অনীক দত্ত পরিচালিত ‘অপরাজিত’ ছবির সহ-চিত্রনাট্যকার ও সহযোগী পরিচালক হিসেবে ছবিটা নিয়ে লিখতে বসে বুঝতেই পারছি না আদৌ লেখার মতো কী আছে! দর্শক ছবিটা দেখেছেন আর দর্শকের কাছে সেটাই তো একমাত্র সত্য। তবে কোনও এক মহামতি একবার বলেছিলেন,‘Fiction is the lie through which we tell the truth.’ হক কথা। আর চলচ্চিত্রশৈলীর মধ্যে তো ম্যাজিকের মতোই তথাকথিত ‘মিথ্যে’ বা ‘ভ্রম-‘এরউপাদানথরে-থরেঠাসা।ছবি তৈরির হেঁশেলে যা ঘটে,তার অধিকাংশই দর্শকরা জানতে পারেন না। ভাগ্যিস পারেন না, তাহলে আর সিনেমার বাস্তবতা তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হত না। তবে আজকাল আপামর দর্শক অনেক বেশি সচেতন, তাঁরা সিনেমা তৈরির অনেক নেপথ্য-কথা শুধু জানেন তাই নয়, সে-ব্যাপারে আগ্রহীও বটে।আজ ‘অপরাজিত’-রঅন্দরমহলের কিছু কথা বরং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই।
মানুষের সব থেকে বড় বিপদ হল, মানুষ সময়কে কখনও থামাতে পারে না বা উল্টোমুখে চালাতে পারে না। যুগে-যুগে তাই মানুষ নানান পন্থা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে, যা দিয়ে সময়কে বা একটা মুহূর্তকে থামিয়ে রাখা যায়। যে-কোনও শিল্পই, তা সে সাহিত্য-চিত্রকলা-সঙ্গীত বা চলমান চিত্রমালা যাই হোক না কেন, প্রাথমিক ভাবে যা করতে চায়, তা হল সময়কে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা; Sculptng in Time. তবে বর্তমান সময়কে ধরে রাখতে না-পারার আকুলতা থেকেই মানুষ বারবার ফিরে যেতে চায় তার অতীতে, তার ইতিহাসে। ‘অপরাজিত’-র অভিজ্ঞতাআমাদের কাছে সেরকম এক ইতিহাস-যাপন; শুধু এখানে বিষয়টা আরও একটু জটিল, কারণ আমরা চেষ্টা করেছিলাম একটা নির্দিষ্ট কালখণ্ডকে পুনর্নিমাণের মাধ্যমে তৎকালীন ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার। আপনারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন ‘অপরাজিত’ ছবিটি সত্যজিৎ রায়ের যুগান্তকারী ছবি ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির নেপথ্য-কথার ঐতিহাসিক দলিলের ওপর তৈরি এক কাহিনিচিত্র। এ-ছবি ‘বায়োপিক’ নয়, তবে সত্যজিৎবাবুর জীবনের একাংশ এবং ‘পথের পাঁচালী’তৈরি ও তার কিছু পূর্ব ও উত্তরপর্বই ‘অপরাজিত’ ছবিটির আঁতুরঘর।
এই ছবির প্রস্তুতিপর্ব সত্যিই ব্যাপক। প্রায় একটা গোটা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায়, নাছোড়বান্দা মনোভাব ও গোটা ইউনিটের পরম যত্নের ফসল হল ‘অপরাজিত’। এ-ছবির বিভিন্ন সাংঘাতিক প্রতিকূলতার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের আদলে নতুন করে চরিত্র নির্মাণ; সেখানে আবার দু’রকমের চরিত্র। কিছু মানুষ সম্পূর্ণ বাস্তব যেমন সত্যজিৎ রায়ের আদলে অপরাজিত রায়, বিজয়া রায়ের ধাঁচে বিমলা রায় বা সুব্রত মিত্রের ছায়ায় সুবীর মিত্র— আবার কিছু মানুষ একইসঙ্গে বাস্তব ও সিনেমার বাস্তব। যেমন চুনীবালা দেবীর আদলে ননীবালা দেবী বা করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে বরুণা বন্দ্যোপাধ্যায়— তাঁরাই ইন্দির পিসির আদলে পিসি বা সর্বজয়ার আদলে সর্বমঙ্গলা; অর্থাৎ তাঁরাই আবার সিনেমার চরিত্র।
অনীক দত্তের সঙ্গে চারটে ছবির চিত্রনাট্য লেখার সূত্রে এবং তাঁর ছবি তৈরি খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমি তাঁর কাজের ধরন বা অভিমুখ অনেকটা জানি। তাঁর কাজের বিবিধ পন্থা আমার খুব পছন্দের এবং যে-কোনও কাজের ক্ষেত্রেই অনীকদার একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমার বড় প্রিয় ও অনুকরণযোগ্য মনে হয়। হলিউড, বলিউড বা দক্ষিণ ভারতীয় ছবির তুলনায় বাংলা ছবির বাজেট ও অন্যান্য সংস্থান যে হাস্যকর ভাবে কম তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু অনীকদা সবসময় মনে করেন যে, আমাদের সীমিত সামর্থ্য বা উপকরণ নিয়েই এমন একটা ছবি তৈরি করা সম্ভব যা গুণে-মানে একটা পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। আর শুধু মনে করা নয়, তাঁর ছবি তৈরির দর্শনে এই বিষয়টা আমি সারাক্ষণ পাই; তাই টাকা বা অন্যান্য অভাবকে বুদ্ধি, যুক্তি, সাধারণ বোধ ও জ্ঞান, নানান বিরল পদ্ধতি বা সিনেমার বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে অতিক্রম করা অনীকদার কাজের একটা অন্যতম বিশেষত্ব; যা থেকে আমি অন্তত প্রতি মুহূর্তে প্রচুর নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে নিয়েছি আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে।
যে-কথা বলছিলাম, ‘অপরাজিত’-র চরিত্রান্বেষণ চলেছিল বহুদিন ধরে। যে যে মানুষের আদলে আমরা আমাদের চরিত্র তৈরি করতে চাই, তাঁদের সময়োপযোগী যত রকমের ছবি সম্ভব, প্রথমে সেসব জোগাড় করা হয়। আমরা ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম খুব প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাদের মধ্যে এই ধরনের মুখ বা অবয়বের মিল পাওয়া বেশ মুশকিল; তাই আমাদের দলের প্রায় সবাই তাদের নিজেদের পরিচিত মহলে খুঁজতে থাকে, তুলনামূলক ভাবে কম প্রতিষ্ঠিত বা একেবারে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে। আমি যে-সময়ের কথা বলছি, তখন একজন অত্যন্ত লব্ধপ্রতিষ্ঠ অভিনেতারই মূল অর্থাৎ অপরাজিত রায়ের চরিত্রে অভিনয় করার কথা। বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিনেতাদের খোঁজ আসতে থাকে। তবে সমস্যা হয়, কাউকে চট করে ছবিতে দেখলে মিল পাওয়া গেলেও ভিডিও-অডিশন দেখার পর সে-মিল উধাও! তখন ২০২১ সালের লকডাউন চলছে তাই সাক্ষাতের উপায়ও নেই। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, একজন অভিনেতাকে একটা বিশেষ চরিত্রে চূড়ান্ত করার পর শুটিং-এর কিছুদিন আগে অন্য একজনকে পাওয়া গেছে যিনি চেহারাগত বা আচরণগত ভাবে আরও যথাযথ; তখন পূর্ববর্তী অভিনেতাকে বুঝিয়ে বলে, মার্জনা চেয়ে নিয়ে, আমরা নতুনজনকে নিয়ে এগিয়েছি কিন্তু আপোস করিনি। গোটা ছবির চরিত্রায়নের কাহিনি বলতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। আমি বরং দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নির্মাণকথা বলি আজ। অপরাজিত রায় ও ননীবালা দেবী।
তখন বাকি মূল চরিত্র মোটামুটি পেয়ে গেছি কিন্তু কিছুতেই ননীবালা দেবীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। আর এত গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্র! আমি একজনের কথা ভেবেছিলাম যিনি অভিনেত্রী না হলেও তাঁর মধ্যে ওই তোবড়ানো গাল, ভেঙে যাওয়া মুখ আর ফোকলা দাঁতের হাসি অনেকটাই ছিল, কিন্তু খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম তিনি আগে কলকাতাতেই থাকতেন কিন্তু কোভিডের পর দেশের বাড়ি চলে গেছেন আর সে-ঠিকানা কেউ জানে না। আমরা যে-ক’জন অভিনেত্রীর খোঁজ পেয়েছিলাম, তাঁদের কারোর মধ্যেই এই চরিত্রের অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্যগুলো পাইনি। এই ছবির চরিত্রচিত্রণে একটা মারাত্মক বড় ভূমিকা আছে আমাদের মেক-আপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডুর, তাঁকে ছাড়া এই কাজ সম্ভব ছিল না। তিনিও এই সব অভিনেত্রীদেরকে মেক-আপের সাহায্যে ননীবালা দেবীতে পরিণত করার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। একটা সময় বিষয়টা বেশ গভীর সংকটের দিকে যেতে শুরু করে, কারণ এরকম একটা কালজয়ী সৃষ্টি যথাযথ ভাবে তৈরি না করা গেলে তার থেকে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না। বস্তুত ননীবালা দেবী ঠিকমতো পাওয়া না গেলে ‘অপরাজিত’ ছবিটা হওয়াই সম্ভব নয়। দুরাশার মেঘ দানা বাঁধতে লাগল। আক্ষরিক অর্থে না হলেও প্রায় বিনিদ্র রাত কাটার উপক্রম হল আমাদের। এমন সময় একদিন বেশ রাতে অনীকদা এক পাকা চুলের প্রায়-অশীতিপর বৃদ্ধর ছবি পাঠালেন। আমি একটু আলগোছেই জিজ্ঞেস করি, ‘ইনি আবার কোন চরিত্র করবেন?’ অনীকদা জানান, ‘ভাবছি ননীবালা দেবী। দেখ তো ভাল করে, একবার সোমনাথের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’ চমকে উঠলাম। কী সাংঘাতিক চোখ আর পর্যবেক্ষণ ভদ্রলোকের! সত্যিই তো বৃদ্ধের মুখের গড়নে, আদলে, শারীরিক ভঙ্গিতে এক অদ্ভুত মিল আছে। এরপর সাময়িকভাবে ফোটোশপে এই বৃদ্ধর ছবিকে চুনীবালা দেবীর আদল দেওয়ার চেষ্টা হল। ফলও পাওয়া গেল আশাপ্রদ। তারপর বাকি ম্যাজিক দেখালেন সোমনাথদা; তাঁর প্রস্থেটিক্স মেক-আপের জাদুকাঠির স্পর্শে বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামের লেটো সঙ্গীত-সম্রাট হরকুমার গুপ্ত হয়ে উঠলেন আমাদের ননীবালা দেবী। হ্যাঁ ঠিক-ই পড়লেন, একজন মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন একজন পুরুষ। অনীকদা হরবাবুর সন্ধান পেয়েছিলেন নাট্যকার ও পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। এরপর একদিন ট্রেনে চড়ে হরবাবু ছেলের সঙ্গে কলকাতায় এলেন, হোটেলে থাকলেন, আমাদের সঙ্গে অনেক গল্প করলেন, গান শোনালেন, অনীকদার কাছে চরিত্রটা বুঝে নিলেন, ‘পথের পাঁচালী’তে চুনীবালা দেবী অভিনীত কিছু দৃশ্য দেখলেন। তাঁর ওপর মেক-আপের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হল, অভিনেতা সুমিত সমাদ্দার (যিনি এই ছবিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়-ও করেছেন) হরবাবুর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন একটা অভিনয়ের কর্মশালার মাধ্যমে তাঁকে ধীরে-ধীরে ননীবালা দেবীর চরিত্রটা ধরিয়ে দিলেন। তারপর আমরা শুটিং করলাম। ক’দিন বোলপুরে, বাকিটা কলকাতায়। একটা দৃশ্য কখনও ভুলব না। বোলপুরে শুটিং চলছে, ইন্দির পিসির মরদেহ নিয়ে শ্মশানযাত্রার দৃশ্য। তারই মাঝে সামান্য বিরতি; ননীবালা শুয়ে আছেন খাটিয়ায়। হঠাৎ আমি তাকিয়ে দেখলাম, সাদা থান পরে, শাল গায়ে আমাদের ননীবালা হরবাবু পরম আমেজে ঘন ঘন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন আর অপরিসীম তৃপ্তিতে ধোঁয়া ছাড়ছেন।
জিতু কামালকে আমি চিনতাম না। ব্যক্তিগত ভাবে তো নয়ই, অভিনেতা হিসেবেও তাঁর কাজ দেখার সুযোগ আমার হয়নি। অনীকদা কোনও এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের পথসভায় জিতুকে দেখেছিলেন; জিতু এসেছিলেন অত্যন্ত স্বাভাবিক আধুনিক পোশাকে— জিন্স ও টি-শার্ট জাতীয় কিছু একটা পরে। অনীকদার তীক্ষ্ণ নজর এড়ায়নি জিতুর উচ্চতা ও মুখের গড়ন। এরপর জিতুর কিছু ছবি জোগাড় করা হয়। আগেই বলেছি, তখন অপরাজিত রায়ের চরিত্রে অভিনয় করার কথা অন্য একজন অভিনেতার। আমাদের ছবিতে অপরাজিত রায়ের একটু কম বয়সের ছোট-ছোট কিছু সিন আছে যখন তিনি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছেন বা কলকাতার সিনেমা হলে হলিউডের ছবি দেখছেন। এই সময়টা হল বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের একদম গোড়ার কথা। আর আমাদের ছবির মূল ঘটনাকাল চল্লিশের দশকের শেষ থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। অনীকদা বললেন জিতুর একটা লুক টেস্ট করে দেখা যাক, তাহলে ওকে অনুরোধ করব ছোটবেলাটা করতে; তাহলে দুজন অভিনেতার মধ্যে বয়স বা চেহারাগত একটা পার্থক্যও তৈরি করা যাবে।
সেদিন আরও বেশ অনেকজন চরিত্রের লুক সেট হচ্ছিল সকাল থেকে। তখন বেলা পড়ে এসেছে। জিতু ঢুকল মেক-আপ আর্টিস্ট সোমনাথদার ঘরে। বাকি সব কাজ সেদিনের মতো শেষ হয়ে এসেছে, তাই আমাদের গোটা দলের মধ্যেই একটা হালকা পরিস্থিতি। স্টুডিয়োর মধ্যে তখন খুব অল্প আলো আর বেশ খানিক আঁধারি, সঙ্গে হালকা গুঞ্জন, টিফিনে মুড়িমাখা চিবোনোর মর্মরধ্বনি… আচমকা ‘আঁক’ করে একটা অস্ফুট শব্দ শোনা গেল আমাদের সহকারী দলের ঋতুপর্ণার মুখে।ঋতু মেক-আপ ঘরের দরজার দিকে তাকিয়েছিল। দরজা খুলে, পর্দা একটু সরল; ঘরের ভেতরের আলোর তীব্রতা বেশি থাকায় অবয়বটা একটু সিলুয়েট হয়ে যায় সেই সময়ে। তিনি বেরিয়ে এলেন; এসে একটা চেয়ারে খুব চেনা ভঙ্গিতে মাথার ওপর একটা হাত তুলে বসলেন। আমরা তখন বাক্রূদ্ধ। সমস্ত গুঞ্জন, নড়াচড়া, মোবাইলে খুটুর-খাটুর, মুড়ি চেবানো সব বন্ধ। আমাদের তখন আক্ষরিক অর্থে ভূত দেখার মতো অবস্থা। নেপথ্যে তখন সোমনাথদা ব্যাখ্যা করছেন যে, তিনি মেক-আপে কী কী করেছেন, কিন্তু আমাদের কানে সেই কথাগুলো তখন তালগোল পাকিয়ে বাক্যবন্ধ থেকে ভাসা-ভাসা কতগুলো শব্দে পরিণত হয়েছে। Doppelganger বলে যে একটা শব্দ আছে, তার প্রকৃত অর্থ যে কী, তা এরকম বাস্তব উদাহরণ-সহ কখনও বোঝা যেত বলে মনে হয় না। তবে আমাদের উদ্দীপনা অনেকটাই স্তিমিত হল, কারণ তখনও জিতুর খানতিনেক দৃশ্যেই অভিনয় করার কথা। ছবির প্রস্তুতি এগোতে থাকল।
এরপর আমাদের শুটিং-এ একটা বড় বাধ সাধল আবহাওয়া। আমাদের শুটিং-এর আউটডোর ছিল ২০২১-এর অক্টোবরের দুই বা তিন তারিখ থেকে পুজোর আগে পর্যন্ত। এই সময়টা আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের কাশফুলের ওই দৃশ্যটা শুট করতে হবে। সেপ্টেম্বরের শেষদিক থেকে শুরু হল সাংঘাতিক বৃষ্টি। বর্ষা-পরিস্থিতি ক্রমশ সংকটময় হয়ে উঠল। আমাদের শুটিং গেল ভেস্তে। নতুন করে সব তৈরি হল, পুজোর পরে ১৭ই অক্টোবর থেকে। তার বেশি দেরি হলে আমাদের ইউনিটের অনেকেই অন্য কাজে চলে যাবে। এই সময়ে একটা সমস্যা দেখা দিল, যে-অভিনেতা অপরাজিত চরিত্রে অভিনয় করছিলেন তাঁর। তিনি আমাদের সময় দিয়েছিলেন পুজোর আগে কিন্তু পুজোর পর থেকে তাঁর সময় দেওয়া আছে জাতীয়স্তরের কোনও একটা কাজে, নভেম্বরের মাঝামাঝির আগে সেই কাজ শেষ হবে না। আর নভেম্বর পর্যন্ত আউটডোর শুটিং পেছনো মানে এ-বছরের মতো কাশফুল পাওয়া যাবে না, কারণ কাশ মরশুমি ফুল। গোটা একটা বছর অপেক্ষা করার বিলাসিতাও আমাদের নেই, সেক্ষেত্রে ছবিটা আদৌ হবে কি না সে-বিষয়েই একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন উঠে আসতে লাগল। অবশেষে প্রচুর টালাবাহানার পর সিদ্ধান্ত হল জিতুই গোটা ছবিটা করবে। এদিকে জিতুর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তখন খুবই কম; হাতে মাত্র আর ক’দিন।শুরু হল এক অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াস। প্রথমদিনের শুটিং-এ ঘটল আর এক বিপর্যয়। পুজোর পরেও আমরা একটা জায়গা পেয়েছিলাম যেখানে অল্প কিছু কাশফুল অবশিষ্ট ছিল, কিন্তু শুট-এর আগের দিন সারারাতের নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টিতে সব ফুল গেল ঝরে। তবু নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হল। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে জিতু এল প্রথম দৃশ্যের শুটিং করতে। আমরা সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু শরীরী-ভঙ্গি অপরাজিত রায়ের চরিত্রের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছিলাম; তার মধ্যে একটা ছিল সত্যজিৎবাবুর রুমাল চিবোনোর একটা মুদ্রাদোষ। জিতু শটের মাঝে এক অদ্ভুত স্বাভাবিকতায় রুমালটা হাত থেকে নিজের কাঁধে রেখে তারপরে আনমনে রুমালের কোণাটা চিবোল। এটা দেখে কীরকম আমাদের সবারই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। আস্তে-আস্তে জিতু আমাদের আরও, আরও অবাক করে দিল। মাঝে মাঝে মনে হত, কীরকম একটা ঘোরের মধ্যে আছি। চোখের সামনে যা ঘটে চলেছে সেটা বাস্তব নয়, সেটাই যেন একটা সিনেমা। এরপর জিতুর দৃশ্যপটে কণ্ঠদান করল চন্দ্রাশিস রায়। আমাদের অপরাজিত রায় সম্পূর্ণ হলেন।
আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হল ‘অপরাজিত’ আমাদের ছবি থেকে দর্শকের ছবি হয়ে গেছে। বিভিন্ন পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘অপরাজিত’ যখন এত সমাদৃত হচ্ছে, অসংখ্য মানুষ যখন তাঁদের অকুণ্ঠ প্রশংসা ও অকৃত্রিম ভালবাসায় ছবিটাকে ভরিয়ে দিচ্ছেন,তখন বারে বারে মনে পড়ছে এ-ছবির নেপথ্যের অসংখ্য গল্প-অভিজ্ঞতা, যা চিরকালের জন্যে আমাদের স্মৃতি-সম্পদ হয়ে থাকবে।