অফিসের কাজে বোলপুর যাচ্ছিলাম। হাওড়া থেকে শতাব্দী এক্সপ্রেস ছাড়বে-ছাড়বে করছে, সিগন্যাল হয়ে গেছে, গার্ডসাহেব হুইসলও দিয়েছেন, এমন সময় ওরা হুড়মুড় করে উঠে পড়লেন। স্বামী-স্ত্রী এবং বেশ ফুটফুটে একটি মেয়ে।
একগাদা লটবহর নামিয়ে দিয়ে উর্দিধারী কুলি পয়সার জন্যে চলন্ত ট্রেনের হাতল ধরে ছুটতে লাগল।
ভদ্রলোক একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘যাও, বাকিটা ফেরত দিতে হবে না। তুমহারা বকশিস!’ অবশ্য ততক্ষণে ট্রেন যা স্পিড নিয়েছে, তাতে উপরিটুকু ফেরত দিতে হলে কুলিটির চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়া ছাড়া উপায় থাকত না। টিকিট দেখে সিট নম্বর মিলিয়ে সপরিবারে বসলেন ঠিক আমার উলটোদিকে।
দূরপাল্লার ট্রেনে দেরিতে এলে লাগেজ রাখার জায়গাগুলো আগে থেকেই ভর্তি হয়ে থাকে। নিজের লাগেজ রাখতে গিয়ে ভদ্রলোকেরও নাজেহাল অবস্থা। এটা টানেন, ওটা সরান, বাধা পেলে ‘সরি’ বলেন, এমনকী দু’একটা বাঁকা কথাতেও উনি ঝগড়ার লাইনে গেলেন না।
হঠাৎ এক সময়ে লক্ষ করলাম, ভদ্রমহিলা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তে পরিচিতের মতো হাসলেন। ফর্সা-গোলগাল ঘরোয়া চেহারা, এককালে যে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন, অস্তগামী যৌবনের বিলীয়মান ছটায় তারই আভাস। দামি সিল্কের শাড়ি আর হিরের নাকচাবিতে আলোর ঝলকানি ভেদ করে মনে করবার চেষ্টা করলাম, কোথাও কি দেখেছি ওকে? কোথায়? কবে?
নিজের অজান্তেই বার বার তাঁর দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা আর তাকালেন না। মহার্ঘ্য চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা সিনেমার পত্রিকা বের করে চোখ বোলাতে লাগলেন। এক সময়ে মনে হল, হয়তো আমারই দেখার ভুল। চেনা নেই, জানা নেই, উনি আমাকে দেখে হাসতে যাবেন কেন!
ভদ্রলোক তাঁর কন্যাটির সঙ্গে মোবাইল ফোনে ওয়ার্ড-পাজল খেলছিলেন। মেয়েটি সম্ভবত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, স্টক অফ ওয়ার্ডস এবং উচ্চারণ, দুটোই বেশ ভাল।
কিছুক্ষণ বাদে ঘুম পেয়েছে বলে মা’কে সরিয়ে মেয়ে জানালার দখল নিল।
ট্রেনের দুলুনিতে আমারও সামান্য ঝিমুনি এসেছিল, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করছে, ‘আমাকে চিনতে পারলেন?’
তন্দ্রা ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি, সেই ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসু চোখে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখের হাসিতে কিঞ্চিৎ রহস্য। তাকিয়ে দেখলাম, স্বামীটি পাশে নেই, সম্ভবত টয়লেটে গেছেন। মেয়েও ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি আবার স্মৃতির অতলে ডুবে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগলাম। না! একেবারেই মনে পড়ছে না। কিন্তু সে-কথা বলতে সংকোচ হচ্ছিল। তাই অপ্রস্তুত হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, মানে চেনা-চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক প্লেস করতে পারছি না। যদি একটু ধরিয়ে দেন…’
ভদ্রমহিলা একটু অপ্রতিভ হলেন। ভুলটা যে কোন তরফে হচ্ছে, বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি দক্ষিণেশ্বরের ওদিকে থাকেন? মানে কোনও এক সময়ে কি থাকতেন?’
আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, এক সময়ে কেন, এখনও দক্ষিণেশ্বরেই থাকি। ১০/৩, দুর্গা খটিক লেন।’
সাধারণত হিসেব মিলে গেলে মানুষ খুশি হয়। কিন্তু এক্ষত্রে হল ঠিক উলটো। ভদ্রমহিলার মুখের আলোটা দপ করে নিভে গেল। কেমন যেন অভিমানী মুখ করে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এবার নিজেকে সত্যিই অপরাধী মনে হতে লাগল আমার। উনি আমাকে ঠিকই চিনেছেন, অথচ আমি… না! একদমই মনে পড়ছে না। তাঁকে কি সত্যিই দেখেছি কখনও? নিশ্চয় দেখেছি, কিন্তু কবে, কোথায়? মনের মধ্যে হাজারও চিন্তার বুজগুড়ি কাটতে লাগল, অথচ কিছুতেই ওঁকে মনে করতে পারলাম না।
পুনরায় কিছু যে জিজ্ঞেস করব, তারও উপায় নেই। ততক্ষণে ভদ্রমহিলার স্বামী ফিরে এসেছেন এবং উনি মুখে আষাঢ়ের মেঘ নিয়ে সিনে ম্যাগাজিনে চোখ ঢেকেছেন।
ওঁর এই ভাবান্তরটুকু স্বামী বেচারিরও হয়তো নজর এড়ায়নি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল? শরীর খারাপ লাগছে? মাথা ধরেছে? মাথার আর দোষ কি বলো? ট্যাক্সি থেকে নেমে এই হাঁসফাঁস গরমের মধ্যে ছোটাছুটি তো কম হয়নি! তবু ভাগ্য ভালো, শেষপর্যন্ত ট্রেনটা পাওয়া গেছে!’
উনি কোনও উত্তর দিলেন না। কেমন যেন গুম হয়ে বসে রইলেন।
বোলপুর স্টেশনে নামতে যাব, দেখি এসি-র কাচের দরজার বাইরে ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। লোকজন বেরোচ্ছে বলেই হয়তো ভেতরে ঢুকতে পারছেন না।
অপরাধ স্খালনের জন্যে কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনি নিশ্চয়ই আমাকে চেনেন, আমিও হয়তো চিনি, তবু এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। বিশ্বাস করুন, আমার খুবই খারাপ লাগছে। আসলে বয়েস বাড়ছে বলেই হয়তো…’
দেঁতো হেসে রসিকতার ছলে বিষয়টাকে লঘু করার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু তাতে মেঘ কাটল না।
একটু চুপ করে থেকে প্রায় মিনতির সুরে বললাম, ‘দয়া করে যদি একটা ক্লু দেন, মানে আপনি কোথায় থাকেন, কিংবা কোন সূত্রে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল?’
ভদ্রমহিলা কথা না বলে অদ্ভুত ব্যাথাতুর চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।
ওদিকে ট্রেন ছাড়ার হুইসল বাজল। আমাকে এবার নামতে হবে। কিছুটা মরিয়ার গলায় বললাম, ‘প্লিজ, বলুন। ট্রেন ছেড়ে দেবে যে!’
উনি বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘কী লাভ? ভুলেই যখন গেছেন, থাক না সেসব কথা!’
বলতে-বলতে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমিও লাফিয়ে নেমে পড়লাম। তাকিয়ে দেখি, তিনি তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে অপলকে চেয়ে আছেন। মুখে রাজ্যের বিষণ্ণতা।
নিমেষে বিস্মৃতির পর্দাটা সরে গেল।
অনেক দিন আগের কথা। আমার দাদাস্থানীয় এক বন্ধুর সঙ্গে পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম কোলাঘাটে। বিয়েটা তারই, পীড়াপীড়িতে সঙ্গী হয়েছিলাম মাত্র।
ওদের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগাযোগটা হয়েছিল। তাই ঠিক আনুষ্ঠানিক পাত্রী দেখা নয়, বরং আমরা অনেকটা অতিথির মতো গিয়েছিলাম। তারপর সারাদিন ওখানে থাকা, গল্পগুজব করা, একসঙ্গে আশপাশটা ঘুরে দেখা, বেশ কেটেছিল দিনটা।
প্রথম দেখেই ওঁকে দাদার পছন্দ হয়ে গেল। দুজনের বয়েসের ফারাক কিছুটা বেশি বটে, তবে অর্থ, বিত্ত এবং প্রতিষ্ঠায় পাত্র লোভনীয়; পাত্রীপক্ষও এককথায় রাজি। মাসখানেকের মধ্যেই বিয়ে।
আমি তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। হঠাৎ অফিসের ঠিকানায় একটা নীল ইনল্যান্ড লেটার পেলাম।
খুলে দেখি, সম্বোধনহীন কয়েকটা কথা। ‘সেদিন আপনার মুখে নারী স্বাধীনতার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আপনি যা বলেছিলেন, তা কি আপনার অন্তরের বিশ্বাস থেকে বলেছিলেন, না কি কেবল মেয়ে-ভোলানো কথার কথা? বিয়ের জন্যে ছেলেদের যদি মেয়ে পছন্দ করার অধিকার থেকে থাকে, তাহলে মেয়েদেরও কি একই অধিকার থাকা উচিত নয়?
আপনি সেদিন যা বলেছিলেন, তাতে যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা থেকে থাকে, তাহলে একবার অন্তত আমাকে সেই অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ দিন। আমার আপনাকে পছন্দ, হ্যাঁ, আপনাকেই, অবশ্য আমাকে যদি আপনার অপছন্দ না হয়ে থাকে। যদি অপেক্ষা করতে বলেন, আমি করব, কিন্তু আপনাকে দেখার পর আপনার দাদাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আপনার উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলাম। ইতি কণা।’
ততদিনে ওদের বিয়ের কেনাকাটা শেষ, অন্যান্য যা কিছু প্রস্তুতি, সবই নেওয়া হয়ে গেছে। এমন সময় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এমন একটা চিঠি পেয়ে আমি পড়লাম মহা বিপাকে। অনেক ভেবেচিন্তে চিঠির ব্যাপারটা চেপে গেলাম, উত্তরও দিলাম না।
তবুও সেই বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল।
ট্রেনটা বেরিয়ে যাওয়ার পর খালি প্ল্যাটফর্মে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। অকারণে।
লোকাল অফিসের ব্রজেন আমাকে নিতে এসেছিল। বলল, ‘কী হল, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ট্রেনে কিছু কি ফেলে এসেছেন?’
আমি অন্যমনস্কভাবে বললাম, ‘হ্যাঁ, কিছুটা সময়।’
পরের ট্রেনের ঘোষণার শব্দে সে হয়তো আমার কথাটা শুনতে পায়নি। বলল, ‘যা গেছে, তা গেছে। চলুন, প্ল্যাটফর্মের বাইরে গাড়ি রাখা আছে।’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র