ট্রেনে উঠতে হবে বলে গোবরডাঙা থেকে বের হয়নি প্রায় তিন দশক। আগে চটি-ছেঁড়া হাঁটা, ভ্যান, তারপর বাসে করে স্টেশন! বাকিটা অচেনা। আর কলরব। কাড়াকাড়ির এপার।
ছোট থেকেই নাকে কফ। বোঁচা। চওড়া কালো কপাল, শুকনো শরীর। চামড়ায় যেন জল নেই। দাঁতদুটো মাঝখান থেকে উঁচু। গলার স্বরে সামান্য কাক । কিরণ জানত, ও দেখতে খারাপ। বুড়ো-বুড়িরা আদর করে ওকে ডাকত পেত্নি। শুধু বড়দা এই ডাকে খুব রেগে যেতেন। বোনের দিকে বোধহয় দু-এক পা এগোচ্ছে দুঃসময়। দাদা বলত : ‘কিছু খেয়েছিস? রোদ পড়লে ঝিলের ধারে যাব। শুকতারা দেখাব। কিরণের সময় কেটে যেত মিঠুকে নিয়ে। সাদা, চিকন গরু; চোখে ছায়া-সন্ধ্যার পুকুর। পাড়ার সবাই মিঠুকে পেত্নি বলেই এক ডাকে চেনে।
বৌদির হাতের কাজে সবসময় কিরণ থাকত পাশে। দেশভাগের ফিসফিসানি মাইকে-পথসভায় সবে দানা বাঁধছে। পারাপার শুরু হতেই বড়দা পরিবার নিয়ে চলে আসে এপারে। কিরণবালার অবরুদ্ধ গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন বাদে হামলা শুরু হয়। মেয়েদের নিয়ে বাড়ির সকলে ভয়ে কাঁপছে। কুৎসিত ছিল বলে কিরণবালার তেমন ভয় ছিল না। কখনও খড়ের গাদা, জেলে নৌকোয়, কখনও থানার বড় দারোগা মইদুলের বাড়ি, আলু-রসুন ডাল, নির্জলা আশ্রয় শিবির, সমন্বয় সমিতির খিচুড়ি আর স্বেচ্ছাসেবকের লাবড়া করে মাস ছয়েক বাদে গোবরডাঙার কাছে শ্বশুরবাড়ির দিকের এক বোনের বাড়ি ওঠে কিরণ। সঙ্গে স্বামী বীরেন্দ্র। বড় কীর্তনীয়া হবার স্বপ্ন ছিল বীরেনের। গলায় ছিল কাজ। কপাল জুড়ে থাকত থ্যাবড়া চন্দনের ছাপ। অনেক চেষ্টা করেছিল একটা খোল কিনতে, হয়নি। ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর ওর মৃদঙ্গর আঙ্গুল চলে আসে। কিন্তু ওর হাতের তালুতে ছিল অন্য আনন্দ। গ্রামের তাল-সুপুরি পেরিয়ে ওর সুনাম ছিল জেলায়-জেলায়। বানাত অসাধারণ লাবড়া। বেছে-বেছে বাগান থেকে তুলে আনত বেগুন, মাচার কুমড়ো, লতানো বরবটি। দুটো হাত মেথি, জিরা, মৌরি-লঙ্কা-পাঁচফোড়ন আর হলুদে গান বাঁধত। কত খিদে মিটিয়েছে বীরেন নামগানের তাঁবুতে, মহল্লায়। কাঁদিয়েছে ভক্ত-শিবির। প্রাণ যখন বাঁচার জন্য ধুক ধুক করছে, শরণার্থী শিবিরে ফুটছে মসুর খিচুড়ি; মাঝে মাঝে, এতগুলো বিপন্ন মুখে তৃপ্তি দিতে বীরেন কাঠের আগুনে ছিটিয়ে দিত গোটা ডিম, তেজ পাতা, লাল আলু আর ধনেপাতা, সাথে ভেলি গুড়। ধোঁয়া হয়ে মাটিতে নেমে আসত উত্তপ্ত কড়াই। সশরীরে আশীর্বাদ ত্রাণের থালায়। দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বীরেন; পিছু ডাকে পোড়া লঙ্কা, জিরে-ফোড়নের ঝাঁঝ। বীরেন বলত, লাবড়া আমার গান, আমার রামপ্রসাদ।
বাড়ি ছাড়ার আগে মিঠুর জন্য খাবার-জল দিয়ে আসতে পারেনি কিরণ। মিঠুকে কি খেয়ে ফেলেছে! নিশ্চয়ই কেউ মিঠুর জন্য এখনও নিয়ে আসে পাল-বাগানের ঘাস। মিঠুর গলায় হাত রাখলে পাওয়া যেত আলতো প্রদীপের আঁচ। পেত্নির আঙুলগুলো সারাদিন নরম হয়ে থাকত। সন্ধেবেলায় পুকুরপারে গেলে মিঠুর জন্য খুব কান্না এসে যায় কিরণের।
