২০২২ সালে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখলাম। কিন্তু যে আশার আলোয়, যে প্রতিশ্রুতির ঘনঘটায় ভারত ‘স্বাধীন’ হয়েছিল সে-বছর, তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? এই দেশের মধ্যে যারা বসবাস করছি এই সময়ে, তারা আদৌ স্বাধীন তো? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই পেন আমেরিকা জানতে চেয়েছিল, বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য। ‘স্বাধীন’ বা ‘স্বাধীনতা’ শব্দগুলো নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন আজকের দিনে, তাঁরা তা জানিয়েছেন। সেই শতাধিক লেখকের শতাধিক ভাবনার কথাগুলোই এবার থেকে বাংলা অনুবাদে প্রকাশ পাবে ডাকবাংলা.কম-এ।
পি সাইনাথ (লেখক, সাংবাদিক)
২০২০ সালের ২৪ মার্চ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সেই লকডাউন ভাষণ নিশ্চয়ই মনে আছে? মাত্র চার ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। তারপরই ১৪০ কোটি মানুষের দেশ গেল থমকে। পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে এই আলটপকা সিদ্ধান্তে প্রায় লক্ষ কোটি দেশবাসীর জীবন ধসে গিয়েছিল। মোদীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও পরিষেবার তালিকা প্রকাশ করেছিল, যেগুলি লকডাউনের সময় চালু থাকবে।
বাঁচোয়া, মোদী সরকার সেই অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার মধ্যে রাখল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রিক মিডিয়া, টেলিকমিউনিকেশন, ইন্টারনেট পরিষেবা, ব্রডকাস্টিং ও কেবল সার্ভিস।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে, বেশ কিছু বড় মিডিয়া হাউস থেকে ছাঁটাই হলেন দু’হাজার থেকে আড়াই হাজার সাংবাদিক। হাউসগুলির বেশির ভাগই কর্পোরেট অধিকৃত কিংবা পরিচালিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ছাঁটাই সম্পন্ন হল কর্মীর ‘স্বেচ্ছায় ইস্তফা বা অবসরগ্রহণ’-এর মাধ্যমে। অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা হিসাবে গণমাধ্যমকে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের চাকরি কিন্তু বাঁচানো গেল না। এমনকী প্রাণও বাঁচানো গেল না। কোভিড অতিমারীর প্রথম ২০ মাসে, ৭০০জন সাংবাদিকের প্রাণ গেছে। তবে এই সংখ্যাগুলো আসল সংখ্যার চেয়ে অনেকটা কম। বিশেষ করে ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে তো বটেই। তখন ‘প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’-র উপ-কমিটির সদস্য ছিলাম আমি। বড়-বড় মিডিয়া হাউসে আমরা চিঠি পাঠিয়েছিলাম এই প্রশ্ন নিয়ে, কেন এরকম ছাঁটাই করা হল সাংবাদিকদের। উত্তরে প্রতিষ্ঠানগুলির ক্রোধ ও উকিলি চিঠি পাওয়া গিয়েছিল।
দেশের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র সংস্থা জানিয়েছিল— ছাঁটাই সম্পর্কে জানতে চাওয়ার কোনও অধিকারই নেই প্রেস কাউন্সিলের। এই ছাঁটাই নিতান্তই কর্মীনিয়োগ ও কর্মসংক্রান্ত ব্যাপার, এবং কাউন্সিলের অধিকারের আওতায় পড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। ছাঁটাইয়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার নীরব রইল। লকডাউনের প্রভাবে শহর থেকে নিজেদের গ্রামের দিকে লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে রওনা দিতে হল পায়ে হেঁটে, তা নিয়ে যে মিডিয়া সোচ্চার হতে ব্যর্থ হল— তার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে বিপুল ছাঁটাইয়ের সম্পর্ক আছে। মিডিয়ার এই অংশটাই তাদের সম্পাদকীয় পরিসরে দেশজুড়ে ঘটতে থাকা হাজারও সংবাদকর্মীদের গ্রেফতার, কারাবন্দি, জামিন-প্রত্যাখ্যান বা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে একটা টুঁ শব্দ অবধি করেনি— অথচ সেগুলো কখনও-কখনও করা হয়েছে আইনের এমন সব ধারায়, যা ভারতের মাটিতে গত ১০০ বছরে প্রয়োগ করা হয়নি। ভারতের গণতন্ত্র যেভাবে প্রতিনিয়ত খর্ব হচ্ছে, সেসব বিষয়ে মূলস্রোতের সংবাদ সংস্থাগুলির কয়েক বছর জুড়ে তুমুল নীরবতা কেবলই ভীরুতার লক্ষণ নয়, যদিও ভীরুতা কিছু কম নেই। কিন্তু তার সঙ্গে আছে কুকর্মে সহযোগিতা, হাতে হাত মিলিয়ে দুর্নীতি, তুষ্ট করার প্রবণতা এবং জুলুমবাজি।
সন্দেহ নেই, বেশ কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ‘দৈনিক ভাস্কর’ সংবাদ সংস্থা। আয়কর ও বিভিন্ন রকম বিষয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির তল্লাশি হেনস্থা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এই সংস্থা। তবে বেশির ভাগ বিরোধিতার স্বরই উঠে এসেছে ছোটখাটো নন-কর্পোরেট মিডিয়া সংস্থা থেকে। সেখানকার সাংবাদিক ও সম্পাদকদের ওপর অনাচার করা হয়েছে, আয়কর ফাঁকির অভিযোগ এনে হেনস্থা করা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে, এমনকী কারাবন্দিও। তাদের বহু স্পনসর ভয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এই আর্থিক বছরে সংস্থাগুলি কীভাবে কর্মীদের মাইনে দেবে, ভেবে পাচ্ছে না। হালে, সংবাদকর্মী ও সম্পাদকদের আর্থিক দুর্নীতি, টাকা নয়-ছয়ের অভিযোগে গ্রেফতার করাটা রীতিরেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে সংবাদিকদের কলঙ্কিত করা হচ্ছে, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতার হানি হচ্ছে, আর তাঁদের ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হিসেবে দেখার কোনও দায় থাকছে না।
আমাদের মনে রাখা দরকার, গত এক দশকে খুন হওয়া চারজন খ্যাত বুদ্ধিজীবী— নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম. এম. কালবুর্গি এবং গৌরী লঙ্কেশ— প্রত্যেকেই ছিলেন সাংবাদিক। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় লেখালিখি করেছেন। একইসঙ্গে এঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী। ধর্মীয় কট্টরপন্থাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন তাঁরা। এসবের মাঝে, ভারতের বড়-বড় বিত্তবান কর্পোরেট হাউসগুলি একের পর এক মিডিয়া হাউস কেনার খেলায় নেমেছে। উপহাস্য : ১৬৬টি দেশের মধ্যে ভারত ডলার বিলিয়নেয়ারদের নিরিখে তৃতীয়! অথচ, জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বলছে, মানুষের জীবনযাত্রা ও তার মানোন্নয়নের নিরিখে এই দেশ ১৩১ নম্বরে। আর এই বিলিয়নেয়ারদের কোটি-কোটি টাকা আসে সরকারি কন্ট্র্যাক্ট থেকে। দেশের জনসাধারণের সম্পত্তি শেষমেশ বেসরকারি সম্পত্তি হিসাবে কিনে নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় এই বিলিয়নেয়ারদের লাভ দেওয়ার স্বার্থে। আর পরিবর্তে তারা দেশের ক্ষমতাসীন পার্টিদের বিপুল পরিমাণ টাকা উপহার দেয়।
প্যারিস-কেন্দ্রিক একটি রিপোর্টার সংস্থা ‘রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স’ (আরএসএফ) ২০২০ ভারত সম্পর্কে একটা রিপোর্ট পেশ করল, আর তাতেই নড়েচড়ে বসল কেন্দ্রীয় সরকার। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা গেল, ১৮০টি দেশের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের অবস্থান একদম তলানিতে, ১৪২-এ (এখন সেটা ১৫০)। এমনকী, টুইটারের সাম্প্রতিক ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্টেও জানা গিয়েছে, ভারতে সাংবাদিক ও সংবাদ সংস্থার তরফে পোস্ট করা একদম সৎ তথ্য টুইটার থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যে-পরিমাণ আইনি দাবি উঠে আসে, তেমনটা পৃথিবীর আর কোনও দেশে হয় না। এই তথ্য ২০২১-এ জুলাই থেকে ডিসেম্বরের ভিত্তিতে। আর আমরা তো দেখেইছি কাশ্মীরে কত-কত মাস ধরে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, জনসাধারণের নাগাল থেকে বাইরে।
