ভারত তথা আন্তর্জাতিক শিল্প ইতিহাসের আধুনিক যুগে বেঙ্গল স্কুল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সাক্ষী। এই শিল্প আন্দোলনের সূচনায় পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং শিল্পভাবনার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ গড়ে উঠে থাকে এবং পরবর্তীকালে, অবনীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বেঙ্গল স্কুল হয়ে ওঠে বাংলার নান্দনিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞান।
শতাব্দী-প্রাচীন দেশজ নন্দনবোধের সঙ্গে বাংলার লোকশিল্পের মেলবন্ধনে যে সুচারু প্রকাশ বেঙ্গল স্কুলের গোড়ার দিকে দেখা যায়, তা আজও বহমান। যে বার্ষিক, বারোয়ারি উদযাপনে এই ধারা অব্যাহত, এবং অনেক ক্ষেত্রেই যার প্রসার গ্যালারি-কেন্দ্রিক শিল্পের থেকে বহুগুণ প্রশস্ত, তা হল দুর্গাপুজো– তার মণ্ডপ এবং প্রতিমায়, তার পরিকল্পনায়, বিন্যাসে, উৎসবে।
শুধুমাত্র চারুকলা আন্দোলনের পরিচিতির গণ্ডিতে বেঙ্গল স্কুলকে কোনোদিনই বেঁধে রাখা যায়নি; স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ভারতীয় সত্তার পুনর্জাগরণের সঙ্গে এর সংযোগ অনস্বীকার্য। শতাব্দী পেরিয়ে এই নন্দনবোধের প্রতিরূপ যে এক আদ্যন্ত বাঙালি উৎসবের মঞ্চে উত্তীর্ণ হয়ে উঠছে, সেই সম্ভাবনা বাংলার শিল্পের পক্ষে এক বিরাট প্রাপ্তি।
অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাব (তেঘরিয়া)
বিষয়— ‘স্বকাল’
শিল্পী— ভবতোষ সুতার
“অন্যান্য বার আমি কী করব, তা ঠিক করি। এবারে আমি কী করব না, সেটা ঠিক করে ফেলেছি,” তেঘরিয়া অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের মণ্ডপ তদারকের মাঝে বলেন ভবতোষ সুতার। তার কারণ, তাঁর কথায়, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ২০২২-কে একটা ‘বিশেষ বছর’ হিসাবে প্রতিপন্ন করে তুলেছে। এই সম্মান যে কলকাতার দুর্গাপুজোকে দেশ-কালের গণ্ডি পেরোতে সাহায্য করেছে, সে প্রসঙ্গ তুলে ভবতোষ অর্জুনপুরের পুজোয় এবার তাঁর ‘অন্যরকম’ ভাবনার কথা ব্যাখ্যা করেন।
“প্রায় ২২-২৩ বছর ধরে পুজো করছি, তাই একটা স্যাচুরেশন চলে আসে, একটা একঘেয়েমি চলে আসে। দুর্গাপুজোর ভিতর একটা একঘেয়েমি আছে, কিন্তু তার বাইরেও আছে একটা অব্যাহত চর্চার ক্ষেত্র। একজন শিল্পী যখন প্রতিষ্ঠিত হন, ধীরে-ধীরে তাঁর আর্ট ফর্ম একটা ল্যাঙ্গোয়েজে পরিবর্তিত হয়ে যায়, একটা সিগনেচার তৈরি হতে শুরু করে। দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে কিন্তু এই সিগনেচারটার বিষয়ে খুবই সচেতন থাকতে হয়; দুর্গাপুজো সমস্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য তৈরি করা একটা আর্ট ফর্ম, সেখানে একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি মেনে নেওয়া যায় না। এর ফলে, বছর-বছর, প্রায় কিছুটা বাধ্য হয়েই, আমি নিজেকে ভাঙতে চেষ্টা করি। মনে হছে, এই বছরটা বিশেষ, কেননা এইবার সত্যিই যেন পুজোর ভাবনাটাকেও ভাঙতে পেরেছি,” শিল্পী বলেন।
ভবতোষের শিল্পচিন্তা এবং বিন্যাসে তাই অর্জুনপুরে এবার থাকছে একটা গোটা পাড়া জুড়ে দুর্গামণ্ডপ: এবং গোটাটাই গড়ে উঠছে একটা ‘পারফর্ম্যান্স স্পেস’ হিসাবে। মণ্ডপ— এক্ষেত্রে, একাধিক— যেখানে হয়ে উঠবে মঞ্চ; পুজোর প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা চলবে একের পর এক পারফর্ম্যান্স। শিল্পীর ভাবনায়, এই ‘পারফর্ম্যান্স-এর বিষয় যেন সূর্যোদয়। এবং যেহেতু প্রতিমা এই মণ্ডপ-মঞ্চে অবস্থিত, তাই দেবী, তাঁর সন্তানেরা, এবং মঞ্চে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের সবারই উদ্দেশ্য যেন দড়ি ধরে সূর্যদেবকে আকাশে টেনে তোলা। প্রতিমার রূপ লক্ষ্মণীয়—এই দুর্গা যেন সাধারণ বাঙালি ঘরের ছটফটে যুবতী; স্বর্গবাসী, অনাসন্ন দেবী নন।
রূপক-ভিত্তিক এই চিন্তার নাম ‘স্বকাল’— অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোকমূখী হয়ে ওঠার আশার কাহিনি। “আমরা কেউই রাজনীতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলতে পারি না। একজন শিল্পী সমাজকে দেখে যান, এবং সেই সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিফলন তাঁর কাজে ফুটে ওঠা স্বাভাবিক,” বলেন ভবতোষ।
অর্জুনপুরের দুর্গামণ্ডপ তাই এবার বিস্তৃত। গোটা অঞ্চলের অনেকটা জুড়েই তাই যেন মঞ্চের সজ্জা, থাকছে বিভিন্ন ধরনের আলোকপাত, শব্দবিন্যাস করছেন প্রখ্যাত শব্দ প্রকৌশলী সুকান্ত মজুমদার, তৈরি হচ্ছে একটা বিস্তীর্ণ আবহ। “আমার কাজ এখন অ্যাম্বিয়ন্সে; আমার কাছে ‘থিম’ কথাটা আর কোনও গুরুত্ব রাখে না,” বলেন ভবতোষ।
প্রসঙ্গে ভবতোষ মনে করিয়ে দেন, তাঁর কাছে বাংলার সংস্কৃতি পারফর্ম্যান্স দ্বারা চালিত। “বাউল যেমন নেচে-নেচে গান করেন একটা পারফর্ম্যান্স হিসাবে, মায়েরা যে সন্ধ্যায় পুজো দেন, ঘন্টা বাজান, মন্ত্র পড়েন, সেটাও আমার কাছে পারফর্ম্যান্স। তাই যাঁরা এতদিন ধরে এই এত বড় একটা কর্মযজ্ঞের কাণ্ডারি, যারা এই কয়েক দিনে এত বড় একটা মণ্ডপ বানিয়ে ফেলছেন, মাটির, কাপড়ের, কাঠের কাজ করছেন, তাঁদের কাজও আমার কাছে পারফর্ম্যান্স, এবং এই পারফর্ম্যান্স পুজোর সাত দিন চলতে থাকবে; তাঁরা কাজ করে যেতে থাকবেন। সেটাই আমার কাছে সবথেকে বড় পুজো, একটা গ্র্যান্ড পারফর্ম্যান্স। ইণ্ট্যাঞ্জিবল হেরিটেজ সম্মান কিন্তু কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা সম্প্রদায়কে দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে এই প্রসেসটাকে। ছৌ নাচ, বা অন্যান্য লোকশিল্পের মতো, দুর্গাপুজোকে ঠিক কোনো নামেই বেঁধে ফেলা যায় না— এটা কি একটা আর্ট প্র্যাকটিস, না কালচারাল প্র্যাকটিস, নাকি ধর্মীয় প্র্যাকটিস? বরং বলা চলে, এটা সবাইকে নিয়ে একটা কাজ; একটা বহমান শিল্পের ধারা। আমার মনে হয়েছে, দর্শকরা, ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা, যেন শিল্পের এই চালু থাকা প্রসেসটা দেখতে পান, সেখানেই এই সম্মানের সার্থকতা।”
দেবদারু ফাটক সার্বজনীন (বেহালা ম্যান্টন)
বিষয়— ‘আগ্রাসন’
শিল্পী— পূর্ণেন্দু দে
পূর্ণেন্দু দে’র ভাবনায় বেহালা ম্যান্টনে দেবদারু ফাটক সার্বজনীন দুর্গাপুজো সাজছে সম্পূর্ণ প্রকৃতি-কেন্দ্রিক একটি বিষয় নিয়ে, শিল্পী যার নামকরণ করেছেন ‘আগ্রাসন’। মানুষের আগ্রাসী মনোভাব এবং লিপ্সাকে এক আসুরিক আচরণ হিসাবে কল্পনা করেছেন পূর্ণেন্দু। কিন্তু প্রকৃতি-মাতার খেয়ালে, মানুষের এই চলন যে এক লহমায় শেষ হয়ে যেতে পারে, সেই সত্যের কথাও মনে করিয়ে দেবে দেবদারু ফাটক সার্বজনীনের মণ্ডপ। “জল, জমি, এমন কি মহাকাশ— মানুষের আগ্রাসনের কোনও সীমানা আর থাকছে না, সে যেন সব কিছু দখল না করে থামতে চাইছে না। কিন্তু মানুষ তার আসুরিক প্রবৃত্তিগুলি সংযত না করলে আগামী দিন তার কাছে সুখকর হবে না; আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৃথিবী ক্রমশঃ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে, এই ভাবনা থেকেই ‘আগ্রাসন’-এর বিন্যাস,” বলেন পূর্ণেন্দু।
এক সময়ে যাঁর উপনাম হয়ে ওঠে ‘মাটির মানুষ’, দুর্গাপুজোর পরিপ্রেক্ষিতে, ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখে যাওয়া পূর্ণেন্দুর কাজের স্বাক্ষর। ২০২২-এ, কালীঘাটের ৬৬ পল্লী সার্বজনীন দুর্গাপুজোয় পূর্ণেন্দু একটি বহু পুরনো বাড়িকে তাঁর কাজের অঙ্গবিশেষ হিসাবে ব্যবহার করে যেমন তুলে ধরছেন একটি আদ্যন্ত সাইট-স্পেসিফিক ইন্সটলেশন, তেমনই দেবদারু ফাটকে তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে একটি বিস্তীর্ণ মণ্ডপ, যাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে পরিবেশ-দূষণের নানা মোটিফ। মূল উপাদান হিসাবে কাঠ এবং মাটি ব্যবহার করে শিল্পী গড়ে তুলছেন কারখানা এবং তার সংলগ্ন সবুজ ক্ষেত, শিল্প-শহরের আকাশের দূষিত লাল ধোঁয়া; কংক্রিটের গ্যালারিতে দর্শকমণ্ডলী হয়ে উঠছে কেটে ফেলা গাছ, থাকছে লোলুপ, মাটি-খোঁড়া আর্থ-মুভারের আদলে ভাস্কর্য। প্রতিমা যেন করুণাময়ী প্রকৃতি-মাতা, কিন্তু মানুষের লোভ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে চায়, তিনি পৃথিবীকে আদিম যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ধরেন।
বিগত দুই বছরে অতিমারী-উত্তীর্ণ শহরে ‘স্বাভাবিক’ জীবনে প্রত্যাবর্তনের এই ধরনের ভাবনা যে দুর্গাপুজোয় ফিরে আসতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তফাৎ গড়ে দেবে মনন।