ছোটবেলা থেকে কমিক্সের নেশায় মশগুল হয়ে থাকেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একবার কমিক্স জিনিসটির স্বাদ পেলে, সারাজীবন এর মায়াজালে বন্দি হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। যতদুর জানা গেছে, ‘কমিক্স’ নামক এই শিল্পমাধ্যমটির গোড়াপত্তন হয় আজ থেকে কমবেশি দুশো বছর আগে; আমেরিকা, চিন এবং ইওরোপের কয়েকটি দেশে। ছবির মাধ্যমে গল্প বলে প্রধানত ছোটদের আনন্দ দেওয়ার জন্য কমিক্সের উদ্ভাবন হলেও একে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অদ্ভুত সমস্ত বিষয়বৈচিত্রে ভরপুর হয়ে উঠতে থাকে কমিক্সের আঙিনা। এমনকী অবলীলায় ঢুকে পড়ে চরম প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপারস্যাপারও। তবে কথা আর ছবি মিলিয়ে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই কিন্তু একটা বিশেষ ছকের মধ্যেই থেকে গিয়েছিলেন কমিক্সশিল্পীরা। যেহেতু শতকরা নব্বইজন আসতেন ছবি আঁকার প্রথাগত তালিম নিয়ে, ফলে ড্রয়িং-এর পারিপাট্যের দিকে এঁদের নজর থাকত অনেক বেশি। এই রেওয়াজ ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে গত শতাব্দীর শেষদিক থেকে, যখন শট-ডিভিশন বা ফ্রেমের পর ফ্রেম ভাগের সেকেলে পদ্ধতিটাকে নতুন ভাবে গড়েপিটে নেবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন দেশ-বিদেশের বহু শিল্পী, শুরু হয়ে যায় কমিক্সের এক নতুন যুগ। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পিছনে কাজ করেছিল ভিসুয়াল আর্ট সম্পর্কে সম্পূর্ণ আধুনিক এক দৃষ্টিভঙ্গি, সেই সঙ্গে সামাজিক নানা ইস্যুকে তুলে ধরার প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা। এই রাস্তা ধরেই কমিক্সের মূল স্রোতে চলে আসতে শুরু করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মতো একের পর এক বিস্ফোরক সমস্ত বিষয়। ফলে এতদিন ধরে শুধুমাত্র হালকা বিনোদনের বোঝা বয়ে বেড়ানো এই কমিক্সশিল্পকে সাবালকত্ব অর্জন করতে আর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
পশ্চিমের দেশগুলো এ-ব্যাপারে পথ দেখালেও, ভারতবর্ষের কমিক্সচর্চাতেও এর প্রভাব পড়েছিল যথা সময়ে। ততদিনে ‘গ্রাফিক নভেল’ নামক নতুন এক শিল্পমাধ্যম এসে কমিক্সের আদি-অকৃত্রিম ভাষাটার খোলনোলচে পাল্টে দেবার কাজটা সহজ করে দেয়, গল্প বলার ধরন অনেক বেশি সেরিব্রাল হয়ে ওঠে, ছবি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গত করতে থাকে মাত্র। কমিক্সকে রুজি-রোজগারের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন যাঁরা, সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের মনোরঞ্জন করা ছাড়া তাদের অন্য উপায় ছিল না, তারই মধ্যে নতুন প্রজন্মের অনেকেই কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন কমিক্সের প্রতি নির্ভেজাল আবেগকে যথাসম্ভব চরিতার্থ করার এক অদম্য বাসনা নিয়ে।
সাম্প্রতিককালে এই বাংলাতেই নিজ-নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত চারজনের একটি দল ইচ্ছেমতো কমিক্সকে ঢেলে সাজাতে নানা রকম উদ্যোগ নিতে শুরু করে। তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন পেঙ্গুইন বুক্স থেকে প্রকাশিত সম্পূর্ণ মুক্তমনা কমিক্সের একটি সংকলন ‘লংফর্ম ২০২২’। এর পুরোভাগে ছিলেন দীর্ঘদিনের অ্যানিমেশন প্রশিক্ষক শেখর মুখোপাধ্যায়, সঙ্গে ভারতবর্ষের একজন পথিকৃত গ্রাফিক ন্যারেটর, আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারি সর্বজিৎ সেন, এছাড়া অঙ্কবিদ, বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখক এবং কমিক্স-পাগল দেবকুমার মিত্র। চতুর্থজন হলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রচ্ছদশিল্পী ও কমিক্স-বিশেষজ্ঞ পিনাকী দে। গল্প বলার প্রচলিত আঙ্গিককে আমূল ভেঙেচুরে ফেলা একগুচ্ছ কমিক্সকে বেছে নিয়ে এই সংকলনটিকে একজোট হয়ে সম্পাদনাও করেছেন এঁরাই। ২৭২ পাতার বইটিতে সম্পাদক চারজনের কাজ ছাড়াও কুড়িটি বড় মাপের ছবিতে গল্প রয়েছে বিভিন্ন শিল্পীর করা, যাঁদের বেশির ভাগই অ্যানিমেশন বা ইলাস্ট্রেশন-কেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বলা বাহুল্য, এঁদের আঁকার ব্যাপারটা তাই কমবেশি উতরে গিয়েছে সবক্ষেত্রে।
ইংরেজি ভাষায় রকমারি কম্পোজড টাইপের অভাব নেই, মূল টেক্সটের ক্ষেত্রে তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছেন প্রায় সবাই, ব্যাপারটা যাতে যান্ত্রিক না হয়ে যায় সেই দিকেও যথাসম্ভব লক্ষ রেখেছেন। এঁদের মধ্যে জেরি অ্যান্টনি কিংবা একতা ভারতী সম্ভবত ব্যতিক্রম। সম্পাদকবৃন্দ নিজেরা অবশ্য বেশি জায়গা নেননি। দু’পাতার মধ্যে ডিজনির ‘জাঙ্গল বুক’-এর সেই বিখ্যাত গানটিকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করে শেখর তাঁর স্বভাবসুলভ রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন, অন্যদিকে দুনিয়ার যাবতীয় সর্বহারাদের পরিণতি নিয়ে সিরিয়াস প্রশ্ন তুলেছেন সর্বজিৎ। এক পাতায় দেবকুমার দেখিয়েছেন মানুষকে ভুখা করে রাখার চিরকালের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে আর পিনাকী এঁকেছেন এক ভুতুড়ে দৃশ্য। দেবকুমারের উপস্থাপনাটি নিঃসন্দেহে মনে রাখার মতো।
বইয়ের মূল অংশের প্রথমেই রয়েছে দেবজ্যোতি সাহার ‘মার্ডার’ গল্পটি, যেখানে একটি ছোট ছেলে আর কাক নিয়ে কিছুটা পরাবাস্তব আবহ তৈরি হয়েছে, ছবিগুলোর মধ্যে সাদা-কালোর বিন্যাসটিও মানানসই। পভন রুজুরকার-এর ‘নুর’-এ দেখা যায় ঘর-বাড়ি হারানো এক ফুটপাথবাসী ছেলেকে, অসৎসঙ্গে মিশে যাকে শেষে ড্রাগের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। পভনের ড্রয়িং ভাল, শট-ডিভিশনও বেশ সোজাসাপ্টা ধরনের, গল্পটা বুঝতে তাই অহেতুক হোঁচট খেতে হয় না; যদিও বেশির ভাগ লেখা এত ছোট যে, পড়া খুব কষ্টকর। একতা ভারতী তাঁর ‘বিটার সুইট’ গল্পটিতে নারীর প্রেম ও যৌন সমস্যা নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলতে চেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে ছবি সঠিকভাবে তাল মেলাতে পারল কি না তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এতটা বিকৃত মুখ আঁকার কি খুব দরকার ছিল? আলেন্দেভ বিষ্ণু তাঁর ‘টেল’ গল্পে ছোটদের মনের জগৎকে বেশ সহানুভূতি নিয়ে দেখিয়েছেন। জল রঙের হাতটাও তাঁর যথেষ্ট ভাল, বাহাদুরি আছে টপ অ্যাঙ্গেল শটগুলোতেও। জেরি অ্যান্টনির ‘ফ্লেজেড’ গল্পে সরল কিশোরী মেয়েটিকে এক অতিকায় খরগোশ আগাগোড়া বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে রেখে দেয়। এখানে ফ্রেমগুলো ভাঙা হয়েছে অনেকটা সিনেমার মতো করে, সেই সঙ্গে শুধুমাত্র নীল রংকে কাজে লাগিয়ে জেরি জঙ্গলের নির্জন মায়াময় পরিবেশকে ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরভাবে। ‘বোস ভার্সেস বোস’ একটা জটিল মনস্তাত্ত্বিক গল্প, বিজ্ঞান আর অধ্যাত্মবাদের মধ্যে টানা-পড়েনের মাঝখানে দিশেহারা হয়ে পড়েন এক বাঙালি পদার্থবিদ। অর্ঘ্য মান্না মূলত হলুদ আর সিপিয়া টোন দিয়ে এঁকেছেন ইলাস্ট্রেটিভ একটা মেজাজকে বজায় রেখে, ডিটেলসের কাজও ভাল তবে কোনও-কোনও ছবিকে মনে হয় আরও বড় জায়গা দিলে ভাল হত। মিলাড তাহা ‘থিফ’ গল্পটাকে কথা ছাড়াই দিব্যি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, চোস্ত ড্রয়িং তাঁর, আলোছায়াকে খেলাতে পারেন ইচ্ছেমতো। মাঝে মাঝেই পকেটমারের দুটো পাঞ্জার ক্লোজ-আপ দেখিয়েছেন এমন, মনে হবে যেন চুরির জন্য নিশপিশ করছে। এই প্রতীকী ভাবনাটির প্রশংসা করতেই হয়। সাজ আহমেদ তাঁর ‘মিনিং অফ দ্য ওয়ার্ড’ গল্পে ‘আখলাক’ শব্দটাকে লিট মোটিফ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আখলাক অর্থাৎ সামাজিক নীতিবোধের ইতিবাচক দিকটা নানা পর্বে দেখিয়েও শেষে তাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন সাজ। কেন তাঁর এই হতাশা, সেটা কিন্তু স্পষ্ট হল না।
‘পোলারয়েডস অফ প্রাইড’ গল্পে অনির্বাণ ঘোষ বিভিন্ন চরিত্রদের এঁকেছেন খুব যত্ন নিয়ে, বেশ জীবন্ত লাগে, বর্ণনাগুলিও বাস্তবসম্মত তবে এখানেও টাইপ ছোট হওয়াতে দীর্ঘ টেক্সট পড়তে একটু অসুবিধে হয়। বলরাম জে-র ‘ড্রিং ট্রিং’ গল্পে পঙ্গু দাদুর জন্য লালা তার সাধের সাইকেলটাকে হুইলচেয়ার বানিয়ে দেয়। স্বার্থত্যাগের এই ছোট্ট কাহিনিটিকে এমন ভনিতাহীনভাবে দেখিয়েছেন বলরাম, ফিল গুড মেজাজাটা তৈরি হয়ে যায় নিমেষের মধ্যে। শেষ করা যাক ‘পেশেন্ট নম্বর ২৫৯’ গল্পটি দিয়ে, যার ভিসুয়াল ন্যারেটিভ যৌথভাবে তৈরি করেছেন সুধন্যা দাশগুপ্ত ও মণীষা নস্কর। এখানে সুধন্যার লেখা ডায়রির পাতায় ধরা পড়েছে তাঁর মাকে নিয়ে যাবতীয় চিন্তাভাবনা। কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সুধন্যা মিশিয়ে দিয়েছেন কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী মায়ের সঙ্গে ছিন্নমূল হয়ে আসা তাঁর অতীতের দিনগুলোকেও। জটিল চিকিৎসাপর্বের পাশাপাশি উঠে এসেছে মাকে ঘিরে সুধন্যার স্বপ্ন দেখার কথা, জমা হয়েছে ব্যক্তিগত আবেগ, বিষণ্ণতা। শেষ পাতায় ফ্রক পরা মায়ের হাসিমুখের ছবিটি মনকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
লংফর্মের মতো এরকম একটা বই-এর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শিল্পীদের দিয়ে ঠিক কাজটা করানো, সম্পাদনা আর ছাপার দিকে নজর দেওয়া, চার সম্পাদক মিলে এই দুরূহ কাজগুলো ভালভাবেই সামলেছেন সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরবর্তী সৃজনশীল প্রজন্মের সামনে খুলে দিয়েছেন ভিসুয়াল ন্যারেটিভের এক নতুন দিগন্ত; এই কারণেও একটা বড় বাহবা প্রাপ্য এঁদের। সুতরাং পরবর্তী লংফর্মের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেই হচ্ছে!
কভারের ছবি পভন রুজুরকার, ‘নুর’
Longform 2022: An Anthology of Graphic Narratives
Edited by Longform Collective
Penguin Books, Rs 1499/-
লংফর্ম ২০২২: গ্রাফিক ন্যারেটিভ সংকলন
লংফর্ম কালেকটিভ কর্তৃক সম্পাদিত
পেঙ্গুইন বুকস, ১৪৯৯/-