ঢাকায় নাকি দাদার লোক আসার কথা ছিল, কিরণকে কলকাতায় নিয়ে যাবে! পরে গান্ধীর পদযাত্রায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল দাদার। বড়দা আসবে। সেই প্রথম ভয় পেয়েছিল কিরণ, ভয়ের সাথে কলকাতা যাবার আনন্দ বাঁচিয়ে রাখার রুদ্ধশ্বাস। গুমোট রাতে ও স্বপ্ন দেখল, জনা তিনেক পেত্নি তেঁতুল গাছের নীচে কাঠবাদামের পোলাও রান্না করছে আর পাশেই টিনের নৌকায় পালকের আগুনে বুক বুক করে ফুটছে জ্যান্ত পাতিহাঁস। নোলকের বদলে ওদের নাকে ছেঁড়া শুকতারার নাকছাবি, নিভে-নিভে যায়। ওরা কানে-কানে কী যেন বলছে। স্বল্প কথার সেই গরম হল্কায় আকাশ থেকে হ্যাংলা বা ছোট মনের তারারা খসে পড়ছে। কয়েকটা গিয়ে পড়ল চালকলে, একটা নারু মামার তালবাগানে। বড়দা আসতে পারেনি।
বড়দা সুপুরি আর কলার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, চাল পাঠাত কলকাতায়। খুব একটা গা করত না সংসারের কিছুতে। বৌদি আর তার বড় মেয়ে শ্যামলা, কিরণবালার বাপের বাড়ির দিকের সবচেয়ে কাছের মানুষ। অনেক ভেতরের খবর রাখত বড়দা। বীরেন্দ্রকে একবার বলেছিল : ‘চলে যা, থাকতে পারবি না।’ অবিশ্বাস ঘন হবার আগেই দাদা লুকিয়ে মাঝরাতে পরিবার নিয়ে চলে আসে বঙ্গের পশ্চিমে। মাসখানেক বাদে গোবিন্দপুরে ছাই হয়ে গেল দাদার সাধের আটচালা। মেঘ হয়ে চলে গেল বকফুলের ডালপালা চৌমুহিনীর দিকে।
ভ্যাপসা গরমের বেড়ার ঘর। শুধু ঘূর্ণিঝড় এলে জানলা দিয়ে মন-ভালো হাওয়া ঢোকে। আর বৃষ্টিতে বাসনালয়ের ক্যালেন্ডার কঞ্চি দিয়ে সেঁটে দিতে হয়, সঙ্গে পুরনো অয়েল ক্লথ। উঠোনে গাড়ি-রাস্তার থেকে চুরি করা টালি, তিন পা করে রাখা। বারান্দায় শিউলির মতো ছড়ানো ছাগলের নাদি। বড় মেয়ের কানে সারা বছর পুঁজ, কনকনে ব্যথা। রোদে কোনও মিষ্টি নেই। ভাতের ভেতর গন্ধ হয়ে লেগে আছে খড়ের আগুন। ছাগলের দুধ বিক্রি করতে এরা বাট প্রায় ছিঁড়ে ফেলে। বীরেনের ভায়রা চটি দিয়ে মাছি মারে, গুনে-গুনে রাখে। ‘আজকে আঠারোটা।’ এখানে ঘটি আর তামার গ্লাস, সবই অন্যরকম লাগে। সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়ালে নাকি ভিটামিন চলে যায়! পা বাড়ালেই অপরিজন।
বীরেন বহু চেষ্টা করে একটা সাইকেল সারাবার দোকান খুলল লাল রবারের আঠায়, ওর নখে তাড়ির গন্ধ। হল না বিশেষ কিছু। সারা দিন বালি-মাখা শিরিষ কাগজ, তবু কারো টায়ার ফাটে না। রবার টিউব চুরির অপবাদে পাম্পার দিয়ে মেরেছিল নাম করা লোকাল হাফব্যাক, ফুটবলের বিধান রায়। ডান হাতের বুড়ো আঙুল এখন আর কাজ করে না।
আশ্রিতা কিরণের পায়ে-পায়ে অশান্তি, অপমান। নিজের বলে না আছে একটা তুলসী গাছ, না আছে একটা বাসন মাজার ঘাটলা। মাসের শেষে মুদির দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটে না। ডাকলে ডাক্তারবাবু আসে না। চিঠি পাবার ঠিকানা পর্যন্ত নেই। পেত্নি বটে!
কতদিন আর বালতিভর্তি উদ্বৃত্ত লাবড়া নিয়ে আসবে মজুরি হিসেবে! বীরেন অনেক চেষ্টায় একটা মাছের দোকান দিল। ঠাকুরের কৃপায় এখন বড় কারবার। কলাপাতার ওপর কাটা মাছে রক্ত ছড়িয়ে রাখে। রক্তর লাল মানেই এখনও আছে প্রাণ। গিজগিজ করে খদ্দের। তাজা মাছের জন্য ওর নাম-যশ হয়েছে, ভ্যানরিক্সায় উৎসবের সাপ্লাই যায়। কিরণের এখন দুটো গাভী, মিঠু আর মিনু। কিন্তু উৎসবে, কলেরার সচেতন শিবিরে, রামঠাকুরের তিরোধান দিবসে, সরস্বতী পুজোয় বীরেনের দশ আঙুলে জাদুকাঠি জিরা-মৌরি, কাঁচালঙ্কা, সুপুষ্ট বেগুন স্বানন্দে আত্মবিশ্বাস হয়ে আছে। কিরণের অপমান চলে গেছে।
কেটে গেল বছরের পর বছর। ওদের গ্রাম থেকে এদিকে উদ্বাস্তু তেমন কেউ আসেনি। আত্মীয় বলে কেউ নেই গোবরডাঙায়। সবাই কলকাতার আশেপাশে। এখানে সবাই নতুন, কোনও স্মৃতি নেই, ইতিহাস নেই। ভাগ করে বাঁচার গল্প নেই। একা কিরণ আর বীরেন, কিছু কলা গাছ, পেঁপের বাগান, তেল মাখা জাম রঙের চওড়া একটা বেগুনক্ষেত। ব্যাঙাচি আর শালুকে ভরা নতুন পুকুর। খেজুর গাছের ঘাট। রাস্তায় প্রবল গাছের মতো বকফুল। গাছ পেরোলে প্রতিষ্ঠাতা বীরেনের তাসের ক্লাব, গোলাপি দরজার ‘ভোরের আকাশ’। বীরেন রেডিয়ো শোনে। বিশালদেহী চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ। লম্বা ফরওয়ার্ড পাস। বল এখন সিতেশ দাসের পায়ে। গোল! রেডিয়োয় চিৎকার করে ওঠে মাঠের মানুষ। মনে হয় চটকলে আগুন লেগেছে।
এত বড় পরিবারের সবাই কোথায় ছিঁটকে গেল! কত চেষ্টা করেছে বড়দার একটা খোঁজ নিতে, দেখা করবে। শুনেছে কাঁচরাপাড়ায়, আবার কেউ বলে খড়দা বা ব্যারাকপুরে আছে। বড়দা-বৌদি কোথায়? ওঁরাও কি আমার খোঁজ করছে? কত বছর হয়ে গেল, দাদাকে দেখতে চায় কিরণ। কত কথা আছে। দাদাকে বলবে, কিরণ এখন ভালো আছে। নিয়ে আসবে গোবরডাঙায়। নিজের বাড়িতে। দাদা দেখে যাক পেত্নি কী সুন্দর করে বেঁচে আছে।
শীত কাল, দুপর বইছে। খুব হাওয়া। মিঠু আর মিনুর গায়ে ডবল করে চটের বস্তা জড়াতে হয়। হঠাৎ হাজির পিয়ন গোকুল। হাতে পোস্টকার্ড। ছবির মেয়ের বিয়ে, গয়েশপুরে। ছবি বৌদির বোন। ভগবান! দাদার সাথে দেখা হবে! কিরণের উঠোনে মুষড়ে ওঠে নোয়াখালির ছবি! উত্তরের হাওয়ায় জেগে ওঠা কালোজাম গাছ। কাচের চিরুনি দিয়ে ঘুণপোকা, দাঁত কাটে গোয়ালের ঘরে। কত বছর বাদে!
