ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ২৭


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (March 26, 2022)
     

    পুড়ে ঝামা যুক্তি

    অমল তুমি অঙ্কে তিন পেয়েছ কেন? দেখুন না, বিমল দুই পেয়েছে। অমল তুমি ঘড়ি চুরি করলে কেন? দেখুন না, কমল গয়না চুরি করেছে। অমল তুমি পুষ্পিতাকে জোর করে চুমু খেলে কেন? দেখুন না, শ্যামল অর্পিতাকে জোর করে চুমু খেয়েছে। এই হল বাঙালি রাজনীতিকদের তর্কের একমাত্র ধরন। তোমার দল কেন খুন করল? আর ১০ বছর আগে ওদের দল যে খুন করেছিল, তার বেলা? তোমার দল কেন পুড়িয়ে মারল? ১৪ বছর আগে তাদের দল যে পুড়িয়ে মেরেছিল, তার বেলা? আরে ভাই, ও খারাপ সে খারাপ, মানলাম। তাতে কী করে প্রমাণ হয় তুই ভাল? পুড়িয়ে মারা ওর ক্ষেত্রে খারাপ হলে তোর ক্ষেত্রেও খারাপ। তুই কেন খারাপ কাজ করেছিস কৈফিয়ত দে। তুই কেন তিন পেয়ে ফেল মেরেছিস জবাব দে। অন্য লোক ফেল করুক না-করুক, তোর দেখার দরকার নেই। তুই আমাকে দাঁড়িয়ে বল, একটা পুড়িয়ে মারা কী করে আরেকটা পুড়িয়ে মারার সাফাই হয়? কিন্তু উত্তর দেবে কে? বাঙালি রাজনীতিক টিভি চ্যানেলে খুব জোরে অন্যের গলা ঢেকে নিজ স্বর চড়াতে ব্যস্ত। যুক্তি সে বোঝে না, পার্টির শেখানো লব্জ বোঝে। যে কোনও অপরাধের কথা তুললেই সে তক্ষুনি অন্যের অনুরূপ একটা অপরাধের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেয়। চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিলেও নিজের দিকে আঙুল তোলার যাথার্থ্য দেখতে পায় না।

    একজন বলেছিলেন, এই পলিটিশিয়ানদের যদি জিজ্ঞেস করো, দুপুরে কি ভাত খেয়েছ? এরা বলবে গত সন্ধেয় আমি কচুরি খেয়েছিলাম। কিছুতেই সোজা উত্তর দেবে না। অবশ্য দেওয়া শক্ত, কারণ এরা তো বেসিকালি বাঁকা। শুধু বাঁকা ও বোকা নয়, এরা নিজ বুক-পেটের ভেতর ঢনঢন শব্দ পেয়ে জানে যে স্বপক্ষে বলার আসলে কিছুই নেই। হ্যাঁ, বেশ করেছি পিটিয়েছি, খুব ভাল করেছি খুন করেছি, জম্পেশ করে শত্তুরগুলোকে পুড়িয়ে মেরেছি— এ তো ডেঁটে বলা যায় না। অন্তত এখনও যায় না। সেইজন্যেই তৃণমূলকে যদি সন্ত্রাস নিয়ে চেপে ধরো, সে বলবে সিপিএমের এ প্রশ্ন করার অধিকার নেই, কারণ সাঁইবাড়ি। সিপিএমকে চেপে ধরলে সে বলবে বিজেপির এ প্রশ্ন করার অধিকার নেই কারণ গুজরাত দাঙ্গা। বিজেপিকে চেপে ধরলে সে বলবে কংগ্রেসের এ প্রশ্ন করার অধিকার নেই কারণ বরানগরে যুবকদের লাশ ভেসে গেছিল। অর্থাৎ কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও রাজনৈতিক দলকে প্রশ্ন করার অধিকার নেই, তাদের সব্বার হাতে রক্ত। তাহলে ভাই নির্দলকে জবাব দে, মিডিয়াকে জবাব দে, সাধারণ মানুষকে জবাব দে। তা দেবে না, কারণ ততক্ষণে অন্যদের অনাচারের উত্তেজিত বিবরণ দিতে দিতে তার মুখে ফেকো উঠে গেছে।

    এই পলিটিশিয়ানদের যদি জিজ্ঞেস করো, দুপুরে কি ভাত খেয়েছ? এরা বলবে গত সন্ধেয় আমি কচুরি খেয়েছিলাম। কিছুতেই সোজা উত্তর দেবে না। অবশ্য দেওয়া শক্ত, কারণ এরা তো বেসিকালি বাঁকা। শুধু বাঁকা ও বোকা নয়, এরা নিজ বুক-পেটের ভেতর ঢনঢন শব্দ পেয়ে জানে যে স্বপক্ষে বলার আসলে কিছুই নেই। হ্যাঁ, বেশ করেছি পিটিয়েছি, খুব ভাল করেছি খুন করেছি, জম্পেশ করে শত্তুরগুলোকে পুড়িয়ে মেরেছি— এ তো ডেঁটে বলা যায় না। অন্তত এখনও যায় না।

