এই নিয়ে চার বার হল। কখনও মনে হয় প্রেশারের ওষুধের গোটা পাতাটা বোধহয় নেওয়া হয়নি। আবার মনে হয়, ঘরে পরার অর্থোপেডিক চটিজোড়া ঢুকেছে তো? গত বেশ কয়েক মাস যাবৎ ঘুম ভাঙার বেশ খানিকক্ষণ পরেও পায়ের তলাটা ঝিমঝিম করে।
বছর দশেক আগেও কোনও ট্যুরে যাওয়ার আগে বড়জোর আধঘণ্টা বরাদ্দ থাকত প্যাকিং-এর জন্য। মাঝের দশটা বছর চাকরির বাইরে থাকলেও সত্যিই কি কাজ ছিল না রায়ার? না কি যে-কাজের পারিশ্রমিক থাকে না, সেটা নিছকই পরিশ্রম?
এই নিয়ে বেশ ক’বার এপাশ-ওপাশ করল অংকুর। তার মানে এবার ঘরের আলো নেভাতে হবে। বালিশে মাথা রেখেই রায়া বুঝতে পারল সহজে ঘুম আসবে না। তবু মহালয়ার আগের রাতে মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়ার অভ্যেসটা একরকম রিফ্লেক্স অ্যাকশন! কলকাতা ছাড়ার পর এটা বারো নম্বর মহালয়া। মানে, প্রবাসে মহালয়ার এক যুগ! দিল্লিতে এই সময়টা ভোরের দিকে ঠান্ডা লাগে। এসি-র টেম্পারেচারটা সাতাশ করে, কম্ফর্টারটা আরও একটু টেনে নিল রায়া।
পাঁচ বছর পর এবার পুজোয় বাড়ি যাওয়া। একাই যাচ্ছে। একাদশীর দিন দুপুর দেড়টার ফ্লাইট-এ ফেরা। অংকুর একাদশীর দিন রাতে যাচ্ছে দুবাই, অফিস-ট্যুর। আদ্রিজা আর মহাশ্বেতার সাথে পিটার ক্যাট-এর প্রোগ্রামটা এবার যেভাবেই হোক সারতে হবে। সব ঠিক থাকলে, পঞ্চমীর দিন দুপুরেই হবে। শুধু একটাই চিন্তা। বিয়ার খেয়ে ফিরলে কেউ বুঝুক না বুঝুক, ছোট মাইমা ঠিক বুঝে ফেলবে। পঞ্চমীর বিকেলে দেখা করতে আসবে বলেছে।
কলকাতায় নাহয় ঠিক ভোর চারটেতে রেডিয়োয় মহালয়া শুরু হত। এখানে ডিভিডি প্লেয়ারে শোনা, তবু ঠিক চারটের সময়েই শুনতে হবে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আজ অবধি একটি বারও অংকুরের ঘুম ভাঙাতে পারেননি। রায়া আলতো করে অংকুরের গা ঘেঁষে ওর কপালে হাত রাখল, ‘অংকুর, মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।’ অংকুর এপাশ ফিরল। ‘হুম, শুনছি।’ বড়জোর তিন-চার মিনিট। রায়া জানে, তার মধ্যেই অংকুর আবার নাক ডাকবে!
এত তাড়াতাড়ি না বেরোলেও চলত। চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে দিল্লি এয়ারপোর্ট বিশাল কিছু লম্বা রাস্তা নয়। কিন্তু অংকুর রায়াকে নামিয়ে অফিস যাবে। বোর্ডিং পাসটা ব্যাগে ঢুকিয়ে, একবার মুখটা ধুতে গিয়ে রায়ার মনে হল, এবার একটা ফেশিয়াল করিয়ে নিলেই হত। দিল্লিতে এসবের কোনও পাট নেই রায়ার। কিন্তু এয়ারপোর্টে পা রেখেই কেমন যেন মনে হচ্ছে পাড়ার পুজোটাই গন্তব্য! এই নিয়ে কতবার যে ফেসবুকে ব্রত চ্যাটার্জির প্রোফাইলটা দেখল! শেষ আপডেট তিন দিন আগে : ‘কান্ট কিপ কাম। এন রুট কলকাতা!’
