একটু কমিক করুন
সকালে পুরো চার্জ হওয়া মোবাইলে রিলস চলছে! দারুন সব মজার ভিডিও। হাহা!! দুপুরে পুরোনো দিনের বাংলা ছবির মজার দৃশ্য টেলিভিশন চ্যানেলে চলছে। কী অভিনয়, কী হাস্যকর সিন! হোহো!! সন্ধ্যেবেলা নামকরা কমেডি শো দেখতে দেখতে পুরো পরিবার টিভির সামনে। মজার খেলাধুলো, পাঞ্চ-লাইন! হিহি!!
কিন্তু ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডি’ চালিও না! কারন হাসির কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র নেতাদের নিয়ে নানান প্রহসন।
বিদেশের বহু বিখ্যাত শিল্পী, নানান প্রখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেলে এই ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডি’র ধারাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। সেখানে মূলত হাসির দৃশ্য, কথা ও অভিনয়ের মধ্যে মূল আকর্ষণ হল বিষয়বস্তু। দর্শক সহজেই বুঝতে পারেন যে শিল্পী কৌতুকের ব্যবহারে তাঁর দেশ, সময় ও সমাজ নিয়ে কথা বলছেন। উঠে আসছে এমন বিষয় যা দেশের আপামর জনসাধারণের দুশ্চিন্তা বা ভোগান্তির কারণ। একটি এক ঘন্টার অনুষ্ঠানের মধ্যে হাসির সংলাপের আড়ালে অত্যন্ত সুস্থভাবে চর্চিত হচ্ছে দেশের মানুষের অসুবিধার কথা, হচ্ছে আলোচনা ও সমালোচনা। এরই মধ্যে আরেকটি ভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে যার নাম ‘রোস্টিং’, অর্থাৎ একজন কমেডিয়ান বা কৌতুক শিল্পী/অভিনেতা কড়া সমালোচনার মধ্যে দিয়ে তুলে এনেছেন নানান বিষয়।
আজকের সময়ে ভারতেও বহু স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান নাম অর্জন করেছেন। তবে তার জন্য তাঁকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা এই দেশের বাইরে কোনো শিল্পী ভাবতেও পারেন না। বিদেশের বহু নামকরা কমেডিয়ান যেমন জিমি ফেলন, জিমি কিমেল, জন অলিভার, জেরি সাইনফিল্ড প্রমুখের অনেক অনুষ্ঠানে সমালোচনা হয়েছে তাঁদের দেশের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি নিয়ে। ‘রোস্টিং’- এর মাধ্যমেও বহু শিল্পী আলোকপাত করেছেন এমন দিকে যা মূলধারার সংবাদ বা মনোরঞ্জনের অনুষ্ঠানে সম্ভব নয়। তবে তাদের কাউকেই স্বাধীন শিল্পীর বক্তব্য প্রকাশের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারের জন্য লড়তে হয়নি!
তা একমাত্র সম্ভব ভারতে।
যেকোনো ভারতীয় বাড়িতে এই স্ট্যান্ড আপ কমেডির ধারাটি নতুন। হাসি বা মজার অনুষ্ঠান বলে প্রচলিত কিছু অনুষ্ঠানকে শুধুমাত্র বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রহণ করেছেন। এই নতুন ধারার দর্শকও তাই কেবলমাত্র নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা যারা টিকিটের বিনিময়ে বা অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন মাধ্যমে এই কাজ দেখে অভ্যস্ত। বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বাইয়ের মতো শহরে তাও এই সংখ্যাটি বেশি। কলকাতায় এখনো তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি স্ট্যান্ড আপ কমেডি। প্রশ্ন হল, কেন? সেখানেই উঠে আসে আমাদের শিল্পীর কাজকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গ।
এই বিষয়ে খতিয়ে দেখতে গেলে বোঝা যায় ‘সহিষ্ণুতা’ এখানে সবচেয়ে জরুরি শব্দ। গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়া ছাড়াও দেশের মানুষের কাছে তিরস্কার, অপমান বা আইনি হেফাজতের শিকার হয়েছেন ভারতের হাতে গোনা সেই কিছু স্ট্যান্ড আপ কমিক।
ভারতের বহু নামী কমেডি চ্যানেল বা সংস্থা ও একাধিক কৌতুক শিল্পীদের নামে ক্রমাগত এফ. আই. আর. হয়েছে। বিষয়বস্তু নির্বাচন ও শিল্প সৃষ্টি করার জন্য শিল্পীকেই হেনস্থা হতে হয়েছে কখনো পুলিশ/প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের কাছে এবং অবশ্যই সংবাদ মাধ্যমের কাছে। ভারতে এখনো স্ট্যান্ড আপ কমেডির এই অন্য ধারা তুলনামূলক নতুন, তাও বহু কমেডিয়ান সোশ্যাল মিডিয়াতে হুমকি, সংবাদ মাধ্যমদের তিরস্কার, রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের আক্রোশের মুখোমুখি হয়েছেন।
এর থেকে স্পষ্ট যে সেই শিল্পীর স্বাধীনভাবে বিষয় নির্বাচন ও তা নিয়ে একটি কমেডি অনুষ্ঠান আয়োজনে দেশের সামাজিক বা রাজনৈতিক মাথাদের ও সাধারণ মানুষের আপত্তি আছে। আমরা তাহলে কোন বিষয়কে হেসে উড়িয়ে দেব আর কোনটাকে ভেবে দেখবো তার পার্থক্য বুঝতে পারছি না! একটি শিল্পের মধ্যে ভঙ্গিমা বদলে একটি জরুরি সামাজিক বিষয় চর্চিত হতে পারে, সেটা আমাদের কাছে তাহলে গ্রহণযোগ্য নয়! অথচ আমরা ভারতীয়রা দিনযাপন করছি একটি ‘কমেডি’র মধ্যেই; হাস্যকর সব কারবারের মাঝে – যেখানে রাত ১০টার পর একটি বিশেষ ভাইরাস জেগে ওঠে বলে সবাইকে কাজকর্ম ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে হবে, যেখানে হাজার হাজার মিস্ত্রি, শ্রমিক, সবজি বিক্রেতা খেতে না পেলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালু থাকবে বা যেখানে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হবে না। এইরকমের হাস্যকর শাসনের মাঝে আমাদের সহিষ্ণুতার পরীক্ষা হচ্ছে – আমরা শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতাকে প্রশ্ন করব না কিন্তু এই বিষয়গুলি শিল্পী তুলে আনলেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে কালিমা লেপন হচ্ছে বলে চিৎকার করব!
তাহলে শুধু নিজেদের বিশ্বাসের বিপরীত কোনো মন্তব্য শুনলেই একজন শিল্পীকে গ্রেপ্তার করতে হবে? তাহলে বুঝতে হবে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথা। এক, আমরা এখনো ‘হাস্যকর’ কথাটির অর্থ বুঝিনা এবং হাস্য কৌতুকে কোনো বিষয়কে তার সঠিক মর্যাদা দিয়ে বিচার করিনা। দুই, ব্যক্তির বক্তব্যের স্বাধীনতা বা ভিন্ন চিন্তার অধিকার, যাকে ‘রাইট টু ফ্রিডম অফ স্পিচ/থট অ্য়ান্ড এক্সপ্রেশন’ বলে, তা শুধুমাত্র সংবিধানে অলংকৃত কিছু শব্দ মাত্র।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দাবানল এতটাই ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে যে, কোনো দলের কর্মী, শিল্পীর ভিন্ন কোনো মতের দ্বারা রুষ্ট হন, তাহলে আইনের তোয়াক্কা না করেই সে অত্যাচার চালাতে পারে। আর স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান একজন সাধারণ ভারতের নাগরিক হয়ে, তার শিল্পের মধ্যে দিয়ে দেশের অবস্থা অথবা নিজের নাগরিক জীবনের সমস্যার কথা বলতে পারবেন না!
সমস্যা স্ট্যান্ড আপ কমেডি দিয়ে শুরু হয়ে এবার ঢুকছে সিনেমা, কবিতা, গান ও শিশুপাঠ্য বইয়ে। এরপর খবরের কাগজে কোন খবর পড়া যাবে ও পড়তে পড়তে কী অনুভূতি হওয়া উচিত সেটাও বলে দেওয়া হবে। আমরা তখনও হাহা, হোহো, হিহি বলতে থাকবো তো?