    অবশ্য শুধু বাঙালি না, কথা বলতে বসলেই অন্যের দোষের প্যাচাল পাড়ার অভ্যাস অনেকেরই। সেদিন টিভিতে এক চ্যানেলে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সেখানে আমেরিকার লোকও ছিলেন, রাশিয়ারও, ভারতেরও। ভারতের বিবেক কাটজু (অভিজ্ঞ কূটনীতিক, পররাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রাক্তন উচ্চকর্তা) স্পষ্টই বললেন, এরকম যুদ্ধ বা খামখা বোম ফেলার জন্যে পুতিনকে আজ তিরস্কার করা হচ্ছে, কিন্তু এ কাজ আমেরিকাও করেছে। ইরাকে তাদের দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার অজুহাত ছিল: ইরাক রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করছে, পরে সে-অনুমানের কোনও প্রমাণের টিকিও সহস্র ঢুঁ মেরে মেলেনি, তখন বলা হয়েছিল ওঃ, তাহলে আমাদের কাছে ভুল খবর ছিল। ভুল খবরের ভিত্তিতে একটা দেশকে আক্রমণ করা যায় কি না, তা নিয়ে আমেরিকার বিবেকদংশন হয়নি। কাটজু বলতে চাইছিলেন, আজ পুতিন ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছেন বলে তাই আমেরিকার অতটা আহত বিস্ময় মানায় না, কারণ আমেরিকা কোনও অংশে কম যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র নয়। এই মর্মে আরও অনেকে বলছেন-লিখছেন। কথাটা শুনতে চমকপ্রদ, কিন্তু প্রশ্নটা সেই একই। আজ রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে, তা নিয়ে ভাবতে বসে যদি ক্রমাগত আমরা বলি ধিক্কারদাতা দেশগুলোও একই দোষে দোষী, তাহলে আসলে আমরা বলছি, কোনও দোষেই কাউকে অভিযুক্ত করার অধিকার কারও নেই, কারণ সকলেই কমবেশি একই দোষ করেছে। তবে কি ইতিহাসের একটা পর্যায়ের পর— যখন আমরা বুঝে গেছি কেউই সুবিধের নয়, কোনও না কোনও যুগে শতাব্দীতে অব্দে সব্বার পুঁটলিতে চরম পাপ সংগৃহীত হয়েছে— নতুন সব পাপই উপেক্ষাযোগ্য হয়ে গেল? ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে বসে আমরা বলতে পারব না, ধুত্তোর মশাই, আগে যা-ই হয়ে যাক না কেন, এই যুদ্ধটা অন্যায় এবং থামাতে হবে?

    অবশ্য ওই যুক্তিধারাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। এটা বলতে চায়, টেকো সেলসম্যানের কাছ থেকে চুল গজাবার ওষুধ কিনব না। পাড়ার ঝগড়াতেও আমরা চিল্লাই: ছুঁচ বলে চালুনি তোর পশ্চাদ্দেশে ফুটো। যার নিজের নীতির ঠিক নেই, সে অন্যকে নীতি শেখাতে আসে কোন মুখে? ব্যাপার হল, সাধারণ ঘরোয়া বা পাড়াগত ঝগড়ায় যা অকাট্য বলে মনে হয়, বা যে দৃষ্টিভঙ্গি মান্যতা পেয়ে যায়, উচ্চ আলোচনাসভায় সেই প্রবণতাই ধরে থাকা একটু খেলো অভ্যাস। কারণ ওই যুক্তিধারাটা ক্ষুদ্র, এবং তাৎক্ষণিক ক্রোধ ও ক্ষোভ-ভিত্তিক। এবং বহু ক্ষেত্রে স্রেফ প্রতিশোধপরায়ণ। বৃহত্তর নেত্রপাত থাকলে বোঝা যাবে, আলোচনা করতে গেলে যা দরকার: আইডিয়াটার প্রতি মনোযোগী হওয়া, সমর্পিত থাকা। প্রতিজ্ঞা হবে: লোকটার দিকে তাকাব না, শুধু কথাটার দিকে তাকাব। যে বলছে তার অতীত ইতিহাস দেখব না, তার এই মুহূর্তের যুক্তিটার দিকে মন দেব। ঠিক যেমন ব্যক্তি বা ছোট-গোষ্ঠীর ‘মার শালাকে’-ধর্মী নখদাঁত পেরিয়ে রাষ্ট্রকে ক্ষমাশীলতার স্তরে উঠতে হয়, তেমনই এই শিক্ষিত ঠাটও সমাজ-বিশ্লেষক বা সমাজ-ধারাভাষ্যকারকে আয়ত্ত করতে হয়। এ কথা কিছুমাত্রায় মানা হয়, নইলে তো দল-বদলানো একজন নেতার কথাও কিছুতে শোনা হত না, কিন্তু একটু পরেই ব্যাপারটা ব্যক্তির ঠিকুজি ঘাঁটার পানে চলে যায়। সেসব ছেড়ে, সভ্যতার অনুশীলনটা হবে: আমার সামনে শুধু বাক্যটা থাক, বাকিটা মুছে যাক।

    এও বোঝা দরকার, ‘যে-লোক নিজে দোষ করেছে, সে অন্য দোষীকে কিচ্ছুই বলতে পারবে না’ সূত্র মানলে— আমরা শেষবেশ এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে পারি, সাধারণ মানুষও কাউকে অপরাধী চিহ্নিত করে হল্লা মচাতে পারে না, কারণ সে যে জীবনে খুনজখম করেনি তার আসল কারণ হয়তো এই যে, তার অতটা মুরোদ নেই (কিন্তু বিষ ছলকাবার ইচ্ছে আছে ষোলো আনা)। যে পরিমাণ হিংস্রতা তার মধ্যেও জমা হয়ে আছে, যা সে উগরে আছড়ে মারে বাসেট্রামে, ফেসবুকে হোয়াটসঅ্যাপে, তা যদি হাতে বারুদ বা পেট্রল বা আধলা পেয়ে যেত, তাহলে দক্ষযজ্ঞ হওয়ার খুব বাকি থাকত না। দোতলায় শুকোতে দেওয়া ভাড়াটের কাপড়ে ক্রমাগত পানের পিক ফেলে তার যে দিন কেটে গেল, তার কারণ মিসাইল ফেলার বন্দোবস্ত সে করে উঠতে পারেনি। আমরা কি সত্যিই চাই না, আমাকে অপমান করা ব্যক্তিটি এক্ষুনি ট্রাকের তলায় পিষে যাক? বা, যে আমাকে টোন কাটল তার জিভ এই মুহূর্তে খসে পড়ুক? পায়ে পায়ে গলির বাঁক নিই মোড় পেরিয়ে যাই আর মুঠো খুলতে বন্ধ করতে থাকি, মাসের পর মাস দাঁত ঘষটাই। আমরা নিজেদের দিকে সম্যক তাকালে রাজনৈতিক নেতাদের কাণ্ডাকাণ্ডে এতটা গরগর করে উঠতে পারতাম কি?

    কিন্তু করি যে, পারি যে, তার কারণ শুধু আত্মসমীক্ষার অভাব নয়, তার কারণ কিছুটা লঘুগুরু-ভেদজ্ঞান, আর কিছুটা এই স্বাভাবিক ফোকাস-বোধ: এই মুহূর্তে রামপুরহাট ঘটেছে, এবং এখন আমি তা নিয়ে ভাবব। রাজনীতিকদের গৎবাঁধা তর্কের নামতা-বাজি যে সাধারণ লোক বুঝতে পারে না তা নয়, তাদের উত্তেজিত হয়ে ওঠার ভড়ং যে পাবলিকের মগজ এড়িয়ে যায় তা নয়, এবং নিজের মুঠো থেকে দায় অন্যের কোলে চালান করার আপ্রাণ চেষ্টায় ইতিহাসের চ্যাপটারের সুবিধেজনক ন্যাজ ধরে টান মারার তুড়ুক-লাফে নেতাদের ত্যানাও প্রায়ই সরে যায় এবং টিভি থেকে জনগণের ড্রয়িংরুমে খসে পড়ে স্লো মোশনে, কিন্তু তা সত্ত্বেও উগ্র তীব্র তপ্ত গোলমালে দর্শকের বিচার প্রায়ই ঝনঝনিয়ে ওঠে। নিজের মতো চিন্তা-বাছাবুছি ও ন্যায়-নির্বাচনের ব্রেন-চালনার সময় তাকধাঁধা লেগে যায়। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সমঝদারিকে একটা আবশ্যিক দায়িত্ব বলে মনে করি, চারপাশটাকে সক্রিয়ভাবে পড়ে নেওয়ার একটা দায় অনুভব করি, আর তাই নিজেদের উন্মাদ-মাছির মতো পিছলে হড়কে ছেতরে যাওয়া অভিনিবেশকে টুঁটি টিপে ধ্যানে বসাই, কেচ্ছা কোঁদল খেউড়ের ফাঁদ এড়িয়ে, অবান্তর তর্কাতর্কির হল্লাকে মাথায় চড়তে না দিয়ে, যদি সত্যিই পারি ