বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও বাঙালির ভবিষ্য-ভোজন
ভারি মুশকিল হল, খাওয়াদাওয়া নিয়ে চর্চা বা লেখালিখি করতে গেলেই মনোযোগের প্রায় সবটাই গিয়ে পড়ে খাদ্যরুচির উপর। আমাদের ইতিহাসের উচ্চাবচ, উপলবন্ধুর পথ বেয়ে বাঙালির যে খাদ্যরুচি গড়ে উঠেছে, তার বিবিধ বাঁক, হরেক দিকপরিবর্তন নিয়ে এই কয়েক মাসে কত কথাই তো হল। কিন্তু বাঙালির খাবারের ভবিষ্যৎ কী? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের হেঁশেলে কী রান্না হবে? কোন খাবারদাবার গড়ে দেবে আমাদের একুশ শতকের আইডেনটিটি?
প্রথমে মনে হয় গোলা প্রশ্ন, কিন্তু আদতে তা নয়। কারণ, দিনকাল ভাল নয়, এই শতকটাই গোলমেলে। আমাদের সামনে রক্তচক্ষু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারা দুনিয়ার জলবায়ুর এক মারাত্মক পরিবর্তন। আমরা জানি বিশ্ব ক্রমশ উষ্ণ হয়ে পড়ছে, বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, গরম বেড়ে চলার ফলে গলছে মেরু অঞ্চলের হিমবাহ ও বরফস্তর, সমুদ্রপৃষ্ঠ আরও উঁচু, আরও গরম হয়ে চলেছে, যার ফলে ব্যাপক, রাক্ষুসে ঘূর্ণিঝড় ও প্লাবনের সম্ভাবনা প্রবল ভাবে বাড়ছে, যার নিদর্শন আমরা বার বার দেখে চলেছি। এ সবের পিছনে আছে হরেক রকম কারণ, মূলত সারা দুনিয়া জুড়ে জীবাশ্ম-জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা, পেট্রোলিয়াম, আর মিথেন বা প্রোপেনের মতো হাইড্রোকার্বন-ভিত্তিক প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার, উন্নয়নের নামে নির্বিচার বনসম্পদের বিনাশ, ইত্যাদি। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের খাওয়াদাওয়ার – খানিক পরিমাণে হলেও – সম্পর্ক আছে। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের ফলে কতখানি কার্বন আমাদের আবহমণ্ডলে নিঃসৃত হচ্ছে, তার উপরেও নির্ভর করে পৃথিবীর উষ্ণায়ন।
যত আমরা চালানের মাধ্যমে আমদানি করা খাবার খাব, তত আমাদের খাওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে কার্বন ছড়াবে বেশি, দুনিয়া গরমও হবে তত বেশি, কারণ এই গ্যাস হল গ্রিনহাউস গ্যাস, যা বায়ুমণ্ডলে আটকে থাকে, গরম বাড়ায়। বাংলাদেশের থেকে আমদানি পদ্মার ইলিশ খাবেন? জানবেন, সেই ইলিশের ‘কার্বন ফুটপ্রিন্টে’ মিশে থাকবে সমুদ্রগামী ইলিশ-ট্রলারের সঙ্গে চাঁদপুর থেকে কলকাতার সড়কপথে ট্রাকের ব্যবহৃত ডিজেল, কাজেই সেই ইলিশের সর্ষেভাপার দীঘল পেটিটি এক অপরাধবোধের ভ্রূকুঞ্চন ছাড়া মুখে তুলতে পারবেন না। চিংড়ির ক্ষেত্রেও সেই একই দশা। তাই, যদি বিশ্ব-উষ্ণায়নের ভয়াবহ প্রক্রিয়ায় আরও অগ্নিসংযোগ করতে না চান, তবে আপনার পারিপার্শ্বিক থেকেই সংগ্রহ করুন আপনার খাবারদাবার। খান আশপাশের পুকুর খাল বিল থেকে তোলা ‘দিশি’ বা ‘লোকাল’ মাছ, তাতে ‘চালানি’ মাছের মতো পরিবহণ-জ্বালানির ধূম্রগন্ধ নেই, আর জালের বদলে ছিপ আর বঁড়শি দিয়ে ধরা – অর্থাৎ যাকে বলে ‘লাইন-কট’ (line caught) হলে তো কথাই নেই, অনেক পরিবেশ-বান্ধব তৃপ্তির সঙ্গে সে মাছ খেতে পারবেন।
আর মাংস যদি নিয়মিত খান, তা হলেও খুব সাবধান। গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, বা উটের মতো যে প্রাণীরা জাবর কাটে, অর্থাৎ ঘাসপালার মতো খাবার প্রথমে গিলে ফেলে পাকস্থলীতে চালান করার পর আবার মুখে ফিরিয়ে এনে ধীরেসুস্থে চিবোতে থাকে, তাদের শরীরে এই সব খাবার হজম করার জন্য যথেষ্ট এনজাইম নেই বলে তাদের পরিপাক হয় প্রধানত গেঁজে ওঠা, অর্থাৎ ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে। এর ফলে তাদের শরীর থেকে আমাদের বায়ুমণ্ডলে বেরোয় প্রচুর কার্বন ডাইঅক্সাইড আর মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস। মাংস বেশি খাওয়া মানে তাই পরিবেশ দূষণে মদত জোগানো, বিশেষত খাওয়ার জন্যই যাদের দানাপানি খাইয়ে খামারে লালন করা হয় বেশ কিছুদিন, তাদের মাংস। গরু আর ভেড়াকে খামারে লালন করার জন্য যে পরিমাণ জল খরচ হয়, সেটাও ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাই এক কিলোগ্রাম গোমাংস স্টেক বানিয়ে খাওয়ার জন্য যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়, পেট্রল বা ডিজেল পুড়িয়ে একশো কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে গেলেও তা হয় না। সাধে কি আমেরিকানরা বছরে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস ছাড়েন ঘরপিছু গড়ে আ-ট-চ-ল্লি-শ টন? এর জন্য আবহমণ্ডলের পরিবর্তনে (climate change) অবিশ্বাসী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্টদের দায়ী করলে চলবে না, এর দায়িত্ব বর্তাবে মার্কিন সমাজ-সংস্কৃতির উপরেই।
আর আমরা বাঙালিরা? আমরা হয়তো পাষণ্ড সাহেবদের মতো মুক্তকচ্ছ ষণ্ডভুক নই, কিন্তু যে রেওয়াজি খাসির গরগরে ঝোলে আমাদের গভীর আসক্তি, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ আর বিশ্বের উষ্ণায়নে তার অবদানও তো কিছুমাত্র কম নয়। যে চিন্তাশীল বাঙালির আজকের ভাবনাকে তামাম বাকি ভারতের ভেবে উঠতে নাকি কাল অব্দি গড়িয়ে যায়, সে তাহলে কী ভাবে হয়ে উঠবে এই একুশ শতকের বিপন্ন দুনিয়ায়, অন্তত ভারতে, এক আদর্শ ভবিষ্য- ভোজনের, এক দায়বদ্ধ খাদ্যাভ্যাসের, অগ্রসৈনিক?
এ প্রশ্নের উত্তর কঠিন, কিন্তু অন্তত কিয়দংশে এই অভ্যাস গড়ে তোলা আমাদের সাধ্যের বাইরে নয়। দূর থেকে চালান আসা, আমদানি করা খাবারের বদলে আমাদের পারিপার্শ্বিক অঞ্চল থেকে আমাদের খাদ্যোপকরণ জোগাড় করার অভ্যাস – যাকে অনেকে বলেন to eat local – বহুদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনে এক প্রচলিত প্রথা ছিল। এখনও, বিশেষত রেলরাস্তা বা সড়কপথের থেকে একটু দূরের গ্রামবাংলায় সেই জীবনাচরণ নিয়মিত দৃশ্যমান। আমাদের ‘কাঁচা বাজার’-এর জন্যও যখন আমরা অনলাইন শপিং-এর দ্বারস্থ হই, তখন কম্পিউটার বা ফোনের অর্ডার-বোতামটি টেপার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কতখানি ফসিল ফুয়েল পোড়ানোর দায়িত্বভাক্ হয়ে যাই, তা নিজেরাও খেয়াল করি না। কিন্তু ধরুন হেঁটে বাজারে গিয়েও আমরা বেশির ভাগ সময়েই কিনে ফিরি অন্ধ্রের ‘চালানি’ রুই (যে মাছের বরফচাপা রেফ্রিজারেশনেই খরচ হয় বিস্তর গ্রিনহাউস গ্যাস), ঝাড়খণ্ডের বেগুন বা মটরশুঁটি, কর্ণাটকের সজনেডাঁটা, উত্তরপ্রদেশের ক্যাপসিকাম, মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তীসগড়ের টোম্যাটো। এ সবের অনেক কিছুই আমাদের বাংলার বিভিন্ন জেলাতেও – ধরুন হাওড়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, ইত্যাদি – হয়, একটু কষ্ট করলে সে সব জিনিসও কেনা হয়, স্বাদে কিছু কম নয়, পরিবেশ-বান্ধবও অনেক বেশি। ভেড়িতে চাষ-হওয়া – অনেক ক্ষেত্রেই ‘হাইব্রিড’ প্রজননে সঞ্জাত – মাছের ভিড়ে হারিয়ে যায় আমাদের খাল-বিল-পুকুরের ‘দিশি’ বা ‘লোকাল’ রুই কাতলা মৃগেল কই মাগুর ট্যাংরা পুঁটি শোল বাটা পার্শে খয়রা, যখন পাওয়া যায়, একটু দাম বেশি পড়ে বটে, কিন্তু স্বাদে অতুলনীয়, আর তার সঙ্গে উপরি পাওনা এই পরিবেশ-নম্র সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে বাহবা দেওয়ার সুযোগ।
ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু দেশে অনেক দিন ধরেই প্রায় এক সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা পালন করেছে ‘Farm-to-Table’ প্রথা, অর্থাৎ চাষির কাছ থেকে খাদ্যোপকরণ সরাসরি নিয়ে এসে – অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে – রান্না করা, যে খাবার সাধারণত হাজির হয় পরিবেশ বান্ধব রেস্টোর্যান্টের টেবিলে। জার্মানির মতো ঘোর মাংসাশী দেশেও সেই ধরনের রেস্টোর্যান্ট অতি জনপ্রিয়। ঋতুচক্রের সঙ্গে তাল রেখে মরসুমি উপকরণ জোগাড় করে, স্থানীয় চাষিদের খামার থেকে সরাসরি অর্গ্যানিক শাকসব্জি ও মাছ-মাংস আনিয়ে, অতি যত্নে তাঁর রেস্টোর্যান্টে এ সব জিনিস পরিবেশন করেন বিশ্বখ্যাত শেফ অ্যালিস ওয়াটার্স, তাঁর এই রন্ধনশৈলীকে বলা হয় ‘স্লো ফুড’, চারিত্র্যে, পরিবেশনে, দর্শনে যা হল ‘ফাস্ট ফুডের’ বিপ্রতীপ। ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে ওয়াটার্সের সুবিখ্যাত ‘ফার্ম-টু-টেবল’ রেস্টোর্যান্ট শে পানিস (Chez Panisse)-এ খেতে গাঁটের কড়ি ভালই খরচ হয় বটে, কিন্তু অতি-বাণিজ্যীকৃত, কর্পোরেটায়িত, বাজার-তাড়িত খাদ্যসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী উদ্যমকেও সমর্থন জানানো হয়। ওয়াটার্সের We are What we Eat: A Slow Food Manifesto (২০২১) বইটিতে রয়েছে এই উদ্যমের এক স্বাদু বর্ণনা, আর বিপন্ন পৃথিবীর মানুষের ভবিষ্য-ভোজনের এক জরুরি দিকনির্দেশ।
আমরা হয়তো এ সব ব্যাপারে খানিক পিছিয়ে, কিন্তু মুম্বাইয়ে, বাঙ্গালোরে বেশ কয়েকটি রেস্টোর্যান্টের মাধ্যমে ‘ফার্ম-টু-টেবল’ কর্মোদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, সেগুলি অতি জনপ্রিয়, আর তাদের এই উদ্যমে চাষিদের পকেটে পয়সা বেশি ঢুকছে, লাভের গুড় দালালরা খেয়ে যেতে পারছে না, সেটাও একটা বিরাট প্রাপ্তি। আশার কথা, কলকাতায় এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে সম্প্রতি, উত্তরের দত্তপুকুরে, দক্ষিণের রাজডাঙায়, পূর্বের নিউ টাউনের মতো জায়গায় বেশ কয়েকটি অর্গ্যানিক ফার্ম, আগেভাগে অর্ডার দিয়ে রাখলে তাঁরা আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবেন (আর, অবশ্যই, কার্বন-ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য আপনি নিজে তুলে নিতে পারেন) পটল বেগুন ঢ্যাঁড়স লাউ থেকে শুরু করে কচি পালং বেসিল কারিপাতা লেটুস রকেটের মতো হরেক স্যালাড-পাতা আর ‘মাইক্রোগ্রিনস’, মায় মরসুমে আপেল থেকে খেজুর গুড় অব্দি।
কী বললেন, অ্যাঁ? শুধু এ সব খেয়ে আপনার পেট ভরবে না? আচ্ছা, অন্তত কিছু তো করুন, যাতে আমাদের ওই ‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস …’ ব্যাপারটা টিকে থাকে। রেড মিট খাওয়া কমিয়ে দিন (মুরগি বা হাঁসের মাংসের কার্বন-পদচিহ্ন অন্তত দশ থেকে পনেরো গুণ কম), মাছ খান হেসে খেলে, বিশেষত খাল-বিল-পুকুরের ‘লোকাল’ মাছ, হরেক রকমের ডাল আর যথাসম্ভব শাকসব্জি ফলমূল খান মরসুম মেনে – ঘোর শীতে আলুপটলের ডালনা বা ঝিঙেপোস্ত বাদ থাক, আপনার মুখে বে-মরসুমি হাসি ফোটাতে পৃথিবীর স্ট্রেস হয় বেশি – আর জায়গা থাকলে নিজের বাড়িতেই লাগিয়ে নিন দু-চারটে লেবু লংকা ধনেপাতার চারা। আমাদের সুবিধে হল আমাদের শাকসব্জির অফুরান ভাণ্ডার, ভারতের অন্য অনেক প্রদেশের মতো আমাদের অপর্যাপ্ত দুধ ছানা পনির মাখন চিজ (হ্যাঁ, এদের কারওই কার্বন ফুটপ্রিন্ট বড় একটা কম নয়) খেয়ে নিরামিষাশী হতে হয়না। কাজেই এবার থেকে বাজারের একটু প্রান্তবর্তী অঞ্চলে শাকপাতা থোড় মোচা এবং কখনওসখনও ‘দিশি’ হাঁস বা মুরগির ডিম নিয়ে বসে থাকা ‘মাসিদের’ কাছে ‘রিলেশনশিপ কাস্টমার’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন, তাতে আপনারও মঙ্গল, তাঁদেরও, আর এই ক্লেদাক্ত পৃথিবীরও। আর ওই শাকপাতার অনুষঙ্গেই বাঙালির এই খাদ্য-খতিয়ানের যাত্রাটিও শেষ করি। আমার নটেগাছটি মুড়োল। সেই মুড়িয়ে-যাওয়া নটে স্যালাড-পাতা বা শাকভাজা হয়ে রাজত্ব করুক আপনাদের ভবিষ্য-ভোজনপাত্রে। হয়তো এই ক্ষয়ে-যাওয়া দুনিয়া তাতে আমাদের অনাগত শিশুদের জন্য, আর একটুখানি হলেও, বাসযোগ্য হবে।
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন