সেটা ছিল রাজ কাপুরের জন্মদিনের পার্টি। সিনেমা-জগতের সব মহারথীই প্রায় উপস্থিত ছিলেন সেই পার্টিতে, সত্যজিৎ রায়ও ছিলেন সেখানে। পার্টি চলার সময়েই কেউ কেউ বলল, মানিকদা আমাকে লক্ষ করছেন। পার্টির শেষের দিকে রাজ কাপুর আমায় বললেন, বিখ্যাত বাঙালি পরিচালকটি ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমার (যেখানে আমি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিক্ষিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম) গোড়ার দিকটা দেখেছেন এবং আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
সেই সন্ধেয় ওঁর সঙ্গে আমার কথা বলা হয়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মানিকদা আমায় ‘অরণ্যের দিনরত্রি’ সিনেমায় একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। অফারটা পেয়ে আমার প্রতিক্রিয়াটা বুঝতে গেলে, একটু পেছন ফিরে তাকানো দরকার। আমি ইংল্যান্ডে বড় হয়েছি এবং আমাদের কাছে ভারতীয় সিনেমা মানেই ছিল সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা। আমরা তখন ভারতীয় হাইকমিশনে সত্যজিৎ রায়ের ক্লাসিক সিনেমাগুলিই দেখতাম। তারপর ষাটের দশকের গোড়ার দিকে যখন বম্বে এলাম, দেখলাম হিন্দি সিনেমার জগতটাই এক্কেবারে আলাদা। আমি চিত্রনাট্য পড়ার সময় প্রশ্ন করতাম বারেবারে, মেয়েরা কেন ছেলেদের পোশাক পরে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায়, কেনই বা তারা প্রশ্নহীন আনুগত্যে পুরুষদের সামনে নত হয়ে থাকে। বলিউডে থেকে মনে হত মানিকদার সিনেমা বহুদূরের একটা স্বপ্ন, এবং তা স্বপ্নই থেকে যাবে।
এবার তাহলে ভাবুন আমার কেমন লেগেছিল, যখন আমি মানিকদার চিঠি পেলাম, যেখানে তিনি আমার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার সুযোগ দিলেন। প্রস্তাবটা পেয়ে মনে হল হাতে চাঁদ পেয়েছি। কিন্তু তখনও কল্পনা করতে পারিনি, এই ছবি থেকেই শুরু হবে আমাদের দীর্ঘ বন্ধুত্ব, যা জীবন্ত হয়ে উঠবে দুজনেরই ওয়ার্ড-গেমের প্রতি ভালবাসা, তাঁর শান্ত নম্র স্বভাব, এবং অবশ্যই আজীবন চিঠিপত্র আদানপ্রদানের কারণে। চিঠিগুলো এখনও আমার কাছে ঐশ্বর্য।
শুটিং অবশ্য একেবারেই সহজ ছিল না। আমরা থাকতাম ছিপাদহর জঙ্গলে, যেখানে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, কলের জলের বালাই নেই, আর বাথরুমে ফ্লাশ থাকা তো চিন্তারও বাইরে। কিন্তু এসব কিছুই আমাকে তখন কাবু করতে পারেনি। কারণ আমি তখন বাংলার তাবড় তাবড় অভিনেতা পরিবৃত— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ। রাত্রিবেলা চাঁদের আলোয় আমরা হাঁটতে বেরোতাম। এই শুটিংটা সত্যিই আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।
দুলির চরিত্রটা অন্যান্য চরিত্রের চেয়ে একদম আলাদা ধাঁচের, আর আমি মানিকদার মুনশিয়ানার কথা ভেবে অবাক হয়ে যাই যে, ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমায় আমায় দেখে উনি কীভাবে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমায় দুলি হিসেবে আমাকে কল্পনা করেছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, মানিকদার চিন্তা-ভাবনা কী স্বচ্ছ ছিল, নিজের সিনেমার চরিত্রদের সম্পর্কে ধারণা কী পরিষ্কার ছিল। দুলির চরিত্রে আমায় কেমন দেখতে লাগবে, সেটা বুঝতে মানিকদা একটা মেক-আপ টেস্ট করেছিলেন। কিন্তু ওই চরিত্রে আমার অভিনয় যে বিশ্বাসযোগ্য হবে, সে ব্যাপারে উনি নিশ্চিত ছিলেন।
মানিকদার একটা গুণ আমায় মুগ্ধ করেছিল (এবং যত দিন গেছে, ভেবে ভেবে আরও মুগ্ধ হয়েছি)— তিনি তাঁর অভিনেতাদের অত্যন্ত ভাল বুঝতে পারতেন আর অভিনেতারা তাঁর কাছ থেকে কী সাহায্য চায়, সেটাও দুর্দান্ত বুঝতেন। প্রথম কয়েকদিনের শুটিং-এ আমার কোনও সিন ছিল না, কিন্তু মানিকদা আমায় সেটে যেতে খুব উৎসাহ দিতেন। শুটিংটা যে-পরিবেশে হচ্ছিল, তার সঙ্গে যাতে পরিচিত হতে পারি, সহজে মানিয়ে নিতে পারি, সেইজন্যেই এটা চাইতেন। একদিন উনি আমাকে ওখানকার একটা ভাটিখানায় নিয়ে গেলেন, যেখানে স্থানীয় লোকজন মদ খেতে আসে, জনজাতির মেয়েরাও আসত। ওখানেই আমরা একজন মহিলাকে বলতে শুনি, ‘ এক পাউয়া দে দো সাহেব’ এবং তা থেকেই এই সংলাপটার উৎপত্তি।
দুলির চরিত্রের মেকআপ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। সত্যিই মেকআপ করাটা ছিল খুব পরিশ্রমের কাজ, ঝাড়া তিন ঘন্টা লাগত। আর ওটা যাতে টিকে থাকে, তার জন্যও নানা কসরত করতে হত। আবার ওই মেকআপ তুলতেও লাগত দু’ঘন্টা! অবশ্য আমার একটুও খারাপ লাগত না, কারণ আগেই বলেছি আমি এমন ধরনের ছবিতে অভিনয় করছিলাম, যা আমার অত্যন্ত প্রিয়।
অরণ্যের দিনরাত্রির শুটিং-এর দুটো শিডিউলের মধ্যে একটা বিরতি ছিল এবং আমি কয়েক মাসের জন্য বম্বে ফেরত এসেছিলাম। এই সময়টায় আমি ‘মেরা নাম জোকার’-এর শুটিং করছিলাম। দুই বিখ্যাত পরিচালকের কাজের ধরনের মধ্যে বিস্তর ফারাক তখন লক্ষ করছিলাম। রাজ কাপুর তখন সিনেমার ‘পদ্মিনী’র অংশটি শুট করছিলেন এবং
৪, ৫০,০০০ ফুট ফিল্ম-স্টক ব্যবহৃত হয়ে গেছে ততদিনে। আর ওদিকে মানিকদা পুরো ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ শুট করে ফেললেন মাত্র ৩০,০০০ ফুট ফিল্ম-স্টক ব্যবহার করে।
মানিকদার কাছ থেকে যেটা সবচেয়ে বড় শিক্ষার বিষয়, তা হল সিনেমার যে কোনও বিষয়ে একেবারে নিখুঁত নির্ভুল ধারণা। তার অনেকটারই মূলে ছিল তাঁর প্রস্তুতি। দিস্তা দিস্তা পাতা খরচ করে লেখা হয়েছে, তিনি কীভাবে প্রতিটি দৃশ্য এবং তার খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এবং সত্যিই এই জিনিসটা ওঁর কাছ থেকে শেখার। আমার মনে আছে, শুটিং-এর আগের রাতে, পরের দিনের দৃশ্যের স্কেচগুলো উনি আমাকে দেখাতেন। যখন আমি আমার ফিল্ম এবং ডকুমেন্টারি তৈরি করি, তখন আমিও ওঁর প্রক্রিয়াই অনুসরণ করেছিলাম। ওঁর মতো মায়েস্ত্রোর সঙ্গে নিজের কোনও তুলনা করছি না, কিন্তু বলছি এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে শুটিংটা সামলানো অনেক সহজ হয়ে যায়।
মানিকদা সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত। আমরা নানারকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম, এবং তার মধ্যে অবশ্যই শব্দ নিযে নানা খেলার প্রসঙ্গ থাকত। ‘পদাতিক’-এর শুটিং-এর সময় যখন আবার কলকাতা এলাম, মানিকদাকে ফোন করেছিলাম। উনি বললেন, ‘তুমি কি কলকাতায়? আমি একটা নতুন ওয়ার্ড-গেমের খোঁজ পেয়েছি’— আর তার কয়েকঘন্টা পরের দৃশ্যই হল— আমরা দুজন শব্দের ধাঁধায় মগ্ন।
(ডাকবাংলা-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা)