মাছগুলো ভাজা সারা। শেষে মুড়োদুটো তেল ছেঁকে তুলছি, এমন সময় বেলটা বাজল। মনটা তখনও মুড়ির ঘণ্ট আর মাছের মাথা দিয়ে লাউ-এর মাঝখানে পেন্ডুলামের মতো দুলছে। দরজা খোলার আগে দেখে নিলাম, ফুটোর ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ছোটখাট চেহারার গোলগাল বয়স্কা সুন্দরী। খুলতেই ফুশিয়া-লাল লিপস্টিক ঘেরা একগাল হাসি।
‘মাছ ভাজছেন?’ ভেঙে-ভেঙে স্পষ্ট বাংলায় বললেন তিনি।
বাংলার বাইরে কেউ বাংলা ভাষায় মাছের খবর নিচ্ছেন! আপ্লুত হয়ে তাঁকে তো আমি, ‘এসো বহিন, বসো বহিন, খাট পেতে দিই, মাছ ভেজে দিই, খাবে বহিন?’ বলে ফেলেছিলাম প্রায়।
খুব চেক করে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ, কেন?’
অ্যাদ্দিনে জেনে গেছি, এসব এলাকায় আমিষ জিনিস আনিয়ে, রেঁধে খাবার জন্য যথেষ্ট বুকের পাটা লাগে। আর অচেনা-আধচেনা কাউকে সেধে ও-জিনিস খাওয়াতে গেলে উলটো গুড়ুম হয়ে যাওয়ার চান্স ষোলো আনা।
উনি পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, রোজই কি রাঁধেন? কে রাঁধেন? আপনি?’
আমি একটু থতমত। তাও তো শুঁটকি রাঁধিনি! কাতলার গন্ধ পেয়েই আঁটঘাঁট বেঁধে এসেছে। এইবার নির্ঘাত আমার ল্যান্ডলর্ডকে গিয়ে লাগাবে।
প্রশ্ন থামছেই না। ‘কোত্থেকে আনান? কীভাবে আনান?’
এ-অবস্থায় আমি হঠাৎ মহিলার চোখের মধ্যে একটা চিকচিকে লোভ দেখতে পেলাম। টম অ্যান্ড জেরি-র জেরি ইঁদুরের চোখে যেমন হঠাৎ-হঠাৎ ‘টঁইই’ করে একজোড়া তেকোণা চিজের টুকরো উঁকি মারে! তেমনি ওঁর চোখেও আমি দু’টুকরো মাছের পেটি দেখতে পেলাম যেন।
ভরসা পেয়ে বললাম, ‘এক পিস ভাজা দেব? খাবেন?’
উনি বললেন, ‘ভাজা? না না, আবার ভাজা কেন?’ বলতে-বলতেই চোখে খিদে আর মুখে লাজের মধ্যে দূরত্ব হয়ে দাঁড়াল ঠিক মাইনাস দু’সেকেন্ড।
এবার বাজারের থলি আচমকা উলটে দিলে যেমন এদিক-সেদিক লেবু, কুদরি, উচ্ছে, টমেটো মুক্তবিহঙ্গ মনে গড়াগড়ি করে, তেমনি মন খুলে বলে গেলেন তিনি। শুরু হল, ‘ইয়ে, রাঁধুন না একটু মশলা দিয়ে কষিয়ে?’ তারপর, ‘কোনও চিন্তা নেই, আমি বসছি ততক্ষণ!’ কিম্বা ‘আরও বেটার হয় যদি প্যাক করে দিয়ে দেন দু’বাটি!’ একটু পরেই, ‘আচ্ছা, না তিন বাটি করে দিন। আমি, শর্মাজি আর সেলফি।’ এবং অবশেষে, ‘বড় টিফিনবক্স আছে তো?’ পরে জেনেছি উত্তরাখন্ডের মেয়ে। খড়গপুরে বড় হবার সুবাদে বাংলা বলেন গড়গড় করে।
অত্যাচারের সেই শুরু। এরপর থেকে প্রায় রোজই সকালের দিকটায় যেই না মাছ ভাজতে শুরু করি, অমনি মিনিট সাতেকের মধ্যেই ‘আয় রে ছুটে আয়, মাছের গন্ধ এসেছে’— করে কোত্থেকে যে শুঁকে-শুঁকে ব্যাগ কাঁধে টিপটপ হয়ে এসে হাজির হয়ে যান!
২.
মঙ্গলবার আমি আলু-পটলের ঝোলে ক’টা মাছ বেশি দিলাম। ওঁর কথা ভেবেই। যথাসময়ে উনি এসে, মিষ্টি হেসে, টিফিনবাক্স গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। সাথে একটু জিজ্ঞাসাবাদও করে গেলেন, আমি দুপুরে বাড়ি থাকি কি না, থাকলে ঘুমোই কি না, ঘুমিয়ে পড়লে উঠে দরজা খুলি কি না ইত্যাদি।
বুঝলাম, আসলে জানতে চাইছেন যখন-তখন হামলা করা যায় কি না! এইবার আমি একটু ভয় খেলাম। যতই ফেসিয়ালের গ্লো থাকুক, মহিলা আদতে মা-শাশুড়ির মতোই বিপজ্জনক-বয়সি। মাছটুকু ছাড়া আর কোনও কিছুই কমন নেই তেমন আমাদের। তা নিয়ে আর কতক্ষণই বা বকা যায়? পাশাপাশি আবার একটু যে আহা-উহু হচ্ছে না মনের মধ্যে, তা নয়। নাহয় একটু মাছই খেতে চাইছে, নাহয় দাতা কর্ণ হয়ে বসলামই একটু মাছসত্র খুলে!
টিফিনবাক্স নিয়ে ফেরত এলেন পরদিন। এসেই বললেন, ‘কী সব পটল-ফটল দিয়েছেন, ওসব আর দেবেন না কাল থেকে। বরং আরেক পিস করে মাছ বাড়িয়ে দিন। শর্মাজি তো আমার থেকে হাফ মাছ নিয়ে নিয়েছেন। আর একটু গুঁড়ো লঙ্কা বেশি করে দেবেন। আমরা আবার একটু বেশি ঝাল খাই।’
আমি অপ্রস্তুত রকমের হাঁ হয়ে হোম ডেলিভারির ফিডব্যাক শুনলাম। একটু গোঁসা হল ঠিকই, তবু আবার ভাবলাম মহিলা সোজা ব্যাটে মনের কথা বলছেনই যখন, তখন কী আর এমন হাতি-ঘোড়া ব্যাপার! নাহয় একটু ঝাল বেশি দিয়ে দুটো মাছ বেশি খাওয়ালামই উদ্বিড়ালিকে। একবার বলার চেষ্টা করেছিলাম, ‘বাড়িতে আনিয়ে রাঁধেন না কেন? অত কিছু কঠিন রেসিপি না!’ তাতে পেটুকমণি গম্ভীর মুখ করে বলেছিলেন, ‘অ্যালাউড না তো! আমার বাড়িওয়ালা সাংঘাতিক। কিচেনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে।’ আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি, আবার গিয়ে ভেরিফাইও করা হয়নি।
এর মাঝে ফোন নম্বর নিয়ে গেছেন। হোয়াটসঅ্যাপে রেসিপির পর রেসিপির বোম পড়েছে। আমি দেখেও দেখিনি। সরকার বাহাদুরের মতো উদাস থেকেছি। একদিন সকালে ছানাকে স্কুলের জন্য তৈরি করছি, এমন সময় কোলে একটা বেগুনি ঝুঁটি বাঁধা শিৎজু কুকুর নিয়ে দেবী প্রকট হলেন। কুকুরটি ভেড়ার ছানার মতো ছোটখাট, ঢুলু ঢুলু, আদুরে। উলুঝুলু-ফেদার কাট লোমে চোখ-মুখ প্রায় দেখাই যায় না! বললেন, ‘এ হল আমার সেলফি। মাছের ব্যাপারটা সবই ঠিক আছে, তবে ঝাল-ঝোলটা সেলফির সহ্য হচ্ছে না, ওর জন্য একটু সেদ্ধ দু’পিস করে দিলে চমৎকার হয়!’
শুধুমাত্র বাঙালির মান রক্ষা করতে কতবার যে হাত মুঠো করে ঘুষি পাকিয়েও জাস্ট কয়েকটা আঙুল মটকে শান্ত করে নিয়েছি নিজেকে তার ইয়ত্তা নেই! এই যেমন সেদিন রাস্তায় কমলা কুর্তিঢাকা ছোট ভুঁড়ি দিয়ে পথ আটকে বলেন, ‘একদিন জমিয়ে ইলিশ রাঁধুন তো সরষে দিয়ে? পেটির পিসগুলো দেবেন, কেমন?’
এ-ঘটনার পর থেকে বেল বাজলে আমি ফুটো দিয়ে দেখি। ভাবি আর খুলব না। দু-তিন বেলে না খুললে সাধারণত লোকজন কেটে পড়েন। তা ওঁর আলাদাই ব্যাপার! ডান হাতে কালো চৌকো ডায়ালের স্মার্ট ওয়াচ। সে-ঘড়িতে নটা উনত্রিশ হতে-না-হতে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন আমাদের কলিংবেলে। জেনে গেছেন সাড়ে ন-টা নাগাদ আমার রান্না চাপে। অনলাইন টিকিট কাটার মতো সিরিয়াস মুখ করে বেলের সুইচে রিফ্রেশ দিতে থাকেন। আর মাঝের সময়টায় পায়চারি করে করে ফুটস্টেপ বাড়িয়ে নেন।
‘ক্লান্ত প্রাণ এক’ হয়ে আমি একদিন গুগলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাউ টু কুক ফিশ উইদাউট স্মেল?’ অর্থাৎ ফিসফিসিয়ে মাছ রাঁধা হয় কী করে? শোনামাত্র গুগল বলল, ‘মাছটাকে জলে দিয়ে পোচ করে খাও।’ কী জ্বালা! জলের মাছ জলেই দেব যদি, তবে তুলে আনা কেন বাপু? এমনিতে তো মামা সবই জানে! আঙ্কোরভাটে আমের আচার খেয়ে আলিয়া ভাটের কেন অ্যাসিডিটি, তাও। খালি আমার দরকারের বেলায়… হুঁঃ!
তবে কি নিজ্জল ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাওয়াই কপালে আছে আমার? নিরামিষ মেনু বিড়বিড় করলাম কিছু। খিচুড়ি-বেগুনভাজা আর ডাল-ভাত-আলুপোস্তর ওদিকে সবটাই খাঁ খাঁ। তার চেয়ে বরং ভেগান হয়ে যাওয়া ভাল। আরও ট্রেন্ডি। ভেগান হওয়া আর কঠিন কী! এই দুধ, মধু এসব পশুকুলের সম্পত্তিতে লোভ না দিলেই হল। সাইমনের জায়গায় ‘পশুধন গো ব্যাক’ (টু পশুগণ)! কিন্তু প্ল্যানটা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ল। আমার অহিংস নীতির এক হপ্তাও ঘুরল না, অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল বাড়িতে।
৩.
ওদিকে উদ্বিড়ালির উপর আমি মহা খাপ্পা। উঠতে-বসতে সদাই কুমিরের মতো দাঁত কিড়মিড় করি। কেন? না, ‘মাঁচ খাঁবঁ, মাঁংসঁ খাঁবঁ’ করে হাত-পা ছুঁড়লেই তো আর হল না! বাড়িতে মাছ-মাংস আনানোটা এখানে বেশ একটা গোপন গা-ছমছমে মিশন। তাতেও কাঠি করার লোকের অভাব পড়ে না। এই যেমন এক কেজি চিকেন, একটা ভেটকি অর্ডার করা হল আর প্রতিবেশী নিরামিষবাবু অর্ডারের কাগজ ছানবিন করে আমিষ আসছে টের পেয়ে গেলেন। অমনি ‘ভুল অ্যাড্রেস’ বলে ডেলিভারি বয়কে একদফা কড়কে, টুক করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল। তারপর ধরুন বাজার করে ফিরছেন অটোয় চড়ে, এমন সময় লিস্টি মেলানোর ফোন এল। আপনি বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আন্ডাফান্ডা সব নিয়ে নিয়েছি।’ ব্যস! অটোওয়ালা ‘জলদি উতরিয়ে! আভি উতরিয়ে!’ করে ধড়ফড় করে নামিয়ে দিল মাঝরাস্তায়। আপনি নাকি এঁটো করে দিয়েছেন তার অটো। এবার আপনি কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারবেন না যে, এঁটো যখন হয়েইছে বাপু, তা একেবারে পৌঁছে দিলেই পারতে! এখুনি মেইন রোডের উপর দিয়ে তো আর গঙ্গানদী বইছে না!
আরও কুটকুটে কম্বুলে একখান ব্যাপার আছে। পিওর ভেজের এই হু হু মরুভূমিতে ননভেজের মরীচিকা কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। সে ফুডকোর্টই হোক বা ফুটপাত! আসলে যে মনে পাপ! ধরুন মেনুবোর্ডে লেখা ‘বারবিকিউ স্যান্ডুইচ’। পড়ে ফেলেছেন যদি তাহলে তো আর নিস্তার নেই!। পাপী মন চিকেনের জন্য অসহায় হয়ে উঠবেই। কিন্তু কিছু করার নেই। বিল মিটিয়ে পেট কাটবেন। পাবেন কচরমচর বাঁধাকপির পাতা। বিরিয়ানি কর্নারের নামে ‘পিওর’ ভেজ কানমলা খেয়ে গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করতে হবে বার বার— ‘আবার আসিবে ফিরে, ভেজ বিরিয়ানির তরে, এ কে হ্যাংলা!’ ডমিনোজের ছবি দেখে, জিভ দিয়ে লালা ঝরবে প্যাভলভের কুকুরের মতো। কিন্তু পাবে সেই চিজ আর টমেটোর ঘণ্টাটি!
ঘরে-বাইরে এত গঞ্জনা সয়ে রেঁধে খাই। তাতে কেউ উড়ে এসে খুঁড়ে গেলে গাল ফুলবে না? একটা নির্বিষ প্রতিশোধ নিতেই হত। অল্প শয়তানি করলাম। আমার ফিশি পড়শিকে নেমন্তন্ন করে দিলাম সত্যনারায়ণের সিন্নির দিনে। পুজো-টুজোর ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কিছুই বললাম না, খালি ‘আসবেন, কেমন?’টুকু অবধি। পর পর ক’দিন আমার মাছসত্রের স্ট্রাইকের পর সেদিন এসে মলিন মুখ করে কিচেনের চিমনি শুঁকে গেলেন দু’বার। প্রসাদী ফিসফ্রাই-কাবাবের আশায় সিন্নির ঝোল ঢেলে দেওয়াতে মাননীয়া বড়ই আহত হয়েছিলেন সেদিন।
এসব করেও খুব একটা দমানো গেল না। পাশাপাশি অন্য একটা ব্যাপারও হচ্ছিল অবশ্যি ক’দিন ধরে। গত সপ্তাহের ভেগান ডায়েটের খামতি পুষিয়ে নিতে এখন মাছের সাথে নতুন করে যোগ হয়েছিল মাটন, বেকন আর সসেজের সুবাস। সেই শুঁকে-শুঁকে বেগুনি-ঝুঁটি সেলফি, তার ছোট্টো জিভ বার করা ‘হ্যা হ্যা’ সমেত হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় করে টেনে নিয়ে আসতে লাগল আমাদের মছলিবিবিকে। অতএব মাটন, বেকন, সসেজের রেশনেও এবার থেকে থাবা পড়তে লাগল। নিয়মমাফিক।
প্রথম-প্রথম সেলফি আসত তাইলং বেড়ালের পিছু-পিছু। আজকাল আর কারো সঙ্গের ধার ধারে না। নিজের জিভের তাগিদেই আসে। এদিকে বিড়ালেরা তো আসলে সিভিল পোশাকের পুলিশ! আর তাইলং তাদের দারোগা। বিড়ালে-কুকুরে এখন দুধওয়ালা-কাগজওয়ালার মতন রোজ সকালে হত্যে দিয়ে যায়। এসব খবর ঠিক কানাকনি হয়ে চলে যাবে। পরের মাসে বাড়িওয়ালা এসে লম্বা-চওড়া একপ্রস্থ শুনিয়ে যাবেন। ভাড়া বেড়ে হবে দেড়গুণ। মোটামুটি তৈরি আমি।
৪.
সেদিন মেঘলা দুপুরে ইলিশের তোলা জমা-টমা করে বিকেলবেলা চরতে বেরিয়েছি। অসহায় মনে উড়ালপুল-ঘেঁষা রাস্তায় সতেরো-আঠেরো-উনিশ করে-করে লাল অ্যাক্টিভা গুনছি। এমন সময় এক মাতালের সাথে দেখা। ‘সাথে দেখা’ বলা ভুল। কারণ তার হাফচেরা লাল চোখ তো তখন অন্য দুনিয়ায়!
প্রথমটায় মাতাল বলে অত বুঝিওনি। তারপর যখন দেখি রাস্তার চৌমাথায় ট্র্যাফিককে থমকে থ করে দিয়ে মহোদয়ের সঙ্গে সিন চলছে এক চকচকে শিং অনিচ্ছুক গোমাতার, তখন অগত্যা অ্যাক্টিভা গোনায় ক্ষান্তি দিয়ে পথনাটিকায় মন দিলুম। কালো শিং-এর চকচকে উঁচু হাড়িকাঠটিতে মাতাল নায়ক আজ গলা দেবেই দেবে। সে নাহয় হল! কিন্তু এই নিরামিষ জামুন শটের দেশে খুল্লমখুল্লা একটি বিশুদ্ধ মাতালের উপস্থিতি! ভাবা যায়? এ-দৃশ্য আমাকে সেই ছাইপাঁশ বাক্যটি মনে করিয়ে দিল, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
উড়ালপুলটি আমার ঠিকানার একদম কাছেই। মনে-মনে ছাই ওড়াতে-ওড়াতে খেয়াল হল, এখানে মেইন রোড থেকে দূরে পিছনের দিকে অলিগলির মতো একটা এলাকা আছে। বিচিত্র এই ভারতভূমি! এখানে গাভীরা সিংহের মতো চরে, আর সিংহেরা গাভীর মতো। উড়ালপুল মার্কেটে আমার যাতায়াত বেড়ে গেল ৷ কখনও নারকোল, কখনও ঝাঁটা তো কখনও শালগমের খোঁজে। আসলে আমার চোখ কিন্তু আপাতত বড় শিং নয়, ছোট শিং কেসের দিকে। ছুটকো মুরগা-টুরগায় মন উঠবে না দেবীর। একটু নাটকীয় ব্যাপার, খানিক শো-অফ না হলে খাল কেটে কুমির বার করা কি আর এত সোজা? সেদিন সকালে ফুল কিনতে গিয়ে খবরি ডাবওয়ালা কনফার্ম করল। কী না, মাথায় পাগড়ি-কানে মাকড়ি ভাইলোগেরা বকরি উৎসব করছে।
অর্থাৎ তাঁরা এখনও আছেন। বাঙালি ছাড়াও, এ-উপমহাদেশের বাণপ্রস্থ বনে, আরও বহু কিসিমের হরিণ এখনও বহাল তবিয়তে ঘাস খেয়ে বেড়ান। অবশ্যই নিজ-নিজ পকেটে বসে। এ-ভাইলোগদের অল্পবিস্তর চিনি। রোজের রোজ কাজেকম্মে থাকা দরাজদিল লোকজন। এক সময় দড়ির খাটে বসে তাদের ছানাদের পড়িয়ে গেছি। দুইবার পাত পেড়ে খাইয়েওছে। হাল-হকিকত মোটামুটি জানা। রেডি হয়েই ছিলাম। সাড়ে ন-টার বেলে আমিষজান আসতে-না-আসতেই তাকে, শেয়ালে যেমন করে বাঘ ধরে নিয়ে যায়, অমনি করে তাকে পাকড়াও করে নিয়ে চললুম। উড়ালপুল চত্বরে, সিংহের মামা নরহরি দাসেদের তল্লাটে।
বকরির ছালের ভিতর তখন ঢেলে মশলা মাখানো চলছে। হলুদ আর লঙ্কাগুঁড়ো মিলে কমলা ধুনো উড়ছে বাতাসে। আদা-রসুনাদির অঞ্জলিপুষ্প ঠেসে ভরে দিয়ে খেজুর পাতা দিয়ে ফটাফট তার পেট সেলাই করে দেওয়া হল। এরপর মস্ত আগুন হল। ডেকচি-ফেকচি কড়াই-টড়াই-এর বালাই নেই। চৌমাথায় একজন মাথায় খাটো-পাকানো গোঁফ রণবীর সিং, সিড়িঙ্গে মতো দুজন দাড়িয়াল বিরাট কোহলি আর বাকিজন চোখে-পড়ে-না ধরনের এক্সট্রা আর্টিস্ট একটা করে কঞ্চি বাঁধা বকরি ঠ্যাং হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। মধ্যিখানে কাঠের হু-হু আগুনে জড়াতে লাগল সেটাকে।
এদিকে ম্যাওমতী মেপে নিয়েছেন। প্রেমিকার মতো একরাশ গুনগুনে মুগ্ধতা তার চোখের আগুনে। মাটনের প্রতি যেমত রসনা তার লক্ষ করেছি, ‘মিস ফিশ’ থেকে ‘বকরি আঁকড়ি’ হয়ে ওঠা খালি সময়ের অপেক্ষা। বিশুদ্ধ ননভেজের দেদার প্রতিশ্রুতি ভাসছে বাতাসে। তিনি হিল খুলে পিঠ টানটান করে, পা গুছিয়ে বসলেন দড়ির খাটে। সাঁটাবার আগে খানিক যোগা-টোগা করে নেবেন মনে হয়। আদা-রসুনের চনমনে গন্ধ বেরোতে শুরু করেছে এইবার। ঘোমটা-টানা ঝমঝমে সাজুগুজু বিবিদের সাথে মন-হাট-করা কথা চালাচালি শুরু হয়ে গিয়েছে অলরেডি।
‘বেহেনজি, কবে-কবে রান্না হয় বকরি?’, ‘অন্যদিন কী রাঁধেন?’, ‘মুরগা কি আলু দিয়ে বানান?’, ‘দুপুরে ক’টা নাগাদ খাওয়া হয় আপনাদের?’, ‘স্টিলের টিফিনবাক্স আছে?’…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র