নামটায় কিছু তো একটা ছিল — স্বপন রেক্স কাঠাম।
১৯৮৪ সালে আমি ক্লাস ফোর-এ পড়ি। দোহারা, স্মার্ট চেহারার মানুষটা এসে আমাদের ক্লাসরুমটাকে চার ভাগে ভাগ করে দিলেন। বায়োলজি ল্যাবরেটরির পাশের ম্যারম্যারে ক্লাসরুমটায় চারটে সারিতে সাজানো থাকত আমাদের ডেস্কগুলো। ল্যাবরেটরিটার সবুজ দরজার পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা কঙ্কালটা বেজায় অপছন্দ ছিল আমাদের, বছর নয়-দশের ছেলেমেয়েদের। কিন্তু কৌতূহল ছিল ষোলো আনা— টয়লেটে যাওয়ার পথে, কাঁচের উপর মুখ ঠেসে আমরা সবাই যেন কঙ্কালটার গোপন জীবনযাপনের খুঁটিনাটি খুঁজে যেতাম, পরকালের প্রমাণে অবাক হয়ে রইতাম।
আমরা ক্লাসরুমটা খুব একটা পছন্দ করতাম না বলেই আমার ধারণা। কয়েকবার ক্লাস টিচার বদল হওয়াটাও সে-ক্ষেত্রে সাহায্য করেনি। এক সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও, আমরা একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলাম। যেন অপেক্ষায় ছিলাম, কবে স্বপন রেক্স কাঠাম এসে এক ধাক্কায় আমাদের একটা জমাট বাঁধা গোষ্ঠিতে পরিণত করে দেবেন।
মনে আছে, আমাদের পদবীগুলো একদিনে বদলে গেছিল। আমার সেই সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেল কে-2, আমি হয়ে গেলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্য আর এক জন এভারেস্ট। যে রো-এ আমরা বসতাম, সেগুলোর নাম কাঠাম স্যার বদলে দিলেন নানা পর্বতমালার নামে। প্রতিযোগিতার স্পৃহাটা যেমন জাগিয়ে দিয়েছিলেন কাঠাম স্যার, তেমনই বইগুলোকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। প্রশ্ন আসত বই থেকেই, তাই বইগুলো হয়ে উঠেছিল এক-একটা কুইজের বিষয়। ব্যাটসম্যানদের মতো প্যাড পরে অপেক্ষা করতাম আমরা— কেননা প্রশ্ন আসত অতর্কিতে, এবং তৈরি থাকা ছিল আবশ্যক।
তখন শিলিগুড়িকে এক চিলতে মনে হত— হাতেগোনা কিছু পাড়া, যা অলিগলি আর সাকুল্যে দুটো বড় রাস্তা নয়, যেন রিকশাওয়ালাদের মর্জি-মাফিক সংযুক্ত। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্বের মাপকাঠি কিলোমিটারে নয়, নির্ভর করত রিকশা যাবে কি যাবে না, তার উপরে। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল ঠুনকো, অনেকটাই মনগড়া।
এই আবহাওয়ায় আমাদের জীবনে স্বপন রেক্স কাঠামের আবির্ভাব। মাঝের নামটা আমাদের কাছে বিস্ময়কর ছিল— স্যারের আগে মাত্র এক জায়গাতেই এই নাম দেখেছিলাম আমরা, বেতালের কমিক্সে। রেক্স ছিল চলমান অশরীরির পালিত পুত্র। একটা বিদেশীয় মুগ্ধতা আর আকর্ষণ ছিল স্যারের নামে, ‘রেক্স’ আর ‘কাঠাম’, দুই শব্দতেই।
কাঠাম স্যারের পদবী অনেকেই ‘কাঁঠাল’ বলে ভুল করতেন, কারণ নামটা বেশির ভাগের কাছেই একেবারেই অচেনা ছিল। কিন্তু এই অচেনা মানুষটি আমাদের জীবনে বহু অজানা শব্দের উপস্থাপন করেছিলেন। আমরা মিড্ল স্কুল এবং হাইস্কুলে ওঠার পথে কাঠাম স্যারও সঙ্গে ছিলেন, ভূগোল শিক্ষক হয়ে। কিন্তু এর বহু আগেই, এই পৃথিবীর নানা কোণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল— এবং সেটা শুধু সর্বোচ্চ পর্বতশিখরের নামে ক্লাসের চারটে রোয়ের নামকরণে সীমাবদ্ধ ছিল না। রেগে গেলে— মানে, যতটা উনি রেগে যেতে পারতেন—আমাদের ডাকতেন ‘প্যাটাগোনিয়ার বুদ্ধু’ বা ‘তাকলামানের বেবুন’ নামে। শুধু পাহাড় বা মরুভূমি নয়, আমাদের ছোট গঞ্জ এবং জীবনের বাইরের সুদূর এবং অন্যত্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন কাঠাম স্যার, যাকে বলা যেতে পারে এক ভূগোল শিক্ষকের পক্ষে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার ।
বহু বছর পর, যখন আমার বাবা-মা একটা গাড়ি কিনে উঠতে পেরেছিলেন, আমরা এক শীতকালীন চড়ুইভাতি থেকে ফেরার পথে গজলডোবা হয়ে ময়নাগুড়ির পথ ধরি, এবং হঠাৎ পথে দেখি ‘কাঠাম বাড়ি’ নামে এক জায়গার নাম। ভাই আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করি, যেন কোনো গোপন তথ্য, বেতালের কমিক্সের থেকে যা খুব আলাদা নয়, হঠাৎ আদানপ্রদান হয়ে যায়। কাঠামবাড়ির রাস্তাটা নেওয়ার জন্য বাবাকে আমরা পীড়াপীড়ি করি। আর খুঁজে পাই ছোট্ট জায়গাটার ম্যাজিক।
চা-বাগানে ঘেরা জঙ্গুলে কাঠামবাড়ির পুরনো গাছের সঙ্গে দেখা হয়ে এর পরেই। কোথাও-কোথাও এই বন এতই ঘন যে মাটি অবধি সূর্যের আলো পৌঁছয় না। হাতি তো আছেই, আরো আছে অনেক বন্য প্রাণী। গত শীতে যখন আবার এই জায়গাটা পার করি, কাঠাম স্যারের কথা মনে হয়— এই জায়গা, যা ছিল তাঁর পূর্বপুরুষের, যা দিয়েছে তাঁকে তাঁর পদবি, তাঁর পরিচয়, যেখান থেকে তিনি প্রথম পৃথিবী দেখতে শুরু করেছিলেন, যেখান থেকে পৃথিবীর নানা কোণের সঙ্গে তাঁর সংযোগের সূত্রপাত।
উত্তরবঙ্গের কবি শৌভিক দে সরকারের একটা কবিতার কথা মনে হয়। কবিতার নাম ‘কাঠাম বাড়ি’; নীচে রইল। কাঠাম বাড়ির নিবিড়, ভূগর্ভস্থ ঘনিষ্ঠতার অভিজ্ঞতা, যে ঘনিষ্ঠতা আমাদের ভেতরে জ্যোৎস্নার আলোর মতো ঢুকে পড়ে, এই কবিতায় সেই অনুভূতি অসাধারণ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কাঠাম বাড়ি
উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে তোমার শার্টের দিকে
উড়ে এসেছিল জ্যোৎস্নার রেণু,
যেভাবে উপচে পড়ে ফেলে যাওয়া শ্বাসনালী
টায়ারের গাঢ় কাদা, অনেকদূরের প্রিয় জলবিভাজিকা
শনাক্তকরণের অজুহাত আর আলস্য ডিঙ্গিয়ে
তোমার শার্টের ভেতর ঢুকে পড়েছিল জ্যোৎস্নার প্রকরণ
খুব নীচু হয়ে এসেছিল বাতাস
রক্তপাতের লীন আর লবণের অসংলগ্ন ঘ্রাণ
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র