সরগরম না শোর-গরম? শোর-গরম না স্বর-গরম? স্বর-গরম না ঘর-গরম? অবশ্য ঘর গরম মানেই বাইরে গরম, কারণ আপনি বললেন বউ শুনল আর পাশের বাড়ির জানলা থেকে চটি-চটাচট চট্টরাজ ভেংচি কাটল—এ কুটির-শিল্প লুপ্ত, এখন যা বলিবেন তক্ষুনি মোবাইলে তুলিবেন, ব্যাস তাহা কালের গর্ভে গর্বে ভাতিবে, আমরা গভীর, নহিকো পাতি বে! যত তুতলে মরুন, অযৌক্তিক স্পিচ আছড়ান, অসভ্যতা ও প্রগতিশত্রুতায় রনরন করুন, জনা পাঁচশো বলবে আপনিই মসিহা, অন্তত তিনশো জপবে: অসির চেয়ে মসী, হা! সব ব্যক্তিই এখন স্টার, সব ব্যক্তিগত দেয়ালাই পাবলিক পাঁচালি, কেলেংকারিয়াস ক্যালরব্যালর আজ কম্পালসরি। এমনিতে বাঙালিকে কথাসর্বস্ব, বাতেলাবাজ, কানপোকা-নাড়ানিয়া, ডিসটার্ব-মহোদয় হিসেবে সহস্র গাল খেতে হয়। কাজ করতে সে নাকি সতত পিছ-পা, কিন্তু আইডিয়া হাঁকড়াতে ও বক্তিমে আওড়াতে অলটাইম আগুয়ান। এখন প্রযুক্তি এসে তাকে আরও তাতিয়েছে, আরও চাগিয়েছে, টিভিতে তারই উদযাপন, সিরিয়াল থেকে টানা সংলাপ ও ব্যাকগ্রাউন্ড বাজনা ঝম্পরপম্পর, নিউজ চ্যানেল থেকে নিরন্তর গাঁকগাঁক ঝগড়া, লোকে বাড়িতে এবড়োখেবড়ো সোফায় বসে তার সঙ্গতেই মুড়ি মুখে চিপস ঠোঁটে নিজেদের অঙ্কবঙ্ক মন্তব্য ছড়ান্তি। আর জাকারবার্গ তো হাতে তুলে দিয়েইছেন গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ আয়ুধ, যা একদানে প্রতি হরিদাস পাল-কে প্রতিষ্ঠা করেছে মাইক-মুখো প্রচারকের বেদিতে। সকল জাগ্রত মুহূর্ত এখন হয় নিজে কমেন্ট করা নয় অন্যের কমেন্ট পড়া, সেলফি পোস্ট বা অন্যের সেলফি রোস্ট, মুহুর্মুহু ব্যস্ততায় বিশ্ব তড়বড়ে চনমনে, সময় বয়ে যায় হুড়হুড়, একঘেয়েমি তার উত্তাল ধ্বজাখানি জমা রেখে যায় স্টেশনে, ট্রেনের গতিপ্রতাপে তা করুণ কুকুরের কানের ন্যায় নড়ে।
এত কথার ভিড়ে আমাদের অস্বস্তি হয় না? একেবারে না! মনে হয় না, উফ বাবা, একটু থামলে ভাল হত? একদম উল্টো। নৈঃশব্দ্যের বা নীরবতার মহিমাগান বহুত গাওয়া হয়েছে, কিন্তু মানুষ আসলে চেয়েছে তার জীবন আঁট-ঠাসা থাক ঘটনায় বিনোদনে, গসিপে রসিকতায়, সহজ বিপ্লবে আর ধোঁয়াটে ভ্যানতাড়ায়। এবং নয় কেন? কী এমন গাঢ়তার স্বরলিপি গাঁথা আছে ধীর মন্থর ঘ্যানরঘ্যানর দিনরাত্রিতে, যেখানে নিজের আঙুল মটকে আর গাছের ছায়া চটকে কাটাতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা? স্রেফ তা নিষ্প্রাণ আলুনি বলেই তার মধ্যে তত্ত্ব-তিমিঙ্গিল ন্যাজ আছড়াচ্ছে? হ্যারিকেনের আলোয় মশা-মারার দিন নয় অদ্য, এখন নর্ডিক নোয়া প্লাস বিদিশি মদ্য, একেলা জগত ভুলে পড়ে আছি নদীকূলে মহা-বোরিং থিমে ভোট মত দো! মানবেতিহাসে এই প্রথম, লক্ষ লক্ষ বছরের চেষ্টায় এই অ্যাদ্দিনে, এমন ধারাবাহিক বিরতিহীন ডেলি ফেস্টিভ্যাল! শুধু কথা নয়, অজস্র আমোদ-ব্যাপার নিযুত মজা-স্যাপার সর্বক্ষণ কম্পমান ডঙ্কাবাজ, হোক তা অবান্তর বা দর্শনরিক্ত, এতদ্দ্বারা প্রাচীন মানুষের চেয়ে আমাদের জীবন তো বহুগুণ হর্ষ-সম্ভাবনাময়? যেভাবে আইপিএল আমাদের সন্ধে ভরে রাখে, তারপরেই হয়তো আসে অলিম্পিক, বা উইম্বলডন, হুড়হুড়িয়ে ওটিটিতে গজিয়ে ওঠে নতুন সিরিজ নয়া সিনেমা, ইউটিউবে বানের তোড়ের মতো গানের ভিডিও বা চটকদার বক্তৃতা, টিভিতে একদিক থেকে রিয়েলিটি শো অন্যদিক থেকে হরেক ফিকশন ‘জি হুজুর’ সেবাব্যস্ত, মোবাইলে খেলা যায় ক্যারম লুডো দাবা পিট্টু, বাতচিত করা যায় ছ’টা গ্রুপে ছত্তিরিশটা বন্ধুর সঙ্গে, চুলে গালে চোখের পাতায় ক্রমাগত জড়িয়ে যায় হোয়াটসঅ্যাপ থেকে উড়ে স্মাইলি কার্টুন নস্টালজিয়া যৌনতা প্রেম খেউড় — তাতে একটা লোকের মূল যে সমস্যা, সময় কাটানো— তা তো অতুলনীয় ভাবে মীমাংসিত হয়? বড় বড় প্রশ্ন নিশ্চয় ঘাই মারে, এতে আমাদের মন ও ব্রেন তেল-জল পাচ্ছে না ফলিডল, এর চেয়ে বই পড়া ভাল না পুতুল গড়া, কিন্তু কটা লোক কোন যুগে সক্রেটিসের কাঙাল? ব্রেনের থাকে থাকে শোপেনআওয়ার রাখে? আজ বুড়োরা অবধি একলা খাটে সিরিয়ালের গল্পের ঘাঁতঘোঁত নিয়ে মেতে থাকতে পারে, যুবাযুবিরা ট্রেন্ডিং-কাণ্ডাকাণ্ডের খেই ধরতে ধরতে পাখলিয়ে নেয় তাদের যৌবন, আর বালক-বালিকা ফোনের দিকে তাকিয়ে বোঝে জীবন কিতনা মনোরম তকতকে ও ফাইভ-জি স্পিডে বহমান, এর সর্বোচ্চ মূল্য হল—একটা স্তরের প্রসন্নতা (বা অন্তত বিষাদ থেকে একটা ত্রাণ-স্থলের ম্যাপ) গ্যারান্টিড হয়, লোকে ভাঙা বুক ও শুখা দুখ নিয়ে হাঁ করে নিশাকালের কন্ধকাটার মাঠের পানে না চেয়ে হুড়ুস করে মার্কিন থ্রিলার কিংবা বাংলার কিলারে ডুবকি খেতে পারে, শুধু চুটকি স্ক্রোল করতে করতেই তার আত্মহত্যার অঙ্গীকার মিহি সাতগুঁড়ো। সভ্যতার শত নিন্দে হোক, মানুষ যে এগোতে এগোতে নিঃসঙ্গতার সহস্র গ্যালন ভ্যাকসিন জোগাড়যন্তর করতে পারবে, ভাবা যায়নি। ভূতের ভয়ে আমসি শুঁটকো যেমন নিউজ চালিয়ে রেখে ভাবে ঘরে লোক আছে, তেমনই অনন্ত অসংখ্য অগণ্য বিনোদন আমাদের জরি-চুমকির ঝালরে ঘিরে বলেছে, ভয় কী রে, সমুদ্দুরে আঁজলা ভরবি টফি তুলবি। এই অভয়মুদ্রার জবাব নেই।
সঙ্গে আছে রাজনীতি। ওয়া, সে আলুর চপের বাবা! প্রতি সপ্তাহে একটা না একটা কমিক বা ট্র্যাজিক (কখনও একই ঘটনা, দু’দিক থেকে দেখলে দু’প্রকার) বিস্ফোরণ হুড়ুদ্দুম, সঙ্গে সঙ্গে তপ্ত আলোচনা রপ্ত কলহ, গালাগাল ছিছিক্কার মিম, বিশারদের উপদেশ আর মানবপ্রেমীর হাহাকার, অ্যাট লিস্ট দেড় সপ্তাহের ভরপেট্টা খোরাকি। একটা মিলিয়ে যেতে না যেতে আরেক স্ক্যান্ডাল। নেতানেত্রীরা ডানদিকের প্রোফাইলে হাস্যকর ও বাঁদিকের প্রোফাইলে ভিলেন, মুখ খুললেই মনে হয় ফের অশিক্ষা দিলেন। হাঁউকাঁউnow বিতর্কের গন্ধ পাঁউ। হিজাব না মুক্তমুখ? হালাল না ঝটকা? কালীপুজোর দিনে আলো না পটকা? বুলডোজার না ফিতে? হনু না সীতে? পেট্রল না ইভি? রাজনীতিবিদ না বুদ্ধিজীবী? যুদ্ধবাজ রাশিয়াকে বয়কট না তার থেকে ডিসকাউন্টে দ্রব্যক্রয়? ছেঁড়া জিনস-এ হাঁটুর রিস্ক না মানসিক অবক্ষয়? কিন্তু স্লাইট বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে জরিপ করলে, যতই হট্টগোলে কানের পর্দা ও গালের জর্দা চ্যুত হোক, এ জিনিসকেও আলিঙ্গন না করে উপায় নেই। কারণ রূপকথা-আমলে যা ছিল: একটা-দুটো কাগজ রেডিও টিভি-চ্যানেলের খবর ও তাদেরই পোষা ব্যাখ্যার প্রচার, আদ্ধেক চোরাগোপ্তা অপরাধ ও ঘোটালা জনগণের অজ্ঞাত, ফলে অগা ও শান্ত চরাচর। এখন মোবাইলেও ছবি ওঠে, রেপ করতে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি চটজলদি নজরে আসে, আগের মতো ‘এ বলল ও এরকম করেছে আর সে বলল চোপ মিথ্যে বকিস না’ দিয়ে ম্যানেজ করা যায় না। অনেক বেশি চোখকান, অনেক পুচকে ক্যামেরা, মিডিয়ার অনেক বেশি নাগাল, মিডিয়া না চাইলেও খবর ছড়াবার ও সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার চাইবার সোশ্যাল মিডিয়ার রবরবা। এ সিনারিতে অবশ্যই জানা যাবে বেশি, বোঝার চেষ্টা হবে বেশি, চেঁচামেচি ঘটবে বেশি, পাবলিক মতামত দেবে বেশি। তাতে প্রকাণ্ড ডামাডোল হয় হোক, এ-ই কি সত্যি সমাজ-সমঝদারি নয়? বা অন্তত সেদিকে অগ্রসর হওয়া নয়? যে কোনও বিষয় নিয়ে আগে কি প্রকাশ্যে এত সরাসরি কথা বলার ও জবাব দাবির আসর বসানো যেত? আমাদের সমাজে সেই অনুমতিময় আবহ তৈরি ছিল? যে কোনও সাধারণ লোক চোখে চোখ রেখে যে কোনও বিখ্যাত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে পারতেন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এই ফ্রি-ফর-অল’এ পেল্লায় ইতরতার প্রশ্রয় ঘটেছে, অবান্তর ঘোলাজল ঢুকে নষ্ট করেছে বহু মাটি ও ঘাস, অনেক বিনীত শিক্ষিত স্বর চাপা পড়ে গেছে লোফারীয় তর্জনে, কিন্তু তা যে কোনও বিপ্লবের প্রাথমিক মুহূর্তগুলোয় ঘটবেই। বাকস্বাধীনতার মোচ্ছবে বহু অযোগ্য বাক্ (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিট ও ফাক) এসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে পা দোলাতে শুরু করে, কিন্তু এক সময় সভ্যতা ঢুকে তাদের নিজ নিজ আসনে স্থিত করবে, সবচেয়ে জরুরি: শাসকের জারি করা ডিসিপ্লিনের চেয়ে, এই মাৎস্য ন্যায় টাইপ ন্যায়সন্ধানী জাঁক-যজ্ঞ অধিক কাম্য। তাই আপাত ভাবে মনে হচ্ছে অশান্তি বেশি কোলাহল বেশি, কিন্তু আসলে সচেতনতা বেশি, কেউ এ কথা শুনে সিনিক-ফ্যাকফ্যাক বাগালে অন্তত বলা যাক, ’সচেতন হতে হবে’ এই দায় (দেখনদারির খাতিরেও) যে প্রায় সক্কলের ঘাড়ে অর্শেছে, তার সুফল-সম্ভাবনা বেশি। এই সরগরম আবহাওয়ায় স্পর্শকাতর কবির বড় দুর্দিন, মুখচোরা জ্ঞানীও ভাবছেন বই বগলে ভিনগ্রহে পাড়ি জমানো যায় কি না, কারণ শিক্ষাহীনের আস্ফালন বেদম বেদনার, তবু যে আজ কোনও নেতা নারীকে অপমান করে, দলিতকে অপমান করে, নিন্দুককে জেলে ভরে, বিজ্ঞাপন ব্যান করে, ছাত্রকে সিডিশাস বলে তক্ষুনি জনতার কামান-গোলার মুখে পড়ে যাচ্ছেন (সমর্থনের তোপও দাগা হচ্ছে), তা কোথাও না কোথাও ক্ষমতাবানের বেপরোয়াপনাকে রোখে, তাদের যাইচ্ছেগিরির পথে কয়েকটা বাম্প ও চেকপোস্ট রচনা করে। প্রধানত গুন্ডা-অধ্যুষিত পলিটিক্সের ম্যাপে, এ খুব কম কথা নয়। তার চেয়ে অনেক বড় অবশ্যই যদুমধু হয়েও (বা ‘সিস্টেমের চাপে যদুমধুর বেশি কিছু হতে না পেরেছি বলে কি ম্যাচ হেরেছি’ স্টান্সে) দ্রোহ ও উপদেশামৃত ফলিয়ে নিজেকে টপ-গুরুত্বপূর্ণ ভাবার ফোয়ারা। কিন্তু এট্টুনি কো-ল্যাটারাল না থাকলে আর রসেবশে বাঁচা কীসের?
জলসারও শেষ নেই। কোভিডের জন্যে কিছু জমায়েত বিকট সাফার করেছে, কিন্তু ফের শুরু হচ্ছে সিনেমা-হলের সামনে প্যাঁচালো লাইন, ফের বায়না পাচ্ছেন গায়ক গায়িকা নাট্যদল, অচিরে পার্কে মাঠে ময়দানে পার্বণ মেনে বইমেলা পিঠেপুলিমেলা রবীন্দ্রমেলা খাদিমেলা মকমক তরতর বনবন, মানুষ কোন গেট দিয়ে ঢুকবে কোথা দিয়ে বেরুবে দিক পাবে না। কেহ বই পড়ে না বই পড়ে না বলতে বলতে সবাই বই লিখছে এবং ফার্স্ট এডিশন হাঁসফাঁসিয়ে শেষ। কেউ সিরিয়াস আর্টে নেই খেদোক্তি সারতে না সারতে সিরিয়াস নাটকের পাঁচশো টাকার টিকিট ফুরিয়ে ফাঁক। রাশিফল থেকে বাসিফল, সমুদয় দেদার বিকোচ্ছে, নেক্সট আইটেমের উঠোন নিকোচ্ছে। ভাই রে, ‘এ জাবন লইয়া কী করিব’-র চেয়ে মেগা-খিটকেল প্রশ্ন: ’দিনটা কেমনে কাটাব’— সে সুচারু ভাঁজাভাঁজির আজ তেত্রিশহাজার অপশন, একটাই লোকের করতলে উত্তেজিত হয়ে ওঠার এতগুলো রামধনুরঙা বল, মানবসমাজের চরম ফ্যান্টাসিতেও পরম দিবাস্বপ্নেও ছিল না। চতুর্দিকে টগবগিয়ে উঠছে জীবন, তাজা খিচুড়ির মতো তার আমন্ত্রণ-ঘ্রাণ। এরপর আবার লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কত্ত ক্যান্ডিডেট— কেউ হাঁকছে হলোগ্রাম, কেউ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কেউ বিকোচ্ছে ক্লাউড গেমিং, কেউ ক্রিপ্টো-ম্যানিয়া, কেউ বিলোচ্ছে মেটাভার্স। কই, তুমি ডাকছ না যে?
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী