সাতের দশক। একদিকে ঔপনিবেশিক রেশ কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট, অন্যদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তোলিত শহর কলকাতা। সেই কলকাতা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ক্যালকাটা-ট্রিলজি—‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’ ও ‘জন অরণ্য’। তারই তিন মুখ্য চরিত্র, যথাক্রমে সিদ্ধার্থ, শ্যামলেন্দু ও সোমনাথ। তাদেরকে ঘিরে অসংখ্য পার্শ্বচরিত্র— কেয়া, টুটুল, মিস্টার ফেরিস, দোলন, টুনু, তপু, বিশুদা, স্যার বরেন রায়, তালুকদার, নটবর মিত্তির এবং আরও অনেকে। তিনটি আলাদা ছবি জুড়ে থাকলেও, এরা আসলে একই পটভূমিকার অংশীদার। তিনটি ছবির সমন্বয়ে রচিত এই ছোটগল্পটি কাল্পনিক, এবং একইসঙ্গে সেই পটভূমিকাকে তুলে ধরার প্রচেষ্টামাত্র।
সোমনাথ, শ্যামলেন্দু আর সিদ্ধার্থ। স্কুলে ফেলে আসা বহু বন্ধুদের মধ্যে তিনজন। ক্লাস এইট অবধি একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসত, শ্যামলেন্দু ক্লাস নাইনে ‘ভাল সেকশন’-এ চলে যাওয়ায় তাতে ছেদ পড়ে, টেন-এর পর থেকে সম্পর্ক ফিকে হতে হতে ইদানীং পাকাপাকি ভাবে ছিন্ন। শুধু এর মুখ থেকে, ওর মুখ থেকে, একে অপরের খবর রাখা।
শ্যামলেন্দু, অর্থাৎ শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি। আজ হিন্দুস্তান পিটার্স নামে একটি বহুজাতিক সংস্থার ডিরেক্টর। বাড়ি সাদার্ন আ্যভিন্যু-তে। সঙ্গে পরিবার বলতে স্ত্রী দোলন। মা-বাবা থাকেন বালিগঞ্জে একটি ফ্ল্যাটে; একমাত্র ছেলে রাজা থাকে কার্শিয়াঙের সেন্ট পলস-এর বোর্ডিং-এ। স্কুলের বন্ধুদের অধিকাংশের অবস্থা কিন্তু তার মতন নয়। শোনা কথা— তারা অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের ১০ লক্ষ শিক্ষিত বেকারদের দলে। বন্ধুদের অধিকাংশ কেরানি। কেউ কেউ দোকানের কর্মচারী, কেউ বা সেলসম্যান। আরেকটু ভাল হলে কলেজের প্রফেসর। তার নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত এক-দুজন হয়তো থেকেও থাকতে পারে, যদিও সেটা তার জানা নেই। বুদ্ধি, ভাগ্য আর পরিশ্রম মিশিয়ে গত ১১ বছরে তার যে উত্থান, সেটা তাকে খুশি করে, কিন্তু আত্মসন্তোষে ভোগায় না। অফিসের মিস্টার রামালিঙ্গম যতই বড় বড় জ্ঞানোপদেশ দিন না কেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে এগোনো যায় না। এম ডি মিস্টার ফেরিস-এর অবসর যে আর মাত্র তিন বছর দূরে।
কয়েক সপ্তাহ হল শ্যালিকা টুটুল পাটনা ফেরত গেছে। সেই থেকে শ্যামলেন্দুর মনটা ভারী। আসলে ভারী নাকি খালি, এবং সেটা কেন, সেটা সে নিজেও ঠিক জানে না। তবু আজ সকালটা সানাই আর সরোদ দিয়ে শুরু করতে ভালই লেগেছে। আজ দীর্ঘ ১৮ বছর পরে সোমনাথ আর সিদ্ধার্থর সঙ্গে দেখা হবে। সোমনাথ কলকাতায় বড়বাজারে কী একটা করে, পোশাকি নাম মডার্ন ট্রেডার্স। সিদ্ধার্থ কলকাতায় কিছু চাকরি না পেয়ে বালুরঘাটে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। শ্যামলেন্দু জানে, সামাজিক অবস্থানে তারা তার সমকক্ষ নয়। সেই কবে ক্লাসে ফার্স্ট হলে যেমন তারা মাতামাতি করত, আজও হয়তো তাকে নিয়ে তারা তা-ই করবে। অনেকটা অফিসে সেন বা নীলাম্বরবাবুর আদিখ্যেতার মতো। এগুলো শ্যামলের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তবু তোল্লা খেতে কার না ভাল লাগে!
এমনিতে এদের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা নয়। বাড়ি আর অফিসের বাইরে যাতায়াত বলতে তো রেস্তরাঁ, রেসকোর্স, টলি বা ক্যালকাটা ক্লাব আর এয়ারপোর্ট, সোমনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তবে ওইটুকু সম্ভাবনাই বাস্তব হল দূর-সম্পর্কের এক ভাগ্নের বিয়েতে। দেখা সোমনাথের সঙ্গে, ও তাদের প্রতিবেশী। সেদিন মাত্র মিনিট পাঁচেকের দেখা, কিন্তু তাতেই আড্ডা মারার দিনক্ষণ ঠিক হল। সোমনাথের সঙ্গে সিদ্ধার্থর গত বছর থেকে হালকা যোগাযোগ রয়েছে, ওকেও নিয়ে আসবে বলল।
অতঃপর আজ সেই দিন, শনিবার, ৫ মে। বেলা চারটে সাত। রেসের মাঠ থেকে শ্যামলেন্দু সোজা গ্র্যান্ড হোটেলে। রেসে আজ হার-জিত মিলিয়ে যাকে বলে হিসেব বরাবর, বা ব্রেক-ইভন। হোটেলে গাড়ি পার্ক করে সে বাইরে এসে দাঁড়াল। সোমনাথ আর সিদ্ধার্থ এসে পৌঁছয়নি। ইতিমধ্যেই সাত মিনিট দেরি; এইজন্যই এদের উন্নতি হয় না। তারপর তো দাবিদাওয়ার জন্য একগাদা ইউনিয়ন আছেই। এই তো সেদিন ডানলপ-এ দেরিতে আসা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। কর্মীদের দাবি, ট্রেন-লাইনে অবরোধ ছিল। অন্যের মুখে শোনা— সিদ্ধার্থই তো কোন এক ইন্টারভিউতে ঢুকে রেগেমেগে টেবিল উল্টে দিয়েছিল। ও বরাবরই রগচটা, সেজন্যই ট্যালেন্ট থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ল। শ্যামলেন্দু নিজের মনে হাসে। তাকে এসব করতে বা সইতে হয়নি, হবেও না। না হয়েছে বাসে-ট্রামে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস যেতে, না হয়েছে কর্তৃপক্ষের টেবিল চাপড়ে গলাবাজি করতে। যা সে করেছে, নিপুণভাবে করেছে। সাধ্য আর ক্ষমতার জোরে। সে টুটুল যা-ই ভাবুক না কেন।
নিজের মনে সে পায়চারি করছিল। আশেপাশের দু-একজন আড়চোখে তাকে দেখছে, উচ্চতা সিক্স-ওয়ান যে! হঠাৎ এক হোঁচট! ডিসগাস্টিং! কে বা কারা ফুটপাথ জুড়ে ইট-বালি রেখে দিয়েছে! চকচকে জুতোটা নষ্ট হতে চলেছিল আর কী! পিছন ঘুরে শ্যামলেন্দু হোটেলের দিকে ফিরতেই দেখে, অদূরে মানিকজোড়। এখনো আগের মতো রোগ-পাতলা। সে নিজেও রোগা, কিন্তু পেটানো রোগা আর খাটিয়ে রোগায় তফাৎ আছে, পিটার্স এর ফ্যান-এর ত্রুটির মতো কয়েক হাত দূর থেকেই বোঝা যায়। একগাল হেসে সোমনাথ বলল, ‘অনেকক্ষণ ওয়েট করছিলি? দুটো বাস বদলে আসতে হল, তার ওপর ধর্মতলার মোড় থেকে হাঁটা। তোর মতো তো গাড়ি নেই।’
‘আর তুই?’
‘আমি ট্রাম। ওকে মেট্রোর সামনে মিট করলাম।’ সিদ্ধার্থ আগের মতোই গম্ভীর। এতদিন পরে দেখা, তবু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ভেসে গেল না। বরাবরই ও এরকম, বালুরঘাট ওকে যেন আরও গম্ভীর করে দিয়েছে। কোথাও যেন অনেক অভিমান জমে আছে।
‘চল ভিতরে যাই। চারটেয় রিজার্ভেশন, উই আর অলরেডি লেট।’ এই জায়গাটা নিউ মার্কেটের এক্কেবারে কাছে, রুনু সান্যাল জাতীয় কেউ দেখে ফেললেই তো জিজ্ঞেস করবে, ‘ব্রাদার, এরা কারা?’ ঢুকতে ঢুকতে দূর থেকে কিছু মানুষের উল্লাস আর চকলেট বোমার আওয়াজ শোনা গেলো। সিগারেট ফেলে মাড়িয়ে সোমনাথ বলল, ‘মোহনবাগান। আরেকটা ঠুকল বোধহয়।’
ভিতরে ঢুকে গরম থেকে বাঁচা গেল। কে কী খাবে ভাবার আগেই সোমনাথ তিনটে বিয়ারের অর্ডার দিল। এরকম জবরদস্তি ইয়ারি-দোস্তি শ্যামলেন্দুর পছন্দ নয়। সে বাধা দিয়ে বলতে গেল, ‘পার্টিতে ছাড়া কোথাও আমি ড্রিংক করি না’, কিন্তু ততক্ষণে বেয়ারা অর্ডার নিয়ে নিয়েছে। বিয়ার এল, সঙ্গে ফিশ ফিঙ্গার আর চিকেন তন্দুরি।
‘কত যুগ পরে দেখা। তা কেমন আছিস?’ কাউকে নির্দিষ্ট না করে প্রশ্নটা শ্যামলেন্দু দুজনের মাঝে ছুড়ে দিল।
জবাবটা দিল সিদ্ধার্থ। ‘আর কেমন! ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে লোকে যেমন থাকে! তার ওপর যা গরম!’
‘ভ্যাপসা গরম শুধু গোবিন্দপুরে না, ইভন কুয়ালালামপুর বা সিঙ্গাপুরেও।’ শ্যামলেন্দু নিজের বিদেশভ্রমণ নিয়ে বলতে আকুল। এর মধ্যেই তার যে ২০টার বেশি দেশ ঘোরা! তা অগ্রাহ্য করে সিদ্ধার্থ বলে চলল, ‘আমার বৌয়ের অবশ্য গরম সয়ে গেছে। দিল্লির মেয়ে তো।’
‘বৌ কী করে?’
‘কেয়া পড়ায়। লোকাল স্কুলে।’
‘তোর?’
‘হাউস ওয়াইফ। অবশ্য দোলন সাদার্ন আ্যভিন্যুয়ের হর্টিকালচার সোসাইটির প্রেসিডেন্টও।’
‘তোদের সব হাই-ফাই ব্যাপার। আমাদের তো কমফর্ট নেই, তাই কনভেনিয়েন্স। কেয়ার স্কুল হাঁটাপথ, চারটের মধ্যে বাড়ি।’
সোমনাথের গ্লাস ইতিমধ্যেই প্রায় অর্ধেক খালি। বলল, ‘নো গোবিন্দপুর, নো সিঙ্গাপুর, নো ওয়াইফ ফর মি। নির্ভেজাল কলকাতার ব্যাচেলর। হ্যাপিলি আনম্যারেড।’
১০ বছর ধরে পঙ্কিল কলকাতার অলিগলিতে আলপিন-টু-এলিফ্যান্ট বেচে বেচে সবকিছুই তার কাছে লেনদেন, বিয়ে সমেত। একবারের অভিজ্ঞতাতেই তার প্রেমের শখ মিটে গেছে, বৌদি কমলার ঐটুকু প্লেটোনিক প্রশ্রয়ই তার কাছে যথেষ্ট। বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক হল। তার পর থেকে দাদা-বৌদি-ভাইঝিই সব সোমনাথের। কেজরিওয়াল মিলসের অর্ডার পাওয়ার পর আরও নতুন বড় বড় খদ্দের জুটেছে, সব মিলিয়ে সংসারে তার মাসিক অবদান নেহাত মন্দ নয়। সারাদিন কলকাতা আর শহরতলিতে ঘুরে ঘুরে রাতে একটু বিশ্রাম, আর শনিবার রবিবারে একটু আড্ডা আর সিনেমা। আর দায়িত্ব বলতে ভাইঝিকে একটু পার্কে ঘুরিয়ে আনা, পড়তে বসানো। বিয়ে করে এই সুখের জীবনটাকে অহেতুক নষ্ট করার অর্থ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শুরুতে একটু ঝটকা লাগলেও বিশুদার কথামতো সব এখন ধাতস্থ হয়ে গেছে। মুশকিলটা একটা জায়গাতেই। কাজটা তো শ্যামলেন্দুদের মতো ভাল না, তাই কিছু কাঁচা পয়সা থাকলেও একটু চেপে খেলতে হয়।
গল্প করতে করতে এক রাউন্ড চিকেন শেষ। বেয়ারাকে ডেকে সোমনাথ আরেক প্লেটের অর্ডার দিল। দালালির কাজ করতে করতে এই সব হোটেলের অনেক কর্মচারীই তার চেনা। তাই সঙ্গে অতিরিক্ত পেঁয়াজ আর কাসুন্দির কথা বলতে হল না।
বাইরে বোধহয় একটা মিছিল যাচ্ছে। আবছা কিছু স্লোগান শোনা যাচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। শ্যামলেন্দু একটা ভুরু তুলে সিদ্ধার্থর দিকে চেয়ে বলল, ‘তোর ভাই রাজনীতি করত না?’
‘কে, টুনু? ও এখন বদলে গেছে। কাউন্টার-রেভলিউশনারি বলতে পারিস। অ্যাংরি ইয়ং ম্যান বলতে নো মোর চে, এখন বচ্চন। মেয়ের পাল্লায় পড়লে যা হয়।’
‘সত্যি, ওকে এইটুকু দেখেছি! আর তুই? তুই কি এখনো রাজনীতি করিস?’
‘রাজনীতি বলতে ডান-বাম?”
‘না তো আর কী!’
‘আরে ধুর! মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ডান-বাম হয় না, হয় শুধু ক্রোসিন আর ক্যালপল।’
‘তোদের ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন নেই?’
‘আছে, তবে সেটা কালেকটিভ বার্গেনিং, আমেরিকাতেও চলে। আর সেটা করতে হয় করার জন্য। তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’ শ্যামলেন্দু বুঝল, এটা সিদ্ধার্থ’র ‘জিওগ্রাফি’। করতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।
সোমনাথ জুড়ল, ‘আমি বস সবসময়ই মধ্যপন্থী। বাবা গান্ধীবাদী ছিলেন কিনা! সব শালা ফালতু। ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন না, পলিটিক্স আর মরালিটির কোনো সম্পর্ক নেই। এই তো সেদিন লেকের ওখানে দুটোকে মেরে দিল। নো ভ্যালু ফর হিউমান লাইফ। শুনিসনি? তোদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে না।’
‘আমরা অবশ্য সাত তলায় থাকি। সেদিক দিয়ে অনেকটাই সেফ। ওয়েল, টু বি ফ্র্যাঙ্ক, রাতে দু’একটা বোমার শব্দ যে শোনা যায় না তা নয়।’
‘গুড। তাহলে গব্বর আসছে বলে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পারিস।’
‘আমার ছেলে এখানে নেই, কার্শিয়াঙে। বোর্ডিং-এ থাকে। আমরা গরমে গিয়ে দেখে আসি। এই তো আসছে মাসে যাব।’
‘সে কী ? ডোন্ট ইউ ফিল স্যাড?’
শ্যামলেন্দু বিয়ারে ছোট চুমুক দিয়ে শুধু ঘাড় নাড়ল।
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। গল্প জমেছে, রেস্তরাঁতে ভিড়ও একটু বেড়েছে। ডান পাশের ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা অনেকটা কেয়ার বাবা আর মাসিমার মতন দেখতে। বাবা মাসিমাকে বিয়ে করার পর তাদের সঙ্গে সিদ্ধার্থদের সম্পর্ক ন্যূনতম, চিঠিতে নববর্ষ আর বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে দায় সারা। সেই চিঠির উত্তর যে সবসময় আসে তাও নয়। তার পরিবার নিয়ে এখানে কথা বাড়েনি, তাই তার ছেলের কথা বলা হয়নি। ছেলে সৌম্য ক্লাস ফাইভে উঠল, ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হয়। আসলে কেয়া ওর পড়াশোনায় প্রচুর সময় দেয়। চারিদিকে যা প্রতিযোগিতা, সেটা সিদ্ধার্থর থেকে বেশি আর কে জানে! আর তা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
শ্যামলেন্দু এখনো প্রথম গ্লাসেই আটকে। দেখে সোমনাথ বলল, ‘তুই তো খাস-ই নি দেখছি। মদ্যপান যদি তোর প্রোমোশনের মতো তরতরিয়ে হত!’
শ্যামলেন্দু হাসল। অবশেষে বলল, ‘আসলে পার্টিতে ছাড়া আমি ড্রিংক করি না। তা, তোদের কাজে প্রোমোশন নেই?’
‘আছে বৈকি!’ সোমনাথ যেন প্রশ্নটা লুফে নিল। ‘তবে তোর মতন না। আমরা সবাই বড়বাজারে চারতলার একটা ঘরে গাদাগাদি করে কাজ করতাম। রিসেন্টলি, আমার নিজের ঘর হয়েছে, সেটাই প্রোমোশন। সিধু, সেই যে বিশুদার ঘরটার কথা বলেছিলাম! মাথার ওপর গণেশ। আর, তার সঙ্গে সেক্রেটারিও আছে, নো বিউটিফুল লেডি দ্যো— নাম ফকিরচাঁদ। বন্ধকের সাইড বিজনেস।’ অবশেষে সিদ্ধার্থরও গাম্ভীর্যের বাঁধ ভাঙল। তাদের হাসিতে পাশের টেবিলের অবাঙালি ভদ্রলোক কটমট করে চাইলেন।
‘আমাদেরটা অবশ্য তোদের মতোই। জোনাল রিপ্রেসেন্টেটিভ, তারপর রিজিয়নাল, তারপর ম্যানেজার। দু’একটা ফাউল না করলে ঠিক ম্যানেজার হওয়া যায় না।’ তুলনাটা শ্যামলেন্দুর ভাল লাগল না, একটু অবমাননাকর মনে হল। এনিওয়ে এনাফ টাইম স্পেন্ট— এদের সঙ্গে আর আড্ডার মানে নেই। ‘চল, এবার ওঠা যাক!’ প্লেটে এখনো দুটো ফিশ ফিঙ্গার পড়ে। ‘খাবি না তো?’ বলে সোমনাথ সেগুলো সাবড়ে দিল। ফাদার অব অল মিডলমেন দ্য গ্রেট নটবর মিটারের কাছে শেখা।
রেস্তরাঁ থেকে লিফ্ট দিয়ে নেমে লবি। কর্মসূত্রে এ লবি শ্যামলেন্দু’র হাতের তালুর মতন চেনা; গত সপ্তাহেই এখানে হংকং ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিটিং ছিল। লবি থেকে বেরিয়েই ডানহাতে পার্কিং।
‘তোদের কোথায় নামালে সুবিধে হয়?”
‘আরে না, নামাতে হবে না। সবে তো সন্ধে, একটা না একটা ট্রাম পেয়েই যাব। তোর সঙ্গে দেখা হল এটাই তো বড় পাওনা।’
‘আমার অবশ্য গড়িয়াহা…’ সোমনাথ কাউকে একটা দেখে কথা শেষ করল না।
সেরেছে! একটু দূরে স্যার বরেন রায় যে! চোখে সেই কালো চশমা। শ্যামলেন্দু রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে ক্ষিপ্র গতিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পিছনে সোমনাথ স্যার বরেনের সঙ্গে কী একটা বলতে আটকে গেছে! এরা একে অপরকে চিনল কী করে? উনি তাকে চিনে ফেলেনি তো? সঙ্গদোষে পরের প্রোমোশনটা আটকে গেলে? ভাবতে ভাবতে শ্যামলেন্দু আবার সেই একই জায়গায় হোঁচট খেল!