কলকাতা থেকে মুম্বই— অ্যানিমেশনের দুনিয়ায় সম্প্রতি সাড়া ফেলে দিয়েছেন দুই যমজ ভাই। শাশ্বত মুখোপাধ্যায় এবং সুশ্রুত মুখোপাধ্যায়। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তাঁরা অ্যানিমেশনচর্চাকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। তৈরি করতে চাইছেন নতুন একটা ভাষা। বিশ্ব অ্যানিমেশন দিবসে শাশ্বত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডাকবাংলা.কম-এর পক্ষ থেকে কথা বললেন পৃথ্বী বসু।
অ্যানিমেশনের দুনিয়ায় আসার যাত্রাপথটা শুরুতে যদি একটু বলেন…
আমরা তো দুই ভাই একসঙ্গে কাজ করি— তো, ছোটবেলা থেকেই আমাদের আঁকার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেছিল। অভ্যাস বলতে আমি কিন্তু ‘নেশা’ বোঝাতে চাইছি এখানে। একদম ছোটবেলায় যখন আমরা নার্সারিতে পড়ি, সেই সময় আমাদের বড়দাদা একটা শক্তিমান এঁকে দিয়েছিল খাতায়। সেইটা দেখে আমরা খুবই অবাক হয়ে গেছিলাম যে, যা আমরা দেখেছি, সেটা ওইভাবে আঁকাও সম্ভব! এইখান থেকেই আঁকা বিষয়টায় আমাদের আগ্রহ তৈরি হয়। পেনসিল দিয়ে এটা-সেটা দেখে-দেখে নকল করা শুরু করি। এছাড়া ছোটবেলায় প্রচুর কমিকস পড়তাম— টিনটিন, হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট— এইসব বইয়ের আঁকাগুলোও খুব টানত। সেগুলোও আঁকতাম। এইসব চরিত্রদের নিয়ে আমরা নিজেরাও কমিকস বানাতাম পরে। ‘ক্রস ওভার’ বলে যাকে। যেমন একবার এঁকেছিলাম মনে আছে, চাচা চৌধুরী-টিনটিন-হাঁদা ভোঁদা— এরা সবাই একসঙ্গে পিকনিক করছে। তারপর আরেকটু বড় হয়ে সত্যজিৎ রায়ের আঁকার সঙ্গে পরিচিত হলাম যখন, তখন অন্য একটা শৈলী আমাদের মুগ্ধ করতে শুরু করল। সত্যজিৎ রায়ের আঁকার ধরনটা নকল করার চেষ্টা করতাম সে-সময়।
আঁকাআঁকিটা যে আমাদের পেশা হয়ে যাবে, অনেকদিন অবধিই সেটা আমরা ভাবিনি। ঠিক ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব, পাশাপাশি আঁকাটা চালাব। কারণ আমরা সারাক্ষণই আঁকতাম। কিন্তু যেটা হল, আমরা দুজনেই জয়েন্টে খুব খারাপ রেজাল্ট করি। অন্যান্য যা যা রাস্তা ছিল, সেগুলোও ঠিক মসৃণ ছিল না তখন। সেই সময়েই আমাদের এক বন্ধু খবর দেয় যে, জেভিয়ার্সে অ্যানিমেশনের একটা চার বছরের কোর্স আছে। সেখানে আমরা এন্ট্রান্সে পেয়ে যাই। এইভাবেই অ্যানিমেশনের জগতে আসা বলতে পারো!
ছেলেবেলার শখ যখন বড়বেলার পেশা হয়ে দাঁড়াল, কাজের ক্ষেত্রে আলাদা করে খুব কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছিল কি?
চেঞ্জ সেভাবে কিছু দেখা দেয়নি। তবে একটা পদ্ধতিতে কাজ করার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিতে পারি, আবার অনেক জায়গায় অনেকরকম নিয়মের প্যাঁচে পড়ে অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। পরিবর্তন বলতে এটুকুই! তা ছাড়া বাকিটা একই রয়ে গেছে, কারণ কাজটা আমরা খুব ভালবেসে করি। ছোটবেলার শখ যখন বড়বেলার কাজে রূপান্তরিত হল, সেটাকে আর কাজ বলে মনেই হল না।
কোন কোন শিল্পীদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন এখনও অবধি?
ছোটবেলায় খুব অনুপ্রাণিত করতেন নারায়ণ দেবনাথ, অ্যালবার্ট উদেরজো এঁরা। কলেজে আমাদের যিনি মেন্টর ছিলেন, তাঁর হাত ধরে পরবর্তীকালে পৃথিবীর আরও নানান শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। যেমন, একজন জাপানি শিল্পী— সাতোশি কন— তাঁর ন্যারেটিভ স্টাইল, এডিটিং, তাঁর চিন্তাভাবনা আমাদের খুবই ভাবিয়েছে। ভিসুয়ালি গল্প বলার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান শিল্পী শন ট্যানের কাজ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। ওঁর এরকম ছবি আছে, যেখানে কোনও সংলাপ নেই কিন্তু যে-কোনও বয়সের মানুষ দেখলেই বুঝতে পারবে কী বলতে চাওয়া হচ্ছে। আমরা সেইখান থেকে প্রভাবিত হয়ে অনেক কাজ করেছি, যেখানে সংলাপ ছাড়াই কাহিনিটা বলা হচ্ছে। এইরকম আর কি!
কলকাতার মতো মিশ্র-সংস্কৃতির শহর, আপনার শিল্পীমনে কোনও আলাদা প্রভাব ফেলে কি? যেহেতু বেড়ে ওঠা আপনার এখানে, কিন্তু বর্তমানে কর্মসূত্রে আপনাকে মুম্বইতে নিয়মিত যেতে-আসতে হয়…
কলকাতা-হাওড়া এই অঞ্চলটা আমাদের কাজকে খুবই প্রভাবিত করেছে। বাবার যে আদি বাড়ি সেটা উত্তর কলকাতায়, আর আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িও সেখানে। ফলে ওই অঞ্চলটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই শহরটা আমাদের কাছে একটা চরিত্রের মতো কাজ করে। আর গোটা শহরটার যদি চরিত্র বলি, সেটা খুব শান্ত, ধীর। মুম্বইয়ের একদম বিপরীত। আর আমার একটা বিষয় খুব মনে হয় যে, ধরো শিল্পের একটা মূল শর্ত তো নিরীক্ষণ করা— তো, আমরা যখন কোনও কিছুর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি, ভালভাবে দেখার চেষ্টা করি, সেটা কিন্তু ওই ধীর গতিতেই— তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করি, লক্ষ করি। সেই মনের বিন্যাসের জায়গা থেকে শহরটার চরিত্রের সঙ্গে আমরা খুবই একাত্ম বোধ করি। যেটা মুম্বই কেন, অন্য কোনও শহরে গেলে পাই না!
নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজের কোনওরকম ‘রাজনীতি’কে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন?
আমরা ছোট থেকে যে-সমস্ত শিল্পীদের কাজ দেখে বড় হয়েছি, দেখেছি, তাঁদের কাজের মধ্যে এক ধরনের ‘রাজনৈতিক ভাষ্য’ ছিল। হয়তো সব জায়গায় খুব প্রকট নয়, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে খুবই সূক্ষ্ম; তবু ছিল। যখন বড় হয়ে আমাদের রাজনৈতিক চেতনা বেড়েছে, বোঝার চেষ্টা করেছি, কীভাবে মতাদর্শগত কারণে মানুষে-মানুষে দূরত্ব বেড়েছে। পারস্পরিক বৈরিতা তৈরি হয়েছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, শিল্প সবসময়েই রাজনৈতিক। চারপাশে যা ঘটছে প্রতিনিয়ত, তার কোনওরকম প্রতিফলন যদি আমার শিল্পের মধ্যে দিয়ে না প্রকাশ করি, সেটাও আমার এক ধরনের রাজনৈতিক ভাষ্য-ই। তবে আমরা আমাদের জায়গা থেকে বলতে পারি, দেশের যা অবস্থা, তার বিন্দুমাত্র ছাপ যদি আমাদের আঁকাআঁকির মধ্যে না থাকে, আমাদের রাতে ভাল করে ঘুম হবে না। যখন কমার্শিয়াল কোনও কাজ করতে যাই, সেখানে যদি দেখি সেটা আমাদের আদর্শের একবারে উলটো, আমরা সেখান থেকে পিছিয়ে যাই। কাজটা করি না। আর আমরা যখন কাজ করি, চেষ্টা করি সমাজের কোনও-না-কোনও রাজনীতিকে চিহ্নিত করার। সেটা যে দলীয় রাজনীতিই হতে হবে এর কোনও মানে নেই। লিঙ্গ রাজনীতি, জাতপাতের রাজনীতি যা খুশি হতে পারে।
বলিউডে কাজ করতে আসার শুরুটা কীভাবে?
বলিউডে যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয় ২০১৭-’১৮ সাল নাগাদ। সে-সময়ে আমাদের কাজ দেখে অনেকেরই ভাল লেগেছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বরুণ গ্রোভার। ওঁর সঙ্গে প্রথমে একটা পাক্ষিক পত্রিকায় আমরা কাজ করি। তারপরে ২০২০ নাগাদ যখন অতিমারী শুরু হয়, সে-সময়ে বিশাল ভরদ্বাজের ইউনিট থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। উনি একটা গান লিখেছিলেন, যেটা ওঁর মনে হয়েছিল, আমাদের কাজের যে-ধরন তার সঙ্গে মানানসই হবে। সেই মিউজিক ভিডিওটা আমরা পরিচালনা করেছিলাম। তারপরে কথায়-কথায় উনি জানতে পারেন যে, আমরা একটা লাইভ-অ্যাকশন ছবি করার কথা ভাবছি। তখন উনি আমাদের বলেন, আমরা চাইলে ওঁর পরের ছবিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারি, তাহলে আমাদেরও একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে। আমরা সেই কাজটাও করেছিলাম। বলিউডের শুরুটা এইভাবে…
কলকাতা থেকে মুম্বইয়ে গিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কীরকম? মানে দুটো শহরের ফারাকটা ঠিক কোথায়?
এখানকার সঙ্গে মুম্বইয়ের সবচেয়ে যেটা বড় ফারাক, সেটা হল মানুষজনের আচরণে। টলিউডে যখন কাজ করা শুরু করেছিলাম, তখন তো আর কেউ চিনত না, কিন্তু লোকজন এমন ভাবে ব্যবহার করত, যেন আমায় কাজ দিয়ে ধন্য করে দিল! কিন্তু মুম্বইয়ে তুমি যত অপরিচিতই হও না কেন, তোমার যোগ্যতা যদি থাকে, ওখানকার লোক সম্মান করবে। সে যত বড় তারকাই হোক। এটা আমাদের ভীষণ ভালো লেগেছে। আর আরও একটা বিষয় ভাল ওদের, ওরা পেশাদারি আচরণটা মেনে চলতে পারে। এবং সেটা খুব দ্রুত। সময়ের একচুল এদিক-ওদিক হয় না। কলকাতা সেই জায়গা থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে বলে আমি মনে করি।
আপনারা দুজন যমজ ভাই-ই অ্যানিমেশনের সঙ্গে যুক্ত, একইসঙ্গে আপনারা কাজ করেন, বাড়তি কোনও সুবিধা তৈরি হয় কি এতে?
সবাই শুনলে আশ্চর্য হয়ে যায় যে, আমাদের দুই ভাইয়ের কোনওদিন ঝগড়া-মারামারি হয়নি। মতবিরোধ অবশ্যই হয়, তবে সেটা খুবই শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটে যায়। আমরা যখন কাজ করি, তখন কোনও সমস্যায় পড়লে আমরা বসে সেটা নিয়ে ভাবি। তাতে দুজনেরই সুবিধা হয়। আলোচনা করতে-করতে এমন একটা সমাধান বেরিয়ে যায়, যেটা হয়তো একা ভাবলে মাথায় আসত না। আর আমাদের চরিত্রের মিল যেহেতু এতটা, কোনও সমস্যাকে ঠিক করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এইটা বাড়তি সুবিধা তো বটেই!
নতুন কোনও মিউজিক ভিডিওর কাজ কি সামনে মুক্তি পাবে?
হ্যাঁ। খুব বিস্তারিত এখন কিছু বলছি না। তবে এই মিউজিক ভিডিওটা নিয়ে আমরা খুবই উত্তেজনার মধ্যে আছি। খুব সম্ভবত সামনের বছরের কোনও একটা সময়ে সেটা বেরোবে। এটুকু শুধু বলতে পারি, বাংলা থেকে এই ধরনের কাজ আগে কখনও হয়নি।
বর্তমানে ভারতের সিনেমাজগৎ কি অ্যানিমেশন নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করছে কিছু?
খুব স্বল্প পরিসরে হলেও, মূল ধারার ছবিতে অ্যানিমেশন কিন্তু একটু-একটু করে জায়গা করে নিচ্ছে। এইটা একটা আশার জায়গা। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘বিক্রম বেদ’ ছবির ওপেনিং সিকোয়েন্স-এ একটা অংশ ছিল অ্যানিমেটেড, যেটা দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে যে, এরকম একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি হলে ভাল হত। ওটিটি-তেও এরকম অনেক ছবি আসছে, যেখানে টু-ডি অ্যানিমেশনের কাজ দেখা যাচ্ছে। এতদিন যে-ধারণাটা ছিল যে, অ্যানিমেশন মানেই ছোটদের একটা শিল্পমাধ্যম, সেই চিন্তাভাবনার জায়গাটা গত দশ বছরে অনেকটাই বদলেছে। এই মতগুলো বদলাতে সাহায্য করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিশাল ভরদ্বাজের সঙ্গেও আমরা যে কাজটা করি, তাতে অ্যানিমেশন থাকবে, এটাও কি আমরা ভেবেছিলাম কখনও! বাংলাতেও কিন্তু অ্যানিমেশনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগেই আমরা একটা ওয়েব-সিরিজের কাজ করেছিলাম, যার টিজারটা ছিল অ্যানিমেটেড।
ভবিষ্যতে কোনও পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড ছবি করার পরিকল্পনা মাথায় আছে?
অবশ্যই। আমরা যে সিরিজটা বানানোর কথা ভাবছি, সেটা অ্যানিমেটেড পুরোটাই। যখন কলেজে পড়ি, তখন প্রচুর বাইরের অ্যানিমেটেড ছবি দেখতাম। প্রাগ, কলম্বিয়া এইসব দেশের। যেমন কলম্বিয়ার একটা ছবি দেখেছিলাম, যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চলের বেঁচে যাওয়া বাচ্চাদের নিয়ে। বাচ্চারা তাদের স্মৃতিগুলো ড্রয়িংখাতায় এঁকেছিল, সেই পৃষ্ঠাগুলো থেকে অ্যানিমেশন করা হয়েছিল। অর্থাৎ, ওর ভেতরের কাহিনিটা বলা। বাচ্চাদের হিজিবিজি আঁকার মধ্যে দিয়েই কিন্তু প্রথমে একটা ঘটনা আর সেই ঘটনা থেকে বড় এক ব্যথার দিকে নিয়ে গেছিল ছবিটা আমাদের। এই মাপের ছবি কিন্তু আগেও হয়েছে। কিন্তু এখানে সমস্যা একটাই, প্রযোজকরা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড ছবি করার জন্য টাকা দিতে চাইবেন না। ফলে আমরা পাঁচ-ছ’বছরে নিজেদেরকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে নিজেদের ছবিটা নিজেরাই করতে পারি কোনও প্রযোজক ছাড়া!
ছবি সৌজন্যে : শাশ্বত মুখোপাধ্যায়