ভারতীয় সাংবাদিকদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া তো সারাক্ষণ চলছে। আর অ-ভারতীয় সাংবাদিকদের ভিসা না দিলেই তাঁদের রুখে দেওয়া যায়। কিন্তু, রাষ্ট্রযন্ত্র আরএসএফ-এর পরিসংখ্যান ও র্যাঙ্কিংয়ে যুক্তিক্রম ও তথ্য খণ্ডন করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। ২০২০ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার, ইউনিয়ন ক্যাবিনেট সেক্রেটারির (বোধহয় ভারতের সবচেয়ে শক্তিধর আমলা, কারণ তিনি সরাসরি দেশের সবচেয়ে দুই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ— প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করেন) নির্দেশে ‘ইনডেক্স মনিটারিং সেল’ (আইএমসি) গঠন করে। আমি সেই ‘আইএমসি’-র দুজন সাংবাদিক সদস্যের একজন ছিলাম। ২০২০-র ডিসেম্বর মাসে, একটি উপবিভাগ সেই কমিটিকে একটি খসড়া রিপোর্ট পেশ করে, কিন্তু সেখানে ‘খসড়া’ শব্দটির কোনও উল্লেখ নেই। সেই খসড়ায় আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু প্রতিফলিতই হয়নি। আর সেখানে অদ্ভুত-অদ্ভুত সব দাবি, যা অকল্পনীয়। এমনকী, কিছু-কিছু বক্তব্যে তো মনে হতে পারে, যেন কাশ্মীরে সাংবাদিকদের হয়রানি বা বিপর্যস্ত হওয়ার ঘটনাগুলিকে রীতিমতো তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা হচ্ছে!
এর বিরোধিতায় আমি একটা চিঠি লিখি। সেটায় (আরও অনেক কিছুর সঙ্গে) কয়েক মাসের মধ্যে ঘটা ১০০টা এমন ঘটনার উল্লেখ ছিল— যেখানে দেশের বিভিন্ন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, বা তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল, বা আইনি শমন পাঠানো, বা মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেমন উল্লেখ করেছিলাম, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেফতারের কথা। তিনি কেরলের একজন ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট। উত্তরপ্রদেশ গিয়েছিলেন হাথরাসে দলিতদের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা কভার করতে। সেই কারণে কিনা তাঁকে গ্রেফতার করা হল, এবং প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁকে কোনও উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আর, প্রায় ২২ মাস পেরিয়ে গেল, তিনি এখনও জেলে বন্দি।
আমি লিখেছিলাম জুবেইর আহমেদের কথাও। এই সাংবাদিককে আন্দামান থেকে একাধিক অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল, কেবলমাত্র একটা টুইটের জন্য। তিনি টুইট করেছিলেন— ‘কেউ আমাকে বলতে পারেন, কেন কোভিড রোগীদের সঙ্গে কেবলমাত্র ফোনে কথা বলার জন্য এক-একটা পরিবারকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে?’ আহমেদ আত্মহত্যা করেছেন জুলাইয়ে, সম্ভবত বিষাদগ্রস্ত হয়ে, তদন্ত এখনও চলছে।
আমার সেই চিঠি পেশ করার পর, কিছুদিনের মধ্যেই সেই কমিটি দেখা গেল একেবারে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে তো আর সেই কমিটির নামগন্ধ পেলাম না। ‘আরটিআই’ করেও এর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার বন্ধুবর্গ বলল, আমি ভারি অকৃতজ্ঞ। তাদের বক্তব্য— তাও তো ভাল, কমিটিটা উধাও হয়ে গেছে, কমিটির সাংবাদিককে উধাও করে দেয়নি!
তাহলে, এই তো হল ৭৫তম বর্ষ পেরিয়ে স্বাধীন ভারতের সংবাদমাধ্যমের হাল!
আমার চার দশকের সাংবাদিক-জীবনে তিন দশক ধরে আমি বলে এসেছি, ভারতীয় মিডিয়া রাজনৈতিকভাবে মুক্ত, কিন্তু লাভের চিন্তার কাছে বন্দি। কিন্তু আজ আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভারতীয় মিডিয়া লাভের চিন্তায় আবদ্ধ তো বটেই, একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও রুদ্ধ হয়ে চলেছে উত্তরোত্তর।
রুচিরা গুপ্তা (লেখক, সমাজকর্মী)
হে প্রিয় দেশ,
স্বপ্ন হোক, আনন্দ হোক, দুঃখ হোক, বা আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা— তোমাকে পাশে নিয়ে, তোমাকে সঙ্গী করেই আমি আগামীর দিকে তাকিয়েছি।
তুমি বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য শিখিয়েছ। তোমারই থেকে শিখেছি, একজন দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ হয়তো একজন উত্তর ভারতীয় মুসলিমের তুলনায় অন্য এক ভাষায় কথা বলছে, তাদের খাবারের ধরন ভিন্ন, তাদের পোশাক-আশাকও ভিন্নরুচির। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই ব্রিটিশ শক্তির কাছে কই রকম ও সম্মিলিতভাবে শোষণের শিকার হয়েছিল। যে-কারণে একটা সর্বাঙ্গীণ ও যৌথ পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল।
ভারসাম্য এবং শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার যে সংস্কৃতি, তুমি তার জলজ্যান্ত নিদর্শন। তা সে বাণিজ্যপথে হোক বা মন্দিরে-মসজিদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে হোক বা রাস্তাঘাটে— সর্বত্র তুমি তোমার এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে রেখেছ। প্রত্যেকটা বাঁকে-বাঁকে, ভাবনার আদান-প্রদান করতে গিয়ে, জিনিসপত্র বেচাকেনা করতে গিয়ে, আমরা আমাদের বৈচিত্রের ব্যবধানের মুখোমুখি হয়েছি, এবং আমাদের সম্মিলন ঘটেছে। আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি। খুঁজে পেয়েছি অভিন্ন লক্ষ্য, এক মূল্যবোধ।
আমাদের শিক্ষায়, জীবনচর্যায় সবসময় গৌতম বুদ্ধ ও গান্ধীজির ভাবনা ছিল।
এখন, অধিকাংশ গণ-সমারোহে, তাঁদের অহিংসার ভাবনাকে প্রেরণা বলে মনে হচ্ছে না। তুমি যে ৭৫ বছর পেরিয়ে এলে, তার চারিদিকে এত হিংস্রতা ও প্রতিশোধের গল্প, এত ক্রোধ ও ভয়— এসবের শেষ কবে কীভাবে হবে, বোঝা কঠিন। অথচ এসব নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই সার্বিকভাবে। আমার হৃদয় ভেঙে যায়— মুসলিমদের ওপর অত্যাচার, সাংবাদিকদের গ্রেফতার— কী হচ্ছে এসব!
তবু মনে রেখো, তুমি একা নও। তোমার ভাই-বোনরা রয়েছে। শান্তি ও সমানাধিকারের সংগ্রামে তোমার পাশে আছে তারা। তোমার থেকে যা কিছু শিখেছি আমি, তা জীবনের সবসময় সবক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারিনি। কিন্তু, আমি আবার চেষ্টা করছি, যাতে কিছু খামতি না থেকে যায়। আমরা যা চাই, এই ভূমিতে তা সবই ছিল। অন্তর থেকে চাই, যেন সবাই মিলে তা খুঁজে পেতে পারি।
রুচির যোশী (লেখক, চিত্র-পরিচালক)
৭৫ বছর পর আজ অন্তত আমাদের স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, ভারতের কেমন হওয়া উচিত, সে-বিষয়ে শুধু একটা বা দুটো নয়, অজস্র ধারণা রয়েছে। এই প্রত্যেকটিকেই আমাদের ঠান্ডা চোখে জরিপ করা প্রয়োজন। আর কয়েক বছরের মধ্যেই এই ছোট্ট সংকটময় পৃথিবীর ২০ শতাংশ মানুষ ভারত নামের এই তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আকুল হয়ে পড়বে। যত দিন যাচ্ছে, যেহেতু বিভিন্ন জাতি ও জেনেটিক গ্রুপের মধ্যে মিলমিশ বাড়ছে, মানুষ ক্রমশ আরও বৈচিত্রময় হয়ে উঠছে। সেখানে সমসত্ত্ব হয়ে ওঠার, একমেটে হয়ে ওঠার সুযোগ একদমই কম। যাদের আমরা আজ ভারতীয় রূপে দেখি— যদ্দূর সম্ভব আগামী ১০০ বছরে সেসব পরিচয়ের ধারণা প্রায় থাকবে না, যা দিয়ে আমরা একটা মানুষের জাতি, ধর্ম বা বর্ণ শনাক্ত করি। তখন হয়তো দেখা যাবে আলাদা করে কোনও বাঙালি বা গুজরাতি নেই, হিন্দু বা মুসলিম বলে কিছু নেই, উচ্চবর্ণ বা নিম্নবর্ণ বলে কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ক্লাইমেট চেঞ্জ হোক বা বিশ্ব উষ্ণায়ন, কিংবা পারিবেশিক সংকট— যে-নামেই আপনি ডাকুন না কেন, ভবিষ্যতে এই প্রকৃতিগত কারণেই মানুষকে জোট বাঁধতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। একে অপরের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা বাঁচতে পারব না। ফলে, আমাদের নিজেদেরকেই প্রশ্ন করা উচিত : ভারতের কোন ধারণা আমাদের এই বৈচিত্রময় মানবসাগরকে উদ্ধার করতে পারবে কিংবা সুরক্ষা দিতে পারবে? কোন ধারণা ভিন্নতাকে সবচেয়ে প্রশ্রয় দিতে পারবে— সে-ভিন্নতা জাতি, বর্ণ, ধর্ম, যৌন পছন্দ— যার ভিত্তিতেই তৈরি হোক না কেন? কোন ধারণাটি প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমবর্ধমান দুষ্প্রাপ্যতার মধ্যেও ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করবে? ৭৫ বছর আগে যে-তাঁবুটা খাটানো হয়েছিল, তা আজ ঢিলে হয়ে গিয়েছে। তাকে ফের টানটান করতে গেলে, মেরামত করতে গেলে, কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে সবচেয়ে বেশি মানুষ সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করতে পারবে?
সামান্থ সুব্রহ্মণ্যম (লেখক, সাংবাদিক)
স্বাধীন ভারতের প্রথম সংসদীয় অধিবেশনে, স্বাধীনতা লাভের সেই মধ্যরাতে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার ইংরেজি অংশটি শুরু হয়েছিল সেই বিখ্যাত পংক্তি দিয়ে– ‘Long years ago, we made a tryst with destiny…’ নিয়তির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছিলাম। এই উচ্চারণের আগে তিনি সমস্তটাই হিন্দি ভাষায় বলেছিলেন। আর এই চূড়ান্ত বাক্যবন্ধ হল তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতা-সার, যা আমাদের মন ভেঙে দেয়। আমরা যদি মনে করি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভারত সক্কলের, তাহলে আমরা অবশ্যই যে-কোনও বড় সমস্যা সামলে নিতে পারব। নেহরু বলেছিলেন– কিন্তু আমরা যদি সংকীর্ণমনা হয়ে পড়ি, তাহলে আমরা কিন্তু মোটেই সমস্যার সমাধান করতে পারব না।
আর বিজেপি ঠিক এই অংশটাই তাদের প্রতিপাদ্য বানিয়ে ফেলেছে, এবং এই লক্ষ্যের ঠিক বিপরীত দিকে ধাওয়া করে চলেছে। ভারতীয় মননকে সংকীর্ণ করে তোলাই এখন রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের লক্ষ্যই হল মানুষে মানুষে সহমর্মিতা বিনষ্ট করা, একে অপরের মধ্যে দ্বন্দ্বে বাধিয়ে দেওয়া, এবং কে কী বলবে বা বলবে না, কে কী খাবে বা খাবে না– সেসবে একে অপরের নীতিপুলিশি করতে লেলিয়ে দেওয়া। এরা আমাদের ভাবনাকে এক রকম চালাকি করে চালিত করতে চাইছে এই পথে যে, অবিশ্বাস একটা মস্ত বড় শক্তি। কিন্তু আসলে তা নয়। ভারতের এখনও অনেক বড়-বড় সমস্যা রয়েছে। কোন দেশেরই বা নেই? কিন্তু আমাদের জনগণের বর্তমান মন আরও সংকীর্ণ, আরও তিক্ত হয়ে পড়েছে। ১৯৪৭ সালে দাঁড়িয়ে দেশবাসী যতটা প্রস্তুত ছিল দেশের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার প্রতি, আজকের দেশবাসী ততটা প্রস্তুত আর নেই।
সন্দীপ জাওহর (চিকিৎসক, লেখক)
আমরা গোটা পরিবার ১৯৭৭ সালের প্রথম দিকে ভারত থেকে আমেরিকায় চলে আসি, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদদের জন্য উদারীকৃত মার্কিন অভিবাসন নীতির সুবিধা পেয়েছিলাম আমরা। ভারতকে নিয়ে আমার একেবারে ছোটবেলাকার স্মৃতি বলতে, বাবার কিছু কথা মনে পড়ে। নয়া দিল্লিতে ইমিগ্রেশন ভিসার জন্য মার্কিন দূতাবাসে যাওয়ার ব্যাপার ছিল আমাদের। তার কিছুদিন আগে, বাবা সেসব কথা বলেছিল। বাবা ছিল একজন সুবিদিত প্ল্যান্ট জেনেটিসিস্ট। তা, ১৯৭৫ সাল নাগাদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশজুড়ে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করলেন। সংবিধানের অপমান করা হল। বিরোধীপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলির কণ্ঠরোধ করা হল। এবং রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের ধরে ধরে পোরা হল জেলে। বোঝাই যাচ্ছিল যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে এই দেশ ও জাতির সদিচ্ছা ক্রমশ কমছে। দেশের সম্পদ সেই কাজে লাগানোর প্রয়াসও কমে আসছিল। আর আমরা বুঝতে পারছিলাম, আমাদের এই দেশ ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। যদিও এই সিদ্ধান্তে মায়ের খুবই কষ্ট হয়েছিল। কাঁদছিল মা। বাবা তখন মাকে বলল– এটা দেশের সমস্যা গো, আমার কোনও দোষ নেই এখানে।
কিন্তু, দুঃখের বিষয়, প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, ভারত এখনও সেই সমস্যায় ভুগছে।
সৌজন্যে : https://pen.org/india-at-75/