আটপৌরে কোলাজ
সাধারণত সিনেমায় একটা গল্প থাকে। কিছু-কিছু সিনেমায় থাকে না, কিন্তু সেখানেও দৃশ্যগুলোয় কোনও আকর্ষক ঘটনা ঘটে, বা অনেকগুলো ঘটনা মিলে পরিচালকের কোনও দর্শন, বা অন্তত দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। কিংবা একাধিক চরিত্রের সম্পর্কের কয়েকটা স্তর উন্মোচিত হয়। অচল মিশ্রের মৈথিলী ছবি ‘গমক ঘর’-এ (২০১৯), এমন কিছুই হয় না। কোনও গল্প বলা হয় না, কোনও ঘটনা ঘটে না, কোনও চরিত্রের সম্পর্কের টানা-পড়েন দেখানো হয় না, এমনকী কোনও চরিত্র প্রতিষ্ঠিত অবধি হয় না। সংলাপ খুব কম, যা আছে তাতে কোনও কারিকুরি নেই, একেবারে সাধারণ জীবনের অনুজ্জ্বল কথাবার্তা। ছবিটা গড়ে তোলা হয় স্রেফ বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে। ফিল্ম শুরু হওয়ামাত্র, তার দেওয়াল-খাট-জানলা, বাইক-গাছ-টিউবওয়েল, ছেলেপুলের দৌড়, বয়স্কদের তাসখেলা, রান্নাঘরের ছ্যাঁকছোঁক— সমস্তটা অসম্ভব চেনা মনে হয়। শুরু ১৯৯৮ সালে, তখন ছবির পর্দার আকৃতিটাও তখনকার দিনের মতো, অর্থাৎ চওড়ায় কম এবং চৌকো-গোছের, আর বাড়িতে একটা উৎসব হচ্ছে, একটা বাচ্চা জন্মেছে বলে। শুধু টুকরো-টুকরো জীবন দেখানো হয় : বড়রা তাস খেলছে, কারা গাড়ি চড়ে এল, নতুন বাচ্চাটাকে দেখতে গেল, সে বাবার মতো হয়েছে না মা’র মতো তা নিয়ে কথা হল, কয়েকজন আম পাড়তে গেল, সেখানে একজন বলল বন্যা হলে ওই অবধি জল উঠে আসে, ঠাকুরেরা এসে রান্না শুরু করল, কড়ায় মাছ ছাড়া হল, একজন বয়স্ক হাত ধুতে গিয়ে একজন ছোটকে বলল, ‘চেনো আমায়? আমি তোমার অমুক হই। কোন ক্লাসে পড়ো?’, ঠাকুমা তদারক করলেন বাচ্চারা আলুভাজা পেয়েছে কি না, একজন প্রতিবেশী তাস-খেলুড়েকে বলা হল ‘আরে ধুর এখানেই খেয়ে যান, আর ওবেলা তো নেমন্তন্ন আছেই’, একজন খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর সন্ধে হল, মেয়েরা শাড়ি পরতে এ-ওকে সাহায্য করল, বাচ্চাটাকে নিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হল, বাইরে সবাই নেমন্তন্ন খেতে বসল, একজন কিছুতেই আর নেবে না কিন্তু তাকে বলা হল আরেকটা নিতেই হবে, মেয়েরা আলাদা বসল, শেষে শাশুড়ি বউমা আর এ-বাড়ির মেয়ে খাটে গল্প করতে বসে পরিহাসের ছলে কথা হল শাশুড়ির বালাটা কে নেবে, রাতে ভিডিও ক্যাসেট এনে সলমন খানের সিনেমা দেখা হল, কেউ-কেউ আপত্তি করল (তারা সানি দেওল দেখবে), সেখানেও পিছনদিকে বসে কে ঘুমোতে লাগল, এক স্ত্রী স্বামীকে শুতে আসার সময় জিজ্ঞেস করল ‘হ্যাঁ গো এত খরচ কী করে করলে?’ আর সে বলল ‘দাদারাই অনেকটা দিয়েছে, ওরাই তো বলল ঘটা করে করতে’, মশারি টাঙানো খাটের পাশে মেঝেতে রাখা মশার কয়েল থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। এ যেন আটপৌরে দিনকালের একটা কোলাজ, এর কোনও তাড়া নেই, কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, শুধু নিরলস আয়নার মতো কয়েকটা চিত্র সে দেখাবে।
এরপর ২০১০, তখন বড়দা মারা গেছেন (এক-আধটা সংলাপে বোঝা যায়, বউদির বৈধব্য-বেশেও), ছটপুজো উপলক্ষে অনেকে বাড়িতে এসেছে, বাচ্চারা বড় হয়েছে, অবিবাহিতদের বিয়ে হয়েছে, তার মধ্যে একজন তার বউকে ছটপুজোতেও বাপের বাড়ি যেতে দেবে না কারণ একবার তার মিসক্যারেজ হয়েছে এবার আর রিস্ক নিতে চায় না, বরং ডাক্তার-বউদিকে রিপোর্টগুলো দেখিয়ে নিতে বলে। পুরনো তোরঙ্গ খুলে ঠাকুর্দার ডাইরি পাওয়া যায়, আর তাঁর লেখা নাটক— যা এই অঞ্চলে বেশ হিট ছিল বহু বছর ধরে, দুজন দরদি স্বরে ঠাকুর্দার কথা আলোচনা করে। একজন দিল্লিতে ফ্ল্যাট কিনেছে, টু-বি-এইচ-কে, তার বউ বেশ গর্বভরে বিবরণ দেয়। একজন প্রায় কিছু রোজগার করে না, এখন ঠিক করেছে ওষুধের দোকান দেবে, কিন্তু জমির সেলামি অনেক, তাই তার ভাগের জমি বিক্রি করে দিতে চায়। মা ইদানীং কখনও থাকেন এই ছেলের কাছে কখনও ওই ছেলের কাছে, ঘুরে-ঘুরে, এক বৃদ্ধা ঝি’কে গল্প করেন এক ছেলের বাড়িতে কত কাজের লোক, কিচ্ছুর অভাব নেই। বাড়ির সামনে দীন স্কুটারের বদলে বেশ দামি বাইক পার্ক করা থাকে। একজন আরেকজনকে দেখাতে-দেখাতে যায়, অমুক বাড়িটা বানিয়েছে তমুক, যে দ্বারভাঙায় থাকে, আর ওই বাড়িটা তমুক, যে পাটনায় থাকে। অন্য লোকটা বলে, থাকেই যদি অন্যত্র, খরচা করে গ্রামে এত বড় বাড়ি তোলার মানে কী? আগের লোকটা বলে, কী বলছ, এটাই তো শেকড়, একে ভুলে গেলে চলবে? বাচ্চারা ঠাকুমার দেওয়া জলখাবারের বদলে ম্যাগি খেতে চায়। এই অংশে পর্দাও আগের চেয়ে চওড়া, সংলাপও কম, এবং কথাবার্তা ছেঁড়া-ছেঁড়া, আন্দাজ করা যায়, এদের মধ্যে আঠা কমে এসেছে। আগেরবারের নেমন্তন্নে যে সবচেয়ে বেশি খেয়েছিল, সে এবারেও গল্প করতে এসেছে, কিন্তু বলে আগের মতো আর খেতে পারে না, শুধু গাঁয়ের লোকের মান রাখার জন্যে এলাহি খেতে হয়। আগেরবারেও একটা বাচ্চা ফ্যামিলি অ্যালবাম উল্টে-উল্টে দেখছিল, আর ক্যামেরা নিয়ে একজন কিছু ছবি তুলেছিল। বাড়ির বড়দা গ্রুপ ফোটো তোলার আগে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাবিটা এনে দাও, শুধু গেঞ্জি পরে আছি।’ এবারে অ্যালবাম উল্টে সেইসব ছবি দেখা হয়, আর দামি ক্যামেরায় ছবিটবি তোলা হয়। বাড়ির সামনে বাজি পোড়ানো হয়, বিধবা বউদি বারান্দায় বসে দ্যাখে। ভিড়ের পুজোর রমরমার পিছনে স্পিকারের গান চলে। বাড়ির দুজন বয়স্ক ভাই একটা চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে থালা রেখে খায়, মাটিতে পাত পেড়ে পাশাপাশি খাওয়ার চল উঠে গেছে, শহরের মতো ডাইনিং টেবিল না পেলেও বদলি-বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। আগেরবার বাড়ির চাল ফুটো নিয়ে কথা হয়েছিল, এবার দরজা দেওয়াল মেরামত নিয়ে কথা হয়। কে একটা বলে, চৌকিদারকে ভাল করে টাকা দিও, লোকটা ফাঁকি মারে, বাড়িটার দেখভাল করে না।
পরের ভাগটা ২০১৮-র, তখন গোটা বাড়িটা একেবারে ফাঁকা, শুধু চৌকিদার উঠে বারান্দা ঝাঁট দেয়, চাতালটায় বসে থাকে। বাড়িতে চড়াইপাখি আর কিছু উপদ্রবকারী ছাগল ছাড়া কেউ আসে না। তারপর দেখা যায়, বাড়িটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, একজন বলে তার ছেলেকে কেন্দ্র করে কী একটা উৎসব হবে, তার আগে নতুন নির্মাণ শেষ করে ফেলতে হবে। সে ভাঙা বাড়ির দেওয়াল থেকে ঠাকুর্দার ফোটোগ্রাফটা নামিয়ে নিয়ে যায়।
মোটামুটি এই হচ্ছে ছবি, যা জীবনের ডিটেল দেখায়, বহু খুঁটিনাটির দক্ষ সম্মিলনে কোনও চরিত্রের নয়, একটা বাড়ির গল্প বলে। একটা বাড়ি, যা অনেকদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে বহু মানুষ হাসে-খ্যালে, জন্ম দেয় মরে যায়, তারপর নতুন মানুষ আসে। তারা অন্যরকম জীবনের টানে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং বাড়ির প্রতি মমতা হারায়। তারপর এই বাড়িরও একদিন মৃত্যু হয়। এই ধরনের ছবিকে কয়েকটা গাঢ় ঘটনা দিয়ে একটু আবেগপূর্ণ করে তোলা হয় সাধারণত, কারণ শেষদিকের দৃশ্যে তখন দর্শকের মনে হয়, হায়, অত সব ঘটনা যেখানে ঘটেছিল, এত সুখ-দুঃখ যেখানে গজিয়েছিল, ডালপালা মেলেছিল, তার আধার এই বাড়ি কিনা সম্পূর্ণ মুছে গেল! কিন্তু এই পরিচালক একটাও স্মরণীয় ঘটনা, কোনও প্রেম কোনও কলহ কোনও নাটকীয়তাকে কাছ ঘেঁষতে দেন না। ওঁর প্রতিজ্ঞা, শুধু সাধারণ স্বাভাবিক সাদামাটা হাওয়া বয়ে চলবে। এ সংকল্প গল্প-অধ্যুষিত চলচ্চিত্র-জগতে অভিনন্দনযোগ্য হলেও, একটা সময় ছবিটা একঘেয়ে লাগে, কারণ শুধুমাত্র জীবনস্রোত ও নিখুঁত দৈনন্দিনতার প্রতিফলনের জোরে একটা ছবি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, যদি তা ছোট হয়। ফিল্মটাকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে, যেহেতু তা আমাদের অনেকের শৈশব-কৈশোর-যৌবনের কথা হুবহু মনে করিয়ে দেয় কিন্তু বাড়ি-ভাঙাভাঙির দৃশ্যগুলো একটু বেশিসংখ্যক মনে হয়, তৃতীয় ভাগটায় অ্যাক্কেবারে কোনও সংলাপ না থাকাতে একটু ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে, কারণ যা বোঝার তো বহুক্ষণ বোঝা হয়ে গেছে। ঘটনাহীন, বা ঘটনাহীনতাকে জোরের জায়গা করে তোলা ছবির ঝঞ্ঝাট হল, এর ঘোর কেটে দর্শকের বেরিয়ে আসা সহজ, কারণ একটা চরিত্রের সঙ্গেও তো আমাদের বিশেষ পরিচয় হচ্ছে না, কাউকে ভালবাসছি বা ঘৃণা করছি না, শুধু টুকরোগুলো দেখে ঘাড় নাড়ছি আর বলছি, হ্যাঁ এরকমটাই হয়। এই চিনতে পারা খুব মূল্যবান, কিন্তু একইসঙ্গে যাকে চিনছি তার জীবনে প্রবিষ্ট হওয়াটাও, বা অন্তত অংশ-ঘটনার তীব্রতায় ডুব খাওয়াটাও কম জরুরি নয়, বিশেষত যখন দর্শকের স্বাভাবিক সিনে-প্রবণতা সেইদিকেই।
তবে গৎ ভাঙারও আবেদন আছে। যখন আমরা বুঝি বহু ছোট-ছোট দৃশ্যে অনেক মানুষের সহজশ্বাস উন্মেচিত হবে, মনোযোগে সেদিকে ঝুঁকে পড়ি। ছবিটা আমাদের বদলে যাওয়া সমাজের কথা বলে, যা গ্রামকে, শেকড়কে, অতীতকে অনুতাপহীন ভাবে একলা ও অবহেলিত রেখে শহরে মজে গেছে। কিছু দীর্ঘশ্বাস ও স্মৃতিবিলাস নিঃসৃত হয়, যৌথ পরিবারের পারস্পরিকতার কথা ভেবে, রংচটা আলমারি নিয়েই সুখী থাকার সরলতা ভেবে। ক্যামেরা সারাক্ষণ স্থির ও কিছুটা দূর থেকে পর্যবেক্ষণকারী। কখনও-কখনও অনেক চরিত্র বসে কথা বলছে, কিন্তু ক্যামেরা সংলাপকারীর মুখে কিছুতে কাট করে আসে না, ঠায় একই দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো দৃশ্যটা দ্যাখে। যেন সে বাড়ির আত্মা, সাক্ষীমাত্র, অধিক কৌতূহলী নয়। ছবিটাও তা-ই, সময়ের সাক্ষী, কিছু নিরাসক্ত, এবং সম্পূর্ণ নায়কহীন— এর মধ্যে দিয়ে বহমান প্রাত্যহিকতাই এর আসল নায়ক। একলা দুপুরের নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতো ছবি, যার টলটলে জলে বহু ভাবনা উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যায়, দানা বাঁধার দায় নেই। নস্টালজিয়াকে কেন্দ্র করে এমন নিরাবেগ ভঙ্গিতে ছবি করার কথা ভাবা শক্ত, এমন নিপুণ হাতে তা সামলানো আরও শক্ত।