কুকুর হইতে সাবধান। বিজ্ঞাপন মারিবেন না। ৩ বৎসরের ঊর্ধ্বে পুরা ভাড়া লাগিবে। পকেটমার হইতে সাবধান। নির্দেশ বা বিবৃতিগুলি চেনা। রোজকার চলিতে মোড়া চলার পথে এখনও দেখা হয়ে যায় এসব সাধু বাক্যবন্ধের সঙ্গে। কিন্তু কেন? আমাদের মান্য চলিতের বজ্র আঁটুনি জীবনে দু’একটা ফস্কা গেরোর মতো আজও কীভাবে রয়ে গেল সাধু ভাষার এমন কিছু ‘টিপিক্যাল’ ব্যবহার? ভাষাতাত্ত্বিকেরা এ-প্রশ্নে নির্দিষ্ট ও যথাযথ পথনির্দেশ করতে পারবেন; তবে সাধারণ পথচারী ও ভাষা ব্যবহারকারী হিসেবে মনে হয়, একটি নয়, এই প্রবণতার নেপথ্যে মিলেমিশে রয়েছে একাধিক কারণ।
ইশকুলের রচনা হোক কিংবা পত্রিকার প্রবন্ধ। কোনও মতকে প্রতিষ্ঠা করতে হরবখত উদ্ধৃতির ব্যবহার দেখা যায়। অনেকে তো লেখা শুরুই করেন মাথায় কোটেশন-চিহ্নের তিলক কেটে! সব ক্ষেত্রে নয় বটে, তবে অনেক সময়ই এর মধ্যে যেমন লেখকের পাণ্ডিত্য জাহিরের প্রবণতা কাজ করে, তেমনই আবার নিজের যুক্তিগুলি যথেষ্ট শক্তপোক্ত ভাবে নিজস্ব ব্যাখ্যা দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে না পারাও অতীতের রেফারেন্স টানার দিকে ঠেলে দেয়। পূর্বজর উক্তি সম্বল করে তখন নিজের অপারগতা অতিক্রম করে যেতে চাই আমরা। এই শর্টকাটের সুবিধে হল, এমন ধারণা সাধারণত আমাদের আগাম বশ করে রাখে যে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে তা পরীক্ষিত এবং ধ্রুব সত্য, ফলে সহজেই কাজ হাসিল হয়। ক্লাসিক্যাল পিরিয়ডে ভুল কিছু হতে পারে না— আমাদের এই কতকটা ‘ব্যাদে আছে’ মানসিকতা সাধু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে ক্রিয়াশীল থাকে।
পূর্বোক্ত অপারগতা অতিক্রমণের প্রয়াসের মতো এ-লেখাতেও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হলে দেখতে পাই ‘সাধুভাষা’ বলতে বোঝানো হচ্ছে— ‘বিশুদ্ধ বা ভ্রমশূন্য ভাষা’। এই ভাষায় যা বলা হবে, তা-ও যেন ভ্রমশূন্য। কাজেই অনুজ্ঞা বা আদেশসূচক বাক্যে অনেক ক্ষেত্রে সাধু ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ‘বিজ্ঞাপন মারবেন না’ লেখার বদলে আজও দেওয়ালে-দেওয়ালে স্টেনসিলের ছাপ পড়ে— বিজ্ঞাপন মারিবেন না। ‘৩ বছরের ওপরে পুরো ভাড়া লাগবে’ নয়, বাসের গায়ে কার্সিভ ক্যালিগ্রাফি ফুটে ওঠে— ৩ বৎসরের ঊর্ধ্বে পুরা ভাড়া লাগিবে। সাধু ভাষার সঙ্গে এই আপাত পবিত্রতার বোধ জুড়ে রয়েছে। তা উচ্চারণ করলে গুরুত্ব বাড়বে, লোকে মানবে, এমন ধারণা নিহিত আছে বলেই বোধ হয় আমরা মনে করি ‘সদা সত্য কথা বলিবে’; কিন্তু ‘সবসময় সত্যি কথা বলবে’ না।
এই ধারণা অবশ্য হালের আমদানি নয়। বাংলায় চলিত ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা যখন পূর্ণ উদ্যমে চলছে, সেই সংক্রান্ত বিবিধ ব্যাখ্যা ও বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখনও এই মনোভাব জনমানসে দেখা গিয়েছিল। প্রায় নব্বই বছর আগে ‘সাধু ও চলিত ভাষা’ প্রবন্ধে যার উল্লেখ করছেন রাজশেখর বসু : ‘ধারণা দাঁড়িয়েছে— চলিতভাষা একটা তরল পদার্থ, তাতে হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কাটা যায়, কিন্তু ভারী জিনিস নিয়ে নয়। ভার বইতে হ’লে শক্ত জমি চাই, অর্থাৎ সাধুভাষা। এই ধারণার উচ্ছেদ দরকার। চলিতভাষাকে বিষয় অনুসারে তরল বা কঠিন করতে কোনও বাধা নেই।’ এক শতকেও আমাদের মন থেকে সে-ধারণার যে পুরোপুরি উচ্ছেদ হয়নি, তা বুঝতে পারা যায়।
সাধুর বিপরীত চলিত। আবার, অসাধুও। যাবতীয় অসৎ বা অসাধু অনুষঙ্গ এড়িয়ে জগতের পবিত্রতম শব্দমালা রচনার সহজ আকাঙ্ক্ষাটিও কখনও সাধু ভাষা নির্বাচনের কারণ হয়ে পড়ে। যেমন, বিয়ের কার্ড। তার গতবাঁধা সস্তা বয়ানটি আজও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধু ভাষাতেই লেখা হতে দেখি। ‘রাত দশটা’ না, বিয়ের লগ্ন পড়ে ‘রাত্রি দশ ঘটিকায়’। ‘আমার বাড়িতে’ নয়, নেমন্তন্ন করা হয় ‘মদীয় বাসভবনে’। এক্ষেত্রে অবশ্য আরও একটি ব্যাপার কাজ করে। আমরা, সাধারণ মানুষরা অনেক বিষয়ই নতুন করে ভাবতে চাই না। যা প্রচলিত, তাকেই চূড়ান্ত ধরে নিয়ে ‘টেমপ্লেট’ হিসেবে ব্যবহার করে চলি। ভাবনাচিন্তার একপ্রকার অসারতাও অনেক সময় এসবের পিছনে থাকে। ফলে, কোনও আমন্ত্রণপত্রের ক্ষেত্রে সাধু ভাষার প্রথাগত বয়ানটিই বস্তুত চালু বা চলিত হয়ে দাঁড়ায়।
উলটোটাও আছে। ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’-এ গোলাম মুরশিদ সাধু ভাষার অর্থ হিসেবে বলছেন : ‘মার্জিত লিখিত ভাষা’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা’। সোজা কথায়, ভদ্দরলোকের ভাষা। কয়েক দশক আগে পর্যন্ত এই ভাষাই সংবাদপত্রে ব্যবহৃত হত। ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ প্রতিবেদনে চলিত ভাষা ব্যবহার শুরু করে। ক্রমে অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্রগুলি সেই পথে হাঁটে। বাংলাদেশের ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সাধু ভাষায় প্রতিবেদন লেখার রীতি বজায় রেখেছিল। ওইদিন ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় একটি ঘোষণা দেওয়া হয়, যা উদ্ধৃত করছেন বাংলাদেশের সাংবাদিক ও ভাষাতাত্ত্বিক আবু জার মোঃ আককাস, তাঁর ‘পত্রিকায় সাধু ভাষা-রীতি’ ব্লগপোস্টে। ঘোষণাটিতে বলা হচ্ছে— ‘ভাষা-বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, তরুণ প্রজন্ম, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, পাঠক-পাঠিকা এবং শুভানুধ্যায়ীদের সুচিন্তিত মতামত অনুযায়ী আগামীকাল বুধবার থেকে দৈনিক ইত্তেফাকে সাধু ভাষা-রীতির বদলে চলতি ভাষা-রীতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের গত ৫০ বছরের ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে সম্পাদকীয় নিবন্ধ আগের মতই সাধু-রীতিতে প্রকাশিত হবে।’ দীর্ঘদিনের রেওয়াজ কাটিয়ে অতিসম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ এই সাধু ভাষার সম্পাদকীয় ছেড়ে বেরোতে পেরেছে। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সম্পাদকীয় অবশ্য এখনও সাধু গদ্যেই লিখিত হচ্ছে।
সম্পাদকীয় স্তম্ভে সাধু ভাষার ব্যবহার কিংবা সাধারণ প্রতিবেদনের তুলনায় খানিক ভারী গদ্যে রচনা কোনও প্রতিষ্ঠানের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর নেপথ্যে কি এক ধরনের ‘এলিটিজম’-কে আঁকড়ে থাকার প্রবণতাও কাজ করে না? ফরাসি ভাষায় যাকে বলে ‘Mots savants’ বা ‘মো সাভঁ’। অর্থাৎ কিনা, যা জ্ঞানীদের শব্দ। আমাদের আশপাশে নজরে আসা সাধু ভাষা কিংবা সংস্কৃত-ঘেঁষা প্রয়োগগুলির ক্ষেত্রেও জ্ঞানীর ভূমিকায় অভিনয় করতে চাওয়ার এক অদম্য চেষ্টা কখনও-কখনও ধরা পড়ে যায়। সামাজিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবহারের প্রভাব অনস্বীকার্য।
তবে, সবটা অবশ্যই সচেতন প্রয়াস নয়। কোনও ভাষাগোষ্ঠীর দীর্ঘকালের অভ্যাসে থাকা কিংবা একদা লব্জ হয়ে ওঠা পুরনো কথাও চলতে-চলতে বিবর্তিত নতুন ভাষার মধ্যে অবিকল রূপে এবং স্থায়ীভাবে ঠাঁই পায়। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ‘কুকুর হইতে সাবধান’ পড়ে বেমালুম সতর্ক হওয়া যায়। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না’ শপথ পাঠ করতে বেগ পেতে হয় না। আবার প্রচলিত প্রবাদ, পরিচিত বচন, মুখের কথায় মিশে যাওয়া সাহিত্যিক উদ্ধৃতিসমূহ উদ্ধারচিহ্ন ছাড়াই সরাসরি আমাদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তৈরি করে ভিন্ন ব্যঞ্জনা। ভাষা যত আধুনিকই হোক-না-কেন, প্রবহমান লোকস্মৃতির এইসব প্রভাব এড়ানো যায় না। তখন সাধুরূপে থাকলেও তা হয়ে ওঠে চলিত। ‘বাংলা প্রবাদ’ বইয়ের সাধু ভাষায় লেখা ভূমিকায় সুশীলকুমার দে এই ‘চল্তি কথা’-র প্রতিই দিক্নির্দেশ করছেন— ‘… যাহা পিতার বচন ছিল, তাহা কালক্রমে পুত্রের সম্পত্তি হইল; গৃহিণীর সরস বুলি গৃহের বাহিরেও মেয়েলি ছড়ায় নিত্যতা লাভ করিল; গ্রামের মোড়লের রসিকতা গ্রামের আপ্তবাক্যে পরিণত হইল; শিল্পী বা কারিগরের ধারাবাহিক শিল্প-রহস্য কোন প্রবচনের সংক্ষিপ্ত স্থায়িত্বে স্মরণীয় হইয়া রহিল। প্রবাদের রচয়িতার নাম লুপ্ত হইল বটে, কিন্তু তাহার চটকদার বাক্য সাধারণের প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা বাস্তব অনুভূতির নির্য্যাস হিসাবে লোক-প্রিয়তার কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হইয়া লোকপরম্পরায় প্রচলিত হইল। ক্রমে সাহিত্যিক রচনায় উদ্ধৃত বা চল্তি কথায় অন্তর্ভুক্ত হইয়া ইহাদের রূপ ও রস পরিপুষ্টি ও স্থায়িত্ব লাভ করিল।’ এইভাবেই ‘কহেন কবি কালিদাস’ অথবা ‘পিপীলিকার ডানা উঠে মরিবার তরে’ খুব সহজে আমাদের নিত্য আলাপে জায়গা করে নেয়। রবি ঠাকুরের ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে’ কিংবা শশধর দত্তের ‘কোথা হইতে কি হইল…’ ঋণস্বীকার ছাড়াই অনায়াসে লিখে ফেলা যায় ঝরঝরে ফিচারের প্রথম প্যারায়।
সাধু ভাষা মানে তো শুধু সর্বনাম আর ক্রিয়াপদের সাধু রূপ ব্যবহার নয়, সমাসবদ্ধ পদ ও অন্যান্য শব্দচয়নের মাধ্যমেও উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো। এই অসাধু সময়েও সাধু ভাষার ব্যবহারে সেই লক্ষ্যপূরণ কখনও-কখনও জরুরি হয়ে পড়ে। আধার ও আধেয়র বৈপরীত্য এনে হাস্যরস সৃষ্টি করতে একদা যে-পথ বেছেছিলেন ‘লোকরহস্য’-র বঙ্কিম। আজও হ্যাটা করার উদ্দেশ্যে তেমন-তেমন ক্ষেত্রে সাধু ভাষা ব্যবহার বিশেষ রকম প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর। নিরাপদও। ‘শুয়োরের বাচ্চা’-র বদলে ‘বরাহনন্দন’ বললে শ্লেষ খানিক বাড়ে বলেই মনে হয়। উপরন্তু মানহানির মোকদ্দমায় তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনাটি কমে।
কৃতজ্ঞতা: আবু জার মোঃ আককাস