সুপ্রিম কোর্টের থেকে সুড়ঙ্গের মতো রাস্তাটা তিন নেতার মাজারের দিকে গেছে, রাস্তাটা অতিক্রান্ত-দুপুরে নিঝুম। দূর থেকে ভেসে আসা গাড়ির শব্দে মৃদু ও দীঘল কম্পনে বাতাস উঠছে আর নামছে। এ-রাস্তাটা অধিকাংশ লোকে তেমন চেনে না, ব্যবহারও করে না। তার সঙ্গত কারণ হল— রাস্তাটা সরু, গাড়ি যাওয়ার বন্দোবস্ত বেশি নেই, আর সুপ্রিম কোর্টের রক্ষীগণ প্রায়শই রাস্তাটিতে যাতায়াত সীমিত করে দেন। কিন্তু রাস্তাটা আমি শর্টকাট নেওয়ার জন্য প্রায়ই ব্যবহার করি। এদিকে আমার প্রায়ই কাজ থাকে, তার মাঝে সময় পেলে বাংলা একাডেমিতে ঢুঁ মারার জন্য এ-পথটুকুই আমার পাঁচালি।
আজ সেখানে ঢুকতেই আমের মুকুলের সশস্ত্র আক্রমণে আহত ও বিক্ষত হয়ে বুঝলাম, বসন্ত পরিণত হয়ে গেছে সেই কবে। সামনে আমের দিন। বইমেলায় যাবার বিশেষ ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বইমেলার ভেতর দিয়েই আমার পথ। অতএব, কলা বেচতে যেহেতু এসেছি, রথ দেখতে দোষ কোথায়?
গত ১৮টি বইমেলা আমার প্রত্যক্ষ দেখার সুযোগ হয়েছে। এর আগে পর্যন্ত বইমেলা ছিল মফস্সলের কিশোরের নিকট এক সুদূর কিংবদন্তি, পত্রিকায় খচিত থাকা নক্ষত্র-সংবাদ। ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা (কিংবদন্তি প্রকাশক, মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা) বর্ধমান হাউজের বটতলায় ৩২টি বই চটের ওপর বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন। ৩২টি বই-ই ছিল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা) থেকে প্রকাশিত। লেখকেরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী। এরপর প্রতি বছরই তিনি ও অন্যান্য কিছু প্রকাশক ফেব্রুয়ারিতে এভাবে বই বিক্রি করতেন। বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেতে শুরু করে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে, যথাক্রমে ‘বাংলা একাডেমি এবং পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’ এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। বটগাছের নীচে ৩২টি বইয়ের ছোট্ট উপস্থাপনা ডালপালা বিস্তার করে আজ সুবিশাল প্রাচীন বটে পরিণত হয়েছে। যেমন বটগাছ নিজে, তেমনি বইমেলাও।
আমার দেখা মেলার ১৮ বছরও কম নয়। প্রথম যখন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসি, তখন মেলা হত শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। মাত্র একটা প্রবেশ পথ, বেরোবার একটা পথ। মেলায় ঢোকা— সেটা যদি শুক্র শনিবার বা অন্য ছুটির দিন হত— তাহলে সে এক মহাপ্রস্থানের পথ। প্রায় দেড়’দুই কিমি লাইন, সেই শাহবাগ মোড় থেকে শামুকের মতো ঠেলে-ঠেলে মেলায় ঢোকার অভিজ্ঞতা, তখনকার লোকেরা জানেন। বাংলা একাডেমির ওইটুকু ছোট্ট পরিসর। তাতে মানুষের আয়তন যতটা, ঠিক ততটাই ধুলোর সাম্রাজ্য। তখন যে-কোনও স্টল যে-কোনও প্রকাশনীর বই বিক্রি করত। বড় প্রকাশনীগুলি নিজেদের বইয়ের বাইরে অন্যদের বই বিক্রি করত না। কিন্তু ছোট স্টলের ক্ষেত্রে শুধু নিজেদের বই বিক্রি করে পোষাত না। তারা জনপ্রিয় লেখকদের বই ভিন্ন প্রকাশনীর হলেও, নিজেদের স্টলে রাখত। পরে এ-নিয়ম বাতিল হয়ে যায়। এক প্রকাশনীর স্টলে অন্য প্রকাশনীর বই বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয় (যদি না উক্ত প্রকাশনী ভিন্ন প্রকাশনীটির কেতামাফিক পরিবেশক না হন)।
বাংলা একাডেমির পুকুরের পাশে শামিয়ানার নীচে বেশ কিছু খাবারের স্টল বসত। তবে, লোকে ভিড়ের কারণে খাবারে আগ্রহ দেখাত কম। আর বর্ধমান হাউজের পেছনে লিটল ম্যাগ কর্নারে চলত কবি-লেখকদের আড্ডা। সিগারেট তখন মেলায় ‘নিষিদ্ধ’ নয়। এখন যেমন কোনও চেষ্টাতেই মেলায় সিগারেট বা দেশলাই নিয়ে ঢোকার উপায় নেই, তখন সহজেই ঢোকা যেত। তখনও সেলফি-মহামারী আসেনি পৃথিবীতে। মোবাইল ব্যবহার করেন এমন লোকের সংখ্যাই হাতে গোনা। ফলে দিকে-দিকে সেলফি-জট করে লোকের হাঙ্গামা তখন ছিল না। মোটা চশমা পরে লেখকেরা গম্ভীর ভঙ্গিতে স্টলে বসে থাকতেন। পাঠকেরা অটোগ্রাফ নিতেন। কোনও জনপ্রিয় লেখক স্টলে বসলে সেই স্টলের আশেপাশে যাওয়াটাই কঠিন হয়ে যেত। হুমায়ুন আহমেদ মেলায় থাকলে সেটা সামলানো মেলা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ছিল না। এই নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় হুমায়ুন আহমেদ নিয়মিত মেলায় আসা ছেড়ে দেন। প্রতি বছর একটি দিন তিনি আসতেন। সেদিন শুধু হুমায়ুন আহমেদের বই কেনার জন্য ভিড় আর লাইন সামলাতে পুলিশ মোতায়েন থাকত মেলায়। মেলার প্রশাসনিক আরও অনেক ব্যবস্থাই ঢিলেঢালা ছিল। অনেক দোকানেই নকল বই বিক্রি হত। প্রবেশপথ বা বেরোবার পথে ভিড় সামলানো যেত না।
বইমেলা যে শুধু বইয়ের মেলাই নয়, আরও বহু কিছুর মেলা, সেটা বোঝা যেত মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে এলে। মুড়ি, বাতাসা, মুড়কি, মুরলী, কদমা— এসব বাঙালি জলখাবারের সঙ্গে ফুচকা-চটপটির মতো রসনারঞ্জককারী খাবারের দোকান বসত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত। চুড়ি, টিপ, মাটি-কাঠ প্রভৃতির গয়নার অজস্র দোকান থেকে অরূপলোকের দেবীগণ গলা ফুলিয়ে দরদাম করে সস্তায় জিনিস কিনে নিয়ে যেতেন। ছোট-ছোট তৈজসপত্রের দোকানও বসত সেখানে। বসত নানা রকম পুতুল ও ঘর সাজাবার জিনিসও। বইমেলা শুধু বইয়ের নয়, আদতে বাঙালি মনের ও মনোহরণকারী দ্রব্যের মেলা ছিল বললেই ঠিকঠাক বলা হবে।
গত কয়েক বছর ধরে মেলা প্রসারিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (সাবেক রেসকোর্স ময়দান। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭-ই মার্চ তাঁর বিখ্যাত ভাষণ প্রদান করেন) পর্যন্ত । প্রতি বছরই মেলার পরিসর বাড়ছে। ঢোকা বা বের হবার জন্যই দরজা আছে ১৫ থেকে ২০টা। ঢুকতে কোনও ভিড় নেই, ভিড় নেই বের হতেও। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় নানান প্রযুক্তির পসরা বসিয়ে সেসব জায়গা পাহারা দিচ্ছেন পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীগণ। আলাদা করে করা আছে শিশু কর্নার, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য আলাদা জায়গা, লেখকদের আড্ডার জন্য আলাদা জায়গা। এছাড়া চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো আছে বসার জন্য অগুণতি বেঞ্চি। সেসবে জায়গা না পেলেও অসুবিধা নেই, স্টলের সামনে-পাশে যথেষ্ট পরিসর, আপনি অনায়াসে দাঁড়িয়ে বা বসে কিংবা দলবেঁধে আড্ডা দিতে পারবেন। মেলায় রয়েছে বেশ কিছু তথ্যকেন্দ্র। প্রয়োজনীয় স্টলটি খুঁজে না পেলে সেখানে যোগাযোগ করলেই তাঁরা ম্যাপ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মেলায় বেড়াতে আসা শিশু-কিশোর হারিয়ে গেলেও জমা থাকছে তথ্যকেন্দ্রে। লাউড স্পিকারে একটু পর পর ঘোষক ঘোঘণা করছেন মেলা সংশ্লিষ্ট তথ্য বা সংবাদ। খাবারের জন্য বিরাট একটা অংশ ফুডকোর্ট হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে বেশ উচ্চমূল্যে মূল্যবান খাবার বিক্রি হচ্ছে। রসনাতৃপ্তির প্রায় সকল রকম অভিজাত খাবারের পসরা সেখানে।
মেলায় ঘুরতে-ঘুরতে যেটা বোধ হল, কয়েক বছর ধরেই মেলায় বইকেন্দ্রিক আগ্রহটা অনেকটাই বিকেন্দ্রীকৃত হয়েছে। এত-এত লোক এত-এত ছবি তুলছে যে, তাদের এড়িয়ে হাঁটা দায়। আপনমনে আপনি হয়তো হাঁটছেন, কিন্তু অজান্তেই কোনও-কোনও ক্যামেরার ফোকাসে ঢুকে পড়ছেন। ফলে ছবি তুলতে চাওয়া লোকেদের বিষদৃষ্টির সামনে মুখ কাঁচুমাচু করা ছাড়া উপায় থাকে না। এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে ভিডিওর অত্যাচার। অথচ মনে রাখা উচিত, বইমেলা আদতে আনমনে স্টলে-স্টলে ঘুরতে থাকা ক্রেতাদের জন্যই আয়োজিত। ছবি বা ভিডিও তুলুন, কিন্তু লোকের বই খোঁজাকে বিব্রত করে নয়। এখানে ঘটছে উল্টোটা। বেশ আমি ছবি তুলছিলাম, তুমি বাপু কেন এদিক দিয়ে এলে!
কেবল জনপ্রিয় লেখকদের বিপুল আধিপত্য মেলায় কমেছে বোধ হয়। এখন তো আর পত্রিকা দেখে লিস্ট করে লোকে বই কিনতে তেমন আসেন না! প্রত্যেক লেখক বা প্রকাশনী প্রতি মুহূর্তে ফেসবুকে জানাচ্ছেন নতুন বইয়ের খবর। জানিয়ে দিচ্ছেন কে কখন মেলায় থাকবেন। ফলে ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে, মোবাইল ফোনে সংবাদ পেয়ে জড়ো হচ্ছেন সকলেই। তাই আপন-আপন বন্ধুবৃত্ত ঘিরে রাখছে প্রায় সকল লেখককে। আগে লেখককে দেখার একমাত্র উপায় ছিল বইমেলা। এখন সারা বছরই ফেসবুকে তাঁদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে। ভিডিওবার্তায় কথাবার্তা-আলাপ-দেখাশোনা করা যাচ্ছে। মেলায় সহসা দেখার সেই রহস্যময় আনন্দ আর কই?
বইয়ের প্রতি আকর্ষণ কমার আরও একটি কারণ হয়তো আছে। সেটা অনলাইন বইয়ের বাজারের প্রসার। বাংলাদেশে একক ভাবে সবথেকে বেশি বই বিক্রি করে এক’দুটি অনলাইন বইয়ের দোকান। এছাড়া প্রত্যেক প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ রয়েছে। তারাও সারা বছর নিজেদের বইয়ের খোঁজ জানিয়ে দেন। পূর্বে কেবল প্রকাশনীর স্টলে বা ক্যাটালগেই এর হদিস মিলত। প্রকাশনীগুলো, অনলাইন বিক্রেতারা নিজেরাও ছোট-ছোট সময়ের পরিধিতে মেলা করে থাকেন, সেসব মেলায় এই মেলার চাইতে অধিক কমিশনে বই বিক্রি করা হয়। আবার বেশ কিছু বড় বইয়ের দোকানও বইমেলা করেন বছরের নানা সময়ে। সেসব মেলায় নিজে গিয়ে হাজির না থাকলেও চলে, প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ বা মোবাইল ফোনে জানিয়ে দিন আপনার কাঙ্ক্ষিত বইয়ের নাম, আপনার বাড়ির দরজায় বই পৌঁছে দিয়ে যাবে। ফলে বইয়ের বিক্রি বা অনুসন্ধান এখন অনেকটাই বছরব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেলা মূলত সারা বছরের জমে থাকা আড্ডা বা সাক্ষাতের জায়গা অনেকাংশেই। অনেককেই বলতে শুনলাম, মেলা থেকে বই দেখে গেলেন, বাড়িতে গিয়ে অনলাইনে অর্ডার করে দেবেন। এত-এত বই বয়ে নেওয়ার ঝক্কি পোষাবে না। মেলায় এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে, সময় কাটাতে।
তবু মেলায় আসার উপযোগিতা কম নয়। হয়তো নাম-না-জানা কোনও স্টলের সামনে দিয়ে ঘুরছেন, সহসাই এমন একটি বই চোখে পড়ল যেটা আপনি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলেন, কিংবা লেখক প্রকাশক দুই-ই অজানা, কিন্তু একটি বইয়ের কয়েক পাতা পড়েই বুঝলেন এ-বইটি আপনার জন্য প্রয়োজনীয়, এই আকস্মিক আবিষ্কার, নতুন দেশ আবিষ্কারের চেয়ে কম নয়। আমিও এমন কিছু বই ব্যাগে পুরে মেলা থেকে বের হয়ে এলাম।
এমন ঝকঝকে বর্ণিল কিন্তু বইয়ের প্রতি কম আগ্রহী মেলার চাইতে পুরনো ধূলিধূসর কিন্তু অধিকতর বইনির্ভর মেলাকে মনে পড়ে। মোটা চশমা পরিহিত সরল লেখক ও পাঠকদের দিন আর ফিরে আসবে না, কিন্তু ফিরে না আসার বেদনা ফিরে-ফিরে আসবে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র