সতেরো থেকে একুশ— জীবনের এই সবচেয়ে এলোমেলো বয়সটার অনেকটা জুড়ে ছিল রায়ার ঘরের বারান্দাটা । মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে এই বাড়িতে আসা। ক্লাস ইলেভেন থেকে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত ঠিক কতগুলো বিকেল ছিল, কখনও গোনা হয়নি। কিন্তু প্রত্যেকটা বিকেল ছিল এক ছাঁচে ফেলা। হাতে সোশিওলজির বই নিয়ে, একটি মেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে আর ঠিক তার মিনিট দুয়েকের মধ্যে পাড়ার একটি রোগা, লম্বা ছেলে উলটো দিকের ব্যানার্জিদের রকে এসে বসে সিগারেট ধরাবে। যতক্ষণ সুখটান, ততক্ষণ দু’জোড়া চোখের তাকিয়ে থাকা। মেয়েটি যদি-বা মাঝেমধ্যে চোখ নামিয়ে নিত, কিন্তু পরমুহূর্তে তাকালেই দেখত ছেলেটি তাকিয়ে আছে। রোজ বিকেলের এই ঘটনা ঘড়ি ধরে ঘটত, না কি ঘড়ি চলত এই ঘটনা অনুযায়ী, কে জানে! তবে এই বোবা প্রেমের, থুড়ি, দৃষ্টি-বিনিময়ের পরিধি ছিল সীমিত। সিগারেট শেষ হলেই ছেলেটি রক থেকে চলে যেত বাড়ি আর রায়া ঢুকে পড়ত ঘরে। তখন মনে হত, ইশ, সিগারেটের যদি XL বা XXL সাইজ হত…
তবে বছরের পাঁচটা দিন বাঙালির সমস্ত কিছু যেমন বাঁধা ছকের বাইরে হয়, এই নির্বাক শুভদৃষ্টিও তাই হত। দুর্গাপুজোর পাঁচটা রাত পাড়ার ছেলেরা আড্ডা সহযোগে মণ্ডপ পাহারা দিত। যে-রাতগুলো ব্রত সেই দলে থাকত, রায়াও ঠায় বসে থাকত অন্ধকার বারান্দায়। বড্ড ভাল গাইত ব্রত। কখনও কফি হাউস, কখনও বেলা বোস…
ল্যান্ডিং অ্যানাউন্সমেন্ট-এ ঘুমটা ভাঙল। ভাগ্যিস জানলার ধারের সিটটা কেটেছিল অংকুর। দেবীপক্ষের কলকাতার আকাশটা প্রাণ ভরে দেখল রায়া।
পার্ক স্ট্রিট থেকে ফেরার পথেই রায়া ঠিক করে নিল দশমী অবধি আর বেরোনো নয়। এত ভিড় আর ভাল লাগে না আজকাল। মহাশ্বেতাটা এখনও নিজেকে কী সুন্দর রেখেছে! চাকরি আর নাটক, দুটোই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে।
আজ অষ্টমী। বেশ কয়েকবার ফেসবুক ঘাঁটা হয়ে গেছে, নতুন কোনও আপডেট নেই। অনেক কিছু ভেবে, অষ্টমীর অঞ্জলির শাড়ি-ব্লাউজ আগে থেকেই আলাদা করা ছিল। এখন আর পাড়ার ইয়ং ব্যাচ রাতে মণ্ডপ পাহারা দেয় না। সিকিউরিটি এজেন্সির লোক থাকে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড অদ্ভুত ঠেকছে। এসব কেন মাথায় আসছে? মানসিক বিকার না স্রেফ খামখেয়াল? সব হচ্ছে— আলোর মালা, ঢাকের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ, মাইকে অঞ্জলির মন্ত্র… অথচ সব কিছুর মাঝে যেন একটা বিরাট খালি জায়গা, যার সবটা জুড়ে একটা অদ্ভুত ছটফটানি!
দশমীতে এ-বছর বার বার করে যেতে বলেছে বড়মামা। কত বছর পর বাড়ির পুজোতে যাওয়া। আজ ওখানেই ঠাকুর বরণ করে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ফেরা। রাতে অনেকটা সময় চলে গেল প্যাকিং-এ। মা যে-হারে নারকোল নাড়ু আর নিমকি পাঠাচ্ছে, লাগেজ ওভারওয়েট না হয়ে যায়! আজ বৃহস্পতিবার, তাই পাড়ার ঠাকুর বিসর্জন কাল। জিনিসপত্র সব এখনও ছত্রাকার হয়ে আছে। এবারের আসা-যাওয়াটাই যেন কেমন অগোছালো। আজ অনেক রাত অবধি মায়ের সাথে গল্প করেছে রায়া। এগারোটা নাগাদ প্রায় জোড় করেই মা’কে শুতে পাঠাল। মা দশটার মধ্যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেন।
এত বছর পর মশারির মধ্যে শোওয়ার জন্য ঘুম আসতে দেরি হয়। একটু ঝিম এসে গিয়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙল হাসির রোলে। মোবাইলে দেখল রাত পৌনে দুটো। কথাবার্তার মাঝে কেউ একজন গিটারের স্ট্রিং সেট করছে। এক ঝটকায় মশারির বাইরে এল রায়া। জানলার পর্দাটা অল্প সরিয়ে নীচে তাকাল। সব কিছু ঘোলাটে হয়ে গিয়ে ফোকাসে এল একজন ছিপছিপে, লম্বা পুরুষ! এক লহমায় কতগুলো বছরের ফ্ল্যাশব্যাক— চোখে তার এখন চশমা, চুল বেশ কিছুটা পাতলা হয়ে গেছে, ট্র্যাক প্যান্ট আর টি-শার্ট। হাতে গিটার। কোরাসে, ‘ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল/ এইটুকু সম্বল…।’
কিন্তু, রায়া এক ছুটে বারান্দায় যাওয়ার সাহসটা পাচ্ছে না কেন? সেই মেয়েটা তো এত ভাবত না! পা-দুটো টনটন করে ওঠায় রায়া ঘড়ি দেখল। প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট একনাগাড়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মণ্ডপের আসর প্রায় ভোর পৌনে তিনটে নাগাদ ভেঙেছিল। বাকি রাতটা আর ঘুম আসেনি।
প্যাকিং শেষ। সুটকেস ছাড়াও দুটো ব্যাগ। অংকুর আসতে পারবে না এয়ারপোর্টে, তবে গাড়ি বুক করে নম্বরটা পাঠিয়ে দিয়েছে। বোর্ডিং পাস হাতে পেয়ে রায়া অংকুরকে একটা ফোন করল। ‘তোমার লাগেজ রেডি?’ ওদিক থেকে অংকুরের উত্তর এল, ‘সেকী! সব ঠিক আছে তো?’ রায়া একটু অবাক হল। ‘কেন?’ এবার অংকুর সহাস্যে বলল, ‘না, আসলে এ ক’টা দিন একবারও তো নিজে থেকে ফোন করোনি! দেখো বাবা, শুধু পুজোর আনন্দ তো, না কি কোনও পুরনো প্রেমিক-টেমিক?’
প্রথম সমুদ্রে নামার সময় বাবা শিখিয়েছিলেন, ‘খুব উঁচু ঢেউ এলে ভয় পাবি না। বড় করে শ্বাস নিয়ে তারপর নীচে ডাইভ করবি।’ অংকুরের শেষ মন্তব্যটাও ঠিক সেভাবেই সামলে নিয়ে রায়া বলল, ‘তুমি ট্যুর থেকে ফিরলে, চলো না দিল্লির কাছাকাছি কোথাও দিন তিনেক ঘুরে আসি।’
প্লেনে বসে অনেকদিন পর আজ নিজের ফেসবুক প্রোফাইলটা খুলল রায়া। পোস্ট করল, ‘এন রুট হোম!’ চোখ মুছে রুমালটা ব্যাগে রাখার সময় খেয়াল হল, এবারের কাজলটা সত্যিই ওয়াটার প্রুফ!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র