১৪ অগস্ট, ২০২২, রাত পৌনে বারোটা— আরব সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে মুম্বইয়ের মেরিন-ড্রাইভের ওপর।ঝোড়ো হাওয়া আর হালকা বৃষ্টি এলোমেলো করে তুলছে গাছপালাদের, সঙ্গে জনপদচারীদের। ভারতীয় পতাকা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে স্বাধীনতা ৭৫বছর পূর্তির অমৃত মহোৎসব, আর মেরিন ড্রাইভের পাশেই এনসিপিএ (ন্যাশনাল থিয়েটার ফর পার্ফমিং আটর্স, মুম্বইয়ে)-তে তখন হল ভর্তি দর্শক একসঙ্গে গাইছেন— বন্দেমাতরম। স্টেজের সমস্ত শিল্পীরা হাত গুটিয়ে, মাইক বন্ধ করে শুনছেন ভারতীয় নাগরিকদের শ্রদ্ধা-সংগীত।
স্টেজে কে বা কাঁরা উপস্থিত তখন? গুলজারজী, সুরকার শান্তনু মৈত্র, আম্বি সুব্রমনিয়াম, পাপন, বম্বে জয়শ্রী, পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর, সঙ্গে আরও বিশেষ কয়েকজন যন্ত্রশিল্পী ও বাদ্যকর এবং সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা অফ ইন্ডিয়া। তাঁরা সবাই বিস্ময়ে চুপ। আনন্দে আপ্লুত। প্রায় ছ‘শো নাগরিক তখন এক সঙ্গে গলা মিলিয়ে এক সুরে বন্দেমাতরম গাইছেন। এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধা আর কী-ই বা হতে পারে!
এনসিপিএ-মুম্বই ১৪ অগস্ট রাত ১০টা থেকে আয়োজন করেছিল এক সঙ্গীতসন্ধ্যার—ডন অ্যাট দ্য মিডনাইট। যে সন্ধ্যায় ভারতীয় রাগসঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের আশ্চর্য মিশ্রণে শান্তনু মৈত্র তৈরি করেছিলেন এক মায়াবী সঙ্গীতআবহ। আর তাতে ফোঁটা ফোঁটা করে অমৃত যোগ করেছিলেন গুলজারজী। তাঁর স্মৃতিতে, বর্ণনায়, আশাবাদে, কবিতায়, বক্তৃতায়, রসিকতায় ৭৫ বছরের স্বাধীনতার পূর্তি হয়ে উঠেছিল একান্ত ভারতীয় ঘরানার। অর্থাৎ কিনা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। প্রাপ্তির ভাণ্ডার ভরিয়ে তুলেছিলেন উপস্থিত সঙ্গীত শিল্পী ও গায়ক-গায়িকারা।
গুলজারজী যখন সেই সন্ধ্যা শুরু করলেন এই বলে যে, ‘আসলে আমাদের দু‘টো জন্মদিন। একটা আমােদের নিজেদের, আর একটা আমাদের দেশের। যে দিন দেশের জন্মদিন হয়, সে দিন সেই দেশটার জাতির অঙ্গ হিসেবে আমাদেরও জন্মদিন হয়। আসলে তো দেশ তৈরি হয় মানুষ দিয়ে। তাহলে দেশের জন্মদিন হলে, আমাদেরও জন্মদিন হল। একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকদের চিন্তা-ভাবনা-শৈল্পিকচেতনা-তীক্ষ্ণ সমালোচনা-ভোটাধিকার-মুক্তচিন্তা-বিজ্ঞানমনস্কতা-সংস্কৃতিবোধই একটা দেশ তৈরি করে। তার চলার পথ নির্ণয় করে, তার গতি নির্ণয় করে। কিন্তু তাতে বাধাও আসে। এবং সেই বাধা কাটিয়ে যুক্তির পথকে পরিষ্কার রাখা উচিত।’
এর পরেই গায়ক পাপন গাইতে এলেন, ‘মেরা হাত বন্ধেগা, পা-ও বন্ধেগা, শোচ বন্ধেগা ক্যায়সে’…হলের সমস্ত বাঙালি দর্শক আপন মনে গুনগুন করে উঠলেন, ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে!’ গুলজারজী অনুবাদ করেছেন।
এর পরের গানটি গাইতে এলেন গায়িকা বম্বে-জয়শ্রী, তাঁর সঙ্গে গলা মেলাল শিশুশিল্পীরা। সেই গানও গুলজারজীরই লেখা। এর পরেই শুরু হল ভারতের চিরন্তন সুর— যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে— কেবল সুরে সুরে ধ্বনিত হল এই সত্য। একদিকে শান্তনু মৈত্রের পরিচালনায় বেহালা (অম্বি সুব্রমনিয়াম), সরোদ (প্রতীক শ্রীবাস্তব), সেতার(মেহতাব আলি নিয়াজী), ড্রামস, গিটার, পিয়ানো, বাঁশী, তবলা আর ঢোল (শ্রীধর পার্থসারথী)-এ রিনরিনিয়ে উঠল ভারতীয় সত্তা আর কায়জাদ প্যাটেল-এর পরিচালনা সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার পাশ্চাত্য ছোঁয়ার সুর এসে মিলে গেল প্রাচ্যের অঙ্গনে। সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। সুরের অনুরণন তখন ছড়িয়ে পড়ছে দর্শকদের মনে, তাঁদের শরীরী ভাষায় আন্দোলিত হচ্ছে রবিঠাকুরের গান আর গান্ধীজীর জীবনের মূল মন্ত্র।
এর পরে গাইতে এলেন, পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকরজী। গান্ধীজীর প্রিয় ভজন গাইলেন, ‘বৈষ্ণবচন তো তেনে কহিয়েজে’। অপূর্ব পরিবেশনা। যেমন গায়কী তেমন প্রাণ ভজনের মধ্যে দিয়ে ঝলসে উঠল। বাহুল্যহীন এই অনুষ্ঠানে ভারতের সত্যিকারের অস্তিত্বকেই উদযাপন করা হল।
তার পর ছিল একটা চমক। ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর জাকির হোসেন একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছিলেন এনসিপিএ-মুম্বইতে, ১৯৯৭ সালে। সেই প্রসঙ্গকে মনে রেখে, শান্তনু মৈত্র জানালেন তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। কী ভাবে তিনি লস অ্যাঞ্জেলস-এ জুবিন মেটা-র এক কনসার্ট থেকে জানতে পারেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রিয় কম্পোজিশনের কথা। যে কম্পোজিশন শুনলে রবিশঙ্করজীর মনে হত তিনি পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থেকেও নিজের মধ্যে ভারতকে অনুভব করতে পারছেন। সেই কম্পোজিশনটি হল ‘এলগার ভেরিয়েশনের নিমরোড’ কম্পোজিশন। শান্তনু মৈত্র’র অনুরোধে সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা বাজাল সেই অপূর্ব কম্পোজিশন। দর্শকের মোহিত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই ছিল না। তার পর রাত পৌনে বারোটা নাগাদ শুরু হল ‘বন্দেমাতরম’। দর্শকদের গাওয়ার পর বম্বে-জয়শ্রীজী আরও একবার গানটি গাইলেন আর লেখার ১৫২বছর পরেও মাতৃবন্দনা একই ভাবে উদ্বেল করল ভারতবাসীকে।
এরপর আর যা অবশ্যম্ভাবী, তা হল আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গেয়ে শেষ হল উদযাপন। সকলে বেরিয়ে আসছেন পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে। আরব সাগরের তীরে শুরু হয়ে গেছে জয়োৎসব। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ পতাকা হাতে, হাসি মুখে বেরিয়ে পড়েছেন, স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে।
আমার মনের ভেতর অনুরণিত হচ্ছে কয়েকটা শব্দ— শোচ বন্ধেগা ক্যায়সে, যুক্তির পথ পরিষ্কার রাখতে হবে, মানুষ দিয়ে দেশ তৈরি, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে!