জানুয়ারি, ১৯৭৮। সম্ভবত বরোদার এম এস ইউনিভার্সিটিতে শিল্পী মীরা মুখোপাধ্যায়ের (১৯২৩-১৯৯৮) আসন্ন সচিত্র বক্তৃতার জন্য কিছু রঙিন ট্রান্সপারেন্সির প্রয়োজন। খবর পেয়ে তাঁর পদ্মপুকুরের বাড়িতে হাজির হন অরুণ গাঙ্গুলি। তার কিছুদিন আগে বিজ্ঞাপনের জগৎ ছেড়ে তিনি নিজের তালে, নিজের খেয়ালে ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজ করবেন স্থির করেছেন। বন্ধু কিশোর চ্যাটার্জির সূত্রে শিল্পীর সাথে এই মোলাকাত যে তাঁর জীবনের দুই দশক ব্যাপী এক অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে, তা হয়তো অরুণ গাঙ্গুলি তখনও ভাবেননি; যদিও একটা ‘মোমেন্টাস’ ঘটনা তাঁর চোখের সামনে ঘটছে, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। রঙিন ছবির পাশাপাশি, অরুণ গাঙ্গুলি ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইটে মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজের ছবি তোলা শুরু করেন, যা দেখতে-দেখতে তাঁর কাজ অতিক্রম করে তাঁর সমগ্র শিল্পকর্ম-জীবনের বিভিন্ন দিকের এক অমূল্য আর্কাইভ হয়ে ওঠে। একেবারে শেষের ছবিগুলো তোলা মীরা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর, যখন তাঁর অসমাপ্ত বুদ্ধমূর্তি তাঁর কিছু সহকর্মীর মিলিত প্রয়াসে সংযোজন করা হচ্ছিল। সেই অরুণ গাঙ্গুলির-ই তোলা ছবির প্রদর্শনী চলছে কলকাতার গ্যালারি ৮৮-এ; কিউরেট করেছেন শিল্পী অদীপ দত্ত এবং অধ্যাপক তপতী গুহঠাকুরতা।
প্রদর্শনীর ন্যারেটিভটা সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর করে, যাতে মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজের সাথে অল্প বা অ-পরিচিত কারুর তাঁর শিল্প বা আদর্শের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে অসুবিধা না হয়। প্রবেশ করার পর বাঁ-দিকে রয়েছে শিল্পীর একটি পোর্ট্রেটের পাশাপাশি দুটো প্রিন্ট, যেগুলোর একটা ৯০-এর দশকের শেষভাগে আর অন্যটার ২০২২-এ ছাপা। তুলনা করে দেখানো হচ্ছে নেগেটিভ থেকে অ্যানালগ পদ্ধতিতে ছাপা আর ডিজিটাল স্ক্যানের থেকে ছাপার পার্থক্য, অর্থাৎ অরুণ গাঙ্গুলির আর্কাইভের সাথে প্রদর্শনীর পার্থক্য— যা সময়ের ব্যবধানে হতে বাধ্য। তার পর আলাপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে মীরা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
জানা যায়, তাঁর শিল্পশিক্ষার শুরু হয় ১৪ বছর বয়সে, কলকাতার ইন্ডিয়ান সোসায়টি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টে। তারপর তিনি দিল্লির পলিটেকনিকে পেন্টিং, গ্রাফিক্স ও স্কাল্পচার নিয়ে ডিপ্লোমা করেন। ফিরে আসার পর ১৯৫২-তে শান্তিনিকেতনে তাঁর আলাপ হয় ইন্দোনেশিয়ার এক শিল্পী, আফান্দি কোসোমার (১৯০৭-১৯৯০) সাথে, যাঁর কাছে পেন্টিং শিখে তিনি সমৃদ্ধ হন (আফান্দির উপদেশ তাঁর মনে দাগ কেটেছিল; তিনি বলেছিলেন অতিরিক্ত ছবি না এঁকে, মাঝেমধ্যে নিজের ছবি মন দিয়ে দেখতে ও তা নিয়ে চিন্তা করতে)। ১৯৫৩ থেকে ’৫৬— মীরা মুখোপাধ্যায় কাটান বার্লিনের একাডেমি ডের বিল্ডেন্ড কুন্সট-এ। টোনি স্ট্যাডলার (১৮৮৮-১৯৮২) আর হাইনরিক কার্চনারের (১৯০২-১৯৮৪) মতো শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে তাঁকে বার বার একটি অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় : অনুকরণীয় ভাষা ত্যাগ করে শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশের নিজস্ব ভাষা কেমন করে খুঁজে পাবেন?
তবে মীরা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তিনি লাভ করেন ভারতীয় মানববিজ্ঞান সর্বেক্ষণের ফেলোশিপ নিয়ে ’৬০-এর দশকে বস্তার থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বহু ‘বিশ্বকর্মা’ গোষ্ঠীর ধাতু ঢালাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করার সময়ে। কিউরেটরদের মতে, ‘এই অভিজ্ঞতার গভীর প্রভাবের ফলে তিনি নতুন পদ্ধতিতে ভাস্কর্য নির্মাণ করা শুরু করেন, এবং শারীরিক শ্রম আর সমষ্টিগত প্রয়াস তাঁর বৃহত্তর ভাবনায় শিল্পের সাথে একাকার হয়ে যায়।’ এই দুটো দিক ফুটে ওঠে প্রদর্শিত ছবির মধ্যে দিয়ে; কিন্তু শুধু তাই নয়, ভাস্কর্য, ফোটোগ্রাফ আর কিউরেটরদের আখ্যানের মধ্যে চলতে থাকে এক ধরনের সংলাপ, যা কখনও একে অপরের সমান্তরালে চলে, কখনও স্পর্শকভাবে।
দেখে নেওয়া যাক মীরা মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ও শিল্পকর্ম-জীবনের সঙ্গী কারা ছিলেন। প্রথমেই উঠে আসে নির্মল সেনগুপ্তর নাম, যাঁর সাথে মীরা মুখোপাধ্যায়ের আলাপ হয়েছিল তাঁর দাদার সূত্রে; ৪০-এর দশকের শেষভাগে অথবা ’৫০-এর গোড়ায়। প্রধানত সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, নির্মল সেনগুপ্ত সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন বেশ কিছু বছর। এছাড়া তিনি ট্রেড ইউনিয়নবাদী ছিলেন এবং নরেন্দ্রপুর সংলগ্ন নলগোড়াহাটে গ্রামের মানুষের সাথে কাজ করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা ধানক্ষেত বিদ্যালয়ের সাথে মীরা মুখোপাধ্যায় জড়িয়ে পড়েন, আর এলাচি গ্রামে নির্মল সেনগুপ্তর বাড়িতে শিল্পী নিজের কর্মক্ষেত্র তৈরি করেন। এরই মধ্যে শুরু হয় মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাঁথার কর্মশালা— যেখানে স্থানীয় বাচ্চাদের আঁকিবুঁকি থেকে নকশা তুলে মহিলারা কাঁথা এমব্রয়ডারি করতেন; পাশাপাশি চলতে থাকে শিল্পীর নিজস্ব ফাউন্ড্রি বা ঢালাইয়ের কারখানা। দুই সঙ্গীর কাজকে কেন্দ্র করে গজিয়ে ওঠে একটা ছোট পরিবার, যাকে হয়তো এক অর্থে শৈল্পিক সম্প্রদায় বলা যেতে পারে। অরুণ গাঙ্গুলির ক্যামেরায় ধরা পড়েছে মীরা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের এই অধ্যায়ের কিছু মর্মস্পর্শী মুহূর্ত। কোথাও তিনি সকলের সাথে বসে গান-বাজনা করছেন, আবার কোথাও এলাকার বাচ্চাদের কোলে তুলে আদর করছেন।
এ ছাড়াও ছবির মাধ্যমে আমাদের আলাপ হয় লু রাট্-এর সঙ্গে। আমেরিকান ফুলব্রাইট স্কলার হয়ে ১৯৮৬ সালে তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন আধুনিক ভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে। মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রাট্ তাঁর স্বামী জন ও কন্যা ফেলিসিটির সাথে এলাচি যাওয়া-আসা শুরু করেন। অপ্রকাশিত একটি প্রবন্ধে রাট্ লেখেন, ‘ভারতের এবং পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার কিছু শিল্পীদের মতো মীরা নিজেই যেন একটি শিল্পকর্মে পরিণত হয়েছেন; তাঁর গোটা জীবন খোলা বইয়ের মতো, সর্বসাধারণের দৃষ্টির সামনে উদ্ঘাটিত… নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি যতটুকু বললেন, পুরোটাই ‘দেখা’-র বিষয়ে। জীবনের যাত্রাপথে আমরা কী দেখি? অন্যের জীবনের পথে চলতে গিয়েই বা আমরা কী দেখতে পাই?’একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম-জীবনের ছবির প্রদর্শনীতে কথাগুলো যেন বিশেষ তাৎপর্য গ্রহণ করে।
আর আছেন নিমাই চন্দ্র ভাস্কর, মীরা মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকারী। তাঁর একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, নিমাই চন্দ্র ভাস্করের জন্ম হয় মুর্শিদাবাদে। তাঁরা বংশ-পরম্পরায় পাথর খোদাইকারী। মীরা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর নিমাই চন্দ্র-ই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর অসমাপ্ত বুদ্ধমূর্তিটি সংযোজন করার। অরুণ গাঙ্গুলিকে সেই কাজের ছবি তুলতে আমন্ত্রণ করেন তিনি। কিন্তু প্যারাফ্রেজ করা সাক্ষাৎকার পড়তে গিয়ে একটু হোঁচট খেতে হয়। আমরা মীরা মুখোপাধ্যায়কে চারুশিল্পী হিসেবেই জানি, যদিও এই পরিচিতির ব্যাপারে তিনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেন। তাঁর বন্ধু মায়া ফন রোসেনব্লাড লিখেছেন যে, মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিল্পীর কল্পনাশক্তির থেকে তাঁর কলাকৌশল বা শ্রমের দাম কোনও অংশে কম নয়, আর তিনি নিজেও কখনও ‘শিল্পী’ হবেন ভেবে কাজ করেননি। যখন কিছু গ্রামের কারিগর তাঁর বিখ্যাত ‘কলিঙ্গে অশোক’ নামের মূর্তির গায়ে হাত বুলিয়ে নিখুঁত ঢালাইয়ের কাজের প্রশংসা করেছিলেন, মীরা মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এর থেকে অকৃত্রিম প্রশংসা আর হয় না।… যাঁরা যুগ-যুগান্ত ধরে এই শিল্পের ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন, তাঁদের মতো কারিগর হওয়া তো গর্বের বিষয়!’ মীরা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পকর্ম-চর্চার মধ্যে এই বিশ্বাস প্রস্ফুটিত হয়। কতগুলো বাক্য যেমন, He was discovered by Meera Mukherjee অথবা Taking him under her wings পড়ে মনে হয় যেন কারুশিল্প ও চারুশিল্পের যে-হায়ারার্কি সম্পর্কে মীরা মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, তা পুনঃস্থাপিত হচ্ছে।
অন্যদিকে রয়েছে অরুণ গাঙ্গুলির ‘দ্য লাস্ট কাস্ট’ সিরিজে মীরা মুখোপাধ্যায়ের সহকর্মীদের ন’টা একক আর একটি গ্রুপ পোর্ট্রেট। এলাচির তিনজন স্থানীয় মহিলার ফোটোগ্রাফ দেখে— তাতে সম্ভবত রয়েছেন মেনকা পাল, রোকেয়া বিবি ও সাইদা বিবি— মনে পড়ে যায় অমৃতা শেরগিলের ‘থ্রি উইমেন’ নামক বিখ্যাত কাজটির কথা, যদিও এক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহকের দৃষ্টিতে রোম্যান্টিসিজমের কোনও চিহ্ন নেই। ধরা পড়েছেন তিনজন খেটে-খাওয়া কারুশিল্পী। ‘দ্য লাস্ট কাস্ট’ নামটাও তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে যেমন এই ১৪ জন মীরা মুখোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত বুদ্ধমূর্তি ঢালাই বা কাস্টিং-এর কাজ করেছিলেন, অন্য দিকে শিল্পীর জীবনের শেষ অঙ্কে সহ-অভিনেতা হিসেবেও এঁরাই নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন।
আসা যাক মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজের প্রসেসের ছবির অংশে। কিউরেটরের নোট থেকে জানা যায়, সাধারণত ভাস্কর্যের ছাঁচ নির্মাণের জন্য সেই সময়কার শিল্পীরা প্লাস্টার অফ প্যারিস আর ইষ্টিকা ব্যবহার করতেন। দেশজ কারিগরদের অনুপ্রেরণায় মীরা মুখোপাধ্যায় তার জায়গায় বেছে নিলেন মাটি। সব ধরনের মাটির নমনীয়তা এক রকমের হয় না। নানা স্তরে তাঁর ছাঁচ প্রস্তুত করতেন মীরা মুখোপাধ্যায়— প্রথমে বেলে মাটি তারপর হয়তো ভাল করে ছেঁকে নেওয়া গোবর, বালি, এটেল মাটি, গমের ভুষি ইত্যাদি। তার ওপর কোনও-কোনও ক্ষেত্রে নুডলসের মতো করে তৈরি মোমের সরু-সরু পটি বসানো হত, যার ওপর দিয়ে ঢালাই করা হবে। মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজের অপূর্ব স্পর্শানুভূতি থেকে আন্দাজ করা যায় কী সাংঘাতিক শ্রমসাধ্য পদ্ধতিতে, কত যত্নে তা নির্মিত। অরুণ গাঙ্গুলির ছবি এবং কিউরেটরদের লেখায় শুধু যে কার্যধারার বিভিন্ন ধাপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তাই নয়, শিল্পকর্মের শ্রমের বাস্তবতা, ঘাম-মাটি-ঘুঁটের গন্ধ, ঢালাইয়ের আগুনের তাপ আর বন্ধুত্বের উষ্ণতা উপলব্ধি করা যায়।
প্রদর্শনীতে মীরা মুখোপাধ্যায়ের একটাই কাজ সশরীরে উপস্থিত। দেখা যাচ্ছে বহু মানুষের জটলা। বেশির ভাগের হাত মাথার ওপরের একটা রড ধরে আছে— যেন তাঁরা ঝুলে আছেন— আর বাকিরা তাঁদের গায়ে-গায়ে কোনওক্রমে চিপকে। একজন ব্যক্তি একটি ভার্টিকাল রড ধরে আছেন, দেখে মনে হতে পারে নৌকোর দাঁড়। অসামান্য এই কাজটার নাম ‘মিনিবাস’। ভাল করে দেখলে দেখা যাবে, শিল্পীর কল্পনায় যে-পাত্রটার মধ্যে এই সমস্ত মানুষ কিছুক্ষণের জন্য উভয়ের সংস্পর্শে আসে, তাঁদের ক্ষণস্থায়ী জনসমষ্টি-ই শেষে মুখ্য হয়ে ওঠে, মিনিবাসটা গৌণ হয়ে যায়। তার পাশে অরুণ গাঙ্গুলির তোলা চারটে ছবিতে মীরা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পকর্ম-প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। প্রথমটি উনুনের ধোঁয়ায় প্রায় ঢাকা; ক্রমশ সেই ধোঁয়া কেটে যায় আর পরের ফোটোগ্রাফগুলোতে বেরিয়ে আসে তার মাঝখান থেকে শিল্পীর হাতে-গড়া ভাস্কর্য। মীরা মুখোপাধ্যায়ের হাতে হাতুড়ি, ছেনি, মাথায় রুমাল বাঁধা। সেই মুহূর্তে শিল্পী এবং তাঁর শিল্পের বাইরের জগৎটার কোনও অস্তিত্ব আছে কি নেই, তাতে কিছু এসে যায় না— তিনি সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত তাঁর কাজে।
দেশের বহু ‘বিশ্বকর্মা’র সাথে আলাপ করে, তাঁদের সাথে কাজ করে মীরা মুখোপাধ্যায় এক সময়ে প্রশ্ন করেছিলেন, আধুনিক শিল্পীদের কাজের সাথে সম্পর্ক কেন সেই সমস্ত দেশজ কারুশিল্পীদের মতো নয়? তাঁরা যে সম্পূর্ণ সাধনা হিসেবে তাঁদের কাজকে দেখেন, তার থেকে কি শেখার কিছু নেই? তার জন্য দেবতামূর্তি গড়তেই হবে এমন কোনও কথা নেই কিন্তু মানুষের সাধারণ জীবনের বাস্তবতায় কি সেই সাধনা, সৌন্দর্য, আত্মসমর্পণ খুঁজে নেওয়া যায় না? জীবনের শেষার্ধে মীরা মুখোপাধ্যায় বৌদ্ধদর্শন এবং শিল্পচিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হন। ‘আমি শিল্পের কারিগর’, তিনি লেখেন তাঁর ‘বিশ্বকর্মার সন্ধানে’ বইতে। ‘সেদিক থেকে দেখেছি যে, যেখানেই বৌদ্ধধর্ম বিশেষ প্রসার লাভ করেছে, সেখানেই শিল্পের বহুল প্রাচুর্য। তাই জানতে চেয়েছি, শিল্পসাধনার পথ ধরেই বৌদ্ধরা নিজেদের মুক্তিপথ রচনা করে নিয়েছেন কি না।’ অন্যদিকে তিনি এও বলছেন যে, ‘কাজটি করতে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্বকর্মা নামের সঙ্গে বুদ্ধের নাম, সমস্ত অসুরের নাম, রাবণের নাম, পীর ও গাজির নাম, ব্রহ্মার নাম জড়িয়ে রয়েছে।’ অর্থাৎ, ধর্মমত নির্বিশেষে তিনি খুঁজে নিতে চেয়েছেন শিল্পের মধ্যে শুধু নয়, শিল্পকর্মের মধ্যে জীবন-সাধনার পথ। অরুণ গাঙ্গুলির ছবিতে, অদীপ দত্ত ও তপতী গুহঠাকুরতার লেখায় শিল্পীর প্রসেসের মধ্যে দিয়ে মীরা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পকর্ম-জীবন-ভাবনাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাতেই প্রদর্শনীর সার্থকতা।
তবু কিছু জিনিস নিয়ে যেন শিল্পী আমাদের ভাবতে বলছেন, কারণ শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে যে-ধরনের সত্যের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, তা হয়তো ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করা কঠিন। প্রতিষ্ঠিত চিন্তার কাঠামোয় যে-বাইনারিগুলো মাঝে মাঝে চলে আসে, সেগুলোকে যেন তাঁর কাজ প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছে : চারুশিল্প ও কারুশিল্পের যে-হায়ারার্কি, তা কি কোনওদিন মুছে ফেলা যাবে? আর যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে সেই নতুন ধরনের শিল্প কী রূপ নিতে পারে? দ্বিতীয়ত, আধুনিক শিল্পীর একক পরিচিতি ও শিল্পগোষ্ঠীর পরিচিতির মধ্যে বিভেদ কি কোনওদিন ভাঙবে? আর তৃতীয়ত, আধুনিক শিল্পচিন্তায় সেকুলার আর্ট আর ধর্ম-সম্পর্কিত আর্টের বাইনারিটা কি আবশ্যক, না কি সে-বিষয়ে আমাদের আরেকটু অন্তর্দর্শন করা দরকার? আশা করব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রদর্শনীটি ছবির ক্যাপশন আর কিউরেটরদের নোট কোনও আকারে বাংলাতেও প্রকাশ করা হবে, যাতে আরও অনেকেই মীরা মুখোপাধ্যায়ের চিন্তনের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেন, আর শিল্পীর সাথেই প্রশ্নগুলোর উত্তরের সন্ধান করতে পারেন।
তথ্য সহায়তা :
১. মীরা মুখোপাধ্যায়, ‘বিশ্বকর্মার সন্ধানে’ (বইপত্তর ২০১৮, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৩)।
২. Bronzeskulpturen von Meera Mukherjee: Indien im Buccheim Museum (Akar Prakar, 2012)
৩. Meera Mukherjee: Purity of Vision (Akar Prakar, Mapin Publishing, Raza Foundation, Emami Art, 2018)
ছবি সৌজন্য গ্যালারি ৮৮