বীরেন গয়েশপুর যেতে চাইছে না, এত দূর! কিন্তু কিরণের মুখ শুধু কালো হবে। দাদার সাথে দেখা করার সুযোগও হাতছাড়া হবে। ‘নাহ! ভালই লাগবে। চল।’
দাদাবৌদির জন্য ডাল-বড়ি, অর্ডার দিয়ে মাখা সন্দেশ, আর বড় দুটো গামছা গুছিয়ে, দুঃসময়ের এক যুগ বাদে, এই প্রথম পরিজনের সাথে মেলার আনন্দে গয়েশপুর রওনা দিল কিরণ। বিয়েবাড়িতে, ঘন সিঁদুর মাথায়। জুতোয় সবুজ প্লাস্টিক। ঠিকানা আছে, কিছু চেনে না, এই প্রথম অত দূর! রেলগাড়িটা কাঁপছে কেন? লাইন থেকে পড়ে না যায়। বীরেনের হাত শক্ত করে ধরে রাখে কিরণ। মাঝে মাঝে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। আর লোকজনের মুখে তাকিয়ে নিজেকে সাহস জোগায়। বীরেনের মনে পড়ে না, কতদিন বাদে মাছের ভেরির বাইরে। এখন সে আত্মমগ্ন মানুষ। ভয় আর বিরক্তি সহজে ঠাঁই পায় না মনে। গাড়ির দোলায় ধারদেনা শোধ করার কথা ভাবছে। জানালা দিয়ে দেখে যায় কেমন পাল্টে যাচ্ছে ইঁটভাটা, চিমনি, দোকান আর গরিবের মুখ।
কিরণ ভেঙে পরে যখন জানতে পারে দাদার জামাই-এর শরীর ভালো যাচ্ছে না, দাদারা আসতে পারবে না! বড়দা আসবে না! এরকম কিছু ভাবতেই পারেনি কিরণ। কপালে নেই। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ব অনুভব কিরণের মন ভরিয়ে দিলো। গোবিন্দপুরের বাপের বাড়ি যেন গয়েশপুর এসেছে। এতো চেনা মানুষের ভিড়ে কিরণ আবিষ্কার করে ও কত একা এবং বিচ্ছিন্ন, অন্য এক পৃথিবীতে আছে। পেত্নির কানের দুল, হাতের পলার ভরি, ওর বিস্তৃত উঠোনের মালতী, টগর আর বীরেনকে নিয়ে কারো উৎসাহ নেই! মেয়েরা সবাই সুখী, উজ্জ্বল মুখ। সবাইকে খুব ফর্সা লাগছে! বৌদি জড়িয়ে ধরেছে। দেখা হল বাসন্তী কাকিমা, দেখা হল স্বপনের বোন। মাথায় জুঁইফুল, সবুজ নখ, গায়ে রজনীর ঘ্রাণ।
আরেকবার মাংস চাইল বীরেন, হাড় ছাড়া। বেছে-বেছে, গরম-গরম।
তবে একটা দারুন কাজ হল। জানা গেল বড়দা এখন বেলঘরিয়া আছে। শ্যামলার বিয়ে হয়েছে, দোতলা বাড়ি। দাদার ঠিকানা পেয়ে যায় কিরণ। কমিউনিস্ট পার্টি করে, বড় নেতা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন নিয়ে খুব আন্দোলন করছে। বক্তৃতায় দারুণ! দাদাকে সোমনাথ লাহিড়ী খুব ভালবাসে।
কিরণের এখন একটাই লক্ষ্য, বেলঘরিয়া আসবে। খুব শিগগির। ব্যবসার কারণে বীরেন আসতে পারে না। একাই একদিন দাদার বাড়িতে বেলঘরিয়ায় পৌঁছে যায় কিরণবালা। দাদা বাড়ি নেই, খড়্গপুরে গেছে,পার্টির মিটিং আছে। দু’তিনদিন লাগবে ফিরতে। কিরণ ঠিক করে দু’দিন দাদার বাড়ি থেকে যাবে।
দাদার একটা ছেলে হয়েছে, কিরণ জানত না। সবে কলেজে ঢুকেছে। চুলে টেরি। হাতে বালা। ছেলেটা মাঝে মাঝে দু’হাত তুলে চিৎকার করে উঠত : ‘গো-ব-র-ডা-ঙা!’ প্রথম-প্রথম কিরণ ভেবেছিল, ওর বোধহয় খুব শখ পিসির বাড়ি যেতে। সারাদিন কিরণ বকবক করে যায়, ওর গল্প শেষ হয় না। প্রথম-প্রথম বৌদি আগ্রহে কিরণের কথা শুনে যাচ্ছিল, কিন্ত বৌদির কথা ফুরিয়ে যায়, যেন কিছুই বলার নেই। কেমন আলগা-আলগা ভাব। নোয়াখালির বৌদির সাথে কিরণ এই মানুষটার কোনও মিল খুঁজে পায় না। অনেক পালটে গেছে। কিরণকে আতিথ্য দিতে-দিতে বৌদি বিরক্ত হয়ে যায়। ওর রোজকার নিয়ম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সারাদিন কিরণকে সময় দিয়ে। বৌদি বুঝতে পারে না পেত্নির এত আবেগের মানে কী! দুপুরে গা ছেড়ে ঘুমটাও হল না। এক অনাহুত অতিথিকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে আরও একটা রাত! তার ওপর স্বামী অমানুষিক পরিশ্রম নিয়ে ফিরলে দরকার টানা ঘুম আর বিশ্রাম।
কিরণ বুঝতে পারে বৌদি খুব একটা খুশি নয়। যত্ন আর রান্নার, ঘর সাজানোর তারিফ করেও বৌদির মুখে হাসি ফোটাতে পারল না কিরণ। চুপচাপ বৌদির মুখ। তবে অনিচ্ছুক আপ্যায়ন আছে। একটু বেসুরো লাগল কিরণের কাছে। দাদার ছেলে কথাই বলল না! ছেলেটা তো জানেই না যে, ওর একটা পিসি আছে! তবুও আরেকটা রাত থেকে যায়, যদি দাদা আসে!
বড়দার সাথে দেখা হল না। বৌদি বলেছিল বীরেনের জন্য একটা আলোয়ান দেবে। ভুলে গেছে। কিরণ রওনা দেয় গোবরডাঙায়। বাসে ওঠে। আরেক বেলা থেকে গেলে দাদার সাথে কিন্তু দেখা হত। এতদূর এসে চলে যাবে! একটা ধুলোমাখা বাসে ওঠে কিরণ। লেডিস।একটা সিট পেয়ে যায়। ব্রেক ফেল। কন্ডাক্টরের অপূর্ব চামড়ার ব্যাগ থেকে সিকি-আধুলি ছিটকে পরে। ড্রাইভার বসে আছে, নিরুত্তাপ। কিরণ চট করে নেমে গেল, বাস থেকে। বেশি দূর নয়। খোঁজখবর করে দাদার বাড়ি চলে গেল। মিনিট পনেরোয়। বৌদি অবাক!
‘কী রে?’
‘বাস ব্রেক-ফেল করেছে। একটু জল দাও।’ বৌদির মন সত্যি খুব ভাল। এক গ্লাস জল, সঙ্গে ছানার সন্দেশ। ‘তোর দাদার আসতে আজকেও দেরি হবে। আমি ব্যাংকে যাব এখুনি।’ কিরণ বুঝল আর ঢোকা যাবে না বাড়িতে। ‘তুই কিন্তু সাবধানে যাস।’ ‘তাড়াতাড়ি যাই, ওখানে আবার সন্ধেবেলায় বেশ ঠান্ডা পড়ে।’ কিরণ বৌদিকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করে বীরেনের আলোয়ানের কথা। ‘দেখিস, ঠান্ডা লাগাস না। দাদা শুনে খুব কষ্ট পাবে, তুই এতদূর এসে ফিরে গেলি। দুগ্গা দুগ্গা…’
অনেক মাস, একটু-একটু শীত পড়ছে।
একদিন অবিশ্বাস্য একটা খবরে কিরণ উচ্ছ্বাসে উপচে ওঠে। বীরেন্দ্রর কাছে খবর এসেছে পার্টির সংগঠনের সভায় বড়দা গোবরডাঙার রেলমাঠে আসছে! এর থেকে বড় খবর কিরণের কাছে কিছু হতে পারে না। একজন কমরেড রাস্তায় বীরেনকে বলেছে, বড়দা নাকি বোনের সাথে দেখা করতে আসার ইচ্ছে জানিয়েছে!
স্বামী-স্ত্রী দু’দিন ধরে জল্পনা করে— নারকোলের মোদক, বোয়াল পাতুরি; বড়দার প্রিয়; সঙ্গে কাতলা। কিরণ চায় কাছিমের মাংস ঝাল-ঝাল করে। বীরেনের মনে হল কাজটা ঠিক হবে না। ‘উনি মানবকল্যাণে কাজ করেন। না, দাদাকে কাছিমের মাংস দেওয়া যাবে না।’ পাঁঠার মাংস করতে হবে, কষা করে। ‘আমি ভীমের দোকান থেকে বেছে নিয়ে আসব।’ কুমড়ো ফুলের বড়া করতে চায় কিরণ। ফুল ছিঁড়তে গিয়ে বীরেনকে বোলতা কামড়ে দেয়। কিন্তু বীরেন জেদ ধরে আছে, আজ মন-প্রাণ দিয়ে লাবড়া হবে।
নিকোনো উঠোন। মাঝখানে চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা করেছে কিরণ। লতাপাতার সাথে ফুল আর মাছ। মধ্যে-মধ্যে আমড়া গাছের পাতা, গোবিন্দপুরে উঠোনের হাঁস-ঘরের পেছনে সেই আমড়া গাছ। দু’একটা বকফুল। বড়দার মনটা ভরে যাবে। মিঠু আর মিনু দুজনকে ঘরের পেছনে বেঁধে রেখেছে। ওদের দুধে একটু ক্ষীর বানিয়েছে। দাদাকে আজ কিছুতেই ফিরতে দেবে না, এখানে থাকবে।
হালকা করে জল-টিফিন করে কিরণ বীরেনকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। বীরেন আয়না ধরে থাকে। কিরণ দাড়ি কামিয়ে দেয়। গোঁফের, কানের কাছে আস্তে-আস্তে ঘষে-ঘষে স্বামীকে পরিচ্ছন্ন ও ভাবুক পুরুষ করে তোলে।‘হাত ওঠাও।’ বিরক্ত হয় বীরেন। তবু ওঠায়। ‘এখান থেকে মাঝে মাঝে লৈট্টা মাছের গন্ধ বেরোয়। এটাও একটু পরিষ্কার করে দিই।’ বগলে শেষ সাবান পরেছে গরমের সময়। সেই এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়। কিরণ সব লোম কেটে দেয়, যতক্ষণ না খরখর শুকনো আওয়াজ বালকের স্পর্শ হয়ে ওঠে। ওর হাতের তলায় স্বাধীনতার ট্রাম্পেট বেজে ওঠে। পায়ের সব নখ সমান করে কাটে। সর্ষের তেল বুলিয়ে দেয়। বীরেনের মুখে আজ মঠ-সন্ন্যাসীর আলো।
বীরেন রান্নাঘরে। নিজের হাতে করবে এক নতুন জাতের লাবড়া। কয়েকটা কাঁঠাল বিচি, দারুচিনি, কাঁচকলা আর ঘরে পাতা ঘি খুঁজে-খুঁজে নিয়ে এসেছে পাড়াপড়শির থেকে। আদা, হলুদ বেটে দিচ্ছে কিরণ। ফোড়নের ঝাঁঝে মনে হচ্ছে ভাল কিছু একটা হবে।
এত সব করার পর, বীরেনের এবার মাথা ঠিক থাকে না। একদিনের মাছের ব্যবসা বন্ধ। এক পেট লোকসান। ভোরবেলায় দুটো বড় কাতলা আনার পর থেকে ঘরকন্নায় মেতে উঠেছে বড়দার জন্য। এবার কিরণের বায়নায় বীরেন তিতিবিরক্ত। দাদা নাকি নোয়াখালিতে কাঁসার থালায় ভাত না দিলে খেত না। থালায় মাঝখানে লেখা ছিল ‘শরৎচন্দ্র’। কিরণের আবদারে রাধেশ্যাম সরু ছেনি দিয়ে থালার ওপর খোদাই করে দিয়েছে ‘আমার বীরেন’। বড়দার জন্য সেরকম একটা নতুন বড় থালায় লিখে আনতে হবে ‘বড়দা’। বিড়বিড় করে বীরেন, ‘পেত্নি’।
কিরণ দাদার জন্য যে মুগ্ধ উপহার সাজিয়ে রাখছে, তার নাম নিজের পায়ে দাঁড়ানো সফল, দরদী বীরেন। টানটান বিছানা বালিশ, ফুলদানিতে লাল শালুক। বীরেন ইস্ত্রি করছে ওর খাদির পাঞ্জাবি। লবঙ্গ খেয়ে মুখটা পরিষ্কার রাখছে। বৌদির দেওয়া টাঙ্গাইল শাড়ি পরে মাথাভর্তি সিঁদুর দিয়ে ঘরের দরজা থেকে, বাড়ির গেট অবধি অস্থির পায়চারি করছে কিরণ। তাঁতের ফানুস যেন উঠোনে হাঁটছে। বীরেন কোথাও বসতে পারছে না। ভয়। যদি পাঞ্জাবি কুঁচকে যায়!
বেলা হয়ে গেল, রোদ পড়তে শুরু করেছে। দাদা কোথায়! কী ব্যাপার!
মেনগেট থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরণ। আজ রাস্তাটা একটু খালি-খালি। তবু যেন অন্য এক আলো রাস্তায় জড়িয়ে আছে। উনুনের পাকা আঁচের মতো হলদে আভা। আনন্দের রং! একটা নিভৃত সাইকেল কদম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে! বিচুটির ঝোপের পাশে। ইটমাটির রাস্তা দূরে দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা চলে যায় গাড়ি-রাস্তায়, আরেকটা বাঁক নিয়ে মাটিভাঙা খালের দিকে। রাস্তার ওপার দিয়ে সেচ-অফিসের জল নিরিবিলি বয়ে যাচ্ছে, কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে এলোমেলো দুপুর। জলের দিকে তাকালে, চোখে লাগে তেজ।
একটা হলদে ধুলোর ধোঁয়া গাড়ি-রাস্তার দিকে ভাসতে-ভাসতে ওপরে উঠে যায়। এটা বড়দার গাড়ি? ধুলোর মেঘ আরও লালচে আর ঘন হয়ে ওঠে। কিরণ আকুল হয়ে তাকিয়ে থাকে। গাড়িটা বোধহয় ঢুকছে! তারপর সব কিছু পরিষ্কার, শুধু একটা স্কুটারের চলে যাওয়ার হালকা শব্দ মিশে যায় বুলবুলির ডাকে।
কিরণ বিশ্বাস করে, কোথাও যেন ওর জন্য বড়দার মনটা কীরকম করত। বিয়ের পরের দিন। বিকেলে সিল্কের লাল ঘোমটা, নতুন চটির ফোস্কা, সারা শরীরে ব্যথা, দাদার অর্ডার দেওয়া কানপাশা আর গলায় সোনা, হাতের মুঠোয় কাঠের লক্ষ্মীসিন্দুর, অথচ মুখটা পুড়ে শুকিয়ে গেছে। রাত জাগার, সংশয়ের ধকল আর নিতে পারছে না কিরণ। বেনারসির গায়ে সোনালি ফুলপাতা, চোখ জ্বলে। চন্দন, কাজল লেপটে গেছে মুখে, গালে-মাথায় মুছতে গিয়ে সিঁদুরের দাগ মিশে গেছে ওর কালো চামড়ায়। একটা ডোবার পাশ দিয়ে নন্দীবাড়িতে যখন প্রায় পৌঁছে গেছে, বড়দা বুঝতে পারে প্রথমবার এই মুখে শ্বশুড়বাড়ি ঢোকা ঠিক হবে না। বড়দা এগিয়ে এসে ওর মাথা বুকে রেখে বলেছিল : ‘জানি আর টানতে পারছিস না।’ ব্যান্ডপার্টিকে বলল, তোমরা মন দিয়ে বাজাও, এখানে দাঁড়িয়ে। সবাইকে দাঁড় করিয়ে বড়দা শোলার মুকুট ঠিক করে দেয়, ভেজা রুমাল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। ‘তোকে ঠিক মহারানির মতো লাগছে।’ সাবধানে মুছে দেয় চোখের নীচের কাজল। অনেকক্ষণ কিরণের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল বড়দা। ‘চিন্তা করিস না, সব খুব সুন্দর হবে।’ দাদার পাঞ্জাবির সেই দিনের লবঙ্গ বা লেবুর গন্ধ, মনে নেই, এখনও কিরণের কাছে একটা নিশ্চিন্ত আশ্বাস।
চাষের নালিতে এখন জলের জোর কমে এসেছে, সাইকেলটা আর নেই। আরেকবার গাড়ি-রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরণ। জলের মধ্যে গাঢ় কমলা আকাশ আর সুস্থির কদম গাছের ছায়া মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। টগর পাপড়ির মতো দু’ফালি মেঘ, সামান্য দোলায় ভেঙে যাচ্ছে জল হয়ে।
রিক্সাস্ট্যান্ড অবধি এগিয়ে যায় বীরেন। অনেক ল্যাটা মাছ এসেছে। পেঁয়াজি শেষ।
প্রায় সন্ধ্যা নেমেছে। মিঠু আর মিনুকে মশা কামড়াবে এবার।
একটা গুজব রটে যায়, পার্টির সভায় বিরাট গন্ডগোল হয়েছে। রক্তপাত হয়েছে। রাস্তায়-রাস্তায় ব্যারিকেড। গুলি চলছে। শোনা যায় কয়েকটা পুলিশের নাকমুখ ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনতা কিছুটা স্বস্তি পায়।
হুড়মুড় করে লোক কালো লক্ষ্মীর চায়ের দোকানে জড়ো হচ্ছে আরও খবরের লোভে। ট্রানজিস্টার খুঁজে পাচ্ছে না দেবদুলাল।
এবার ঝিঁঝি ডাকছে। মিঠু-মিনুকে আর ঠান্ডা লাগানো যাবে না। কিরণ ওদের ঘরে নিয়ে আসে। বীরেন বুঝতে পারে পেত্নি আজ একদম একা, ভেঙে পড়েছে। ও বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
বড় ক্লান্তি আজ, কিরণের। ঢলে পরে ঘুমে।
খাবার-দাবার তুলে রাখে বীরেন। নব্যপ্রস্তরের বড় বাটি। খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা লাবড়া।
হ্যারিকেনের আলোয় বীরেন দেখে দুটো নাম লেখা ঝকঝকে থালা। দেওয়ালে হেলান দিয়ে, রান্নাঘরে। একটা টিকটিকি চকিতে মিটকেসের পেছনে লুকিয়ে যায়।
রান্নার বাসনকোসন নিয়ে পুকুরপারে চলে যায় বীরেন। আজ একটু ঘুমোক কিরণ। আজ নিজে সব বাসন মেজে রাখবে, যদিও কিরণের পছন্দ হবে না। পাথরে রাখা লাবড়া, অসম্ভব সুগন্ধ নিয়ে ডুবে যায় পুকুরের জলে, ভাসে কিছু লাউপাতা, চিকন পটল। একটা মাছ লেজের আচমকা ছিলায় আঁশবটির মতো নিখুঁত কেটে দেয় রাতজাগা দ্বাদশী বাতাস। বাইরে বড় অন্ধকার। করতালে শুরু হল কানুর গুণগান।
একটা ঘোমটা পড়া লম্বা ছায়া উঠোন দিয়ে মালতীগাছের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
হ্যারিকেন নিয়ে কিরণ তখন প্রায় পুকুরঘাটে।
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন