১৮১৫-র এপ্রিল মাসে চৌরঙ্গির উত্তর দিকে এসপ্ল্যানেড ট্যাঙ্ক (সম্ভবত ধর্মতলা তালাও) খনন করার সময়ে দীঘির খাতের চার ফুট গভীরে সুন্দরী গাছের স্কন্ধের সারি খুঁজে পাওয়া যায়। কলকাতা শহরের বুকে – তাও আবার বুকের গভীরে – এই বিস্ময়কর উপস্থিতির নানা ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক মহল থেকে পেশ করা হয়। ‘নেটিভ’ ভূতত্ত্ববিদদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেন যে সেই গাছগুলি তাদের আদি জন্মস্থলেই রয়েছে; বরং সেই ‘সমতট’ (হিউয়েন সাঙের লেখায় যার উল্লেখ পাওয়া যায়) ঢাকা পড়ে গেছে বহু বছরের পলিমাটির তলে।
‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ ক্যালকাটা’-র লেখক এ.কে. রায়ের অনুমান, এই ধারণার উৎসে রয়েছে ষোড়শ শতাব্দীর কবিরাম রচিত দিগবিজয় প্রকাশ-এর একটি গল্পে। লোককথা অনুযায়ী সমুদ্র মন্থনকালে মন্দার পর্বত আর অনন্তের মাঝে পিষ্ট হয়ে কূর্মের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে গভীর নিশ্বাস। সেই নিশ্বাস যে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সেখানে জন্ম হয় ‘কিলকিলা’ অঞ্চলের (যার আয়তন ২১ যোজন; পশ্চিমে সরস্বতী, পূর্বে যমুনা)।
দেবযানী ভট্টাচার্যের ‘এম্পায়ার অ্যান্ড ইকোলজি’ থেকে জানা যায় যে আধুনিক ভূতাত্ত্বিক গবেষণা যা বলছে তা কূর্মের উপকথার থেকে – অন্তত রূপক অর্থে – খুব আলাদা নয়। দেখা যাচ্ছে, বঙ্গভূমি যে শুধু টেকটনিক প্রক্রিয়ায় তৈরি তা-ই নয়, সেটির ভিতে রয়েছে মহাসাগরীয় অববাহিকা। দেবযানী ভট্টাচার্য তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে কলকাতার জলময় উৎসের কথা ও নদী-নির্ভরশীলতা কী ভাবে স্মৃতি ও ইতিহাস থেকে মুছে গেছে, বা মুছে ফেলা হয়েছে। সুতরাং, সেই ইতিহাসকে বাদ দিয়ে শহরের ভবিষ্যৎ কল্পনা করার চেষ্টা অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। আজ আমরা দেখতে চেষ্টা করব বিভিন্ন সময়ে কলকাতার ভবিষ্যৎ কল্পবিজ্ঞান অথবা ক্লাইমেট ফিক্শনে কীরকম রূপ নিয়েছে।
চলে আসা যাক ‘এখনকার কলকাতায়’। এখনকার বলতে ২০২২ নয়; কোনো অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে একদিন, যার এক ঝলক উপমন্যু ভট্টাচার্য ও কল্প সাংভি তুলে ধরেছেন তাঁদের ‘ওয়েড’ নামক অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম-এ। অনির্দিষ্টতার কারণ আছে – যে সময়টা দেখানো হয়েছে, কলকাতা শহর জল-কাদার তলায়, প্রায় জনশূন্য; অতএব সময়ের মনুষ্যসৃষ্ট হিসেব অর্থহীন। ছবিটি শুরু হচ্ছে দুটি স্যাটেলাইট ইমেজ দিয়ে। একটিতে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালের সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চল। বেশিরভাগ সবুজ, তার ফাঁক দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে নদীর শিরা-উপশিরা। দ্বিতীয় ছবিটি ‘এখনকার সুন্দরবন’-এর। প্রায় পুরোটাই ঘোলাটে নীল, উঁকি মারছে কতকগুলো ছন্নছাড়া, সবুজ দ্বীপ।
ক্রমশ ‘ক্যামেরা’ নীচের দিকে নামছে। বার্ডস আই ভিউ-এ দেখা যাচ্ছে কলকাতার প্যানোরামা। ধূসর আকাশ; রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমা সব একাকার, জঞ্জালে ভর্তি। শহরের কিছু সুপরিচিত ল্যান্ডমার্ক দেখা যাচ্ছে, যেমন আকাশ ছোঁয়া ‘ফর্টি-টু’, হাওড়া ব্রিজ, বা গড়িয়াহাটের মোড়ে ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলি। তাদের গায়ে ঝুলছে পরিবেশ সংকট সংক্রান্ত ছেঁড়াখোঁড়া পোস্টার, ফ্লেক্স, ব্যানার। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, শেষের দিকে এই বিষয়গুলি রাজনৈতিক আকার ধারণ করেছিল। সারি সারি বেপরোয়া এয়ার কন্ডিশনার ঝুলে আছে একটি ছাইরঙা বাড়ির গায়ে, হাজার চোখ-ওয়ালা অচর দৈত্যের মতো। অতি সাধারণ কিছু জিনিস যে অন্য প্রসঙ্গে কী ভয়ঙ্কর দেখাতে পারে, ওয়েড-এর কিছু দৃশ্য তার প্রমাণ। ট্রয় বসন্তের সাউন্ডস্কেপ আর অ্যানিমেশন শিল্পীদের অসাধারণ কল্পনাশক্তি— দুইয়ে মিলে দর্শকের জন্য সৃষ্টি করে এক অসাধারণ, অস্বস্তিকর, গায়ে কাঁটা-দেওয়া অভিজ্ঞতা।
বিপর্যয়ের মুখে কিছু জলবায়ু শরণার্থীরা চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াই – তাদের এক দল মানুষ, আরেক দল বাঘ। প্রথম দলের জনা পাঁচেক কোমর-জলের মধ্যে দিয়ে খাবার বা আশ্রয়ের আশায় বেরিয়ে পড়ে। তাদের সাথে দৃষ্টিশক্তিহীন একটি মেয়ে। তার বাহন মিনারেল ওয়াটারের বোতল দিয়ে তৈরি ভেলা। আর আছেন একজন লোক, সুন্দরবনের জেলে, কাঠুরেদের মতো মাথার পেছনে মুখোশ পরে। কিন্তু বাঘের হাত থেকে বাঁচা অত সহজ নয়। পার্ক স্ট্রিটের ফ্লুরিস-এর ঠিক সামনে দু-দলের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। কিন্তু গল্পটা আদতে মানুষ বনাম জানোয়ার নয়। আছে আরও কিছু সূক্ষ্ম সামাজিক বা দার্শনিক প্রশ্ন – যা আমরা সাধারণত ‘মানবতার’ আওতায় ফেলি— তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, যেমন জীবনবোধ বা শিশুর প্রতি আচরণ।
কলকাতার উৎসের ইতিহাসের মতো এখানেও মিলেমিশে যায় বিজ্ঞান ও শ্রুতিকথা। নবজাত একটি বাঘের বাচ্ছার থাবা থেকে মানুষের আঙুলের মতো কী যেন গজাতে দেখা যায়। আরেকটি বাঘ অনায়াসে হেঁটে চলে বেড়ায় জলের পৃষ্ঠতলের ওপর দিয়ে। একটি সাক্ষাৎকারে উপমন্যু ভট্টাচার্য এই দুটো দিক নিয়ে বলেছেন। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের মতে, ‘দ্রুত নিঃশেষকরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিউটেশনের সাহায্যে, নতুন পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করার জন্য, কিছু সুপার-স্পিসিসের জন্ম হয় ।’ আবার অন্য দিকে সুন্দরবনের গল্প ঘাঁটতে গিয়ে তাঁরা শোনেন একজন গ্রামবাসীর কথা, যিনি স্বচক্ষে একটি বাঘকে তাঁর দিকে জল ডিঙিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেছিলেন। জন্তুটির পা জলের মধ্যে কিন্তু নয়; সে যেন হাঁটছে কাচের ওপর দিয়ে অর্থাৎ জলের উপরিতল দিয়ে।
সুপার-স্পিশিস আর ডুবন্ত শহরের কথা যখন উঠল, দেখে নেওয়া যাক আরও কিছু বছর আগের একটি ছোট গল্প, নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘২০০ বছর পরে ফ্যাতাড়ু’। ২২১০ সাল, কলকাতা শহর। তিনজন ফ্যাতাড়ু, মদন, ডি.এস., আর পুরন্দর ভাট ক্রায়ো-ঘুম থেকে উঠবে উঠবে করছে। ২০০ বছরের টাইমার সেট করে তাদের ঘুম পাড়ানো হয়েছিল যাতে মানব সভ্যতা প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে গেলেও এই তিনজন স্যাম্পল বেঁচে থাকে। ক্রায়ো-ঘুম কী? নবারুণ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ‘৭৭.১৫ কেল্ভিন তাপমাত্রায়, জ্যান্ত বা হাফমরা মালদের দীর্ঘ সময়ের জন্য জমিয়ে রাখার একটা পদ্ধতি।’
এই গল্পে, নেতা হিসেবে মদনের দায়িত্ব বেশি, তাই তার ঘুম ভাঙে বাকিদের দুদিন আগে। ২০০ বছর মাইনাস ২ দিনের ঘুম থেকে উঠে নোয়ার সেই ঘুঘু পাখির মতো মদন পরিদর্শন-পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে। অনেকটা ওয়েড-এর মতোই দৃশ্য: ‘যতদূর দেখা যায় জল আর ঢেউ। কয়েকটা বাড়ির ওপরটা দেখা যাচ্ছে, জলে থার্মোকল, পচা কাঠ, মরচে পড়া পেট্রলের ক্যান, নানা সাইজের জেরিক্যান, জাম্বো সাইজের পুতুল ভাসছে…জল কালচে এবং ঘোলাটে।’ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল জলের তলায়, মনুমেন্টের ডগাটা খালি উঁকি মারছে। ভাটার সময়ে হাওড়া ব্রিজটাও দেখা যাচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর, আবেগপ্রবণ পুরন্দর একটি কবিতাও রচনা করে ফেলেন:
‘কোথা সে সিনেমা হল
কোথা সে শপিং মল
চারিদিকে ঘোলা জল
করিতেছে খলবল।’
চারিদিকের শোচনীয় অবস্থা দেখার পর ফ্যাতাড়ুদের মনে একটা সন্দেহ জাগে। গোটা শহরটা জলের তলায় চলে গেল কী করে? সত্যিই কি তার জন্য উষ্ণায়ন দায়ী, না কি কোনো পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ? যদি সমুদ্রের ঢেই শহরের ওপর আছড় পড়ে, মানুষ কি গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে, না কি পালানোর চেষ্টা করবে? গল্পের শেষটা এখানে না বলাই ভালো, তবে শহরডুবির কারণ সেই জলের মতোই কিছুটা ঘোলাটে থেকে যায়।
এবার চলে যাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ইম্পিরিয়াল ওয়ার ফান্ড-এর জন্য তহবিল সংগ্রহ উদ্দেশ্যে ছাপা হয় ‘ইন্ডিয়ান ইঙ্ক’ নামের এক পত্রিকা। তাতে বহু বিশিষ্ট ভারতীয়দের লেখার পাশাপাশি এভেরার্ড ডিগবি বলে একজন সাংবাদিকের একটি ছোট লেখা প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’, অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর পর কলকাতার চিত্র। যদিও ফিকশনাল, লেখাটিকে ঠিক গল্প বলা যায় না। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক পরিবেশ সব মিলিয়ে স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধ বলা চলতে পারে। গল্পটি বলা হচ্ছে ১৯৬৪-র একজন পর্যটকের দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি কলকাতা আসছেন নদীপথে। সাগরদ্বীপ পেরিয়ে তাঁর চোখে পড়ছে প্রকাণ্ড পাহাড়ের মতো একটা কী বস্তু যা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। আরেকটু কাছে গিয়ে বোঝা যায় পাহাড়টি মাটির সংলগ্ন নয়। সেটি ভাসছে জলাভূমির কিছুটা ওপরে, গোছা গোছা অ্যালুমিনিয়াম ব্যান্ডের ওপর ভর করে।
‘এই আশ্চর্য পরিস্থিতির কারণ? ১৯১৪ থেকে কলকাতার বাড়ির উচ্চতা বাড়তে থাকে। তার জন্য কিছুটা দায়ী নিকটবর্তী টাটা স্টিলের কারখানায় তৈরি সুলভ ইস্পাত। কিছুদিন যেতে না যেতে ইঞ্জিনিয়াররা প্রশাসনকে সাবধান করে দেন যে কলকাতা যেহেতু কাদার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, ভিত মজবুত না হলে, যে কোনো দিন, সব বসে যেতে পারে। তার উত্তরে আইন জারি করা হয় যে শহর কেন্দ্রে কমসে কম ২০ ফুট আর শহরতলীতে ১০ ফুট কাদার ভিত ছাড়া মাল্টিস্টোরি বাড়ি বানানো যাবে না। কাদা তুলে আনা হয় শহরের বাইরে থেকে, আর সেই জায়গায় তৈরি হয় বিরাট বিরাট নোনা জলের দিঘি। মশার জ্বালায় শহরবাসী টিকতে পারে না। এমন সময়ে মেসার্স স্মিথ অ্যান্ড ওয়েস্টোভার কাদা কোম্পানির মালিকের মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি আসে। গোটা শহরটাকেই যদি মাটি থেকে তুলে নেওয়া যায়?
দক্ষিণ ভারতে তৈরি তুলোর মতো সূক্ষ্ম, স্টিলের মতো মজবুত অ্যালুমিনিয়ামের তার আমদানি করা শুরু হয়। সেই তারের ওপর ভর করে পঙ্কজ নগরী ক্রমশ উঠে যায় মাটি, জলাভূমি ছেড়ে, আকাশের দিকে। অনুভূমিকভাবে না বেড়ে উচ্চতায় বাড়তে থাকে শহর, আর সেই উচ্চতাও কিছুটা শ্রেণী বিভাগ মেনে নির্মিত হয়। বিভিন্ন স্তরে মানুষের বাড়ি শুধু নয়, রাস্তাঘাট, দোকান পাট সবই। দিনমজুরদের জায়গা হয় সব থেকে নীচে কিন্তু লেখকের মতে তাতে আপত্তি করার কারণ নেই যেহেতু নীচের স্তরের রাস্তাঘাট বাড়ি ঘরদোর ওপরের স্তরের ছায়ায় বেশ ঠান্ডা আর ছায়াময়। (সামাজিক গতিশীলতার সম্ভাবনা নিয়ে যদিও ডিগবি কোন মন্তব্য করেন না।)
১৮২৯-এ টমাস ব্যাবিংটন মেকলের একটি লেখায় ২০০ বা ৩০০ বছর পরের লন্ডনের কাল্পনিক বর্ণনা পাওয়া যায়। সভ্যতা বলতে তিনি যা বুঝতেন তার কিছুই বাকি নেই। মহান ইউরোপীয় শহরগুলির ধ্বংসাবশেষে বিচরণ করছে কিছু ‘হাড়গিলে অর্ধ-উলঙ্গ জেলের দল আর কিছু শিয়াল, কুকুর’। তার কিছু বছর পরের আরেকটি লেখায় প্রথম আবির্ভাব হচ্ছে ‘দ্য নিউ জিল্যান্ডার’ বলে এক চরিত্রের, যার চোখ দিয়ে আমরা দেখছি অতীতের সভ্যতার শেষ কিছু চিহ্ন। এই চরিত্রটি এবং নাগরিক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের চিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংল্যান্ডের সাংবাদিক সাহিত্যে বার বার ফিরে আসে। সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে শহরের অধ:পতিত ভবিষ্যৎ কল্পনা করা যেন এক ধরনের ফ্যান্টাসির আকার গ্রহণ করে এই সময়ে। (এই ফ্যান্টাসির শুরু বা শেষ কোনটাই ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে নয়; এটি উদাহরণ মাত্র।) অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যখন ডিগবি কলকাতার ভবিষ্যৎ কল্পনা করছেন, তিনি কিন্তু আশাবাদী— ইউটোপিয়ানও বলা যেতে পারে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ভার যদি কাদা-মাটি বহন করতে না পারে, তাহলেও প্রযুক্তিগত সমাধান বেরিয়ে আসবে। আর তার ফলে যে শুধু সমস্যা মিটবে তাই নয়, শহরের অপ্রত্যাশিত উন্নতির আশাও করা যেতে পারে। পঙ্কজ নগরী সত্যিই ইস্পাতের পদ্ম ফুলের মতো ভেসে উঠবে কাদায় লাগানো শিকড়ে ভর করে।
নবারুণের লেখায় ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ফ্যাতাড়ুরাও সঠিক জানে না কী ভাবে শহর জলের তলায় চলে গেল। মানুষের হিংসা কি বিশ্ব উষ্ণায়নের আগেই সব ধ্বংস করে দেবে? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই মনে হয় ‘হিংসা’ শব্দটি নিয়ে আরেকটু খুঁটিয়ে ভাবা উচিত। প্রচলিত অর্থে আমরা হয়তো অনেকেই রাজনৈতিক বা আন্তঃব্যক্তিগত হিংসা বুঝি। কিন্তু গোটা প্রজাতি হিসেবে প্রকৃতির প্রতি উদাসীনতাকেও কি এক ধরনের হিংসা বলা যেতে পারে?
ফ্যাতাড়ুদের প্রশ্নের ঢেউ দেখেও কি মানুষ পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করবে না? উত্তর আমরা ওয়েড-এ কিছুটা পাই। খেয়াল করলে দেখা যায়, কোনো কোনো বাড়ির গায়ে ‘আশ্রয়’ বলে নির্দেশক চিহ্ন আঁকা। অর্থাৎ জলবায়ু শরণার্থীরা ক্রমশ ওপরের তলায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের মধ্যে যারা অন্য ব্যবস্থা করে নিতে পেরেছে, তারা শহর ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে গেছে। যারা আরও কঠিন অবস্থা থেকে এসেছে, তাদের কপালে মিনারেল ওয়াটারের বোতলের ভেলা।
অমিতাভ ঘোষ প্রমুখ আরও অনেকেই সাহিত্যে, শিল্পে মনুষ্যসৃষ্ট প্রাকৃতিক অবনতির ছবি তুলে ধরার প্রয়োজন সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে দিয়েছেন। (যদিও তাঁর ন্যারেটিভে কল্পবিজ্ঞান লেখকদের বহু বছরের এই একই প্রচেষ্টা কেন উপেক্ষিত হয় বলা কঠিন।) ক্লাইমেট সেন্ট্রালের ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৫০-এর মধ্যেই কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৪.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু শরণার্থী হয়ে দাঁড়াতে পারে। শিল্পীরা যদি ওয়েড-এর মতো আরও কাজ আমাদের সামনে তুলে ধরেন, তাহলে হয়তো বৈজ্ঞানিক আলোচনা, উপদেশ, সতর্কবাণীর পাশাপাশি গল্পের মাধ্যমেও আমাদের সচেতনতা কিছুটা বাড়তে পারে।
কভারের ছবি: উপমন্যু ভট্টাচার্য ও কল্প সাংভির অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম ‘ওয়েড’ থেকে স্ক্রিনশট
তথ্য সহায়তা:
১। Wade, directed by Kalp Sanghvi and Upamanyu Bhattacharya, Ghost Animation, 2020. https://www.youtube.com/watch?v=KSKjxrL0MWo
২। E.D. [Everard Digby], Calcutta Fifty Years Hence, in ‘Indian Ink’, Thacker, Spink & Co., 1914.
৩। নবারুণ ভট্টাচার্য, ‘২০০ বছর পরে ফ্যাতাড়ু’, ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক। ভাষাবন্ধন প্রকাশনী, ২০০৯।
৪। ‘When London is in Ruins: Gustave Dore’s The New Zealander (1872)’, Public Domain Review.
৫। A.K. Ray, ‘A Short History of Calcutta’, Census of India, Vol. 7, Bengal Secretariat Press, 1901.
৬। Debjani Bhattacharya, Empire and Ecology in the Bengal Delta: The Making of Calcutta, Cambridge University Press, 2018.
৭। Upamanyu Bhattacharya, ‘The Making of Wade’, The World of Apu, 10 July 2020.