কাটাকুটির ছবি
খুব অভিনব একটা ছবি যদি খুব বোরিং হয়, মনে হয় ঠকে গেলাম। ডেভিড ক্রোনেনবার্গ নতুন ছবি করেছেন, ‘ক্রাইমস অফ দ্য ফিউচার’ (২০২২), বলেই দিয়েছেন এ-সিনেমা দেখে বহু মানুষ হল থেকে বেরিয়ে যাবেন— সবাই অধীর আশা নিয়ে বসে ছিল, শখ-করে-শক-দেওয়া ছবি বিস্ময় ও তর্কের ঘূর্ণি রচবে। কিন্তু ছবিটায় আছে সুপ্রচুর অন্ধকার আর বৃহৎ ঘ্যানঘ্যান। কিছু ধাক্কা আছে বটে, কিন্তু এও মানতে হবে এখন দর্শকের হজমশক্তি অনন্ত : ফিল্মের পর ফিল্মে মাল্টিভার্স, ওয়েব সিরিজে একটা লোকের সাতশোবার মরে যাওয়া বা অন্য সময়বৃত্তে আটকে হাঁকপাক, ‘নর্ডিক নোয়া’ ভর্তি কদর্য খুন ও সমস্যাদীর্ণ গোয়েন্দার লুকোচুরি— এসব খেয়েমেখে তার লিভার-প্যানক্রিয়াস প্রথমে চড়কগাছ, পরে অভিযোজনের বশে প্রসারিত হয়ে গভীর তোরঙ্গ। অবশ্য এ-কথা ঠিক, পর্দায় যদি তরিবৎ করে দেখানো হয় একটা লোকের ঠোঁটজোড়া বাঁকানো ছুঁচ দিয়ে সেলাই করা হচ্ছে কিংবা কারও পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করা হচ্ছে, মানুষের ব্যাব্যাগো ঘটতে বাধ্য, কিন্তু সেগুলো একটু নিরাপদ জুয়াও বটে, কারণ সেখানে কল্পনার নতুনতা নেই, আছে উগ্রতার চামচ উঁচিয়ে নিশ্চিত অস্বস্তি চেঁছে নেওয়া।
তবে সিনেমার কাহিনি-ভাবনা খুব অন্যরকম : ভাবী পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষের ব্যথার অনুভূতি লুপ্ত, তাই ছুরি দিয়ে ত্বক কাটলেও কিছুই এসে যায় না, অনেকেই নিজের গা কেটেকুটে পারফর্মিং আর্ট প্রদর্শন করছে, প্রচুর ভিড় হয়, ক্যামেরা হাতে লোকে দেখতে আসে, কার গাল ছুরি দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ক্ষত তৈরি করা হচ্ছে, কার পায়ের হাড় দু’ফাঁক হচ্ছে। দেখেশুনে মালুম হয় এই কাটাকুটিতে লোকের যৌন আনন্দও ঘটে, তারা বিবশ হয়ে গা মোচড়ায়। সংলাপ শোনা যায়, ‘সার্জারি ইজ দ্য নিউ সেক্স’, এবং গল্পের কেন্দ্রে যে যুগল, তারা পারফর্মিং আর্টিস্ট, নারীটি রিমোটের সাহায্যে পুরুষের পেট কেটে ফাঁক করে এবং কোনও একটি প্রত্যঙ্গ বার করে এনে দর্শকদের দেখায়। এই অপারেশনের গোটা প্রক্রিয়ায় পুরুষটির তীব্র শারীরিক সুখ ঘটে। নারীটির মধ্যেও (রিমোটের সাহায্যে) পুরুষের অন্তঃপুরে শলাকা প্রবেশ করানোর কালে প্রবল উত্তেজনার লক্ষণ দেখা যায়। ঘনিষ্ঠ যৌনতাও তাদের আমরা করতে দেখি অন্যভাবে, অপারেশনের একাধিক বিরাট স্ক্যালপেল (রিমোটের ইচ্ছানুযায়ী, এলোপাথাড়ি) বারবার নর ও নারীর শরীরের যে-কোনও জায়গা কেটে ফুঁড়ে চিরে দেয়, রক্ত চুঁইয়ে পড়ে, এবং তারা আকুল ছটফটায়, শেষে তৃপ্ত হয়। অন্য দৃশ্যে এক চরিত্র এক সময় ছেলেটিকে চুমু খেতে গেলে, সে বলে, ‘আমি পুরনো ধরনের যৌনতায় খুব একটা দড় নই।’
পুরুষটির শরীরটি অদ্ভুত, তা প্রায়ই নতুন-নতুন প্রত্যঙ্গ তৈরি করে, যা মানুষের দেহে কখনও দেখা যায়নি। নারী সেগুলোয় ট্যাটু করে, তারপর দর্শকসমক্ষে একটা অপারেশন করে সেই প্রত্যঙ্গকে বাইরে আনা হয়, সবাই তার আকৃতি রং আর ওপরে-আঁকা উল্কি দেখে অবাক মানে ও বাহবা দেয়। তাদের খ্যাতি প্রচুর, বিশেষত পুরুষটিকে মহৎ শিল্পী হিসেবে মানা হয়, তার এক-একটা নতুন প্রত্যঙ্গ দেখতে পাওয়াকে কেউ-কেউ পিকাসোর নতুন ছবি আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করে। একজন গোয়েন্দা অবশ্য জিজ্ঞেস করে, ‘টিউমার’ কী করে আর্ট হয়? তাতে সেই আবেগ-নির্মাণ কোথায়, সেই দার্শনিক বোধই বা কোথায়, যা শিল্পের মূলে থাকতে হবে? উত্তরে বলা হয়, পুরুষটি খুব সম্ভব অবচেতনে নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এই আশ্চর্য প্রত্যঙ্গগুলোর জন্ম দিচ্ছে, সেগুলো শেষ অবধি কীরকম হয়ে উঠবে তা নিয়ন্ত্রণ করছে, তারপর আবার তাতে ট্যাটু করা হচ্ছে, সব মিলিয়ে অনেক ‘মানে’ তৈরি হচ্ছে, দর্শক নতুন বোধ নিয়েই বাড়ি যাচ্ছে। বোঝা যায়, ছবিটা আসলে শিল্প নিয়েই, কারণ শিল্পও মানুষের ভেতরেই জন্ম নেয়, বাড়ে, ছড়ায়, পেকে ওঠে, শেষে এক সময় বেরিয়ে এসে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় বা হতাশ করে। কবির মধ্যে যেরকম প্রথমে হুট করে একটা লাইন বা ভাবনা আসে, তারপর তিনি সেটাকে বেশ কিছুদিন ধরে হৃদয়ে (বা হাতের শিরায়, বা গর্ভে) বহন করে, অনেক কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে রাঁধেন-বাড়েন এবং শেষমেশ একটা পূর্ণ কাব্যে রূপ দেন, এখানেও একটা একদম নতুন অজানা প্রত্যঙ্গ নিজে থেকে শুরু হয়, তারপর তাকে চেষ্টা করে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। মেয়েটি এক সময় বলে, এ শুধু ‘ডিজাইনার ক্যানসার’ নয়, এটাকে সংহতভাবে চালনা করতে হয়।
তাই এখানে বলা হচ্ছে নয়া যুগের নয়া শিল্পের কথা, যা সরকারের চোখে আষাঢ়ে ও সন্দেহজনক, কারণ যে প্রত্যঙ্গ মানুষের থাকে না, তা আচমকা গজাবে কেন? বলা হচ্ছে এমন এক বিশ্বের কথা, যেখানে কিছু মানুষ নতুন আধার ও নতুন প্রকাশভঙ্গি নিয়ে আনকোরা ঝলকাচ্ছে, আর রাষ্ট্র তাদের বলছে, ভাই, পুরনো ও পরীক্ষিত পন্থা থেকে পিছলে যাচ্ছিস কেন? ফলে দ্বন্দ্ব আমাদের চেনা : গোঁড়ামি ভার্সাস কালাপাহাড়পনা। সরকারি এক আমলা বলে, এই যে বহু লোকে আজকাল ব্যথা বোধ করে না, তা তো ঠিক ‘মানুষিক’ নয়। ঠিক যেমন সেন্সরবাবুরা মনে করেন, বাড়াবাড়ি অন্যবাজি ঠিক ‘ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’বাহী নয়। পুরুষটি জানে, সে আসলে একজন রোগী, যার শরীরের নতুন প্রত্যঙ্গগুলোকে সময়মতো বের না করতে পারলে সে মারা যাবে। সে রোগটাকে একটা সৃষ্টির কাজে লাগিয়ে নিচ্ছে। কেউ বলতেও পারে, প্রতিভাও আর কিছুই নয়, অস্বাভাবিক মস্তিষ্ক-লেজুড়, সত্তার একটি উদ্ভট ফাউ, যাকে কাজে লাগিয়ে কেউ-কেউ কিছু কাণ্ড তৈরি করে প্রকাশ্যে আছড়ায়।
এদিকে এমন দলও তৈরি হয়েছে, যাদের মতে, গ্রহণ-বর্জনের তাবৎ ব্যাকরণ বদলাও। এই পরিবর্তিত সময়ে পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং মানুষ যে খাবার খায় তার বদলে খেতে হবে প্লাস্টিক বা অন্য industrial waste। তারা নিজেদের পেটের মধ্যে এমন সার্জারি করিয়ে নিয়েছে, যাতে প্লাস্টিক হজম করতে পারে। তারা একরকম চকোলেট-বার তৈরি করে, যা কৃত্রিম জিনিস দিয়ে গড়া, সাধারণ মানুষের পক্ষে হজম করা অসম্ভব, কিন্তু চোরাবাজারে এর চাহিদা বেড়ে চলেছে, কারণ বহু মানুষ এই ধারণায় এখন দীক্ষিত। এই কাল্ট-এর যে নেতা, তার ছেলে জন্ম থেকে প্রচলিত খাবার না খেয়ে প্লাস্টিক খেত, তার মুখ দিয়ে অ্যাসিডের মতো গাঢ় লালা গড়িয়ে পড়ত। প্লাস্টিক হজম করার ক্ষমতা মানুষের থাকতে পারে না, কিন্তু এই জাতকের ছিল। ছেলেটির মা এই মিরাকল (যা তার মতে অভিশাপ) সহ্য করতে পারেনি, প্লাস্টিক (এবং অন্যান্য বর্জ্য) খাওয়ার অবাঞ্ছিত ও অমানবিক আচরণ ঘোচাতে সে ছেলেটিকে হত্যা করে। ছেলেটির বাবা সন্তানের শব-সংরক্ষণ করেছে। এখন সে চায় এই পারফর্মার-যুগল, সর্বসমক্ষে ছেলেটির পেট কেটে তার পাকযন্ত্র বের করুক ও লোককে দেখাক, তা কতটা অভিনব, এবং মানুষ কী আশ্চর্যভাবে বিবর্তিত হতে পারে। দেখুক, মানুষ বদলে যাচ্ছে, ফলে মন-নিসর্গ বদলে নিতে হবে। পারফর্মার-পুরুষটিকে সে বলে, তোমার শরীরে কয়েকটা বেয়াড়া উদ্ভট প্রত্যঙ্গ গজাচ্ছে, তুমি তাদের কেটে ফেলে দিচ্ছ, এই তো? তুমি ভাবছ, তোমার শরীর তোমাকে নাশ করতে চাইছে, আর তুমি সেই বিনষ্টি-আয়ুধকে নিজের জোরের জায়গায় রূপান্তরিত করছ, এই তোমার বিদ্রোহ? এমনও তো হতে পারে, শরীর তোমাকে বার্তা দিতে চাইছে, যা তুমি বুঝছ না, উপেক্ষা করছ? হয়তো শরীরের এই কথাগুলো মেনে নেওয়ার মধ্যে তোমার অধিক মুক্তি ও চরিতার্থতা লুকিয়ে? সত্যিই পুরুষটির স্বাভাবিক খাবার খেতে খুব অস্বস্তি ও কষ্ট হয়। এই প্লাস্টিকপন্থী নেতা বলে, হয়তো তোমার শরীর তথাকথিত স্বাভাবিক খাদ্য প্রত্যাখ্যান করছে? হয়তো সে এবার প্লাস্টিক খেতে চায়?
ছবিটা বেশি কিছু দেখায় না, শুধু কয়েকটা বিচ্ছিরি দেখতে ঘর, এবং মূলত বিচ্ছিরি দেখতে বাইরের জগৎ। কয়েকটা লোক, তারা হয় খুন করে, নয় চক্রান্তকারীর মতো ফিসফিসিয়ে কথাবার্তা বলে, নয়তো থতিয়ে-থতিয়ে ঘসঘসে স্বরে অদ্ভুত উচ্চারণ করে। পুরুষ-শিল্পী ব্যথা অনুভব করতে পারে ঘুমের মধ্যে, তাকে আরাম দেওয়ার জন্য বিশেষ বিছানা (বা খাওয়ার সময় যাতে শরীর হজমের আদর্শ অবস্থানে থাকতে পারে তার জন্য নির্মিত বিশেষ চেয়ার) তৈরির কোম্পানি থেকে যে মেয়েরা আসে, তাদের আচরণও অদ্ভুত। ফলে ছবিটার স্টাইল হল, সবটাই বিশেষভাবে বানিয়ে-বানিয়ে উপস্থিত করা। সাধারণত এ-ধরনের ছবি শুধু বক্তব্যে জোর দেয়। প্রতিটি চরিত্র শুধু আইডিয়ার ধারক ও বাহক হিসেবে উপস্থিত হয়, তার তথাকথিত স্বাভাবিক আচরণের কোনও দায় থাকে না। এ ছবির বুলি : নতুনকে গ্রহণ করতে শেখো। ক্ষমতাধারীদের মতে যা ক্রাইম, তা-ই প্রকৃত আর্ট অফ দ্য টাইম। সে-বক্তব্য জরুরি, কিন্তু হেন উরেব্বাবা নয় যে, (কোনও বক্তব্যই এত জরুরি নয় যে) ছবিতে লীলা বা রেলা না থাকলেও চলবে।
ছবির উদ্দেশ্য মহৎ, চাল নিষ্প্রাণ। ক্রোনেনবার্গই বলেছিলেন, অনেক ছবি দেখেই লোকে হল থেকে বেরিয়ে যায় না, কিন্তু হল-এ বসে থেকেও কোনও আনন্দ পায় না। এ-ফিল্ম সেই গোত্রেরই। মহা একঘেয়ে। আমরা গভীর মানে-টানে সবই বুঝি, একটা লোকের চোখ আর ঠোঁট বন্ধ করে দেওয়া হল আর সারা গা-ভর্তি কান বুনে দেওয়া হল (অর্থাৎ কিনা বহু দেখেছ আর বলেছ এবার শুধু শোনো)— এই প্রদর্শনীকে একটু ঠেস দিয়ে স্টান্টবাজি গোছের গাল যখন দেওয়া হয়, আমরা বুঝি নয়া শিল্প-আন্দোলনেও থাকবে ফাঁপামি ও দেখনদারি। কেটেছেঁটে নিজেকে অনন্য করে তোলার ফ্যাশনে আজকের যুগের লক্ষণও আমরা চিনতে পারি, কারণ ট্যাটুর এমন হিড়িক পড়েছে, বহু তারকার গায়ে এক-ইঞ্চি ত্বকও বোধহয় খালি নেই। আবার সদর্থক স্পর্ধার দ্যোতনাও আমাদের নজর এড়ায় না : গালে ও কপালে স্বেচ্ছায় ক্ষত তৈরি করা সুন্দরী বলে, আমি কাউকে বোঝাতেই পারছিলাম না যে আমি আরও সুন্দর হতে চাই না! কিন্তু কেবল উপদেশামৃতে ছবি জমে না, নিজের পেট চিরে আন্তরিক নীতিকথা উগরে উন্মোচনালেই হয় না, অন্তত তার ওপর ইন্দ্রজালের ট্যাটু থাকতে হয়।