চোখধাঁধানো চকবাজার
‘স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।’
— উৎপলকুমার বসু
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, অর্থাৎ জেলখানা রোড ধরে আপনি সেদিকে যেতে পারেন। যেতে পারেন লালবাগ কেল্লাগামী অন্যান্য রাস্তা ধরেও। চাইলে বেগমবাজারের দিক দিয়েও আসতে পারেন। আমি অবশ্য জেলখানা রোড ধরে এগিয়ে উর্দু রোড ঘেঁষে ঠিক ডাইনে বাঁক নেব। যেদিক দিয়েই আসুন না কেন, আপনি যদি দ্যাখেন হঠাৎ করেই রাস্তা সরু হতে শুরু করেছে, আর অকস্মাৎ মানুষ ও রিকশার ভিড়ে সমস্ত রাস্তা চিনির বয়ামের ভেতর জড়োসড়ো হয়ে থাকা পিঁপড়েদের মতো স্থির ও আশঙ্কাকাতর, আর যদি কিছু দূরেই দেখতে পান যে পেঁপে, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, হালুয়া, নানা রং ও নানা স্বাদের শরবতওয়ালাদের হাঁকডাকে জনপদ সরগরম, আপনি বুঝে যাবেন, আপনি চকবাজারে এসে পৌঁছেছেন।
মোগল আমলের এই বাজার, চারশো বছরের পুরনো। মোগল-পাঠান হদ্দ হয়েছে, তাঁতি বহাল তবিয়তেই আছেন, ফার্সি না পড়েও তাঁত বুনছেন। মোগল সেনাধিপতি মানসিংহ ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে ভাওয়াল থেকে সদর দপ্তর নিয়ে এসেছিলেন লালবাগে। এই এলাকার পাশে তখন থেকেই ধীরে-ধীরে বাজার গড়ে ওঠে। যদিও এর সৌকর্যময় পত্তন ঘটান আলিবর্দী খাঁ। চারশো বছরের বাজার পাল্টেছে কালের নিয়মে, তবে মূল চরিত্র বদলায়নি। এখনও এটি সর্বজনের সহায়, চকবাজার কাউকে ফেরায় না। প্রসাধনী, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, চিকিৎসাপণ্য, কাপড়, প্লাস্টিক দ্রব্য, বেকারিপণ্য, অলংকারসামগ্রী, খেলনাপাতির পাইকারি বাজার আর এসবের খণ্ডাংশ হিসেবে বহু খুচরো দোকানের সমাহার। কিন্তু এত কিছুর পরও চকবাজারের নাম শুনলেই ঢাকাবাসীর মনে আসে দুটো কথা— কাবাব, ইফতার আর রঙিন পুঁতির দেশ।
২.
উর্দু রোড থেকে ডানদিকে ঢুকতেই এলোমেলো পুরনো এক মার্কেট। রং সেখানে বিশেষ বাহারি নয়, ঢাকার পুরনো বাজার ঘাট যেমন হয় তেমনই। কৌতূহলবশত সেখানে একদিন ডুব দিয়েছিলাম। এক বন্ধুর সেখানে ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে যাতায়াত আছে। তিনিই নিয়ে গেলেন। সেখানে ঢুকে গেলে আপনার নিজেকে ডুবুরিই মনে হবে। আপনি কখনও প্রবালের দেশ দেখেননি, দক্ষিণ সাগরের দেশে মুক্তোচাষের অভিজ্ঞতা আপনার নেই, আপনার চোখ সীমাবদ্ধ ঢাকার ধূসর বিস্মরণে আবদ্ধ। আপনার কাছে সহসা মনে হতে পারে, আপনি হয়তো ঢুকেছেন আরব্য রজনীর কথিত কোনও গল্পের মধ্যে, অথবা সাগরের তলদেশে জলদস্যুদের জাহাজ থেকে ফেলে যাওয়া কোনও সিন্দুকে। কী আছে সেসব দোকানে? শুধু তো দোকান নয়, বিশাল-বিশাল গুদামঘরে সঞ্চিত রয়েছে রত্নরাজি। পুঁতি, পাথর, মুক্তো, অষ্টধাতুর নকল প্রতিরূপ ও মিশ্রিত সমাহার। এসবের খুব সামান্যই বাংলাদেশে তৈরি হয়। অধিকাংশই চিন থেকে আমদানি হয়ে থাকে। এত মুক্তো চিনে উৎপাদিত হয় কি না তা আমার জানা নেই। তবে অপরিশোধিত মুক্তোয় রং করা হয়ে থাকে চিনেই, এরপর বিভিন্ন দেশের বাজারে সেগুলো বিক্রি হয়। পৃথিবীতে রঙের যে এত সমাহার, এবং এত অজস্র রঙের পাশাপাশি থাকাটা যে চোখের জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা, সেটা সত্যিই নতুন করে উপলব্ধ হল এখানে এসে। প্লাস্টিকের পুঁতি, মালা, গয়নার ধাতব উপাদান— এসব চিনেই তৈরি। গয়নার ধাতব খণ্ডাংশ বাজারি ভাষায় ‘মেটাল’ নামে পরিচিত। প্রচলিত উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে সেখানে রূপা। সোনার রং করা নকল সোনাও রয়েছে বহু। এ-জিনিসগুলো রঙে তেমন বাহারি নয়, তবে আকৃতিতে বৈচিত্রময়। রঙের দারিদ্র্য নকশায় পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাজারের অধিকাংশ ক্রেতা নারী। বিস্ময়কর তাঁদের দৃষ্টি। দোকানের মেঝে থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত লক্ষ-লক্ষ ছোট-ছোট বাক্স, মোড়কে সহস্রবর্ণ দ্রব্যের ভেতর থেকে তাঁদের চোখ ঠিক কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি খুঁজে বের করে ফেলে। দোকানিরা আরও এক কাঠি সরেস মহাজন। বহু ক্রেতাকে দেখেছি, তাঁরা কী চাইছেন সেটার কোনও সুনির্দিষ্ট নাম-ধাম-সাকিন কিছুই বলতে পারছেন না। শুধু অনুমানে আধুনিক ফরাসি কবিতার মতো বিমূর্ত ইঙ্গিত করে উচ্চারণ করছেন, ‘এরকম কিছু একটা চাই’। দোকানি কী করে সে-সংকেত বোঝেন, তিনিই জানেন। তিনিও ‘অনুমান’ করে কিছু একটা খুঁজে বের করেন, দেখা যায় ক্রেতা ঠিক এই জিনিসটাই খুঁজছেন। এখানকার যাঁরা ক্রেতা, তাঁরা আসলে নিজেরাও বিক্রেতা। যে-নারীরা এসব কিনতে আসছেন, তাঁরা মূলত উদ্যোক্তা। এসব কিনে নিয়ে বাহারি নকশার নানা ধরনের গয়না প্রস্তুত করে অনলাইনে তাঁরা বিক্রি করেন। অনেকেরই নিজস্ব ব্র্যান্ড রয়েছে, যার প্রতিনিধি হচ্ছে একটি ফেসবুক পেজ। আগে নারীদের গয়না বানানোর কাজটা করত পুরুষেরাই। সংখ্যায় সেটা ছিল সীমিত ও পেশাদারি লোকেদের কাজ। এখন ক্ষুদ্র-মাঝারি নানা ধরনের সক্ষমতা নিয়ে নারীরা এ-কাজের অধিকাংশ চাহিদা পূরণ করছেন। কেউ-কেউ এটাকেই মূল পেশা বানিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। মেয়েরা রঙিন পুঁতি, পাথর ও মুক্তো পরিহিতা হয়েই পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন এতকাল, এখন এ-সকল প্রস্তুত করেও আলোকিত করছেন দেশ ও পৃথিবী।
৩.
রোজার মাসে চকবাজারের লোকের আনাগোনা বাড়ে ভিন্ন কারণে। রোজা আসবে আর পুরনো ঢাকার মানুষ চকবাজারে ইফতার করবে না তা কি হয়? সারা চকবাজার জুড়ে ছড়ানো ইফতারের সরঞ্জাম। তবে মূল ভিড় হয় চকবাজার জামে মসজিদের আশপাশ ঘিরে। দুপুরের পর আর কোনও কারণেই চকবাজার যাওয়ার সুযোগ নেই। ততক্ষণে রাস্তা দখল হয়ে গেছে হরেক রকমের চপ, বেগুনি, পিঁয়াজু, হালুয়া, ছোলা, মুড়ি, ঘুঘনি, আস্ত মুরগি, আস্ত খাসির রোস্ট এসবে। চকবাজার মানেই চকবাজারের কাবাব। সারা বছরই কাবাবের খোঁজে ঢাকাবাসী চকবাজার আসেন। তবে, ইফতারিতে কাবাবের প্রস্তুতপ্রণালী, বিক্রির পরিমাণ দুটোতেই বদল ঘটে। হাকিম হাবীবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ঢাকা: পাচাস্ বারস পহলে’তে (বাংলায় অনুবাদ করেছেন ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিম, ‘ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে’ নামে) চকবাজারের সেকালের ইফতারির বাজার, ঢাকায় ইফতারির খাবার ও পানীয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন, ‘চকে ইফতারির দোকান বসত, ধনী-গরিব সবাই চকে আসত এবং তিন প্রহরে বেশ ভালো মেলা জমে যেত।’ হাবীবুর রহমানের বর্ণিত খাবারের চেয়ে এখনের চকের খাবারের খুব বেশি মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয়নি। খাবারের মধ্যে মোগল ও পাঠানদের খাবারেরই প্রভাব বেশি। সেকালে যে-সকল কাবাব পাওয়া যেত, একালেও সেসব কাবাবেই রসনা জুড়োয়— সুতি কাবাব, শামী কাবাব, জালি কাবাব, রেশমি কাবাব, বটি কাবাব, খিরি কাবাব, গুর্দা কাবাব, হাড়ি কাবাব (হড়িয়ালি কাবাব) প্রভৃতি। হালিম রয়েছে কয়েক রকমের। রয়েছে খাসির পায়া। রয়েছে দইবড়া। আর ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ জিলাপি। কী ভাবছেন? দু’আঙুলে উঁচু করে ধরে টপ করে মুখে পুরে ফেলবেন তেমন জিলাপি? দুই হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে যদি পুরোটা মুখের ভেতর কোনও উপায়ে চালান করতে পারেনও, গলায় আটকে ধরাধাম ত্যাগ করতে হবে নিশ্চিত। কারণ মহামহিম এইসব জিলাপির ওজন এক কেজি থেকে দুই কেজি। অজস্র প্যাঁচ ও বিপুল ব্যাসার্ধ সম্বলিত।
চকবাজারে ইফতারি করতে গেলে রাস্তা থেকে দোকানিরা হাঁক পাড়বে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভরে নিয়ে যায়।’ এরপরই তারা বলবে, ‘অজ্জিনাল খাইতে অইলে এইদিকে…’ বাক্যের অসমাপ্ত অংশে নিজ-নিজ দোকানের নাম থাকে। অর্থাৎ কিনা, খাঁটি ‘অমুক’ দোকানের খাবার খেতে হলে আমার এখানে আসো। তা, কী জিনিস এই বড় বাপের পোলারা খায়? বলা ভাল, কী নেই তাতে! এটা আসলে এক রকমের মিশ্রণ। দশ থেকে বারো রকমের মাংসের কিমা, কাবাব, ঘুঘনি, ডাল, চপ, বেগুনি, পিঁয়াজু ছোলা, জিলাপি, আর কয়েক রকমের মশলা। এই মিশ্রণ অত্যন্ত গুরুপাক। এটা মুড়ির সঙ্গে মিলিয়ে খেলে অমৃতের স্বাদ দেয় ঠিকই, তবে মৃত্যুর সম্ভাবনা তাতে কমে কি না সে-প্রশ্ন রয়েই যায়। তবে পুরনো ঢাকাবাসী কবেই বা খাবারের লঘুত্বকে গুরুত্ব দিয়েছে? অবশ্য, এ-মিশ্রণে আর সব মাংস থাকলেও গরুর মাংসের ব্যবহার নেই। কেননা, ইফতার শুধু মুসলমানরাই করেন তা নয়, পুরনো ঢাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীরও সন্ধ্যাকালীন আহার্য এই ইফতার। একই থালায় বসে হিন্দু-মুসলমানের ইফতার এখানকার রীতি। কারণ আশেপাশের দোকানে মালিক-কর্মচারী যাঁরা আছেন, তাঁরা হিন্দু-মুসলমান দু’ধর্মেরই সংখ্যাসাম্য বজায় রেখেছেন। এই অঞ্চলের ব্যবসাদাররা পুরুষানুক্রমে ব্যবসা করে চলেছেন। কারো-কারো দোকান শতবর্ষের কাছাকাছি পুরনো। দাদা-পরদাদাও এই ব্যবসা করতেন, বাবাও করেছেন, এখন পুত্র এসে হাল ধরেছে। ক্রেতারাও তাই। কারো দাদা হয়তো কোনও দোকান থেকে খাবার নিতেন, আজ নাতি-নাতনিরাও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে একই দোকান থেকে খাবার নেন। তবে, একশো বছর আগে যে প্রযুক্তিতে খাবার তৈরি হত, এখন তাঁর কৌশল বদলেছে। নানা রকমের চিনা উনুন, রান্নার সরঞ্জামে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় খাবার তৈরিতে সময় লাগে এখন কম। উনুনের আড়াল ভেঙে ক্রেতার সামনেই বানিয়ে দেয়া হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। চিনা বা থাই খাবার কম পরিমাণে হলেও বেশ জায়গা করে নিয়েছে মোগল-পাঠানদের পাশে।
ইফতারি নেওয়া তো হল। খাবেন কীভাবে? সাথে তো পেস্তার শরবত, ঘনীভূত ঠান্ডা লাচ্ছি আর ফলের শরবতও নিয়েছেন। আপনি পুরনো ঢাকার বাসিন্দা হলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাবেন, আর নতুন ঢাকা থেকে যদি যান, এই সময়ে আপনি বাড়িতে ফিরতে পারবেন না। আপনাকে ইফতারি করতে হবে রাস্তায়। ঢাকার রাস্তা এভাবেই আপনার জন্য উন্মুক্ত রেখেছে তার পথচারী ক্যারাভান সরাই…