ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • এক কণ্ঠে হাজার পাখি


    ইন্দ্রদীপ ভট্টাচার্য (July 2, 2022)
     

    ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২২-এর অক্টোবরে লন্ডনের ‘দ্য ক্রাইটিরিয়ন’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় টমাস স্টার্ন্স এলিয়টের দীর্ঘ কবিতা
    ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। আমেরিকান যুবক এলিয়ট ততদিনে পাকাপাকি ভাবে লন্ডনের বাসিন্দা। দুই দেশের সাহিত্যমহলেই তাঁর কিঞ্চিৎ নামডাকও হয়েছে; মূলত একটি কবিতার সূত্রে— ‘দ্য লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’। নামে ‘লাভ সং’ হলেও তা তথাকথিত প্রেমের কবিতা মোটেই নয়; তার বক্তব্য এবং আঙ্গিক দুইই বেশ ছকভাঙা। প্রথম অনুচ্ছেদেই তাক লেগে যায় একটি উপমার ব্যাবহারে; শহরের আকাশে সন্ধ্যা নেমে আসাকে প্রুফ্রকের কবি তুলনা করেছেন অপারেশন টেবিলে শায়িত অচেতন এক রোগীর সঙ্গে— যা দেখে অনেকের মনে হয়েছে সেই সপ্তদশ শতকের মেটাফিজিকাল কবিরা ফিরে এলেন না কি, কবিতায় অদ্ভুত সব উপমার ব্যবহার তো ছিল তাঁদেরই একচেটিয়া কারবার!  

    ‘প্রুফ্রক’-এর বছর দশেক পর প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের ধবংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফরাসী সিম্বলিস্ট কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকা হার্ভার্ড-সর্বোনের প্রাক্তনী ৩৫-ছুঁইছুঁই এলিয়ট লিখলেন ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। প্রকাশিত হল বলা ভুল, এ কবিতা যেন আছড়ে পড়ল। গোটা ইউরোপকে এলিয়ট এক প্রাণহীন ঊষর ভূখণ্ড হিসেবে কল্পনা করলেন। শুরুতেই লিখলেন এমন এক লাইন, যা প্রচলিত সব ধারণাকে নস্যাৎ করে দিল। বললেন ‘April is the cruellest month’. এ আবার কেমন কথা! এপ্রিল তো বসন্ত; নবজন্মের বার্তা নিয়ে আসে। এপ্রিল তো গুড ফ্রাইডে, ইস্টারের সময়। পুনরুত্থানের কাল। তার জন্য তো সকলেরই উন্মুখ অপেক্ষা। স্বয়ং কবি চসার সেই কবে লিখে গেছেন ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’-এর শুরুতে, এপ্রিলই হল সমস্ত নতুন উদ্যোগের সঠিক সময়। কিন্তু এলিয়ট বললেন বসন্ত বীভৎস, কারণ তা জীবনের দিনে আমাদের নিয়ে যেতে চায়, মৃতদেহের স্তূপেও লাইলাক ফোটাতে চায়। যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে জীবন এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ। ঢের ভাল জীবন্মৃত হয়ে থাকা। অতি পরিচিত ‘If winter comes, can spring be far behind?’-কে নস্যাৎ করে দিয়ে এলিয়ট লিখলেন,  ‘winter kept us warm, covering earth in forgetful snow… Summer surprised us…’ ক্লিওপাট্রা-ওফেলিয়া’র প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, এই বন্ধ্যা দেশে প্রেমের অনিবার্য পরিণতি আত্মহনন। জল সেখানে জীবনের নয়, মৃত্যুর ইঙ্গিতবাহী। ধর্ম সেখানে মানুষকে আশ্রয় দিতে ব্যর্থ।  

    শুধু তা-ই নয়, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ কোনও আখ্যান নেই, কোনও পোয়েটিক-সাবজেক্টিভিটি নেই, কোনও স্পষ্ট দৃশ্যকল্প নেই। ৪৩৩ লাইন জুড়ে খালি কিছু ছেঁড়া-ছেঁড়া কথা, অগণিত মানুষের এলোমেলো কণ্ঠস্বর। আপাত ভাবে তাদের মধ্যে কোনওরকম সংযোগ স্থাপন করা প্রায় অসম্ভব। এলিয়ট নিজেই বললেন, ‘…I can connect nothing with nothing.’ যেমন প্রথম অংশে অভিজাত মেরি ল্যারিশের এক পশলা স্মৃতিচারণ, কিংবা ভণ্ড জ্যোতিষী ম্যাডাম সসস্ত্রিসের কথাবার্তার কয়েক টুকরো, কিংবা ওয়্যাগনারের অপেরা ‘ট্রিস্টান এন্ড আইসল্ডে’-র করুণ কাহিনির কয়েক লাইন।  

    (এলিয়ট) বললেন আরও এক এক অদ্ভুত কথা: যে মানুষটা যন্ত্রণা পাচ্ছে, আর যে মানুষটা সেই যন্ত্রণার কথা লিখছে— তাদের হতে হবে সম্পূর্ণ পৃথক। ব্যক্তিগত আবেগের কি কোনওই ভূমিকা নেই? এলিয়ট বললেন, আছে, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটকের মত; উদাহরণ দিলেন: হাইড্রোজেন আর সালফারের বিক্রিয়ায় প্ল্যাটিনাম যেমন। সে বাইরে থেকে বিক্রিয়ায়/ শিল্পসৃষ্টির কাজে সাহায্য করবে, তার বেশি নয়।

    খুবই চিত্তাকর্ষক দ্বিতীয় অংশ ‘আ গেম অফ চেস’-এর শেষে এক পানশালায় দুই নিম্নবিত্ত মহিলার আড্ডা। স্বামী যুদ্ধ থেকে ফিরবে তাই একটু নিজেকে ফিটফাট করে নাও— একজনের পরামর্শ অন্যজনকে। বাড়ি ফিরে পুরুষমানুষ তো একটু ফুর্তি দাবি করবেই। প্রসঙ্গক্রমে আসে বেশ্যাদের কথা, গর্ভনিরোধকের কথা, দাঁত পড়ে যাওয়ার কথা, শুয়োরের মাংস গরম গরম খাওয়ার কথা— সবই এলিয়টীয় ভঙ্গিতে, ছেঁড়া-ছেঁড়া। আর সেসবের পেছনে মাঝে মাঝেই শোনা যায় পানশালার কর্মীর গলা: ‘Hurry up Please, it’s time!/ Hurry up Please, it’s time!’ একবার নয়, বারবার। কী বোঝাতে চান এলিয়ট? কার সময় উপস্থিত? কীসের? ওই মহিলাটির স্বামীর ঘর ছাড়বার? না কি এই জীবনটা শেষ করে ফেলার? তার কি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া উচিত? তার শেষ কথাগুলি: ‘Good night, ladies; good night, sweet ladies; good night, good night’ তো আমাদের চেনা! হ্যামলেট-এর চতুর্থ অঙ্কের সপ্তম দৃশ্যে আত্মহননের ঠিক আগে এই কথাগুলিই তো বলে ওফেলিয়া। ছেঁড়া ছেঁড়া কথার ভেতর থেকে এইবার একটা বয়ান তৈরি হয়— এলিয়ট হয়তো বলতে চাইলেন যে শিল্পসাহিত্যে যা কিছু একসময়ে ছিল মহান সৃষ্টি, আজ তা অন্তঃসারশূন্য। ‘কার্পে ডিয়েম’ বা সময়ের প্রবহমানতার কথা, যা আদিকাল থেকে সাহিত্যের অতি পরিচিত বিষয়, বা ওফেলিয়ার বিদায়বাণী, যা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পংক্তি, এই প্রাণহীন বন্ধ্যা পৃথিবীতে অর্থহীন, ছিন্নমূল, এক অতি সস্তা পানশালার এক অতি সাধারণ আলোচনার ছেঁড়া টুকরো মাত্র!     

    আবার যেমন ভার্জিলের মহাকাব্য দ্য ইনিড-এর চরিত্র সিবিল। কবিতার একেবারে শুরুতে, বলা যেতে পারে প্রাককথনে, আমরা তাঁর মুখোমুখি। সিবিল ঈশ্বরের কাছে অমরত্বের বর চেয়েছিলেন। পেয়েওছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে চিরযৌবনও যে চেয়ে নিতে হবে সে কথা তাঁর খেয়াল হয়নি। ফলে শতকের পর শতক জুড়ে তিনি বৃদ্ধ থেকে অতি-বৃদ্ধ হতে থাকেন। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর শুরুতে এলিয়ট ‘স্যাটিরিকন’ নামক এক প্রাচীন খণ্ডকাব্য থেকে দুটি ল্যাটিন পঙক্তি উদ্ধৃত করলেন। কতগুলি বালক সিবিলকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কী চাও?’ সিবিল উত্তর দেন, ‘মৃত্যু’। 

    এলিয়টের ‘‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ যার কাজে ফিরে-ফিরে এসেছে, সেই ইংলিশ শিল্পী বার্থলোমিউ বীল-এর আঁকা ছবি ‘আ হিপ অফ ব্রোকেন ইমেজেস’, ২০১৪। ব্রেন টিউমারের কারণে, ২০১৯ সালে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মারা যান বীল, ফেলে রেখে যান অপার সম্ভাবনা।

    মহাযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতেও জীবনের সবথেকে অভিপ্রেত, কাম্য আশীর্বাদ: মৃত্যু। সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের কথা অনুসারে, মৃত্যুর বোধ ছাড়া মানুষ সম্পূর্ণ নয়। তাঁর মোটামুটি সমসাময়িক কবিরা মৃত্যুকে রোমান্টিসাইজ করেছিলেন; ‘ওড টু আ নাইটিঙ্গেল’-এ কিটস লিখেছিলেন সেই অমোঘ পংক্তি: ‘Now more than ever seems it rich to die/ To cease upon the midnight with no pain.’ ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর পৃথিবীতে মরণ মোটেই রাধিকার কাছে শ্যাম-সমান নয়। বরং খানিকটা জীবনানন্দীয়। ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতায় জীবনানন্দ দেখিয়েছিলেন জীবনের সমস্ত ক্লান্তি, বিপন্নতাবোধ থেকে মুক্তি ‘লাশকাটা ঘরে’। আর এলিয়ট দেখালেন উনিশ শতকীয় যুদ্ধোত্তর জীবনের ভয়াবহ, অর্থহীনতা, বিচ্ছিন্নতা, গভীর নৈরাশ্যবোধ থেকে নিষ্কৃতির শেষ পথ মৃত্যু, কিন্তু সেই পথটিও সমান ভয়াবহ; যে কারণে বারবার দান্তের ইনফার্নো-র প্রসঙ্গের অবতারণা। 

    কবিতার প্রথম অংশের নাম এলিয়ট রাখলেন ‘দ্য বেরিয়াল অফ দ্য ডেড’। খ্রিষ্টধর্মে মৃতদেহের সমাধিকার্যের মধ্যে অবিসংবাদিত ভাবে নিহিত থাকে ‘রেজারেকশন’-এর অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি। কিন্তু প্রথম অংশের শেষে এসে সেই স্বপ্ন শুধু মুখ থুবড়েই পড়ল না, বরং যুদ্ধক্ষেত্র-ফেরত দুই সৈন্যের কথোপকথনের এক টুকরো আমাদের মনে করিয়ে দিল মৃত্যুর কুৎসিত রূপ। আর মনে করিয়ে দিল যে গোটা ইউরোপটাই যেন এক কবরখানা!: ‘Oh keep the Dog far hence, that’s friend to men,/ Or with his nails he’ll dig it up again!’ জীবনের প্রতি আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় কোথাও যেন মিলেমিশে গেল।    

    সারা কবিতা জুড়ে এলিয়ট বুনে চললেন অসংখ্য অস্পষ্ট ইঙ্গিত। কীসের প্রতি ইঙ্গিত? কীসের প্রতি নয়, সেটা বলা বরং সহজ। যত কালজয়ী কাব্য-সাহিত্য-সঙ্গীত, প্রাচীন ও অর্বাচীন, প্রাচ্যের ও প্রতীচ্যের, লাতিন, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, ইংরাজি তো বটেই, বাইবেল, উপনিষদ থেকে ওয়াগনারের অপেরা— সবই এই কবিতার অংশ। প্রখ্যাত সমালোচক আই এ রিচার্ডস তাই সোজাসুজি এই কবিতাকে বললেন মহাকাব্য।

    সারা কবিতা জুড়ে অন্তত ৪০জন সাহিত্যিকের ৬০টিরও বেশি টেক্সটের ভাঙা টুকরো। সেসবের শেষে এসে এলিয়ট লিখলেন ‘These fragments I have shored against my ruin … Shantih Shantih Shantih’। এলিয়ট শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ করলেন, কিন্তু সচেতন ভাবেই ‘ওম’ বললেন না। যে বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রসঙ্গ এলিয়ট আনলেন কবিতার শেষ পর্বে, তার প্রথম ধ্বনিই তো ‘ওম’! ছান্দোগ্য উপনিষদে ওম-কে বলা হয়েছে জগৎসংসারের সমস্ত অস্তিত্বের, চেতনার সার। এলিয়ট দেখালেন, ১৯২০-এর ধ্বংসস্তূপ-সদৃশ পৃথিবীর গভীর নৈরাশ্যে ও অন্তঃসারশূন্যতার মধ্যে ওম উচ্চারণ করা অসম্ভব।  

    শেষে এসে এলিয়ট লিখলেন ‘These fragments I have shored against my ruin … Shantih Shantih Shantih’। এলিয়ট শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ করলেন, কিন্তু সচেতন ভাবেই ‘ওম’ বললেন না। যে বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রসঙ্গ এলিয়ট আনলেন কবিতার শেষ পর্বে, তার প্রথম ধ্বনিই তো ‘ওম’! ছান্দোগ্য উপনিষদে ওম-কে বলা হয়েছে জগৎসংসারের সমস্ত অস্তিত্বের, চেতনার সার। এলিয়ট দেখালেন, ১৯২০-এর ধ্বংসস্তূপ-সদৃশ পৃথিবীর গভীর নৈরাশ্যে ও অন্তঃসারশূন্যতার মধ্যে ওম উচ্চারণ করা অসম্ভব

    কিন্তু এত ভাঙাচোরা টুকরো টুকরো কথাকে একসূত্রে গাঁথবে কে? বা কী? এমন কিছু কি আছে, যা এই ধ্বংসের সময়েও মানুষকে এবং এই কবিতাকে আরও বেঁধে-বেঁধে রাখবে? এলিয়ট বিশ্বাস করলেন, আছে। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর অবয়বের পেছনে এলিয়ট ছড়িয়ে দিলেন এক প্রাচীন উপকথা, যা সকলেরই জানা। এক পঙ্গু ধীবর রাজার গল্প। প্রাণপণে তিনি আগলে রেখেছেন যিশুর পবিত্র পানপাত্র। কিন্তু রাজা যেহেতু অসুস্থ, তাঁর রাজ্যের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। মড়ক, অনাবৃষ্টি, খরা। উদ্ধার কোথায়? সেই পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, অপেক্ষা করতে হবে এক অশ্বারোহী বীরের জন্য, যে এসে খুঁজে নেবে পানপাত্র, এবং উচ্চারণ করবে এক সাংকেতিক প্রশ্ন। তবেই হবে স্বাস্থ্যোদ্ধার; রাজারও, রাজ্যেরও। এলিয়ট বিশ্বাস করতে এবং করাতে চাইলেন যে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া প্রতিটি ইউরোপীয় শহরের ভেঙে যাওয়া পাথুরে পথের নীচে, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের আত্মিক সঙ্কটের গভীরে, এখনও আছে এমন এক কাহিনি, যা সকলের জানা, যা সামূহিক, যা এখনও পারে আমাদের জুড়ে দিতে। 

    ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ব্যক্তিমানুষের কথা নয়; সমষ্টির কথা, সভ্যতার সংকটের সামনে দাঁড়ানো এক মুমূর্ষু মহাদেশের কথা, যার উদ্দেশে এলিয়ট বললেন: ‘I had not thought death had undone so many’। মহাকবি দান্তে বলেছিলেন এই একই কথা ‘দিভিনা কমেদিয়া’ কাব্যে, নরকের দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষারত জনতার দিকে তাকিয়ে। 

    এই সমষ্টির কথা বলতে চাওয়ার মধ্যে দিয়েই এলিয়ট জন্ম দিলেন এক নতুন কাব্যধারার। ইংল্যান্ডে শুধু নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই কবিতার ধারণার খোলনলচে বদলে দিল দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড। বিশ শতকের সাহিত্যকে এক নতুন খাতে বইয়ে দিলেন এলিয়ট। আমাদের কাছের মানুষ জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসুরা তাঁকে ছুঁয়ে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

    রোমান্টিক কবিতা ছিল একক ব্যাক্তিমানুষের কথা। ১৮০০ সালে ‘লিরিকাল ব্যালাডস’-এর ভূমিকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের দেখানো মডেল অনুযায়ী, কবিতা বা লিরিক লেখার মন্ত্রই ছিল: নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মণিমুক্তো তুলে আনা। কবিতা মানে আবেগ-অনুভূতির অনর্গল এবং স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস (Spontaneous overflow of powerful feelings)। সারা উনিশ শতক জুড়ে সেটাই অনুসৃত হয়ে এসেছে। এলিয়ট তৈরি করলেন এক নতুন মডেল, যার হদিশ পাওয়া গেল ১৯১৯-এ ‘দ্য ইগোইস্ট’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড দ্য ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ নিবন্ধে। 

    মূলত দুটি বিষয়ে এলিয়ট কথা বলেন এই প্রবন্ধে: ‘ট্র্যাডিশন’ এবং ‘ইম্পার্সোনালিটি’। 

    প্রথমত, এলিয়ট বললেন কবিতা আত্মানুভূতির বহিঃপ্রকাশ নয়; আবেগকে অতিক্রম করে যাওয়া, ‘an escape from emotion’। নিজের আবেগ-অনুভূতি কে সরিয়ে রাখলে তবেই তো সমূহের আবেগ-অনভূতিকে স্পর্শ করতে পারবেন কবি। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ এত অগণিত কণ্ঠস্বর, কোনওটিই তাঁর নিজের নয়, প্রত্যেকটিই আমাদের। বিশেষত, ওয়ার্ডসওয়ার্থের এবং সামগ্রিক ভাবে রোম্যান্টিক কবিতার তত্ত্বে যে স্বতঃস্ফূর্ততার ধারণা, এলিয়ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার বিরোধিতা করলেন। ‘Spontaneous overflow’-র মধ্যে একটা অসংযত, অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাসের ইঙ্গিত আছে, এলিয়টের অবস্থান তার ঠিক বিপরীত কোণে। তিনি জোর দিয়ে বললেন কবিতার উপাদান এবং কাব্যসৃষ্টির প্রক্রিয়ার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কবিতা লেখার প্রাথমিক শর্ত। 

    বললেন আরও এক এক অদ্ভুত কথা: যে মানুষটা যন্ত্রণা পাচ্ছে, আর যে মানুষটা সেই যন্ত্রণার কথা লিখছে— তাদের হতে হবে সম্পূর্ণ পৃথক। ব্যক্তিগত আবেগের কি কোনওই ভূমিকা নেই? এলিয়ট বললেন, আছে, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটকের মত; উদাহরণ দিলেন: হাইড্রোজেন আর সালফারের বিক্রিয়ায় প্ল্যাটিনাম যেমন। সে বাইরে থেকে বিক্রিয়ায়/ শিল্পসৃষ্টির কাজে সাহায্য করবে, তার বেশি নয়। বৌদ্ধ ধর্মে ‘নির্বাণ’-এর কথা বলা হয়েছে। নির্বাণ সাধারণ অর্থে নিভে যাওয়া বা মৃত্যু নয়, একটি তুরীয় আধ্যাত্মিক অবস্থা, যেখানে পৌঁছলে সাধক সকল কামনাবাসনা-নিবৃত্ত হয়ে একটি শূন্য আধারে পরিণত হন। প্রাচ্য দর্শনের ছাত্র এলিয়টকে এই ধারণা মুগ্ধ করেছিল। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর তৃতীয় অংশ ‘দ্য ফায়ার সার্মন’-এ এলিয়ট সরাসরি বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ এনেছেন, ঠিক যেমন পঞ্চম অংশ ‘হোয়াট দ্য থান্ডার সেড’-এ পাঠককে নিয়ে গেছেন বৃহদারণ্যক উপনিষদে। (পরবর্তী জীবনে ‘দ্য ফোর কোয়ার্টেট’ কবিতার ‘দ্য ড্রাই সালভেজেস’ অংশে গীতার অষ্টম অধ্যায়ের একটি শ্লোক প্রায় হুবহু তুলে দেবেন এলিয়ট)। 

    উইন্ডহ্যাম লিউইস-এর আঁকা টি এস এলিয়টের বিখ্যাত পোর্ট্রেট , ১৯৩৮

    তাঁর কাব্যতত্ত্ব, যার নাম ‘ইম্পার্সোনাল থিওরি অফ পোয়েট্রি’, যেন নির্বাণ লাভের সাধনা। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তেমনি এক কবিতা। সেখানে কবি তাঁর ব্যক্তিগত সত্তার বাইরে বেরিয়ে সমূহের, সমষ্টির। তাঁর লেখায় তখন একলা মানুষের কণ্ঠে হাজার পাখির গান।  

    ট্র্যাডিশন বলতে এলিয়ট ঠিক কী বোঝাতে চাইলেন? ট্র্যাডিশন মানে গতানুগতিকতা নয়; একজন কবি অবশ্যই নতুন কথা নতুন আঙ্গিকে বলবেন, কিন্তু কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টির পরম্পরায় নিজের অবস্থানের ব্যাপারে তাঁকে সচেতন হতে হবে এবং নিজের কাব্যকৃতির মাধ্যমে তাতে কিছু সংযোজন করতে হবে। একজন কবির সমসাময়িকতায় নিহিত রয়েছে সুদীর্ঘ অতীতের বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা। সেটিকে চিনতে হবে (‘a perception, not only of the pastness of the past, but of its presence’)। এই পরম্পরাকে অস্বীকার করে বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কবিই একক কৃতিত্বে মহীয়ান নন। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ চরণে চরণে সেই কারণেই তো এত অসংখ্য কবি-গদ্যকার-শিল্পীর পদধ্বনি।  

    ১৯২৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনের একই সংখ্যায় বেরোল ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এবং জেমস জয়েসের দুষ্পাঠ্য উপন্যাস ‘ইউলিসিস’-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া। সমালোচক বললেন, দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর সবথেকে বড় সমস্যা দুর্বোধ্যতা। কবিতা পড়ে পাঠক বুঝতেই পারছেন না, কী বলতে চাইছেন এলিয়ট। ১৯৪৮-এ এলিয়ট নোবেল পুরস্কার পেলেন ‘সমসাময়িক কবিতার দিকনির্ণয়’ করে দেওয়ার জন্য। ১৯৫০-এ আরও একবার টাইম ম্যাগাজিনে তিনি। এবার প্রচ্ছদে তাঁর ছবি। ততদিনে টেমস দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। পৃথিবী জুড়ে তিনি তখন আধুনিক কবিতার গুরু।  

    এলিয়টও কী ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতো— শতবর্ষ পরে তাঁর কবিতা কীভাবে পৌঁছবে পাঠকের কাছে? গত এক শতাব্দী জুড়ে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ পড়া ও আলোচনা হয়েছে মূলত প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিতে। আমাদের প্রজন্ম মহাযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু টানা দু’বছর ভয়াবহ অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করেছি আমরা। গত এপ্রিল বা তার আগের মার্চের মৃত্যুমিছিল দেখতে দেখতে, কিংবা ঘরে ফেরার টানে বান্দ্রা স্টেশনের বাইরে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের ছবি দেখে মনে পড়েছে এলিয়টের পংক্তি, ‘Unreal city!… I had not thought death had undone so many…’। এখন মনে হয় এ তো অতিমারী-উত্তর এক পৃথিবীর কাব্যও বটে! 

    ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর কল্পনা, রচনা এবং প্রকাশনাও কিন্তু এমন এক সময়ে, যখন এক মহামারী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে গোটা ইউরোপে। এলিজাবেথ উটকা-র গবেষণা (‘ভাইরাল মডার্নিজম’, কেমব্রিজ, ২০১৯) আমাদের জানাচ্ছে, এলিয়ট ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই ভুগেছিলেন ১৯১৮-২০’র ফ্লু মহামারীতে। সারা পৃথিবী জুড়ে পাঁচ কোটির বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। এলিয়ট তাড়াতাড়িই সেরে উঠেছিলেন, কিন্তু  স্ত্রী ভুগেছিলেন অনেকদিন। অসুস্থ অবস্থায় মা-কে এক চিঠিতে এলিয়ট লিখেছিলেন যে তিনি নিজে খুবই দুর্বল, আর স্ত্রী নিদ্রাহীন রাতের পর রাত। ‘My nerves are bad tonight. Yes, bad. Stay with me. Speak to me. Why do you never speak. Speak. What are you thinking? What thinking? What?’ কবিতার দ্বিতীয় পর্বে পাই এই পঙক্তি; ঘুমহীন রাতে স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত এক মহিলা বলেন তাঁর স্বামীর উদ্দেশে। ভাইরাল মডার্নিজম জানাচ্ছে, এলিয়টের স্ত্রী দেখেছিলেন, তাঁর স্বামী কীভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন— ফ্লু-তে ভোগার ফলে হয়তো তাঁর সমস্ত সৃষ্টিশীলতা লোপ পাবে!

    ১০০ বছর আগের ফ্লু অতিমারী বিশ শতকের কাব্য-সাহিত্যকে কতটা প্রভাবিত করেছিল, তার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা আজও হয়নি। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-কে নতুন করে পড়ার মধ্যে দিয়েই যদি সেই কাজটি শুরু হয়, তা হবে শতবর্ষে এই কালজয়ী কবিতার প্রতি এক চমৎকার শ্রদ্ধার্ঘ।  

    কভারের ছবি: ইংলিশ শিল্পী বার্থলোমিউ বীল-এর ‘আ হিপ অফ ব্রোকেন ইমেজেস’, ২০১৪

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook