কেবলই দৃশ্যের জন্ম
আজ যখন গোটা পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থা দু’হাত তুলে নাচছে, সর্বত্র শুধু ‘মারো, তাড়াও’, এমনকী সুইডেনের মতো দেশে অতি দক্ষিণপন্থী দল জনপ্রিয়, তখন ইরানে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মেয়েরা প্রকাশ্য রাস্তায় চুল কেটে ফেলছে, হিজাব পোড়াচ্ছে। এই সাহস দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। ইরান সেই দেশ যা অমুক সাহিত্যিককে খুন করার ফতোয়া-টতোয়া জারি করে, মেয়েদের হিজাব একটু আলগা হয়েছে দেখলেই যাদের নীতিপুলিশ ৭৪ ঘা চাবুক কষিয়ে দেয়। তার আগে থাপ্পড়ও মারতে পারে, মাথা ঠুকেও দিতে পারে, সেসব তাদের এক্তিয়ার। বহু বছর ধরে মানবাধিকার দলনে বহু রাষ্ট্র হাত পাকিয়েছে, ইরানও তার মধ্যে পড়ে, চিন-রাশিয়াও বাদ যায় না। কিছু বলতে গেলেই তারা বলে, নিজের দেশ আগে সামলা। কথাটা মন্দ না, প্রতিটি দেশেই মানবাধিকার হরণ সবেগে চলেছে, চলছে; কিন্তু নারী হলেই হীনতা অভ্যাস করতে হবে, বা অমুক ধর্মগোষ্ঠী হলেই নিচু-মাথায় চলতে হবে— এতটা সাম্প্রদায়িক ছকে সকলের নিয়মনীতি বিন্যস্ত নয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন আমেরিকা বা ইংল্যান্ড তো ভণ্ড, তাদের নিজের দেশে যখন পুলিশ কোনও নাগরিকের প্রতি হিংস্র আচরণ করে, তখন তো তাদের হেলদোল দেখা যায় না। প্রথমত দেখা অবশ্যই যায়, ওসব দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং বাক্স্বাধীনতার বিস্তার এতটাই যে এই ধরনের ঘটনার তীব্রতম সমালোচনা ও প্রকাণ্ড প্রতিবাদ দেশের মধ্যেই ঘটে, গণমাধ্যম ও দেশের সাধারণ মানুষের মতামত রাষ্ট্রকে ছিঁড়ে খায়, এবং অপরাধীর যথাযথ শাস্তিও বহু ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু মৌলবাদী-অধ্যুষিত বা শাসিত দেশে এসব কিসুই হয় না, হয়তো প্রহারকারী পুলিশটাকে পুরস্কার-টুরস্কার দেওয়া হয়, কে জানে! তারপর আন্তর্জাতিক মঞ্চে এলে এরা আঙুল তুলে বলে, তোদের যে অমুক হয়েছিল, তার বেলা? কেউ বলেনি এরকম ঘটনা কোত্থাও ঘটে না, কিন্তু ঘটনা ঘটার পরে তার প্রতিক্রিয়াতেই যে মূল তফাতটা তৈরি হয়, সে-কথা মৌলবাদীরা যেন বুঝেই উঠতে পারেন না। আর, গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় ঘটনার প্রেক্ষিতটা খতিয়ে দেখা হয়, মৌলবাদী দেশে তাকে শুধু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই ওজন করা হয়, কারণ প্রেক্ষিতটা তো কর্তৃপক্ষের কাছে বাই ডিফল্ট পবিত্র, বিনা বিরোধিতায় ও নিঃশর্তে যাকে আগলে রাখতে হবে। আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হলে তাই আদত প্রশ্ন ওঠে : কালো মানুষদের হীন চোখে দেখা হবে কেন? আর ইরানে ২২ বছরের মাহসা আমিনি-কে হিজাব ঠিকঠাক না-পরার দোষে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সে ধপ করে পড়ে গেলে রাষ্ট্র বলে, ওর তো হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। যেন শুধু পড়ে মরে যাওয়াটুকুকে প্রশ্ন করতে হবে, ধরে নিয়ে যাওয়াটাকে নয়।
তবে প্রায় ৮০টা শহরে, দেশের ভিতরে ও বাইরে প্রতিবাদ ছড়িয়ে যাওয়ায়, কিছুটা বিপাকে পড়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তদন্ত হবে। কিন্তু তদন্ত আর কী নিয়ে হবে? শুধু মাহসার হার্টে অসুখ ছিল কি না, তা নিয়ে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন মাহসাকে পেটানো হয়েছিল, মাথা ঠুকে দেওয়া হয়েছিল, তা সত্যি কি না, তা নিয়েও। কিন্তু তদন্ত আসলে কী নিয়ে হওয়া উচিত? এই নিয়ে : মাহসাকে যে-অপরাধে ধরা হল, তা আদৌ অপরাধ কি? এই নিয়ে : কেন নাগরিকদের ওপর স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় মদতে নীতিপুলিশগিরি হবে? কেন তাঁদের পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকবে না? কেন তাঁদের পোশাক কেমন তা দেখে স্কুলমাস্টারের মতন পুলিশ বেত মারতে পারবে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের? কিন্তু তা নিয়ে তদন্ত করলে ধর্মীয় মৌলবাদকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়, তা কী করে সেই মৌলবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকর্তারা করতে দেবেন? তবে প্রশ্নগুলো একেবারে উড়ে উবে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ মানুষ সম্মিলিত হয়েছেন ও ক্ষোভ জানাচ্ছেন এই প্রশ্নগুলোকে আঁকড়েই, শুধু শুধু তো তাঁরা সমস্বরে ‘স্বৈরাচারী মুর্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছেন না। এই ধরনের প্রহারবাদী দেশে প্রখর প্রতিবাদ সহজ কথা নয়, এখানে শুধু ফেসবুকীয় শখে মিছিলে মুখ দেখিয়ে ফিরে এসে আলুভাজা খাওয়া যায় না, যাঁরা প্রতিবাদ করছেন তাঁদের খুঁজে-খুঁজে জেলে ধরে নিয়ে যাওয়া জলভাত, তা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, জেনে করছেন যে তাঁরা ক্যামেরায় চিহ্নিত, তাঁদের ছবি পাশ্চাত্য (ইরানের মতে নির্ঘাত যা শয়তানের আড্ডাখানা) গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বলে তাঁরা ডবল চক্ষুশূল। তবু এতজন হুড়মুড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসছেন, বহুক্ষেত্রে মহিলারাই প্রতিবাদটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এবং নিজেদের মস্তকাবরণ সরিয়ে দিচ্ছেন বা পুড়িয়ে দিচ্ছেন— এ আসলে শুধু একজন সহ-নারী, সহ-নাগরিকের মৃত্যুর ফলে জাত ক্রোধ নয়, বহু মানুষের যুগ-যুগ ধরে শরীরে ও মনে গুমরে-গুমরে মরে থাকার বিরুদ্ধে আক্রোশ। মানুষ খুব আশ্চর্য জন্তু, একটা সময়ে সে ফেটে পড়ে, শুধু আহার্য ও বাসস্থান দিলেই তাকে পূর্ণ পোষ মানানো যায় না, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় সে একবারের জন্য, শেষবারের জন্য হলেও, অন্তত গালাগাল উচ্চারণ করে অত্যাচারীর মুখে একটা লাথির ছায়া দেখিয়ে যায়। হ্যাঁ, এখনও উত্তর কোরিয়ায় তা হয়নি, চিনেও তেমনভাবে হয়নি; চিন উইঘুর মুসলিমদের দিব্যি অত্যাচার করছে, তাইওয়ানের স্বাধীনতার সম্ভাবনা মিলিটারি দাপটে দমিয়ে রাখছে, আফগানিস্তানে তো তালিবান প্রশাসন মেয়েদের জীবন্মৃত করেই রেখেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে আশা হয়, হয়তো একদিন বহু জায়গার লোকজন আর না পেরে ছুটে বেরিয়ে আসবেন জলকামানের সামনে-লাঠির সামনে-নিজের বন্ধুর রক্তাক্ত মুখের পাশে নিজের রক্তাক্ত মুখটি পেতে রাখার জন্য, এবং অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের জন্ম হবে।
কিন্তু প্রশ্ন, তাতে লাভ হবে কি? ইরানে মেয়েরা একদিন খোলা চুলে ঘুরে বেড়াতে পারবেন? চিনে শি চিনফিং-এর বাণীর ঘেরাটোপের বাইরে স্বাধীন মতামতকে মর্যাদা দেওয়া হবে? উত্তর কোরিয়ায় লোকে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে কিম-জং-উনকে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেবে? এই যে ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স রিপোর্ট’-এ বলা হচ্ছে ১৬৭টা দেশ জুড়ে প্রায় চার কোটি লোক কোনও না কোনওভাবে ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী হিসেবে জীবন কাটাচ্ছেন, হয় তাঁদের বন্দি করে খাটানো হচ্ছে, কিংবা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ের সম্পর্কে আটকে রাখা হয়েছে (এবং খাটানো হচ্ছে), তাঁরা একদিন খোলাচুলে আকাশের নীচে বেরিয়ে আসতে পারবেন? রাশিয়ায় পুতিন বলেছেন, আরও তিন লাখ নাগরিককে (সমর্থ পুরুষদের) সেনাবাহিনীতে ঘাড়ে ধরে জুতে দেবেন, সে-আদেশের বিরুদ্ধে লোকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, গ্রেফতার হচ্ছেন, অনেকে পালাচ্ছেন, কিন্তু যুদ্ধবাজ পুতিনের পতন হবে? গণসঙ্গীত বা গ্রুপ থিয়েটারের ক্লাইম্যাক্সের সূত্র মেনে তো পৃথিবী চলে না। সাধারণত স্বপ্নের ভোর আসে না, এলেও বেশিদিন থাকে না। সোশ্যাল মিডিয়া কিছু বিপ্লব সংঘটিত করেছে, কিন্তু সেসব বসন্ত, খবরকাগজের হেডলাইনের মতোই, ক’সপ্তাহে মিলিয়ে গেছে। প্রতিবাদ কয়েকজনকে আলোড়িত করে বটে, কিন্তু শেষমেশ খতরনাক নিষ্ঠুররা খেলা জেতে। তাহলে? ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’-র ফর্মুলায় হয়তো এর তাৎক্ষণিক ব্যর্থতাকে ঢেকে রাখে দীর্ঘমেয়াদে এর রেশ, যা নির্মূল করা শক্ত। তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে ঘুরতে গেলে ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ, কিন্তু তাতে ট্যাংকের সামনে নিরস্ত্র ছাত্রটির ছবি পৃথিবীর স্মৃতি থেকে মলিন হয়ে যায়নি। আফগানিস্তান নিয়ে কোনও নারী-দরদিই আর ভাবছেন না, দু’বছর আগে অবধি যে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেত তাকে আজকে বাঁদির মতো জীবন যাপন করতে হচ্ছে, যে ২৫ বছরের নারীটি তালিবান কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতি রাত্রে লাগাতার মার ও ধর্ষণের অভিযোগ জানাচ্ছেন তাঁকেই উল্টে গ্রেফতার করা হচ্ছে— সে-কথা পৃথিবীর কোনও প্রান্তে কোনও দীর্ঘশ্বাসের উৎপাদন করছে না, ভাবা ভুল হবে। ইন্টারনেট বন্ধ রেখে প্রতিবাদ সামাল দেওয়ার চেষ্টা বহু হয় (ইরানে, চিনে, হ্যাঁ ভারতে কাশ্মীরেও), কিন্তু বাতাস বার্তা বহন করে নিয়ে যায়।
তবে কি সব প্রতিবাদ অন্য কোনও ভাবী প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ জুগিয়ে যায় মাত্র? কে জানে! কিন্তু প্রতিবাদ করার সময়ে ব্যক্তির অন্তত একটা সত্তার উড়ান হয়। আমি যে নশ্বর ভয়গুলোকে পেরিয়ে শুধু স্বাধীনতার খাতিরে নিজের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে ফেলতে পারলাম, ‘যা হবে হোক গে, আজ আমি নিজস্ব চিৎকার করবই’-এর তোড়ে মনটাকে যে জুড়ে দিতে পারলাম একখান সপাট জ্যা-নিক্ষিপ্ত শরে, এতখানি বেপরোয়া জুয়া যে আমি খেললাম রোজ না মরে অন্তত একবার মরব’খন বলে— তার মধ্যে একটা মনুষ্যত্বের উচ্ছ্বাস রয়েছে, একটা বৃহৎ জয়। সেই অর্জনও কিছু কম নয়। কখনও সমষ্টির সত্তার সঙ্গে নিজের সত্তাকে নিঃশেষে মিশিয়ে দেওয়ার মধ্যেও ব্যক্তি-কাঁটাতার অতিক্রমের আখ্যান মানুষকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। আর, কোনও প্রতিবাদেই কক্ষনও ফল হয়নি, এ তো ঠিক নয়, বিশ্বের ইতিহাস তো প্রতিবাদেরও ইতিহাস বটে। এমনকী এই পোড়া দেশেও জেসিকা লাল হত্যায় মনু শর্মা খালাস পাওয়ার পর শুধু উত্তাল প্রতিবাদের জেরে ফের মামলা হয়েছে এবং অপরাধীর জেল হয়েছে। হয়তো ইরানে অন্তত দায়ে পড়ে কিছু নীতি শিথিল করা হবে। কিংবা আরও-আরও লোকের জেল হবে। তারপর জেলখানায় তাঁদের সঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক জাফর পনাহির দেখা হবে। তারপর একটা আশ্চর্য চিত্রনাট্যের জন্ম হবে। মন্দ কী?