রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের পিছনে কোনো কারণও নেই, তাকে কোনোভাবে ন্যায্যতাও দেওয়া চলে না। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, একটি স্বতন্ত্র, গণতান্ত্রিক দেশকে পত্তনের সময় থেকেই পাশ্চাত্যের প্রতি ঝুঁকতে দেখে একেবারে গোড়া থেকেই রাশিয়ার মেজাজ গরম হচ্ছিল, এই আক্রমণ সেই রাগেরই বহিঃপ্রকাশ। শুধু ইউরোপে ক্ষমতার পরিকাঠামো নয়, নব্বইয়ের দশকে প্রাক্তন সোভিয়েত-নিয়ন্ত্রিত ইস্টার্ন ব্লক বা প্রাচ্যের শক্তিপুঞ্জের পতনের পরে যে নব্য-উদার আর্থ-রাজনৈতিক ব্যাবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে, তাকেও আমূল পাল্টে দেওয়ার এ এক কাঁচা হাতের প্রচেষ্টা।
ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে এই বেসামাল পদক্ষেপে টাল খেতে খেতে ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের প্রতি এই আগ্রাসনের পিছনে একটা ভুয়ো যুক্তি খাড়া করবার চেষ্টা করেছেন বটে। তিনি গোড়াতেই ইউক্রেনের স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্বের অধিকারটাকেই নাকচ করে দিয়েছেন, কারণ তাঁর মতে, ‘আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার সৃষ্টি, বিশদে বলতে গেলে বলশেভিক, কমিউনিস্ট রাশিয়ার সৃষ্টি। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের ঠিক পরেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল…’ বলশেভিক নীতির হাত ধরেই সোভিয়েত ইউক্রেনের জন্ম, যাকে আজও সঙ্গত কারণেই ‘ভ্লাদিমির ইলিইচ লেনিনের ইউক্রেন’ বলা যায়। তিনিই ছিলেন এ দেশের স্রষ্টা এবং জনক। আর্কাইভের নথিপত্র এই দাবিকে সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণ করে— ‘প্রকৃত রাষ্ট্রীয় পরিচয় বা তার প্রথা ইউক্রেনের কোনোদিনই ছিলো না।’
মিস্টার পুতিন যে তাঁর নিজের সত্য নিজেই বানানোর চেষ্টা করছেন, তা স্পষ্ট বোঝা যায় এ কারণেই, যে ঐতিহাসিক তথ্য তাঁর কথাকে মোটেও সমর্থন করে না। ‘সমকালীন জগতে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং বেলারুশ বলে যে দেশগুলি রয়েছে, তারা নবম এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কিয়েভান রুশের অংশ ছিল। এই কিয়েভান রুশ ছিল একটি মহাশক্তিধর মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য, যা পূর্ব ইউরোপের বিরাট বিরাট অংশকেও গ্রাস করে নিয়েছিল নিজের আধিপত্যবাদী আলিঙ্গনে। এই তিনটি দেশেরই সাংস্কৃতিক পূর্বপুরুষদের শিকড় পাওয়া যায় কিয়েভান রুশে। তবে পরবর্তীকালে রুশ এবং ইউক্রেনীয়রা ভাষাগতভাবে পৃথক হয়ে যান। ঐতিহাসিকভাবে এই পৃথক হওয়া ঘটেছিল বহুযুগ আগে, তবে রাজনৈতিকভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তিমলগ্নে ১৯৯১ সালের অগাস্ট মাসে আবার এই পৃথকীকরণ ঘটে। তবে রুশ জাতীয়তাবাদীরা ক্রমাগত দাবি করে যান যে রুশ এবং ইউক্রেনীইয়রা আসলে একই জাতি, তাঁরা ‘রুশ সভ্যতা’-র এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাঁদের স্নেহের আলিঙ্গনে তাঁরা বেলারুশকেও টেনে নেন। তবে ইউক্রেনীয়রা রুশ ভালুকের এই আদরের আলিঙ্গনে মোটেও প্রীত নন।’ কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি লেখায় আমি এই মতামত প্রকাশ করেছিলাম।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সরকারিভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, এবং পূর্ব ইউরোপে তার ক্ষুদ্র স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোর পতন সোভিয়েত কর্মকর্তাদের বেশ আঘাত করেছিল। ২০১৪ সালের অগাস্টে আর একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম, ‘কোল্ড ওয়ার-এ পরাজয় প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে এক ভয়ানক পরিণাম এনে দিয়েছিল। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু নিজের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোকেই হারাল না, নিজের অধীনে যতটা ভৌগোলিক জমি ছিল তারও খানিকটা ছাড়তে হল। তাকে গ্রাস করল অর্থনীতির পতনের অসুখ, এবং তার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক নৈরাজ্য, যেখানে অলিগার্ক, যুদ্ধনেতা আর মাফিয়ারা (ঠিক এই পর্যানুক্রমে নয় অবশ্য) রাজত্ব করতে শুরু করল। এর ফলে শুধু মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের আদর্শই যে ধূলিসাৎ হয়ে গেল তা-ই নয়, রুশ ইতিহাসের যে রাজকীয়তা ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের বহু শতাব্দী আগে থেকেই বিরাজ করছিল, তাও ধ্বংস হয়ে গেল। উদীয়মান বিশ্ব-রাজনৈতিক জগতে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলেই বোধ হতে শুরু করল।’
তবে এই পতন জন্ম দিল এক রূপকথার মত আকশকুসুমের— রাশিয়ার ঐতিহ্য এবং ক্ষমতাকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে, বাঁচিয়ে তুলতে হবে এবং তার আগেকার প্রতিপত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের চৌর্যবাদী সরকার যখন বিংশ শতাব্দীর শেষে অস্ত যাচ্ছে, তখন এই স্বপ্নের পথে প্রথম পদক্ষেপগুলো আস্তে আস্তে প্রকট হতে শুরু করল।
সারা বিশ্বে ক্ষমতা কায়েম করা এবং নতুনভাবে নিজেদের বৈধতা দেওয়ার এই যাত্রা শুরু হল রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির আসনে ভ্লাদিমির পুতিনের আগমন থেকে। রুশ রাষ্ট্র যে কেবল পেশি ফোলাতে শুরু করল তা-ই নয়, তার উপর খনিজ গ্যাস এবং তেলের মোটা টাকার সাহায্যে পূর্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই ব্যবহার শুরু করল।
এই সর্বগ্রাসী স্বৈরতন্ত্রকে বেশ বুদ্ধি করেই গণতন্ত্রের রূপে পরিবেশন করা হল। তবে সে নাটক দেখে বিশেষ কেউ ভোলেনি। রাশিয়ার নতুন দুনিয়াকে হাড়ে-হাড়ে চিনিয়ে দিল সমস্তরকমের নাগরিক স্বাধীনতার উপর অবাধে হস্তক্ষেপ এবং শোষণ। এই ধরনের স্বৈরাচারের মূলে ছিল কমিউনিস্ট বাইপোলারিটির মদোন্মত্ত যুগ (যে যুগ এখন আর পূজিত হয় না) এবং তারও আগে রুশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ— এই দুটি জিনিসকে নিয়ে যে উৎসাহ, যে আবেগ, তাকে আবার করায়ত্ত করার একটা অদম্য ইচ্ছে।
এই ইচ্ছের প্রথম বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল ককেশাসে রাশিয়ার কার্যকলাপে, যে অঞ্চলটিকে রাশিয়া তার নিকট বিদেশ বলে মনে করে। ২০০৮ সালের অগাস্ট মাসে, রাশিয়া জর্জিয়ার থেকে আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়ার দখল নিল/তাকে স্বাধীন করল (এই দুটির মধ্যে কোনটা আপনি বিশ্বাস করবেন সেটা একান্তই ব্যাক্তিগত পছন্দের ব্যাপার)। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে, রাশিয়া ইউরোপে গ্যাসের রপ্তানি বন্ধ করে দিল। অজুহাত হিসেবে অভিযোগ জানাল, ইউক্রেন নাকি যথাযথ মূল্য না দিয়ে গ্যাসের পাইপলাইন থেকে গ্যাস সরাচ্ছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় মহাশক্তিরা কেউই রাশিয়ার প্রতিবেশী অঞ্চলে এই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিলেন না, নতমস্তকে দেখতে থাকলেন।
জর্জিয়ার প্রতি আগ্রাসন দেখেও পাশ্চাত্য দুনিয়া কিছু করল না, এই দেখে আরো সাহস পেয়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রুশ সমর্থক সেনারা ক্রিমিয়ান উপদ্বীপে হানা দিতে শুরু করল। এর পরে একটি বিতর্কিত গণভোট হয়, যার পরে ১৮ মার্চ ক্রিমিয়া এবং সেভাস্তোপোল সাধারণতন্ত্রের সঙ্গে রাশিয়ার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ক্রিমিয়া সরকারিভাবে রুশ রাষ্ট্রে অধিভুক্ত হবার পদ্ধতিটি আরম্ভ করে দেয়।
২০১৮ সালের ২১ মার্চ রুশ সংসদ চুক্তি স্বাক্ষর করার দিন থেকেই এই অধিভুক্তিকরণকে মান্যতা দেন। একইভাবে, ২০১৪ সালের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই রুশ সমর্থক কিছু গোষ্ঠী পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ, লুহান্সক এবং দনেতস্ক অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আজ আমরা যা দেখছি, তা আট বছর আগে শুরু হওয়া ওই ঘটনাবলিরই উপসংহার।
সে সময়েও রাশিয়ার এই আগ্রাসী ভাবমূর্তি দেখে অন্যত্রও সংকটের পূর্বাভাস পাবার কথা ছিল, বিশেষ করে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমাদেশে নানা চাপা পড়ে যাওয়া রাজনৈতিক সমস্যার ব্যাপারে, যেমন মলডোভার ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘদিনের সংকট। কিন্তু নেটো তখনও হাত গুটিয়ে বসে রইল, বলতে গেলে কিছুই করল না।
তিনটি বল্টিক দেশ, যারা আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তারা কিন্তু এখন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য— লাটভিয়া, লিথুয়েনিয়া এবং এস্টোনিয়া। এবং রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ নিয়ে নেটো বারবার সাবধানবাণীও প্রচার করেছে। তবুও কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তারা নেয়নি।
২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত নেটোর সামরিক তুরুপের তাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যত্র ব্যস্ত ছিল— তার নজর ছিল আফগানিস্তান এবং ইরাকে যুদ্ধ-বিগ্রহ সামলানোয়, এবং ১৯১৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যে ভৌগোলিক অচলায়তন চলছে, তাকে নতুন করে গড়ার প্রচেষ্টায়। এই সমস্ত প্রচেষ্টাতেই তারা পরাজিত হয়। যে ইউরোপীয়রা গোয়াঁর্তুমি করে নিজেদের সামরিক খাতে টাকা ঢালতে ইচ্ছুক হয়নি, একটি পর্যাপ্ত ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তোলেনি, তারা কিন্তু আজ আফশোস করে হাত কামড়াচ্ছে।
এই দুটি দশক রাশিয়া এবং চিনকে নিজেদের গড়ে তোলার ফুরসৎ দিয়েছে। সমসাময়িক পৃথিবীতে বিশ্ব-রাজনৈতিক স্তরে যে ক্ষমতার শূন্যস্থান, বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জাজনক পলায়নের পরে যে শূন্যতা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এক নতুন ক্ষমতার কাঠামো জন্ম নিচ্ছে।
দুই রাষ্ট্রপতি পুতিন এবং শি চিংফিং যে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে যৌথভাবে ২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি বক্তব্য পেশ করেছেন, এবং আগ্রাসন শুরু হওয়ার দিন রাষ্ট্রপতি ইমরান খান যে মস্কোতে ছিলেন, তা কাকতালীয় নয়। এক নতুন লৌহযবনিকা জন্ম নিচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে। সেই যবনিকার আড়ালে থাকবে মস্কো, বেইজিং এবং তেহরানের মত প্রাচীন রাজধানীগুলো, এবং পাকিস্তানের মতো কিছু স্যাটেলাইট রাষ্ট্র।