ঝড়ের গতিতে ২০ হাত দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল একজন শেরপা ক্লাইম্বার, উঁচু-নিচু জায়গায় ক্যাম্বিস বলের মতো ড্রপ খেতে-খেতে। ‘উওহ গির রাহা হ্যায়, উওহ গির রাহা হ্যায়’ বলতে বলতে গলা বন্ধ হয়ে গেল, রক্ত হিম হয়ে গেল। গোটা শরীরটা কাঁপছে। প্রথম কাউকে দেখলাম চোখের সামনে এরকম ভাবে পড়ে যেতে। নীচে গিয়ে ৬,১০০ মিটারে থামল। মনে-প্রাণে খুব করে চেয়েছিলাম যদি এবার উঠে বসে। পেম্বাজিকে বললাম, ‘পেম্বাজি, উওহ জিন্দা রহেগা তো? বোলিয়ে না, উওহ জিন্দা রহেগা?’
স্পষ্ট দেখলাম পেম্বাজির ঘামে ভেজা চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে খালি বলল, ‘সত্যরূপজি, সেফটি ঠিকসে লাগানা।’
হঠাৎ বুঝলাম ডান পা-টা বরফের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেল— সর্বনাশ,
স্নো ব্রিজ কি ভাঙছে? আমি রিফ্লেক্স-এ বাঁ দিকে ঝাঁপালাম। নিমেষে ভস্ করে গোটা জায়গাটা আমাকে সমেত ধ্বসে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আমি ক্রিভাসের মধ্যে ঝুলছি!
আমার ইচ্ছে ছিল ক্যাম্প এক আর দুইয়ের মধ্যে বরফের ফাঁকা ময়দানে সেফটি না লাগানোর। আবার নিচু হও, আবার দড়ি থেকে বরফ সরাও—ক্লান্ত শরীরটাকে খামোখা ব্যস্ত করব কেন? পেম্বাজি রাগত স্বরে গর্জে উঠল একবার— ‘সত্যরূপজি, আপ কেয়া সোচতা হ্যায়, ইয়েহ লোগ জো রস্সি লাগাকে গ্যায়া, উওহ বুদ্ধু হ্যায়, কি ইতনা ভারি রোপ লে কে ইধার অ্যায়সে হি লাগা দেঙ্গে, ইতনা অল্টিচিউড মে? আপ আউর ম্যাঁয় নহি জানতে মতলব ইয়ে নহি হ্যায় কি ইধার পে ডেঞ্জার নহি হ্যায়। ইধার ক্রিভাস রহে সকতা। সেফটি লাগাকে জানা।’
পেম্বাজির কথা শিরোধার্য করে নিয়েছিলাম। তাই আরেকদিন ক্যাম্প ২-এর পথে যেতে-যেতে ৪-নং ‘U’-শেপ ক্রিভাসটার নীচে নেমে আবার বেয়ে বেয়ে উঠে রীতিমতো ক্লান্ত শরীরটা যখন হাঁপাচ্ছিল, তখন আর একটু এগোতেই দেখলাম একটা সরু নালার মতো ক্রিভাস এবং আবার একটা বড় স্টেপ ফেলতে হবে, পেম্বাজির কথা মনে পড়ে গেল। আদেশ আছে ফিক্সড রোপ দেখলেই টুক করে সেফটি টা লাগিয়ে নিতে হবে। অত ক্লান্তির মধ্যেও লাগিয়ে নিলাম। হঠাৎ বুঝলাম ডান পা-টা বরফের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেল— সর্বনাশ, স্নো ব্রিজ কি ভাঙছে? আমি রিফ্লেক্স-এ বাঁ দিকে ঝাঁপালাম। নিমেষে ভস্ করে গোটা জায়গাটা আমাকে সমেত ধ্বসে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আমি ক্রিভাসের মধ্যে ঝুলছি! এবং ঝুলছি সেই সেফটি রোপে,ক্রিভাসের ৬-৭ ফুট ভেতরে। তখনও মুখে-চোখে বরফ ঝুর-ঝুর করে পড়ছে। বুঝলাম, এ-যাত্রায় হাড়-গোড় ভাঙা থেকে রক্ষে পেলাম। এবার উঠতে হবে। ভাগ্যিস সেফটি লাগিয়েছিলাম!
নীচে তাকিয়ে আমি চমকে গেলাম। দু-হাত দিয়ে কখন যেন শক্ত করে ধরে নিয়েছি দড়িটা। নীচে পুরো অন্ধকার। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত খেলে গেল। ঝুলতে-ঝুলতে একটা ছোট বরফের টুকরো খুবলে নীচে ফেললাম। যদি আওয়াজ শুনতে পাই, বুঝব কত নীচু। কিন্তু কোনও আওয়াজ পেলাম না। এবার একটা চাঙড় ভাঙলাম, সেটা ফেললাম। এবারও কোনও শব্দ নেই। সেফটি না থাকলে আমি চিরতরে হারিয়ে যেতাম। কেউ জানতেও পারত না আমি কোথায় আছি। হঠাৎ লোকে উপলব্ধি করত আমি হারিয়ে গেছি।
মলয়দা আর রমেশদা মিনিট ২০ পরে আওয়াজ শুনতে পেয়ে বের করে আমাকে। পেম্বাজি অনেক পেছনে ছিল; যখন ব্যাপারটা জানতে পারল তখন আমরা ক্যাম্প ২-তে জাস্ট পৌঁছব। প্রচন্ড বকা-ঝকা করল। পরে দেবাশিসদাকে বলেছিল, ‘সত্যরূপজিকে আমি বকেছি; এখানে স্পিরিটস থাকে, ওরা ওয়েট করে থাকে কখন কেউ কোনো ভুল করবে। পাহাড়ে একটা ভুল— হয়তো সেটা গোটা এক্সপেডিশনের মধ্যে একটা ভুল— ওরা টেনে নেবে। কত জায়গায় প্রেয়ার ফ্ল্যাগস লাগাব?’
এভারেস্ট সামিট থেকে নামার সময় প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। লাস্ট ৩০ মিনিট-এর উপর অক্সিজেন ছিল না। তখন পেম্বাজির সাথে দেখা। রুদ্রদা আর রমেশদাকে নিয়ে পেম্বাজি সামিটের দিকে, মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে। পেম্বাজি ওর মধ্যেই শুনল আমার অক্সিজেন মাস্কের প্রবলেমের কথা। বাকি শেরপাদের খুব করে বকাঝকা করে দিল। আমি তো ভয়ে মরি, হাই অল্টিচিউডে শেরপাদের যদি মাথা গরম হয়ে যায়, আর দরকার হলে সাহায্য যদি না পাই, তাহলে তো কেলেঙ্কারী হবে। কিছুটা নামার পর ভাবলাম পেম্বাজি নামলে একসাথে নামব। ততক্ষণ একটু বসে পড়ি। দড়িটা হাতে পেঁচিয়ে বসতেই চোখ ঘুমে ঢুলে এল। বাকিরা চেঁচাচ্ছে, ‘ঘুমিও না, ঘুমিও না’। আমি বললাম, ‘আগে পেম্বাজি আসবে, তারপর যাব।’
মনে হল যেন চোখ বন্ধ করলাম আর পরক্ষণেই চোখ খুললাম। এর মধ্যে মিনিট পাঁচেক কেটে গেছে। চোখ খুলে দেখলাম পেম্বাজির মুখ। বলল, ‘সব ঠিক হ্যায় সত্যরূপজি?’ আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘পেম্বাজি, আমার এত ঘুম পাচ্ছে কেন? আমি কি মরে যাচ্ছি?’ পেম্বাজি বলল, ‘কেয়া বোল রহে হো সত্যরূপজি? লেকিন হাঁ, ইধার ব্যায়ঠে রহেঙ্গে তো মর জায়েঙ্গে। আপকো চলনা পড়েগা, আউর খুদকো হি চলনা পড়েগা।’ টনিকের মতন কাজ করেছিল।
এরকমই আগলে-আগলে রাখত পেম্বাজি আমাদেরকে সেই অভিযানে। প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল সকাল ১০টার পর যে যেখানে থাকবে ফিরে আসতে হবে, সামিট হোক আর না-ই হোক। জীবন আগে।
ক্যাম্প ৪ থেকে যখন ক্যাম্প ২-এ নামছি, লোহৎসে ফেসের বেস ক্যাম্পে এসে ক্র্যাম্পন খুলছি আমি আর রমেশদা, পেম্বাজি গৌতমদাদের দুর্ঘটনার কথা বলল। নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি, এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আমাদেরই বাংলার টিমের সাথে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি, বসে পড়েছিলাম দুজনেই।
পেম্বাজি বলল, ‘উওহ জো বান্দাকো লেকে যা রহা থা, জিস কো আপ লোগো নে দেখা, উওহ সুভাষদা থা, আউর উওহ নহি বাঁচেগা…’ এক-একটা কথা যেন কুঠারাঘাত করছিল, মাথাটা দপদপ করছিল।
‘উওহ সুভাষদা থা? আউর উওহ কিঁউ নহি বাঁচেগা?’ চিৎকার করে উঠেছিলাম, ‘ম্যাঁয় তো উসকো চলতে হুয়ে দেখা!’
‘কেয়া বাত কর রহে হো সত্যরূপজি, উওহ খুদকে পয়ের পে খাড়া নহি হো পা রহা থা! উসকো রসসিসে লেকে চার লোগ মিলকে লেকে যা রাহা হ্যায়… উওহ নহি বাঁচেগা।’
হঠাৎ খেয়াল হল, সুনীতাদি? গৌতমদা? পরেশদা? বলল, সুনীতাদি মনে হয় বেঁচে যাবে, সিভিয়ার ফ্রস্ট-বাইট… ‘পরেশদা আউর গৌতমদা ওয়াপস নহি আয়া’…
‘নহি আয়া মতলব? জরুর কিসি অউর টেন্টমে হোগা…’
পেম্বাজি বললেন, ‘সত্যরূপজি, কাল রাতকো আপ লোগোকা টেন্ট মে আনে কে পেহলে ম্যায়নে সব টেন্টমে ঢুন্ডা উও লোগ কো, নহি মিলা। আপকা ৩০ মিনিট মে উইদাউট অক্সিজেন কেয়া হালাত হো গ্যায়া থা? আপকো লাগতা হ্যায় হোল রাত অক্সিজেন বিনা জী পায়েগা? নহি, সত্যরূপজি—’
আমি বললাম, ‘হমে পেহলে কিঁউ নহি বাতায়া?’
পেম্বাজি বললেন, ‘আগর উপর আপ লোগোকো বতাতে তো আপ উন লোগোকো ছোড়কে নহি আতে, হামারা অক্সিজেন খতম হো রহা থা। ওয়েদার ভি কভি ভি খারাব হো সকতা থা, তো হম লোগ ভি মর যাতে। মেরা রেসপন্সিবিলিটি হ্যায় আপ লোগোকো সহি-সালামাত ওয়াপস লানে কে লিয়ে। ম্যাঁয় উওহি কর রহা হুঁ। আপকো রাস্তে মে ভি নহি বাতায়া কিউ কি উওহি আপ লোগো কে দিমাগ মে চলতা, আউর রাস্তে মে অ্যাক্সিডেন্ট হো যাতা…’
এতটাও ভাবতে পারে কোনো মানুষ? আর কোনও কথা বলতে পারলাম না…
এ-রকমই আগলে-আগলে রাখা মানুষটা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেল। সেই আওয়াজ এখনও কানে বাজে—‘সত্যরূপজি, সেফটি ঠিকসে লাগা কে যানা…’
ছবি ঋণ: লেখক