আমরা সকলেই খুব কঠিন আর ভয়াবহ একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি— একদিকে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া একটা অসুখ চলছে, অন্যদিকে ভীষণ আর্থিক সংকট চলছে, ওদিকে একটা যুদ্ধ চলছে, যেটা শিগগির থামার কোনও লক্ষণ নেই। এইসব দুর্দশার মধ্যে গত কয়েক মাসে বহুবার শিল্পীদের দোরগোড়ায় মৃত্যু উপস্থিত হয়েছে। প্রখ্যাত ও জনপ্রিয় গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ, যিনি কেকে নামে সুপরিচিত, ২০২২-এর ৩১শে মে কলকাতায় অনুরাগীদের ভিড়ে সঙ্গীত পরিবেশন করার ঠিক পরপরই মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিল। কেকে-র আকস্মিক, অকাল, ও মনে ধাক্কা-দেওয়া মৃত্যু নিয়ে চারিদিকে প্রচুর শোক প্রকাশ করা হয়েছে; সংবাদমাধ্যমে খবর, আলোচনা, বিতর্ক, এবং এমনকী রাজনৈতিক রঙও চড়ানো হয়েছে। যেটা কেউ আলোচনা করতে চাইছেন না, সেটা হল ভারতে কীরকম কঠিন, সম্ভবত মারাত্মক, আর বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে শিল্পীদের কাজ করতে হয়। এই সার্বিক উদাসীনতা দেখে একটা প্রশ্ন উঠে আসে, আমরা কি সত্যিই শিল্পীদের প্রতি যত্নবান? এইধরনের বিষাদময় ঘটনার জন্য কোনও-না-কোনওভাবে আমরা সকলেই কি দায়ী নই? আমি যা বলছি, সেগুলো হয়ত তেতো বা নিষ্ঠুর লাগতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই যেকোনও সত্যি কথা মুখের ওপর সোজাসুজি বলতে হয়। নম্র আচরণ, মৃদু কথাবার্তা, বা ভদ্রতার কৌশল — কোনও কিছুই কখনও সত্যকে বদলাতে পারে না।
কয়েক দশক যাবত বিভিন্ন জায়গায় আমি পারফর্ম করছি, আমি নিজেই এইরকম বহু পরিস্থিতিতে পড়েছি। কয়েকটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয়ের দিকে নজর দেওয়ার জন্য আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। যেসব অনুষ্ঠানে বিশাল ভিড় করে হাজার হাজার শ্রোতা আসেন, সেগুলো সাধারণত খোলা জায়গায় করা হয়। মানে, সেগুলোকে আরও বেশি করে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমার মনে পড়ছে, অনেক বছর আগে উত্তর ভারতের একটা শহরে এইরকম একটা অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। উত্তাল উড়ানের ভেতরে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই ফ্লাইট ল্যান্ডিং করতে হবে। আর, আমরা নামার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম সাংঘাতিক বৃষ্টি আসতে চলেছে। কিন্তু, আয়োজক পক্ষের লোকজন খুবই আনন্দের সঙ্গে আমাদের জানালেন যে, ওই বিশাল ভিড়কে ঠাঁই দেওয়ার জন্য আর অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা জমকালো সেটের জন্যও, পরিকল্পনা মতো ওই খোলা মঞ্চেই অনুষ্ঠান করা হবে। অতএব সেই সন্ধ্যায় আমরা যথাস্থানে পৌঁছে, আগত শিল্পীদের জন্য তৈরি করা অস্থায়ী গ্রিন রুমে ঢুকে পড়লাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আর ধুমাধার বৃষ্টি আরম্ভ হল। পলকের মধ্যে সেই গ্রিন রুম, যেটা আসলে মঞ্চের পিছনে একটা বড় তাঁবু বা প্যান্ডেলের মতো বানানো, সেটা থেকে জল চুঁইয়ে পড়তে লাগল, আর সারা মাঠ কাদায় ভর্তি হয়ে গেল। আমরা এদিক-সেদিক করে নিজেদের সামলাতে সামলাতে শুনতে পেলাম, মঞ্চের ওপরে থাকা ওড়িশি নর্তক-নর্তকীদের অনুরোধ করা হচ্ছে তাঁদের অনুষ্ঠানটা দ্রুত শেষ করার জন্য। কিন্তু, তাঁরা যদিও ঝটপট থেমে যাওয়ার বদলে, একটু শৈল্পিকভাবে অথচ তাড়াতাড়ি শেষ করার চেষ্টা করছিলেন, একজন নর্তকী ভেজা মঞ্চের ওপর পা হড়কে পড়ে গিয়ে আঘাত পেলেন। এসবের মাঝে, আমরা গ্রিন রুমে অপেক্ষা করছি, মোটামুটি বুঝতে পারছি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাবে, বা পরে কখনও হবে। হা হতোস্মি, ওদিকে আবহাওয়া আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করবে ভেবে রেখেছিল! মোটামুটি আধ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টি কমতে-কমতে ইলশে-গুঁড়ির মতো হয়ে এল, আয়োজকেরা লাফালাফি করতে করতে আবার অনুষ্ঠান শুরু করলেন। কিন্তু যেই আমরা মঞ্চে উঠতে যাব, ঠিক তক্ষুনি আবার হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। দৌড়োদৌড়ি করে আমরা গ্রিন রুমে ফিরে গেলাম। এরপর আমাদের অডিও ইঞ্জিনিয়ার আর ইভেন্টের স্টেজ ও সাউন্ড টিম জানিয়ে দিলেন, ওই সাংঘাতিক বৃষ্টির মধ্যে এতগুলো কেবল আর তার মঞ্চের ও মাঠের চতুর্দিকে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে আছে যে, কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্লাগে দেওয়া মানেই বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু আয়োজকেরা হার মানতে রাজি নন। কারণ, এর মাঝে হোমরাচোমরা রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ও অফিসারেরা হাজির হয়েছেন, এবং নিজেদের গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন কখন বৃষ্টি থামবে।
শেষমেশ, জলে ভেজা মঞ্চেই মাইনাস ওয়ান ট্র্যাকে আমাকে একাই গান গাইতে বলা হল। আমি রাজি হলাম না, কিন্তু অন্তত একটা গান গাওয়ার জন্য তাঁরা বারবার চাপাচাপি করতে থাকলেন। কারণ, কমপক্ষে একটা ছোট্ট পারফর্মেন্স না দেখে ভিআইপি-দের ফিরে যেতে হলে, তাঁরা বেজায় অসন্তুষ্ট হবেন। অবশেষে, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আমার মাথায় একটা বিশাল ছাতা ধরে আমার পিছনে একজন বীরের মতো দাঁড়ালেন, আর আমি গান গাইতে শুরু করলাম। আমার অডিয়েন্সের মধ্যে ছিলেন একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর পিছনেও বিশাল ছাতা ধরে একজন দাঁড়িয়েছিলেন। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কয়েকজন উঁচু পদের অফিসার গান শুনছিলেন। আর, কয়েকশো সঙ্গীত-প্রেমী লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার, যেগুলোতে তাঁদের বসার কথা ছিল, সেগুলো উলটো করে মাথার ওপর ছাতার মতো ধরে মহানন্দে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমি লাল রঙের চার শিংওয়ালা বন্য হরিণের ভিড়ে, অপার্থিব অডিয়েন্সের সামনে অব কে সাওয়ান আর ঢোলনা গেয়ে চলেছি। হাততালি পড়ল, সকলে খুশি হলেন; কিন্তু, আমি বা আমার ছাতা-ধারী ভদ্রলোক বা আমরা দুজনেই যেকোনও সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পারতাম। যিনি যোদ্ধার মতো সাউন্ড সামলাচ্ছিলেন, সেই অডিও ইঞ্জিনিয়ারেরও একই বিপদ হতে পারত। অডিয়েন্সের মধ্যে থেকে যেকোনও সংখ্যক মানুষ যেকোনও সময়ে হতাহত হতে পারতেন। হয়ত এই কাহিনি শোনাব বলেই আমি সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছি, কিন্তু বিশ্রীভাবে অন্য কিছু ঘটেই যেতে পারত। ওই ঘটনাস্থলে ওই রাজ্যের সবথেকে ক্ষমতাশালী কয়েকজন অফিসার উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কেউই অনুষ্ঠান বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। আমিও অনড় হয়ে থাকতে পারিনি, বা তাঁদের অসহযোগিতা করতে পারিনি। সুতরাং, একটা সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আমরা প্রত্যেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে, বা বলা ভালো, ইতস্তত করে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
এইরকম আরও অসংখ্য বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে শিল্পীদের কাজ করতে হয়। এমনভাবে মঞ্চ বানানো হয় যে, একগুচ্ছ শিল্পীর কথা ছেড়ে দিন, মাত্র একজন উঠলেই সেটা ভেঙে যাবে! ভিড়ে ঠাসা অনুষ্ঠানে প্রিয় শিল্পীকে সামনে থেকে দেখার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে উচ্ছৃঙ্খল অনুরাগী মঞ্চে উঠে পড়েন! পারফর্মেন্সের আগে, পরে, বা চলাকালীন কোনও সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকে না! এইসব সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে শিল্পীকে পারফর্ম করতে হয়, এবং ভাগ্য ভালো থাকলে তিনি বেঁচে যান! আর, যদি কেউ মনে করেন যে, শুধুমাত্র জনপ্রিয় সঙ্গীতের আসরেই এইসব ঘটনা ঘটে, তাঁরা ভুল ভাবছেন। এই দেশের অন্যতম পুরনো একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎসবে, আমার গান শেষ হওয়ার পর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য সঙ্গীত-প্রেমীরা গ্রিন রুমে ঢুকে পড়েছিলেন। আমি যখন একটা চেয়ারে বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলাম, আমার চারিদিকে ঘিরে-থাকা লোকজন একে অন্যকে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে আমার উপরে প্রায় হুড়মুড় করে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত পুলিশ কনস্টেবলরা আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। অক্সিজেনের অভাবে আমার সারা মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল, মানুষের ভিড় ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম।
স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ভিড় সামলানোয়, মঞ্চ ও সাউন্ডের ব্যবস্থাপনায় শিল্পীদের কোনও হাত নেই। একমাত্র যেখানে তাঁদের হাত আছে, সেটা হল প্রায়শ এইসব অস্বাস্থ্যকর, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তাঁরা পারফর্ম করবেন কিনা সেটা জানানোর অধিকার। তাঁরা সেই অধিকার প্রয়োগ করবেন কিনা, সেটা হয়ত ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এইসব সত্য স্বীকার না করা হবে, ততক্ষণ কেউ কিছু বদলানোর আশা করতে পারবেন না। আর, যেকোনও মুহূর্তে, বারবার, যেকোনওভাবে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন