চাটনির লোভে ডালবড়া
শুধুমাত্র অনুষঙ্গের লোভে যারা টুকি-টাকি খেয়ে থাকেন, আজকের লেখাটা তাঁদের জন্য।
কলকাতার রাস্তাঘাট ভাজাভুজি খুচরো খাবারের স্বর্গ। এই সাড়ে-বত্রিশ ভাজার হাটে (হিসাব করলে যদিও দেখা যাবে যে ভাজা ফ্যামিলিতে প্রায় তেত্রিশ কোটি ভ্যারাইটি রয়েছে!) প্রতিটা আইটেম যে রোজ উড়িয়ে বিক্কিরি হয়, আমার থিওরি অনুযায়ী তার প্রধান কারণ নানা ধরণের অনুষঙ্গ-বিশেষ। মশলা-নুন, বিশেষ ধরণের সস্, ভাজা রসুন-লংকা, এবং অবশ্যই, টক-ঝাল-মিষ্টি চাটনি। আর চাটনির কথা যদি বলতে হয়, তবে ডালবড়া, এবং তার চাটনি, আমার খাতায় এক নম্বর।
দক্ষিণী রেস্তোরাঁয় নয়, আমি ডালবড়া খাই রাস্তায়; ছোট-ছোট, অনেকটা ছানার মুড়কি সাইজের, ইন্সট্যান্ট ভাজা ডালবড়া। এক ঠোঙ্গা এই গরমা-গরমে পেটের চেয়েও বেশি ভরে মন; মনে হয় কেউ যেন উপহার দিয়ে গেল একরাশ কুড়মুড়ে আনন্দ।
তেলে-ধোঁয়ায় পিচ-কালো হয়ে যাওয়া ঠেলাগাড়িতে, হাঁ-হাঁ করে জ্বলতে থাকা মিনি স্টোভের উপর কুচকুচে কালো একটা কড়াইতে ভাজা এবং সঙ্গে-সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাওয়া ডালবড়া। আমাদের বালিগঞ্জ পাড়ায় বিকেল নামলেই ডালবড়ার ঠেলাগাড়ি মোড়ে-মোড়ে দেখা যায়, বিশেষত বাজার অঞ্চলে; লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ স্টেশন, যোধপুর-যাদবপুরে।
তারিয়ে-তারিয়ে চাটনির শেষটুকু খেয়ে মনিরামকে প্রথমে চাটনির ব্যাপারেই জিজ্ঞাসা করলাম। লেক মলের সামনে, বাজারে ঢোকার গলির মুখে তেরচা করে দাঁড় করানো থাকে মনিরামের ডালবড়া ঠেলাগাড়ি। মলের আগে যখন শুধু বাজার ছিল, মনিরাম বসত রমণী চ্যাটার্জির দিকটায়; মল ওঠায় ঘুরে লেক রোডের দিকে চলে আসে। খুব মজার দেখতে মনিরামকে; বেঁটে আর মোটা, বড়-বড় হলদেটে দাঁত, তার উপরে একটা চাড়া-দেওয়া গোঁফ আর কুতকুতে দুটো চোখ, মজার কথা বললেই যেগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে। মনিরামের সাফ বক্তব্য, ডালবড়া নিয়ে তা-ও বা যদি কথা বলা যায়, চাটনি নিয়ে কিছু বলা যাবে না। অর্থাৎ, অতি গোপন রেসিপি! আচ্ছা, সোজাসুজি বলা না যাক, কিছু হিন্ট তো পাওয়া যেতে পারে? স্বাদেই তো আছে— বাটা আদা, কাঁচালংকা, বিটনুন, তেঁতুল… আমচুর? ‘না বাবু’! কাঁচা আম? ‘সব সময়ে কোথায় পাবো’? ধনেপাতা? ‘আজকাল যা দাম’! আরে খেলে যা! তবে আছেটা কি?
চাটনির ব্যাপারটাই আলাদা, বুঝিয়ে বলে মনিরাম। ডালবড়ার প্রধান ‘ব্যাটার’টা তৈরি হয় মটর-মুসুর-ছোলার ডাল-বেসন, গোটা ধনে, হিং, লংকা আর জিরের একটা কম্বিনেশনে, এবং শহরের এক প্রান্ত থেকে আর একে সে কম্বিনেশনটার খুব একটা রকমফের হয় না। তার কারণ, স্বাদটা মোটামুটি এক না থাকলে বড়াটা হয়তো বিক্রিই হবে না। কিন্তু বড়া মোটামুটি একই স্বাদের হলেও, চাটনির ক্ষেত্রে রয়েছে অবাধ এক্সপেরিমেন্টের স্বাধীনতা।
আদা-লংকা-তেঁতুল-নুন সবাই ব্যবহার করে, কিন্তু পরিমাণে বিরাট তফাৎ হয়ে যায়; কারোর বেশি ঝাল, কারোর টকের মাত্রাটা বেশি, কারো চাটনির রসুন-ঘেঁষা ফ্লেভারটাই ইউ এস পি (এই শেষের জিনিসটা মনিরামের মিক্সচারে বেশ টের পাওয়া যায়, কিন্তু স্বীকারোক্তি মেলে না)। কলেজে পড়াকালীন নেবুতলা পার্কের কাছে টিউশন পড়াতে যেতাম যে পাড়ায়, মনে আছে, সেখানে ডালবড়া-চাটনিতে অতুলনীয় কাঁচা আমের স্বাদ খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার বহু, বহু পরেও মুখে লেগে থাকত; চাটনির লোভে পড়ানোটায় ডুব মারতে ইচ্ছা করলেও অনেক দিনই পারিনি। ২০১২-১৩ সালে, থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তকের সঙ্গে একটা সাইট-স্পেসিফিক নাটক হিসাবে সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ কাজ করি; একটা টানা সময় রিহার্সাল হয় মিনার্ভা থিয়েটারের কাছে একটা বাড়িতে। যাত্রা পাড়ার এক কোণে, রবীন্দ্র সরণীতে বসা এক ডালবড়া-ওয়ালার চাটনিটার মত পোটেন্ট ঝাল বস্তু আমি জীবনে খুব কমই খেয়েছি। প্রায় ভূত জোলোকিয়ার সঙ্গে তুলনা চলে যে ভূত-পালিয়ে-যাওয়া ঝাল চাটনির, তাতে কিন্তু বাটা কাঁচালংকাই ব্যবহার করতেন এই ঠেলাওয়ালা।
২০০৯-১০ সালে আমেরিকার বিখ্যাত বেতার নেটওয়ার্ক ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এন পি আর; NPR) গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের উপর একটা তথ্যচিত্র সিরিজ উপস্থাপনা করে, যেখানে ভারত থেকে পাকিস্তান অবধি বয়ে যাওয়া এই রাস্তার চারধারের মানুষজন, সংস্কৃতি – এবং অবশ্যই পথ-চলতি খাবারের বিষয়গুলি একের পর এক এপিসোডে ঘুরে-ঘুরে আসে (https://www.npr.org/series/127024473/along-the-grand-trunk-road )। বর্তমান বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ার অবধি বিস্তৃত ২,৫০০-কিমি লম্বা এই রাস্তা ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশের ২,৫০০ বছরের ইতিহাস গড়ে উঠেছিল, এ-কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। এই ঐতিহাসিক রাস্তার কলকাতা সেগমেন্টে, বাকি আর সব কিছুর সঙ্গে ডালবড়ার রেফারেন্স দেখে ভালো লেগেছিল।
আমার মতো খুঁতখুঁতে খুচরো খাইয়ে হলে, স্পেসিফিক স্ন্যাকের সঙ্গে নির্দিষ্ট চাটনিটার ভূমিকা সম্বন্ধে খুব তর্ক-বিবাদের প্রয়োজন হবে না। বহু খাবারের ক্ষেত্রে এই অনুষঙ্গটাই যে একটা মস্ত বড় ইউ এস পি – কোনো-কোনো ক্ষেত্রে একমাত্র ইউ এস পি, যেমন দোসার সঙ্গে সম্বর ডাল, ফিশ ফ্রাইয়ের সঙ্গে কাসুন্দি, শসার সঙ্গে ঝালনুন, অল্প টক কাঁচা আমের সঙ্গে তেঁতুলের মিষ্টি চাটনি – এটা অনেক খাদ্যরসিকই মেনে নেবেন বলে আমার ধারণা। তাই সাইকেল চড়ে শহর ঘুরতে-ঘুরতে খুচরো খাবার যত না খাই, তার চেয়ে বেশি খুঁজি অনুষঙ্গ। আফটার অল, চাটনিটা তো আরেকটুক্ষণ বেশি সময় ধরে খাওয়া যায়।
বড়ার শেষে কাগজটা চাটছি দেখে বোধহয় মনিরামের মায়া হয়। ‘কাগজি লেবুর খোসা’। কী? ‘কাগজি লেবুর খোসা, ছিলে নিয়ে একটু বেটে দিয়ে দিই। বেশি দিই না; তেতো হয়ে যাবে’। কেয়াবাত আর কাকে বলে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র