে। ফলে ক্যাচাল শুরু। একদিন ভোরবেলায় বড় একটা দল নিয়ে আনন্দী এ-বাড়িতে চড়াও। চিৎকারে ঘুম ভাঙলে জানালা দিয়ে ওই দৃশ্য দেখে তো তার হার্টঅ্যাটাক হওয়ার উপক্রম। বাবা পার্টির কাজে কোথায় যেন একটা গিয়েছেন বাইরে। মা-ও নেই। পিসি আর সবসময়ের ফাইফরমাশ খাটার লোক বীরেন শুধু বাড়িতে। তারা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। দরজা প্রথমে খুলতে না চাইলেও, বাধ্য হয়েছিল শেষে। গালাগালির বন্যাটা তো থামাতে হবে! 

    একদিন কেউ ছিল না বাড়িতে। আনন্দী কাজ করতে এসেছিল। আঁচল নীচে পড়ে যাচ্ছিল। বার বার। ঘর মুছতে-মুছতে। এইসব দেখে সিন্টু নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তারপর আনন্দী প্রেগন্যান্ট। সিন্টু বিয়ে করতে রাজি হয়নি প্রথমে। ফলে ক্যাচাল শুরু। একদিন ভোরবেলায় বড় একটা দল নিয়ে আনন্দী এ-বাড়িতে চড়াওচিৎকারে ঘুম ভাঙলে জানালা দিয়ে ওই দৃশ্য দেখে তো তার হার্টঅ্যাটাক হওয়ার উপক্রম।

    পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আনন্দীর নেতৃত্বে ঘরে তার সঙ্গে মিটিং করতে এসেছিল চারজন ষণ্ডা ধরনের লোক। মিটিং হল। তাতেই কথা হয়ে গেল, বিয়েটা করতে হবে। সিন্টু বি.কম. পাশ। রেগুলার কাগজ পড়ে। রাজনৈতিক নানা আলোচনায় সে অবধারিত। নেতার ছেলে বলে এলাকাতেও গুরুত্ব আছে। মানসম্মানও। মান বাঁচাতেই তাই এই বিয়ে করতে হচ্ছে। নাহলে জেলও হতে পারে। কেন যে সে অপকম্মটা করতে গেল! ডুকরে-ডুকরে কেঁদেছিল, সিন্টুর মনে আছে। 

    আনন্দীকে দেখতে বলশালী নয়, কিন্তু তীব্র ক্ষমতা। বাড়ির সব কাজ সারাদিন করার পরও এতটুকুও ক্লান্তি নেই। রাত্রে দু’বার যৌনতা চাই-ই চাই। গুণ একটাই— আলুসেদ্ধ মাখা। একেবারে আগুনতপ্ত আলুতে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে পারে সে। ভাবলেশহীন ভাবে। তারপর মাখতে শুরু করে। পাত্রটা যেন তার হাতের পুতুল। আঙুলগুলির ডগায় নেচে ওঠে সেটা। কিছুক্ষণ মাখার পর সে নুন দেয়, তেল দেয়। তারপর আবার মাখে; এবার সামান্য লঙ্কা সংযোগ, খানিক গন্ধরাজ লেবুও। এবং মাখতে থাকে। অল্প আলু তুলে রাখে। সিন্টুর জন্য। কারণ সিন্টু বেশি ঝাল খেতে পারে না (এক্ষেত্রে সে দয়ালু)। এবার আরও কয়েকটি লঙ্কা দিয়ে মাখতে থাকে। সেঁকা শুকনো লঙ্কাও দেয়। আশ্চর্য গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আগে থেকে কেটে রাখা কুচো পেঁয়াজ ঢেলে দেয় আলুতে, হালকা চটকানো চালায়। সিন্টুর জন্য সরানো আলুতেও পেঁয়াজ দেয়, তবে বেশি নয়, দুটি মণ্ড থেকেই পেঁয়াজগুলি হাত-পা বার করে থাকে, এতেই সোয়াদ। 

    আনন্দী শুধু রেগে গেলেই খিস্তি দেয় না, এটা তার জীবন-অঙ্গ। অ্যাক্সিডেন্টাল সেক্সের সময়েও বাছা-বাছা খিস্তি দিচ্ছিল। তুরীয় আনন্দে দুরন্ত বেগে তা দিতে থাকে। একটু অবাক হলেও পাত্তা দেয়নি সিন্টু। এখন বুঝছে, কত ধানে কত চাল। তাদের সন্তান, অর্ক, এখন বয়স চার পেরিয়েছে। কথা ফুটেছে। কথা মানে খিস্তি। আধো-আধো ভাবে খিস্তিগুলি নয়া চেহারায় তার মুখ থেকে বেরোয়। শুনতে খুবই বিচিত্র। সিন্টু কিছু বলে না। বললেই তো ধুন্ধুমার! স্কুলেও ভর্তি হয়েছে অর্ক, কিন্ডারগার্টেন ইংলিশ মিডিয়াম। কমপ্লেন আসে। প্রতিদিনই। আনন্দী তাতে হাসে। হাসতে-হাসতে গড়িয়েও পড়ে।

    তা একদিনের কথা। হল কী, বাজারের কাছের ওই গাছ ব্যবসায়ী শ্যামলদা তাকে একটা জবা গাছ গছিয়ে দিলেন। টব-মাটি-সারও দিলেন। বলে দিলেন, গাছ লাগানোর অ-আ-ক-খ। ব্যালকনিতে গাছ-ব্যবস্থা হল। জলসিঞ্চনও শুরু, দৈনিক অন্তত একবার, শ্যামলদার নির্দেশে। গাছে দুটি কুঁড়ি ছিল, দুটিই ফুল ফোটাল। গোলাপি রঙের মনোহর জবা। দেখে চোখ ভরে গেল। শ্যামলদা বলে দিয়েছেন, গোড়া যেন শুকিয়ে খটখট না করে, আবার জল জমেও যেন না থাকে। সার দেওয়ার কায়দাও বুঝিয়েছেন। জবা গাছের নাকি বিরাট খাঁই। শ্যামলদার সাজেশন অক্ষরে-অক্ষরে মেনেই চলল পরিচর্যা। শ্যামলদা অবশ্য গাছ লাগানো বা রোপণ বলেন না। বলেন, গাছ পোষা। সত্যি, আশ্চর্য ভাষা! যা হোক, দোকানে দাঁড়ালেই শ্যামলদা গাছের খবর নেন। প্রথম দিকে সব ঠিকই ছিল। কিন্তু দিন পাঁচেক পর থেকে গাছটার পাতাগুলি নুইয়ে পড়তে শুরু করে। বড়-বড় পাতাগুলি হলুদ। ঝরে পড়তে থাকে একে-একে। আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে বাঁচানোর। শ্যামলদার কথায় কীটনাশকও স্প্রে করে। কাজ হয় না। যেদিন বোঝে গাছটার পুরো পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে, শ্যামলদাকে খবরটা দেয়। শ্যামলদা দেখতে আসেন। সঙ্গে আরেকটা গাছও। সেটাও জবা গাছ, তবে এর ফুল টকটকে লাল। শ্যামলদা জানালেন। পুরনো মড়া জবা গাছটার দিকে শ্যামলদা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তার মাটি পরখ করলেন। তাঁর চোখটা কীরকম যেন বাঙ্ময়। এবার আস্তে-আস্তে তুলে ফেলে দিলেন গাছটাকে। ফেলে দিলেন গাছের মাটিও। একজনকে ফোন করে আনালেন আর একটা টব। মাটিও। গাছ বসালেন। হঠাৎ ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমে এল। 

    কী জানি কী কারণে শোবার ঘরে খুবই খিস্তি দিচ্ছে ছেলেটা। ঠিক স্বাভাবিক খিস্তি নয়, ও কি গান গাইছে? বউ ফোনে কার সঙ্গে যেন খিস্তি দিয়ে কথা বলছে। আর নতুন গাছ পোষার প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে শ্যামলদা বেরোচ্ছেন। তাঁকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছে সিন্টু। দরজার কাছে এসে শ্যামলদা খুব নীচু গলায় বললেন, ‘মরা গাছ ও তার মাটি দেখেই বুঝেছিলাম। একটা ওষুধ তাই টব-মাটির সঙ্গেই আনিয়েছি। প্রথমে একটু সংশয় ছিল, কিন্তু বাড়ির কথাবার্তা শুনে সংশয়টা কেটে গিয়েছে।’ তারপর পকেট থেকে একটা ত্রিশঙ্কু শিশি বার করে তিনি সিন্টুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এ হল খিস্তিনাশক। তুমি হয়তো জানো না সিন্টু, অনেক গাছই খিস্তি-গালাগালিতে মরে যায়। তাই এই ওষুধ দিতে হবে। রোজ ব্রাহ্মমুহূর্তে এক লিটার জলে এক ছিপি এইটি দিয়ে গাছে স্প্রে করে দেবে। পরিমাণ আর সময়টা মানা কিন্তু খুবই দরকার। না হলে হিতে বিপরীত, বুঝেছ তো?’

    সিন্টু আর কোনও কথা বলতে পারছিল না। উপর থেকে বউয়ের খিস্তি ভেসে আসছিল। ফোনালাপ। রাগারাগি নয়, মিষ্টি সুরে খিস্তি। থামছে না।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook