দর্শক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
থিয়েটারের ছাত্র হিসেবে ছোট থেকেই সারা পৃথিবীর থিয়েটার নিয়ে তুমুল আগ্রহ। বই বা ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়াশোনা করলেও, প্রত্যক্ষ দর্শনের আকাঙ্ক্ষা সকলেরই থাকে। আমাদের এখানে গ্রুপ থিয়েটার বা প্রফেশনাল থিয়েটার যেভাবে হয় তার থেকে আমেরিকার ব্রডওয়ে বা লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড বা বার্লিন অনসম্বলের থিয়েটারের রূপ আলাদা – এমনটাই শুনে ও কিঞ্চিৎ ইউটিউবের দয়ায় দেখে বড় হয়েছি। হলিউড খ্যাত বা ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ’ তকমা পাওয়া অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পীরা নাকি বিশ্বখ্যাত মিউজিক্যাল থিয়েটার, সিরিয়াস প্রসেনিয়ামের নাটক ও ‘অফ-অফ-ব্রডওয়ে’ থিয়েটার করতে ছুটে যান। এ তো দেখতেই হবে! আমার ছোট থেকেই ভীষণ ইচ্ছে।
তবে নাটক বা থিয়েটারের শিল্প, মঞ্চসজ্জা, আলো, সঙ্গীত, অভিনয় ইত্যাদি নিয়ে আর পাঁচজনের মতো আমার যতটা আগ্রহ, ঠিক সেই পরিমাণ কৌতূহল থিয়েটারের দর্শকদের নিয়ে। তার বিশেষ কারণ আছে।
প্রথমেই তুলি দুটি নাম। আমেরিকা ও লন্ডনে দুটি মিউজিক্যাল থিয়েটার, ‘দা লায়ন কিং’ এবং ‘দা ফ্যান্টম অফ দি অপেরা’ তিন দশক ধরে চলছে (এগুলো সিনেমাও হয়েছে কিন্তু সেটার কথা এখানে বলছি না, সিনেমা না হলেও এই দুটি নির্মাণের খ্যাতি কিছু কম হত না)। অতিমারী আছড়ে পড়ার আগে এই প্রযোজনা দুটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে – প্রতিটি অভিনয় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে। আর প্রতিটি অভিনয় মানে সপ্তাহে সাত দিনে, ওদের নিয়ম অনুযায়ী, মোট আটটি অভিনয় (সোমবার ছুটি, শনি ও রবিবার দুটি করে অভিনয়)। দর্শক সংখ্যার অঙ্ক কষতে গেলে মাথা ঘুরে যাবে!!
অতিমারীর পরেও দর্শকের অভাব নেই। গুনগত মানে পৃথিবীর এই শ্রেষ্ঠ কাজ দুটির মানুষের জীবনের ওপর ‘প্রভাব’ আমি নিজের চোখে দেখেছি!
তিন দশকে পৃথিবী বদলেছে, প্রজন্ম বদলেছে, মুখ বদলেছে, শিল্পীবৃন্দ বদলেছে, মানুষের চাহিদা বদলেছে, দর্শন বদলেছে, মনোরঞ্জনের ভাষা বদলেছে – কিন্তু এই দুটি নাটকের একটা শো-তেও ‘হাউসফুল’ বোর্ডটা বদলায়নি! এ এক অভাবনীয় ব্যাপার!
শুধু এই দুটো নাটকের উদাহরণ দিয়ে বাকিদের উপেক্ষা করা উচিত হবে না। ঠিক একই রকম নিদর্শন সৃষ্টিকারী নাট্য প্রযোজনা সারা বিশ্বজুড়ে রয়েছে – যেমন আগাথা ক্রিস্টি রচিত ‘মাউসট্র্যাপ’ (লন্ডনে ১৯৩৫ সাল থেকে), রোয়াল্ড ডাল-এর ‘মাটিলদা’, ‘শিকাগো দ্য মিউজিক্যাল’, ‘লে মিসরাবল’-এর মতো অনেক নাম। প্রতিটি হলের সামনে উপচে পড়া ভিড়, ম্যাটিনি-ইভিনিং! টিকিট পাওয়ার জন্য দুই মাস আগে থেকে বুকিং! কে করছে? দর্শক! সোশ্যাল মিডিয়া যুগের ‘ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্স’ নয়, শিল্পের সরাসরি মস্তিষ্কে ও হৃদয়ে আঘাত! এটা একদিন দুদিনের চমৎকারী ঘটনা নয়, দশকের পর দশক ধরে বিস্তৃত এক নিয়ম।
আমি এখনো অবধি দুবার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৮ সালের জুন মাসে আমি নিউ ইয়র্কের মিন্সকফ থিয়েটারে ‘দ্য লায়ন কিং’ দেখি। এছাড়া সম্প্রতি লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের আরো তিনটে থিয়েটার দেখি – ‘হার মাজেস্টিজ’ থিয়েটারে ‘দা ফ্যান্টম অফ দি অপেরা’, কেমব্রিজ থিয়েটারে ‘মাটিলদা’ আর উইনধাইম থিয়েটারে ‘লাইফ অফ পাই’। হাঁ করে দেখেছি যে অনেক টাকা ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও থিয়েটারকে ওরা ম্যাজিক ট্রিক বা চলচ্চিত্রর মতো করে তুলতে চায়নি, বরং শিল্পীদের শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছে একটি একটি নাট্য। সবটাই সত্যি ঘটছে চোখের সামনে, রক্তমাংসের মানুষ সেটা ঘটাচ্ছে, তাঁদের ছোঁয়া যায়!
এই কাজগুলি দেখে ভোলার নয়, অভিজ্ঞতাগুলো চিরকালীন।
কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, প্রযোজনা যত ভাল, দর্শকরাও ততটাই ভাল! এখানেই আমি প্রশ্ন শুরু করলাম, এই দর্শকরা কারা, যারা এত বছর এই থিয়েটারের সত্যিটাকে দেখতে চাইছেন বারবার?
বিদেশে সিংহভাগ পর্যটক বা অন্য দেশ থেকে কাজে আসা মানুষ, যারা এই বিখ্যাত কাজগুলি দেখতে এসেছেন, আমারই মতো। বর্তমান পৃথিবীর শিল্পের উপকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ার কারণে এসব জায়গায় ভিন দেশের শিল্পীদের ভিড় স্বাভাবিক। কিন্তু শিল্পী ছাড়াও তো সাধারণ বহু মানুষ আসেন! এঁরা কেউই থিয়েটারের সাথে যুক্ত নন। কিন্তু দর্শক আসনে বসে তাঁরা একটা শিষ্টাচার মেনে চলেন – যেটা সর্বপ্রথম শিক্ষা বা পাঠ হওয়া উচিত আমাদের দেশের দর্শকদের।
থিয়েটারের অলিখিত শর্ত: দর্শকের আসন আর মঞ্চের শিল্পীদের মিলিত আদান প্রদানে একটা সৃষ্টি হবে, সেটা বিদেশের থিয়েটারের দর্শক হয়ে বারবার অনুভব করলাম তীব্র ভাবে। আদান প্রদানটা আসলে সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহের। হাততালি বা স্টান্ডিং ওভেশন ছাড়াও একটা অদৃশ্য শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিয়ে আড়াই ঘণ্টা অডিটোরিয়াম ভরিয়ে রাখা! ভিন্ন ভাষার, প্রদেশের, চিন্তার ও বয়সের মানুষ এক বোধে আবদ্ধ হচ্ছেন! এখানেই তো নির্মাণের বৃত্ত পূর্ণ!
আমি নিজে পশ্চিমবঙ্গের আর ভারতের নানা প্রান্তে নাটকের কাজে ঘুরেছি, এবং এই আদান প্রদানের খামতি বিশেষ ভাবে অনুভব করেছি । খুব বাছাই করা দর্শক বাদে, লাইভ পারফরম্যান্স-এর জন্য সামান্যতম নিয়মও কেউ মাথায় রাখেন না। ভারতীয়দের শিল্পের প্রতি অবজ্ঞার এই আরেক নিদর্শন। খুব দূরে না গিয়ে কলকাতার নামী নাট্য মঞ্চগুলির কথা যদি বলি, তাহলে এখনও একাডেমি, রবীন্দ্র সদন, গিরিশ মঞ্চ, তপন থিয়েটার প্রভৃতির দর্শক আসনে অভিনয় চলাকালীন শোনা যাবে ফোনের আওয়াজ (বন্ধ করার অনুরোধ সত্ত্বেও), ফিস-ফিস নয় বরং আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা, দেখা যাবে মোবাইল স্ক্রোল করা ও অন্য মনোযোগী সহ-দর্শকের অসুবিধে ঘটানোর প্রক্রিয়া। যদি নিয়ম উলঙ্ঘন না করে কিছু দর্শক এই কাজগুলি বন্ধ করতেন, সেটাই হত ন্যূনতম সম্মান প্রদান । আমি নিজে নাট্যকর্মী হিসেবে এই বদভ্যাসের বদল চাই!
অনেকে বলেন আমরা শুধু বিদেশের কাজকেই ভাল বলি – আমি বলছি শুধু কাজ নয়, ওদের এই মানসিকতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। নাট্য প্রযোজনা ছাড়াও নাটকের, থিয়েটারের ও শিল্পের যে পরিবেশ ওরা সমভ্রাতৃত্ববোধে গড়ে তুলেছে, তা আমরা এখনো পারিনি – থিয়েটার পাড়া থেকে থিয়েটারের শহর হয়ে উঠতে পেরেছে অনেক প্রান্ত! এই শিল্পকে ঘিরে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবনযাপন, শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন আমাদের শেখার।
তাই আমার খুব মনে হচ্ছে ভাল কাজের কদর করতে ভাল দর্শক নির্মাণ করতে হবে। এখন তৈরি করতে হবে ‘দর্শক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’! যেমন আমরা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিই স্টেজে ওঠার আগে, দর্শকদেরও দিতে পারি অডিটোরিয়ামে ঢোকার জন্য!
ভাল বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা, নাটক দেখা, ছবি আঁকা এগুলো জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা জেনে এসেছি ছোট থেকে। এই ভাল বা মন্দ বলতে গেলে আবশ্যিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি, যা তৈরি করার কাজ করতে হবে মূলধারার শিক্ষাকেও— মুখস্থ বিদ্যার সাথে সাথে রুচি ও বোধ তৈরি, আলোচনা ও তর্কের যুক্তি তৈরি।
‘আর্ট এ্যাপ্রিসিয়েশন’-এর মতো কোর্স তাই স্কুল থেকেই শুরু করা উচিত। শিল্পের আপেক্ষিকতা বা কেবলমাত্র একটি মাপকাঠি না থাকার যে জ্ঞান তা ছোট থেকেই একটা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত না করলে আমাদের দেশের দর্শক বদলাবে না! এক বা একাধিক শিল্পীর কাজকে সমালোচনা করার আগে যে শিক্ষা, পড়াশোনা, উপস্থিত জ্ঞান প্রয়োজন, সেগুলো শেখাতে হবে। আমি নিজে স্কুলে পড়ার সময় এরকম একটা পাঠ্যক্রম চেয়েছিলাম, যেখানে বাচ্চারা শিখবে সেই ন্যুনতম শিষ্টাচার যেখান থেকে শিল্পী-দর্শক-পর্যটক-সাধারণ মানুষ, সম্মান ও শ্রদ্ধার আদান প্রদান করবেন। না হলে ভাল কাজ হবে না, ভাল দর্শক দেখা যাবে না, সুস্থ সমালোচনা হবে না।