অস্পষ্ট সাদা-কালো সিনেমা থেকে রং-ঝলমলে টেকনিকালার জগতে সিমি গারেওয়ালের প্রবেশ ছিল যেন এক অনায়াস লালিত্য ও অনবদ্য স্টাইলের রূপকথা। তাঁর নিজের প্রজন্মের কাছে অপরূপ সুন্দরী অভিনেত্রী সিমি যদি এই চলন তুলে ধরেন, পরের প্রজন্ম তাকে চেনে ‘কর্জ’-এর মোহময়ী হিসাবে। আরো পরে, তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় টেলিভিশনের সবচেয়ে বিখ্যাত ইন্টারভিউ শো-এর হোস্ট, যা নব্বইয়ের দশকের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের দেশের ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেয়। একটা গোটা দেশের সন্ধ্যাবেলাগুলো কেটেছে ‘রঁদেভ্যু উইথ সিমি গারেওয়াল’-এর নিখুঁত, শ্বেতশুভ্র সেটে বসা ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী, বিখ্যাত পুঁজিপতি, চলচ্চিত্রতারকা এবং ক্রিকেটারদের গোপনতম কথা শুনে।
মধ্যরাতে জন্ম সিমির। এক কথায়, ভবিষ্যতের বিনোদন-হাওয়া কোন পথে বইবে, তা সঠিক ভাবে দেখাই যেন সিমিকে সংজ্ঞায়িত করে, এই কারণেই তিনি চলতি-চলনের চেয়ে সবসময় এগিয়ে থাকেন। ৭৫-এ পৌঁছে সিমি তাঁর স্বপ্ন এবং আগামীদিনের পরিকল্পনা নিয়ে বেশি উত্তেজিত। সেই কারণেই বোধহয় তাই তাঁর ছয় দশকের কেরিয়ার নিয়ে স্মৃতিচারণ আরো কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতের আগামীকাল নিয়ে উত্তেজিত সিমি; তার অতীত নয়, এমন কী বর্তমানের যা-কিছু তাঁকে সাময়িকভাবে চিন্তিত করে তোলে, তা নিয়েও না।
১৯৪৭-এ পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্ম সিমির, বড় হয়ে ওঠা ইংল্যান্ডে। ‘আমি ক্রুসেড আর টিউডরদের সম্বন্ধে জেনেছিলাম, আমার নিজের দেশের ইতিহাস পড়ে উঠতে পারিনি। আমাদের পাঠ্যক্রমে ভারতীয় ইতিহাসের কোনো রেফারেন্স ছিল না, এমন কি ব্রিটিশ কলোনি হিসাবে ভারতবর্ষের পরিচিতিটুকুও না,’ বলেন সিমি। প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক সিমি যখন প্রথমবার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন, মানিয়ে নিতে তাঁর বেশ অসুবিধা হয়, কেননা ইংল্যান্ডের কাটানো সময়ের থেকে ভারতীয় জীবন এবং অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই আলাদা।
‘ষাটের দশকের ভারতে আমি একেবারেই বেমানান ছিলাম, এবং অনেক কিছু বুঝতে আমার খুবই অসুবিধা হয়েছিল। এ-দেশের সিনেমার সঙ্গে বোঝাপড়াটা আরো কঠিন ছিল, বিশেষত সেই সিনেমায় যেভাবে মহিলাদের দেখানো হত,’ বলেন সিমি। সেই সময়ের ভারতীয় চলচ্চিত্রে নুয়ে পড়া, হার-মেনে নেওয়া মহিলা চরিত্রদের সঙ্গে সিমি একেবারেই একাত্ম হতে পারতেন না, যে-কারণে বহু বড় ছবি তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়। ‘এখন শুনলে মনে হবে পাগলামি, কিন্তু আমি ভীষণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। লন্ডনে থাকাকালীন আমি যা-যা ভারতীয় ছবি দেখেছিলাম, সেগুলো ভারতীয় দূতাবাসের অনুষ্ঠানেই দেখানো হত। এই ছবিগুলো ছিল যাকে আমরা এখন বলি আর্ট ফিল্ম; হিন্দি ছবির তৎকালীন হিরোদের দেখার বহু আগে আমি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলি দেখি,’ সিমি বলেন। তাঁর দশক-বিস্তৃত কেরিয়ারে তিনি যে সত্যজিৎ, মৃণাল সেন এবং রাজ কাপুরের ছবিতে কাজ করেছেন, সে-বিষয়ে সিমি যথেষ্ট গর্ব বোধ করেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজও পুরুষতন্ত্র, মহিলা এবং পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে অসম পারিশ্রমিকের চল এবং পশ্চাদবর্তী কাহিনির হদিশ মেলে, তা নিয়ে সিমি উদ্বিগ্ন। ‘দুঃখজনক, যে এত দিনেও মহিলা এবং পুরুষ অভিনেতারা একই পারিশ্রমিক পান না’। কিন্তু এর চেয়েও বড় চিন্তার কারণ নারী এবং পুরুষ, দুই শিল্পীদের ক্ষেত্রেই সেকেলে, পুরাতনপন্থী চরিত্রায়ন। ‘একটা পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তাঁরা যে পথিকৃত হয়ে উঠতে পারেন, অভিনেতারা তা উপলব্ধি করুন, এটা আমি চাই। সালমান খানের মতো এক মহাতারকাকে যদি রান্না করতে বা বাড়ির কাজ সামলাতে দেখানো যায়, ইমেজটার প্রভাব কিন্তু খুবই শক্তিশালী হতে পারে,’ মনে করেন সিমি।
শুধু চলচ্চিত্র বা ভারত নয়, সিমি এখনও বহু বিষয়ে আগ্রহী। ইংল্যান্ডও তাঁর নিজের দেশ— এবং দুই দেশেই অসহিষ্ণুতার রাজনীতি তাঁর কাছে উদ্বেগের কারণ। ‘বিলেতে ব্রেক্সিটের রাজনীতি ঠিক ভারতে ক্রমশ-বর্ধমান ঘৃণার রাজনীতিরই আর এক আকার; দুই ক্ষেত্রেই এই রাজনীতি মানুষের ভীতি এবং নিরাপত্তাহীনতাকে নিয়ে খেলা করে। এটা খুবই চিন্তার বিষয়, কেননা এই রাজনীতি যে নেতাদের জন্ম দিচ্ছে, তারা জনসাধারণের নীচতাকে কেন্দ্র করে ভোটে জিতছেন’, আক্ষেপ করেন সিমি। স্বীকার করেন, বরিস জনসনের সর্বনাশা প্রধানমন্ত্রীত্ব তাঁকে মোহমুক্ত করেছে। বরং পরবর্তী ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে ঋষি সুনাকের সম্ভাবনা সম্বন্ধে আশাবাদী সিমি।
একই সূত্রে, তাঁর মাতৃভূমি সম্মন্ধে সিমি আজও আশাবাদী। নিজের — এবং ভারতবর্ষের— ৭৫তম জন্মদিনের অপেক্ষায় থাকা সিমি মনে করেন ‘ভারতীয় মনন’ তাঁকে আশা জুগিয়ে যায়: ‘চারপাশে বুদ্ধিমান, উজ্জ্বল তরুণদের দেখি, নানা শহরে যারা আমার গাড়ির চালায়, অনেক সময় তাদের সঙ্গে মাঝে-মাঝেই কথোপকথন শুরু করি। তাদের ধারালো দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই; তাদের রাজনৈতিক চেতনায় যে সূক্ষ্মতার দেখা মেলে, তা আমার সামাজিক মেলামেশায় বহু লোকের মধ্যে পাই না। ভারতের আসল সম্পদ এই তরুণদল, এবং ঠিক এই কারণেই আমি আশা রাখি যে দেশের শ্রেষ্ঠ সময় আসতে চলেছে’।
এ কথা বলা যেতে পারে, তাঁর ‘রঁদেভ্যু’ সিরিজের মাধ্যমে সিমি বহু সেলেব্রিটি ইন্টারভিউয়ারদের পথ দেখিয়েছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম, বহু-বিতর্কিত ‘কফি উইথ করণ’ রয়েছে। সিমির কাছে কিন্তু ‘রঁদেভ্যু’ সিরিজ শেষ হয়ে যায়নি; নতুনভাবে, নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এই প্রবাদপ্রতিম শো আবার লঞ্চ করতে চান সিমি। ওটিটির বিশাল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, এই মাধ্যমের ঢেউ তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। ‘শুধু কিছু বিশেষ মুম্বইয়ের পরিচালকের কাজই এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে দেখানো হচ্ছে,’ মনে করেন সিমি। তাঁর চেয়ে সিমির পছন্দ সোশ্যাল মিডিয়া— যেখানে নিজস্ব স্টাইলে, ফিল্টারহীন কাজ পরিবেশন করতে চান তিনি।