দাদুকে আমার তেমন করে মনে নেই। তবে গোটা দেশের মানুষের কাছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কথা এত শুনেছি যে তিনি আমার মনে জ্বলজ্বল করছেন। তবে দাদুর চেয়ে আমার ঠাকুমা বাসন্তী দেবী ছিলেন আমাদের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী। তাঁর সঙ্গেই আমাদের বেড়ে ওঠা। তাঁর প্রভাবে, তাঁর শিক্ষায় ভারতকে চিনতে শেখা।
ঠাকুমা ছিলেন লোরেটো হাউসের ছাত্রী। তখন লোরেটো হাউসে দুটি ভাষা শেখানো হত—ইংরেজি আর ফরাসী। বাড়িতে বাংলা শিখেছিলেন। পরবর্তী পাঁচ প্রজন্ম ধরে সেই ধারাই চলেছে। আমরাও বাড়িতে বাংলা শিখেছি। এবং অত্যন্ত যত্ন নিয়ে শিখেছি। আমাদের পাশের বাড়িতে কয়েকমাসের জন্য থাকতে এসেছিলেন কমলা নেহরুজী আর ইন্দু (ইন্দিরা গান্ধী)। শান্তিনিকেতন যাওয়ার আগে আমার বাংলা শিক্ষকের কাছে তিন মাস বাংলা ভাষা শিখেছিল ইন্দু। আমরা স্কুলে পরে যেতাম খাদির কাপড়ের নীল রঙা স্কার্ট আর সাদা শার্ট। স্কুলে বাধা পাইনি কখনও। কারণ ইংরেজ আমলে আইরিশ নান-রা ছিলেন আমাদের সহায়।
ঠাকুমা বাসন্তী দেবী ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি কারাবরণ করেন। ঠাকুমা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি ঠাকুমার সঙ্গে হরিপুরা কংগ্রেস, ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনে গিয়েছি। একদম কাছ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপান্তর দেখেছি। ঠাকুমা মেয়েদের নিয়ে আলাদা সংগঠন তৈরি করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। দাদু জেলে যাওয়ার পর, দাদু যে পত্রিকা প্রকাশ করতেন ‘বাংলার কথা’— সেটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঠাকুমা। ফলে আমার স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরো অভিজ্ঞতাটাই হয়েছে ঠাকুমার মাধ্যমে। এ ছাড়া বাড়িতে তখন বহু বিপ্লবীদের আনাগোনা ছিল। আর সুভাষকাকা (নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু) নিয়মিত আমাদের বাড়ি আসতেন। ঠাকুমার সঙ্গে রাজনৈতিক পরামর্শ করতেন। কখনও কখনও এসে ঠাকুমাকে বলতেন, ‘বৌঠান, খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দাও।’ ঠাকুমা তখন উনুন জ্বেলে ভাতে-ভাত করে দিতেন আর সুভাষকাকা কী তৃপ্তি করে খেতেন।
আমার মনে আছে, আমার বিয়ের নেমতন্ন করতে গিয়েছিলাম সুভাষকাকাকে। তিনি তখন গৃহবন্দি। কিন্তু আমরা বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলাম। নেমতন্ন কার্ডটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘পারলে তো নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু কী মনে হয় বৌঠান? যেতে পারব বিয়েতে?’ যে দিন আমার বিয়ে, সেই দিনই সুভাষকাকা বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তাঁর বিখ্যাত নিষ্ক্রমণ। পরে মনে হয়েছে, আমরা যখন দেখা করতে গিয়েছি, তখন সুভাষকাকা সবটাই হয়তো জানতেন, তাঁর পরিকল্পনা করাই ছিল।
অনেক আন্দোলন আর আত্মত্যেগর পর যে স্বাধীনতার দিনটি এল, সেটা বড় সুখকর ছিল না আমাদের কাছে। ঠাকুমা খুব ভেঙে পড়েছিলেন আর অঝোরে কেঁদেছিলেন। তারপর থেকে আর নিউমার্কেট যেতে পারতেন না ঠাকুমা। চোখের সামনে এত তরতাজা সব ছেলেদের রায়টে মরে যেতে দেখেছেন যে জায়গাটাই তাঁর কাছে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। এমন খোলা পরিবেশে তিনি ছিলেন, তাঁর পুত্রসম সুভাষকাকা আজাদ-হিন্দ-ফৌজ তৈরি করেছিলেন যেখানে ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই স্থান পেয়েছিল, সেই ভারতে এমন দাঙ্গা ঠাকুমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল।
এতগুলো দশকের সাক্ষী থাকার পর, একশো-এক বছর বয়সে আজ কিন্তু আমার মনে হয়, ভারত দেশ হিসেবে খুব কম উন্নতি করেনি। বিশেষত নারীরা অনেক এগিয়েছে। সব ক্ষেত্রে তো বাধা থাকেই। তাই অসাম্যও কিছু থাকবে। ক্ষোভ থাকবে। এখন সবাই দুর্নীতি নিয়ে এত চিন্তিত। সত্যিই চিন্তার বিষয়। কিন্তু অন্য ভাল দিকগুলোয় দেখা দরকার। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কি উন্নতি করেনি, শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি করেনি? আমার দাদু চিত্তরঞ্জন দাশ যখন তাঁর বাড়ি দান করে দেন হাসপাতাল তৈরি করার জন্য, তখন আমাদের পরিবারের কাছে থাকার কোনও জায়গা ছিল না। তখনকার মানুষরা সম্ভবত এতটাই স্বার্থহীন হতেন। কিন্তু এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে যদি তাঁদের মতো মানুষ খুঁজতে যাই, সেটা বোকামি হবে। ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন দুর্নীতির হইহই রব উঠল চারিদিকে তখন ঠাকুমা বলেছিলেন, ‘তোমাদের দাদু স্টেজটি তৈরি করে দিয়ে গেলেন কিন্তু বাঁদরনাচটা আর দেখতে পেলেন না’। সেটাও নিশ্চয়ই অত্যন্ত কষ্ট থেকে বলেছিলেন। কিন্তু আমার কোথাও মনে হয়, হয়তো বা আমরা ভারতের মতো একটা বিশাল জনসংখ্যার দেশের কাছে একটু বেশিই আশা করে ফেলেছি। আর যদি মানুষজন আশা করেন যে, এখনও লোকজন চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসু, গান্ধীজীর মতো আত্মত্যাগ করে, আদর্শে স্থির থেকে দেশের কথা ভাববেন, তা হলে সেটা ভুল।
এক একটা সময় আসে তার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে, নিজস্ব কিছু মানুষ নিয়ে। তা আর পুর্নবার হয় না। সেই সময়টা হয়তো এই সব মানুষদের তৈরি করেছিল। এই সময়টা হয়তো তেমন মানুষ তৈরির হওয়ার পক্ষে যথাযথ নয়।