ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মহাতারাদের মাস্টারমশাই


    গৌতম ভট্টাচার্য (March 5, 2022)
     

    মডার্ন টেনিস বলতে যেমন তিন মহাতারা— ফেডেরার, নাদাল, জকোভিচ; তেমনি টেনিসবিশ্বে কোচ বলতে গেলে তিনজন— হ্যারি হপম্যান, টনি রোচ, আর নিক বলিটেয়ারি৷ এঁদের শেষ দু’জনকে দেখার ও ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে৷ বলিটেয়ারি যদি স্বভাবে-ভঙ্গিতে উত্তর মেরু হন, টনি রোচ হলেন দক্ষিণ মেরু৷ এঁদের ছাত্ররাই বোধহয় এঁদের কোচেদের যাঁর-যাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন৷ রোচের মতোই শান্ত এবং সমাহিত হলেন ফেডেরার৷ আর নিক, আগাসি ওই যে টি-শার্টটা প্রায়ই পরতেন, তার ওপর লেখাটার মতোই উজ্জ্বল ওঁর জীবন—ইমেজ ইজ এভরিথিং৷ বলিটিয়ারি হলেন তা-ই৷ ফ্লোরিডায় তাঁর স্থাপিত টেনিসের প্রথম বোর্ডিং স্কুল থেকেই আবাসন টেনিস কোচিংয়ের কনসেপ্ট শুরু৷ আর ব্যক্তিত্বও ফ্লোরিডার আবহাওয়ার মতো সবসময় সূর্যালোকে ভরপুর৷ ডিপ্রেশনের ভূত সেখানে ঢোকার ন্যূনতম সুযোগ নেই। 

    এই ৯০ বছর বয়সেও দেখলাম একটা জুম ইন্টারভিউতে বলছেন, ‘প্রবলেম শব্দটা আমি ঘৃণা করি৷ শুনতেই চাই না কথাটা৷ জীবনের প্রত্যেকটা সমস্যার সলিউশন আছে৷ আমার কাছে সেই খোঁজটা অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট৷’ কী কী সব ছাত্র বার করেছেন নিজের অ্যাকাডেমি থেকে! আন্দ্রে আগাসি৷ মনিকা সেলেস৷ জিম কুরিয়ার৷ মেরি পিয়ার্স৷ এই বয়েসেও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে রোজ দু’তিন লাইন করে টিপস পোস্ট করেন৷ আগাসির সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং অন্য নানা কারণে সার্কিটে যথেষ্ট বিতর্কিত৷ কিন্তু বলিটেয়ারির সাফল্য অগ্রাহ্য করবে কে? তবে টেনিসের বিখ্যাত মাস্টারমশাইদের মধ্যে পয়লা নম্বরে জায়গা পান না বলিটেয়ারি৷ ওটা রাখা রয়েছে বহু বছর আগে প্রয়াত টেনিস গুরুর জন্য৷ সেই শিক্ষকের কথায় এবার আসা যাক৷

    ক্রিকেট কোচদের মধ্যে যদি সবচেয়ে স্বীকৃত এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারাসম্পন্ন কোচের নাম হয় বব উলমার, তাহলে টেনিসে সেই লোকটি হ্যারি হপম্যান৷ কমিয়ে বলা হল, হপম্যান মানে মিলিতভাবে উলমার এবং ববি সিম্পসন৷ যাবতীয় উদ্ভাবনী-ক্ষমতা সত্ত্বেও উলমার কোনও ট্রফি দিতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকাকে৷ না পেরেছেন পাকিস্তানকে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ দিতে৷ ববি সিম্পসন আবার অস্ট্রেলিয়াকে সাতাশির বিশ্বকাপ দিলেও, কোনও যুগান্তকারী প্রভাব ফেলতে পারেননি সাদা বলের অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দর্শনে৷

    হপম্যান দুটোই করেছেন৷ তাঁর আমলের অস্ট্রেলিয়া অপ্রতিরোধ্য ছিল বিশ্বটেনিসে৷ কী পুরুষদের সার্কিটে, কী ডেভিস কাপে৷ এখনও তাঁর তারকা শিষ্যদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে গতকাল গুরুর কোচিং নিয়ে উঠলেন৷ অন্য দেশের প্লেয়ার বা কোচেরাও হপম্যান নিয়ে এমন উচ্ছ্বসিতভাবে কথা বলেন, যেন তিনি তাঁদেরও কোচিং করাতেন৷ আখতার আলি ভারতীয় দ্রোণাচার্যের মর্যাদা পান৷ সে তাঁকে সরকার খেতাব না দিয়ে যতই বঞ্চনা করুক৷ সার্কিটে খুব জনপ্রিয় ছিলেন বেঁটেখাটো চেহারার আখতার৷ সেই আখতারও এমন মুগ্ধ হয়ে কথা বলতেন যেন হপম্যান তাঁরও কোচ৷ আসলে হপম্যান বিশ্বজোড়া খ্যাত ছিলেন কোচেস’ কোচ হিসেবে৷

    অথচ হ্যারি হপম্যান জুনিয়র পর্যায়ে সেভাবে প্লেয়ার তোলেননি৷ তাঁর কেরামতি মুখ্যত অস্ট্রেলিয়ান সিনিয়রদের নিয়ে৷ দেশের হয়ে শেষ কোচিং করেছেন ১৯৬৭-তে৷ আর মারা যান ১৯৮৫-তে৷ ডেভিস কাপ কোচিং করেছিলেন দীর্ঘ ২২ বছর৷ আর সেই ২২-এ, ১৬বার অস্ট্রেলিয়া ডেভিস কাপ জেতে৷ এমন অবিশ্বাস্য কীর্তি জীবিত বা মৃত কোনও কোচের নেই৷ এখানেই শেষ নয়৷ ডেভিস কাপে এমন স্টাইলে কোচিং করাতেন হপম্যান যে, অনুপ্রাণিত হয়ে পড়া তাঁর ছাত্রেরা সার্কিটে ব্যক্তিগতভাবেও দুর্ধর্ষ ফল করতেন৷ কোচিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি যত-না অমল দত্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি পি কে৷ মনে করতেন ট্রফি না পেলে জীবন বৃথা, এবং কোচিংও৷ 

    ট্রফি দেওয়ার টেকনিক জানতেন এই অস্ট্রেলিয়ান গুরু৷ ছোট ছোট টেকনিক ছিল তাঁর৷ তখন তো ভিডিয়ো বিশ্লেষণ আসেনি৷ আজকের মতো আই টি প্রযুক্তিও ছিল না যে অপরিসীম ডেটা-র ব্যবহার হবে৷ কোচিংয়ের পুরোটাই ছিল মগজাস্ত্র৷ একবার প্রেস কনফারেন্স চলছে সেমিফাইনাল-জয়ী অস্ট্রেলিয়ান টিমের৷ নিল ফ্রেজার কথা বলছেন ট্যাকটিক্সে বিপক্ষকে চূর্ণ করা নিয়ে৷ একজন জিজ্ঞেস করল, অমুক প্লেয়ারকে কীভাবে কব্জা করলেন? ফ্রেজার বলতে যাচ্ছেন৷ হপম্যান একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন৷ তার ওপর লেখা— চুপ থাকো৷ পরের বছর ওকে আবার খেলতে হবে৷ ফ্রেজার দ্রুত শুধরে নিলেন, ‘নো কমেন্টস৷’

    জন নিউকোম্ব অস্ট্রেলিয়ান টেনিসের সোনার সময়ের এক অলংকার৷ তিনি মনে করেন, হপম্যান যত-না বড় কোচ, তার চেয়ে বড় মনস্তত্ত্ববিদ৷ জীবনের প্রথম ডেভিস কাপ সিঙ্গলসে ডেনিস ব়্যালস্টোনের কাছে দু’সেটে পিছিয়ে পড়েছেন নিউকোম্ব৷ চোখের সামনে হার দেখছেন৷ হঠাৎ চোখ গেল বেঞ্চে-বসা হপম্যানের দিকে৷ কোচের মুখ দেখলেন উজ্জ্বল৷ যেন কিছুই হয়নি৷ নিউকোম্ব ওই উজ্জ্বল মুখ দেখে অদ্ভুত কনফিডেন্স পেলেন৷ তার মানে তো কিছুই হয়নি৷ দুটো সেট এবার পরপর জিতে লাস্ট সেট হারলেন ৫-৭৷ কিন্তু গুরুর কাছে প্রথম দিনই অমর শিক্ষা পেলেন যে, প্রচণ্ডতম চাপের মুখেও নিজের ওপর বিশ্বাস হারাতে নেই৷ 

    হপম্যানের রাজ করা দীর্ঘ সময়ে অস্ট্রেলিয়ান চ্যাম্পিয়নদের সমাবেশ দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে৷ ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন এই যে ঘটা করে ‘হল অফ ফেম’ দেয়, এঁরা তো সমবেতভাবে ‘হল অফ ফেম ভবন’! লিউ হোড৷ রয় এমার্সন৷ রড লেভার৷ ফ্রেড স্টোলে৷ ম্যাল আন্ডারসন৷ টনি রোচ৷ জন নিউকোম্ব৷ নিল ফ্রেজার৷ কেন রোজওয়াল৷ মুম্বই ক্রিকেট টিমের রঞ্জি আধিপত্যের মতো একচেটিয়া ছিল সার্কিটে অস্ট্রেলিয়ার প্রাধান্য৷ ১৯৫০-৭১ এই সময়ের মধ্যে ৪২ উইম্বলডন ফাইনালে ২৮ ফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়ার৷ 

    রড লেভার বলেছিলেন হপম্যান তাঁকে যৌবনেই এমন একটি টিপস দেন যাকে মশাল করে তিনি গোটা টেনিস-জীবন এগিয়েছেন৷ হপম্যান বলেছিলেন, এমন ফিটনেস রাখার চেষ্টা করবে, যাতে ফার্স্ট সেটের এনার্জি নিয়ে ফিফথ সেট খেলতে পারো৷ যদি ফিফথ সেটে তোমার ওই ফিটনেস থেকে যায়, তাহলে দেখবে তোমায় বিশেষ কিছু করতে হচ্ছে না৷ ওই বেসিক খেলাটাই ম্যাচ বার করে দিয়েছে৷ শুনে আরও বোঝা যায়, তাঁর কোচিং মিনার দাঁড়িয়ে ছিল দুটো স্তম্ভের ওপর৷ মন তৈরি আর ফিটনেস৷

    টেনিস সার্কিটে নিরন্তর একটা বৈশিষ্ট্য দেখেছি, আড্ডা শুরু হলেই বিভিন্ন প্রজন্মের প্লেয়ার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা শুরু হয়— অমুকের সঙ্গে অমুকের ম্যাচ হলে কী হত? শিবাজী পার্ক জিমখানা বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মাঠে কিন্তু এসব আলোচনা শুনিনি৷ ময়দানে ক্রীড়া-সাংবাদিক ক্লাবের তাঁবুতে তো একেবারেই না৷ অথচ সাউথ ক্লাবের সোনার সময়ে নিত্যকার আড্ডায় উঠত এ-জাতীয় আলোচনা যে, কী হত যদি কৃষ্ণন খেলতেন বিজয়কে হার্ড কোর্টে? বা জয়দীপ-লিয়েন্ডার সিঙ্গলস হত ঘাসের কোর্টে?

    সেই কত বছর আগে ভেবেছিলেন হপম্যান৷ তারপর বিশ্বটেনিস তো সেই রাস্তাতেই এগিয়েছে৷ আজ প্লেয়াররা মনস্তত্ত্ববিদ নিয়ে ঘোরেন৷ শক্তিশালী মন তৈরির এতই গুরুত্ব যে, ম্যাচ-নির্ধারণকারী সময়ে বা সার্কিটের একরাশ বিষণ্ণতার চুল্লিতে শুয়ে মনই সব কিছুর মীমাংসা করে৷ আর ফিটনেস-চর্চা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, চোখে আঙুল দিয়ে প্রথম দেখান ইভান লেন্ডল৷ আজ তাকে চূড়ান্ত সীমান্তে নিয়ে গিয়েছেন নাদাল-জকোভিচেরা৷ 

    সচিন-ভক্তদের যেমন আজ ব্যাকুল হয়ে মনে হতে থাকে, যদি কোহলির মতো ফিটনেস-চর্চা তাঁকে ছোটবেলা থেকে করানো হত, অন্তত একটা ট্রিপল সেঞ্চুরি কেরিয়ারে বাঁধা ছিল৷ ম্যাকেনরো-ফ্যানদের যেমন মনে হয়, হপম্যানের মতো যদি কেউ তাঁকে ছোটবেলা থেকে কোচ করতেন, তাহলে জন্মগত দক্ষতার সঙ্গে ওই ফিটনেস মিশলে তিনি হতেন ফেডেরারের আগের আরও বিশালকায় ম্যাকেনরো৷ বা লেভারের পরের লেভার৷ 

    টেনিস সার্কিটে নিরন্তর একটা বৈশিষ্ট্য দেখেছি, আড্ডা শুরু হলেই বিভিন্ন প্রজন্মের প্লেয়ার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা শুরু হয়— অমুকের সঙ্গে অমুকের ম্যাচ হলে কী হত? শিবাজী পার্ক জিমখানা বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মাঠে কিন্তু এসব আলোচনা শুনিনি৷ ময়দানে ক্রীড়া-সাংবাদিক ক্লাবের তাঁবুতে তো একেবারেই না৷ অথচ সাউথ ক্লাবের সোনার সময়ে নিত্যকার আড্ডায় উঠত এ-জাতীয় আলোচনা যে, কী হত যদি কৃষ্ণন খেলতেন বিজয়কে হার্ড কোর্টে? বা জয়দীপ-লিয়েন্ডার সিঙ্গলস হত ঘাসের কোর্টে?

    লেভার-ম্যাকেনরোয় অবশ্যই তুলনা হয়, কারণ দু’জনে খেলেছেন ১০ বছরের এদিক-ওদিক সময়ে৷ নিয়ম এক ছিল৷ সরঞ্জাম এক ছিল৷ প্রতিদ্বন্দ্বী যা আলাদা৷ উইম্বলডন সেন্টার কোর্টে দু’জনে দেখা হলে কী হত, সেই উত্তর আমায় দিয়েছিলেন নিউকোম্ব৷ ‘উইম্বলডনে লেভার সহজেই বর্গকে হারাত, এবং আমার ধারণা ম্যাককেও হারিয়ে দিত৷ কিছু ম্যাচে ম্যাক হারাবে রডকে৷ কিন্তু ও যত না হারাবে, তার চেয়ে বেশি হারবে৷ তুলনায় ম্যাকের সার্ভ অনেক ভাল৷ লেভারের আবার গ্রাউন্ড স্ট্রোক বেটার৷ ভলিতে অনেক ভাল৷ কেন আমি ম্যাকের পর্যায়ের প্লেয়ারের চেয়ে রডকে নিঃসংকোচে এগিয়ে রাখি, তার কারণ অভিনেতা যেমন চরিত্র অনুযায়ী ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে, তেমনি লেভার পরিস্থিতি অনুযায়ী নানান স্টাইল প্রয়োগ করতে পারত৷ প্লাস ওর ফিটনেস৷ কখনও ক্লান্ত লাগত না৷ ম্যাক অনেক লম্বা লম্বা ম্যাচ দারুণ খেলেছে৷ কিন্তু রকেট (রড লেভারের ডাকনাম) কখনও টায়ার্ড হত না৷’

    ক্রিকেটে একটা প্রশ্নের উত্তর মুম্বই-ক্রিকেটমহল খোঁজে৷ উত্তর পাবে না, জেনেও৷ কী হত যদি সুনীল গাভাসকর আর সচিন তেন্ডুলকরের জন্মবছর দুটো ওলটপালট হয়ে যেত? যদি গাভাসকর জন্মাতেন ১৯৭৩-এ, আর সচিন ১৯৪৯-এ? তাহলে ওঁদের খেলার স্টাইল কি আমূল বদলে যেত না? একইভাবে একটা জিজ্ঞাসা থেকে যাবে যে, কী হত যদি হপম্যানের কোচিংয়ের ছয়ের দশকে বেড়ে উঠতেন ম্যাকেনরো, আর সাতের দশকের মাঝামাঝি নিউ ইয়র্কের পেন স্টেশন থেকে খেলা শেখার জন্য ট্রেন ধরতেন লেভার? 

    জয়দীপ মুখার্জি এবং প্রেমজিৎ লাল ১৯৬২-তে মেলবোর্নে প্র্যাকটিস করেছিলেন৷ অস্ট্রেলিয়া ডেভিস কাপ টিম তখন ইতালির সঙ্গে ফাইনাল খেলবে বলে হপম্যানের কাছে অনুশীলন করছে৷ হপম্যান তাঁদের খুব পছন্দ করতেন বলে কমবয়সি দুই ভারতীয়কেও ক্যাম্পে ডেকে নেন৷ আজও সেই অভিজ্ঞতা বলতে গেলে আঁতকে ওঠেন জয়দীপ৷ ‘ওরে বাবা! মিলিটারি ট্রেনিং! সকাল থেকে পাঁচটা করে সেট খেলো৷ দৌড়োও৷ রিয়াল স্ট্যামিনা বিল্ডিং ট্রেনিং৷ কিন্তু ওই কুড়ি-একুশে প্রসেসটার মধ্যে দিয়ে যাওয়া পরবর্তীকালে আমাকে আর প্রেমজিৎকে অনেক সাহায্য করেছিল৷’

    পি কে ব্যানার্জির শিষ্যেরা যেমন পরবর্তীকালে কোচিংয়ে নামধাম করেছিলেন, তেমনি হপম্যানের এক বিখ্যাত শিষ্য পরবর্তীকালে কোচ হিসেবে বিশ্বসার্কিটে সম্ভ্রম তৈরি করেন৷ তিনি টনি রোচ৷ রোচ নিজে ডাবলসে নাম করেন বেশি৷ তিনি ও নিউকোম্ব দুর্ভেদ্য জুড়ি হিসেবে সার্কিটে পরিচিত ছিলেন৷ রোচের টেনিস-ভাগ্য অনেকটা কেন রোজওয়ালের মতো৷ রোজওয়াল চারবার উইম্বলডন ফাইনালে উঠে একবারও জিততে পারেননি৷ রোচ পাঁচবার গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে উঠে জেতেন মাত্র একটি খেতাব৷ অথচ অস্ট্রেলীয় টেনিসমহলে বলাবলি হত, লেভারের উত্তরাধিকার হতে পারেন রোচ৷ হেড-টু-হেড সংঘর্ষে লেভারকে একমাত্র তিনি সবচেয়ে বেশিবার হারিয়েছেন৷ কিন্তু এরপর হঠাৎ কনুইতে চোট হয়ে যায়৷ চোট না লেগে গেলে এতগুলো ফাইনাল হাতছাড়া হত না৷ প্লেয়িং জীবনও সীমাবদ্ধ হয়ে আসত না৷ 

    কিন্তু সিঙ্গলসদের চূড়ান্ত পর্যায়ের ব্যর্থতা থেকে যেন রোচ আরও ভাল করে উপলব্ধি করেছেন সাফল্যের চাবিকাঠি৷ পি কে-র বংশপরম্পরা যেমন সুভাষ ভৌমিক— হপম্যানের তিনি৷ বলা হয় যাবতীয় ক্যারিসমার মধ্যেও পি কে-র একটা সুবিধে ছিল৷ তিনি ডিল করেছেন মুখ্যত বাঙালি ফুটবলার নিয়ে৷ বাংলা তখন ভূভারতের ফুটবল নিয়ন্ত্রণ করত৷ সেই সময় বাঙালি মননে ভরা ড্রেসিং রুম চাগানো অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক ছিল পি কে-র পক্ষে৷ সুভাষের আমলে অবাঙালি আর বিদেশি ফুটবলারে ঠাসা থাকত মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল৷ ড্রেসিং রুমের ভাষা তখন আর বাংলা নয়৷ সেখানে টিমকে সংঘবদ্ধ রাখা এবং স্বপ্ন দেখানো নিঃসন্দেহে কঠিনতর চ্যালেঞ্জ৷ 

    টনি রোচের আমলে তাঁকে ঘর করতে হয়েছে এমন সব পেশাদারের সঙ্গে, যাঁরা হপম্যান-আমলের তারকাদের চেয়ে অনেক হাই-প্রোফাইল৷ হপম্যান-আমলের সর্বোচ্চ তারকা এবং টেনিসের প্রথম কোটিপতি লেভার একাই ট্র্যাভেল করতেন৷ না থাকত সঙ্গে কোনও কোচ৷ না ডায়েটিশিয়ান৷ না মনস্তত্ত্ববিদ৷ প্লেয়ার-কোচে সম্পর্ক তখনকার দিনে অনেক সহজ ছিল৷ এখন মধ্যিখানে এজেন্ট এসে গিয়েছে৷ প্লেয়ারের ব্যক্তিগত বান্ধবী থাকে৷ তার স্ট্রেংথ কোচ থাকে৷ মনোবিদ থাকে৷ পছন্দের প্র্যাকটিস পার্টনার থাকে৷ নিরাপত্তাকর্মী থাকে৷ এই গোটা স্কোয়াডের সঙ্গে কোচকে মানিয়ে চলতে হয়৷ সুপারস্টার প্লেয়াররা এখন মহাতারকা শুধু নন৷ বিলিয়নেয়ার৷ তাঁদের কারও কারও প্রাইভেট জেট রয়েছে৷ কারও রয়েছে আস্ত একটা দ্বীপ৷ পৃথিবীর সব বিলাসবহুল শহরে নিজস্ব বাড়ি৷ কোচ যে-ই হোন না কেন, সম্পর্কটা শুরু থেকে খুব পরিষ্কার থাকে যে আমি মালিক৷ আর তুমি কোচ হতে পারো, কিন্তু দিনের শেষে আমার মাইনে করা পেশাদার৷ 

    বরিস বেকারের মতো তারকাকে জকোভিচের কোচ হতে গিয়ে আবিষ্কার করতে হয়েছে যে গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়নের পুরনো গৌরব বাদ দিয়ে কাজটা করতে হবে৷ আমি বেকার— মাথায় থাকলে এক ইঞ্চি এগোনো যাবে না৷ কোনর্সের মতো বড় প্লেয়ার৷ তিনিও তো কোচ করেছেন অ্যান্ডি রডিককে৷ পরবর্তীকালে মারিয়া শারাপোভাকে৷ কিন্তু সেই সন্তুষ্টি পাননি৷ হয় নিজের বুকের আগুন শিষ্যের মধ্যে সংক্রামিত করতে পারেননি৷ বা মনে হয়েছে, এ তো আমার তুলনায় কোনও প্লেয়ার নয়৷ ইতিহাসেই থাকবে না৷ তাহলে এত তারাবাজি সহ্য করব কেন? 

    টনি রোচ সেদিক দিয়ে স্বতন্ত্র৷ দু’ধরনের চ্যাম্পিয়নই পারফর্মেন্সে শান দেওয়ার জন্য তাঁর দ্বারস্থ হয়েছেন৷ টপ লেভেলে তো আর মাটি থেকে ধরে কোচিং হয় না৷ ছোট ছোট কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হয়৷ প্লেয়ারের মনের গঠন প্রয়োজনে বদলানো হয়৷ আর এগুলোতে রোচ মাস্টার৷ লেন্ডলের মতো পেশাদার নিজের ভলি উন্নত করার জন্য রোচের স্মরণ নিয়েছেন৷ আবার ফেডেরার গিয়েছেন বেসলাইন প্লে নিখুঁত করার জন্য৷ এর থেকে পরিষ্কার, সর্বোচ্চ মানের পেশাদাররা মনে করেন নেটের কাছে এবং দূর— দু’জায়গার খেলা ঠিক করে দেওয়ারই তিনি আদর্শ লোক৷ 

    লিয়েন্ডারও কিছুদিন রোচের কাছে ট্রেন করেছেন৷ কিন্তু বেশি দিন করা সম্ভব ছিল না, কারণ এত নামী পেশাদার কোচ এক-দুই-তিনের রোজগারের বাইরে অ্যাফোর্ড করা শক্ত৷ রোচের কোচ হিসেবে এত প্রসিদ্ধি ফেডেরারের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার জন্য৷ এমনিতে এই পর্যায়ের কোচেরা মাইনে হিসেবে নেন প্লেয়ারের রোজগারের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ৷ যেটা কোটি কোটি টাকা৷ এর বাইরে রয়েছে ফ্রি ট্র্যাভেল৷ থাকা-খাওয়ার ফাইভ স্টার ব্যবস্থা৷ কিন্তু ফেড-এক্সের সঙ্গে রোচের সম্পর্ক এত মধুর যে শোনা যায় তিনি কোনও চুক্তি করতেন না৷ ফেডেরার নিজেই একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রতিবছর তাঁকে দিয়ে দিতেন৷ 

    রোচ অবশ্য এত লাজুক আর মুখচোরা, নিজেকে নিয়ে প্রচার ও বিজ্ঞাপনী জগতে কোনও তরঙ্গ তৈরি করতে পারেননি৷ হয়তো প্লেয়ারদের কাছে তাঁর উপস্থিতি অনেক আরামদায়ক হয়েছে যে, এ পিছনে থাকবে৷ আমাদের ইমেজে কখনও ছায়া ফেলবে না৷ 

    সেদিক দিয়ে কোচেদের মধ্যে সবচেয়ে বর্ণময় নিক বলিটেয়ারি৷ মার্কেটিং কাকে বলে— তাঁর কাছে ম্যানেজমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের শেখা উচিত৷ ৩১ বছর আগে ওঁকে যখন প্রথম একান্তে ইন্টারভিউ করি, তখনই শুনেছিলাম, বলিটেয়ারির রয়েছে সাতজন স্ত্রী, ছটা রোলস রয়েস আর আটটা বি এম ডব্লিউ৷ এখন সেন্সাস নিলে কী পাওয়া যাবে জানি না৷ তবে বলিটেয়ারি একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলেছিলেন যে, আগাসি বা জিম কুরিয়ারের মতো তাঁর বিখ্যাত শিষ্যদের তিনি উইম্বলডনের জন্য তৈরি হতে বলতেন দুটো চ্যাম্পিয়নশিপ সপ্তাহের জন্য দু’রকমভাবে৷ প্রথম সপ্তাহ খেলতে হবে এটা ঘাসের কোর্টের টুর্নামেন্ট মনে করে৷ দ্বিতীয় সপ্তাহ খেলতে হবে হার্ড কোর্ট টুর্নামেন্ট মনে করে৷

    এইরকম আজব কথা কারও মুখে শুনিনি৷ কিন্তু বলিটেয়ারি হলেন বলিটেয়ারি৷ পেছনে উজ্জ্বল কোনও টেনিস কেরিয়ার নেই বলে দিগগজেরা তাঁর সমালোচনা করে থাকেন৷ কিন্তু দিনের শেষে পারফর্মেন্স হল পারফর্মেন্স৷ সাফল্যই সেরা সাফল্য৷ ফ্লোরিডায় নিজের টেনিস অ্যাকাডেমি থেকে কী কী সব প্লেয়ার তুলেছেন! তিনি টেনিস নিয়ে কিছু বললে গুরুত্ব দিতেই হয়৷ আর বলিটেয়ারি বলেছিলেন, বর্গের ঘাসের কোর্টের স্বাভাবিক খেলা না থেকেও পাঁচবার উইম্বলডন জেতার কারণ ঘাসগুলো টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুকিয়ে কিছুটা চাপড়া উঠে যাওয়া৷ তখন বল যত গড়ায়, তার চেয়ে বেশি লাফায়৷ যে আচরণের সঙ্গে বর্গের টেনিস খুব উপযুক্ত ছিল৷

    টেনিস ব্যাকগ্রাউন্ড  নেই বলে সার্কিটের টেনিস প্লেয়াররা একটু খাটো চোখে দেখেন মার্কিনিকে৷ কিন্তু তিনি এমনই জীবন্ত কমন সেন্স যে, পেছনে কী সি ভি আছে, কী নেই, তাতে কিছু আসে যায় না৷ টেনিসের যেহেতু সরঞ্জাম বদল হয়েছে, খেলাটা আরও গতিসম্পন্ন হয়েছে, তাই টেকনিকের সূক্ষ্ম পরিবর্তন করতে হবে— এটাই তাঁর মন্ত্র৷ বলেন, ‘আগে যতটা এগিয়ে প্লেয়ার বলকে মিট করত, এখন তার চেয়ে বেশি এগোতে হবে৷ প্লাস এখন ভাল চশমা এসে গিয়েছে৷ প্লেয়ারকে তার সুবিধে নিতে হবে৷ প্লেয়ারদের ফিটনেস বেড়ে গেছে৷ খেলাগুলো বেশি লম্বা লম্বা হচ্ছে৷ মেঘলা সেন্টার কোর্টে বিকেল ছটা মানে কার্যত সন্ধে৷ ওই সময় বল নিখুঁতভাবে দেখতে হলে ওই চশমা চাই৷’ আর-একটা খুব দামি কথা বলেছিলেন যে আগেকার দিনে অমুকের সম্পর্কে বলা হত, সে বেসলাইনার৷ অমুক নেটের কাছে ভাল৷ এখন সেসব সম্ভবই না৷ এখন ফুল কোর্টের খেলা সবাইকে তৈরি করতে হবে৷ কমপ্লিট প্লেয়ার হতে হবে৷

    আগাসি সম্পর্কে এমন উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে নিজের ছেলের মতো তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন৷ আগাসির ক্যাম্প অবশ্য পরবর্তীকালে বলেছে আন্দ্রে-আন্দ্রে করে মাতামাতি পুরোটাই নিজের প্রচার৷ আমি যে বছর মহাবিতর্কিত মার্কিনি কোচকে ইন্টারভিউ করি, তার পরের বছরই আগাসি আর তিনি আলাদা হয়ে যান৷ বলিটেয়ারির অভিমান ছিল যে আগাসি খেলায় একশো ভাগ মন দিচ্ছেন না৷ অন্য অনেক জিনিসে তাঁর আগ্রহ জন্মে খেলার ক্ষতি করছে৷ যা হোক, আগাসি দ্রুত কোচ বাছেন ব্র্যাড গিলবার্টকে৷ পেশাদার জীবন শেষ করা অবধি গিলবার্টই ছিলেন তাঁর কোচ৷ আর বলিটেয়ারির সঙ্গে তিক্ততা এমনই বাড়ে যে নিজের আত্মজীবনীতে অবধি এক হাত নিয়েছেন কোচকে৷

    বিশ্বটেনিসে তখন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত আগাসি বনাম সাম্প্রাস৷ বেশির ভাগ ম্যাচ জিততেন সাম্প্রাস৷ কেরিয়ার রেকর্ড খুললে দেখা যাবে, সাম্প্রাসের পক্ষে ফল থেকে গিয়েছে ৫৯-৪১৷ আগাসি শুরু করেছিলেন বেসলাইনার হিসেবে৷ বলিটেয়ারি এবার উন্নত করলেন তাঁর নেট প্লে৷ যাতে সাম্প্রাসের সামনে কঠিনতর বিপক্ষ হিসেবে নতুন করে আবির্ভাব ঘটে তাঁর প্রিয় ছাত্রের৷ তাতেও দেখা গেল সম্পূর্ণ সুরাহা হচ্ছে না৷ এমনই কমপ্লিট প্যাকেজ নিয়ে এসেছিলেন সাম্প্রাস৷

    তাঁর উত্থানের পেছনেও সলিড ব্যাকরণ৷ মাত্র সাত বছর বয়েসে খুদে সাম্প্রাসকে তুলে দেওয়া হয় পিট ফিশার নামক ভদ্রলোকের হাতে৷ ফিশার নিজে একজন জিনিয়াস৷ দুশোর ওপর আই-কিউ৷ তিনি সাম্প্রাসের খেলার এক-একটা ভাগ তৈরি করান এক-একজন কোচের কাছে৷ ট্রেসি অস্টিনের কোচ শেখান, কী করে ভলি মারতে হবে। অ্যাঞ্জেলিসের এক প্রশিক্ষক: সার্ভ অ্যান্ড ভলি৷ নিউ জার্সির এক পেশাদার: ফুটওয়ার্ক৷ পেছনে রড লেভারের ভিডিয়ো চালিয়ে ফিশার এরপর ফিনিশিং টাচ দিতেন৷

    এভাবে বছর দশেক নিরুপদ্রবে চলার পর প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন সাম্প্রাস৷ বলেন, ‘ভেবেছেনটা কী? আপনার মগজ আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেবেন না কি? আমাকে আমি হয়ে উঠতে দিন৷’ কোচের সঙ্গে এরপরই সম্পর্কছেদ৷ বাবা বহু বুঝিয়েও পারেননি৷ জাম্প কাট ইউ এস ওপেন ১৯৯০৷ টেনিস দুনিয়া তোলপাড় করে খেতাব জিতলেন সাম্প্রাস৷ আর প্রথমেই ধন্যবাদ দিলেন ফিশারকে, ‘উনি না থাকলে আজ এই মঞ্চে আমি দাঁড়াই না৷’

    টেনিস কোচিং প্রণালী বহু বছর ধরে এত উন্নত যে এক-একটা অংশ ভাগ করে স্পেশালাইজড ট্রেনিং দেওয়া হয়৷ সার্ভ করার সময় কোমর ঠিকমতো ঘুরছিল না বলে জেনিফার ক্যাপ্রিয়েতিকে নাচ শিখতে হয়৷ নাচ থেকে এসেছিল কোমরের ফ্লেক্সিবিলিটি৷ আর প্র্যাকটিসে ক্রমাগত ফুটবল ছুড়ে ছুড়ে সার্ভিসের থ্রোয়িং মোশন৷ বেকার যেমন অভিনব চিন্তাভাবনার অধিকারী তাঁর প্রথম কোচ বরিস ব্রেসকোয়ার কথা বলেছিলেন৷

    ব্রেসকোয়ার কাছে প্রথম যখন আসেন, বেকারের বয়েস ছিল ১০৷ পেটানো চেহারা, কিন্তু শরীরের গড়ন লম্বাটে নয়৷ জার্মান শিবিরে তখনই অত্যাধুনিক এক্স-রে’র ব্যবস্থা রয়েছে৷ রিস্ট এক্স-রে’তে দেখা গেল, ছেলের হাইট হবে ছ’ফুট দু’ইঞ্চি৷ সেই অনুযায়ী সার্ভ-ভলির তালিম দেওয়া হবে বলে ঠিক হল৷ যদি দেখা যেত পাঁচ ফুট ন’ইঞ্চির কম হবে, তাহলে বেসলাইন-নির্ভর অনুশীলনে তৈরি করা হত বেকারকে৷ 

    শুনলে মনে হয় স্বপ্ন৷ কী করে তাহলে এগোবে ভারতীয় উঠতি পেশাদার? তার না আছে পরিকাঠামো, না নামী কোচ রাখতে পারার মতো কাঁড়ি কাড়ি ডলার বোঝাই ব্যাগ৷

    ভারতীয় টেনিস কোচেদের মধ্যে পাতে দেওয়ার মতো একমাত্র আখতার আলি৷ ছেলে জিশান, কি নঈমের ছেলে ফজলুদ্দিনসহ বেশ কিছু ভারতীয় ডেভিস-কাপারকে তিনি তৈরি করেছেন৷ দীর্ঘ তিন দশকের বেশি ভারতীয় ডেভিস কাপ টিমের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আখতার৷ শুরু করেছিলেন নরেশ কুমারের আমলে৷ শেষ হয় লিয়েন্ডার পেজের জমানায়৷ অসম্ভব দিলদার মানুষ ছিলেন৷ শুধু টেনিস কেন, কলকাতার ক্রীড়ামহলেও পাশে রাখার মতো এমন সুপার এক্স এক্স এল সাইজ দ্বিতীয় খুঁজে পাচ্ছি না৷ আটের দশকে খেলতেন উইলসন ব়্যাকেটে৷ পরে বদলে সেটা দাঁড়ায় ইউরোপীয় স্ন্যায়ার্ট৷ কিন্তু কেন জানি না মনে হত, ওই ব়্যাকেটের ওপর কেউ লিখে রেখেছে ‘লাভ ইউ জিন্দেগি’৷ পার্ক সার্কাস জিমখানার টেনিস মার্কারের ছেলে হিসেবে টেনিস কোর্টে প্রবেশ৷ তারপর অসম্ভব প্রাণশক্তি, জেদ আর প্রতিজ্ঞা নিয়ে অভিজাত টেনিস সমাজে নাগাড়ে ট্রেকিং৷ কাগজে লিখে যা টাকা পেতেন পেতেন৷ তার সঙ্গে নিজের সঞ্চয় যোগ করে গ্র্যান্ড স্ল্যামে যেতেন আখতার৷ লক্ষ্য— যাতে কোচ হিসেবে তাঁর শিক্ষণপদ্ধতি প্রাসঙ্গিক থাকে৷ ফিটনেস ও প্রযুক্তি টেনিসে ঢুকে যাওয়ার পর আলির সাবেকি ব্যাকরণ অনেকটাই আক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ কিন্তু প্লেয়ার চেনার চোখটা ছিল৷ আর দ্রুত বিপক্ষের দুর্বলতা বার করে ফেলতে পারতেন৷ 

    একবার জয়পুরে ডেভিস কাপ কভার করতে গিয়েছি৷ তখন তো সেলফোন বলে কিছু নেই৷ হোটেল থেকে বাড়ি বা অফিসে ফোন করতে গেলে অনেক টাকা৷ আধ কিলোমিটার দূরে একটা এস টি ডি বুথ ছিল৷ সেখানে রাত ন’টার পর রেট কমে আসত৷ প্রায় ফাঁকা হয়ে আসা লাইন শেষে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি আখতার৷ আপনি এখানে? ফোন করতে এত দূরে? আখতার হাসেন, ‘জীবন দিয়েছে বলে তার অপচয় করব কেন? সবসময় খেলব নিজের সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী৷’ শুনে দারুণ লেগেছিল৷ মনে হয়েছিল তাঁর কোচিংয়ের ভিতটাও নিশ্চয়ই তা-ই, রক্ষণ সামলে আক্রমণে যাও৷ নাগাড়ে এতগুলো বছর তখনই ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় দলের সঙ্গে থাকা সম্ভব, যদি কারো মাথা না ঘোরে৷ 

    একবারই শুধু ফ্যান্সি শট খেলে ফেলেছিলেন আখতার৷ আর তার মাশুল দেন৷ ১৯৮৫-তে ভারতের ডেভিস কাপ ম্যাচ ছিল সাউথ ক্লাবে৷ বিপক্ষ ইতালি৷ বিজয় অমৃতরাজ ক্যাপ্টেন-কাম-প্লেয়ার৷ বিজয় টেনিসে তখন ঠিক তা-ই, যা গাভাসকর ভারতীয় ক্রিকেটে৷ অমিত ক্ষমতাশালী৷ অথচ আখতার ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার জন্য ডাবলসের দিন প্রকাশিত কলামে লিখলেন, ‘কাল আমার ছেলেদের যা খেলা দেখেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে ডাবলস কম্বিনেশনে বদল আনা যায় কি না ভাবছি৷’

    সেদিন সাউথ ক্লাবে ম্যাচ কভার করতে ঢুকে দেখি ফিসফাস চলছে চারদিকে৷ চুনী গোস্বামী এগিয়ে এলেন প্রথম, ‘আরে তোমাদের কাগজে লেখা নিয়ে তো আজ ড্রেসিং রুমে চূড়ান্ত অশান্তি৷’ বিজয় বলেছে আখতারকে, ‘কাগজে দেখছি তুমি নাকি কম্বিনেশন বদলাবে৷ জানতে চাইছি তুমি কে? আওতার বাইরে গিয়ে এত লম্বা লম্বা কথা লেখো কী করে?’ নিজের লেখা ছাড়াও আমার প্রেমজিৎ লালের অনুলিখনের দায়িত্ব ছিল৷ প্রেমজিৎও বললেন, ‘আখতার তো কোচ৷ এত কথা বলার কী দরকার?’ ঘরের ক্লাবে পরিচিত ড্রেসিং রুম কর্মীদের সামনে সেদিন আখতার যথেষ্ট অসম্মানিত বোধ করেছিলেন৷ কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিল না৷ পরের দিন থেকে আলির কলম মোটামুটি মাটিতে নেমে আসে৷ 

    আখতার প্রয়াত হওয়ার পর বিজয়ের শোকগাথা লক্ষণীয়, ‘এত আমুদে ছিল মানুষটা যে আমাদের ডেভিস কাপ টিমকে সবসময় মাতিয়ে রেখে দিত৷’ নাহ্, কোচিং নিয়ে কোথাও কিছু বলা হয়নি৷

    আসলে টেনিসের পৃথিবী ঠিক ফুটবলীয় নয়৷ ফুটবলে একজন ফার্গুসন বেকহ্যামের চেয়ে বড়৷ এমনকি রোনাল্ডোর চেয়ে বেশি শ্রদ্ধেয়৷ একজন মোরিনহোকে দেখলে ফুটবল ট্র্যাফিক দাঁড়িয়ে পড়বে৷ পেপ গুয়ার্দিওলা অবধি তো যাচ্ছিই না৷ 

    অথচ টেনিসে হপম্যান বাদে কোচেরা মূলত সাহায্যকারী৷ মানে গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র৷ কিন্তু নায়ক নন৷ ওই উপকারী মাস্টারমশাই অবধি৷ চ্যান্সেলর নন৷

    লেখকের ‘টেনিস ল্যাবরেটরি’ বইয়ের অংশ। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook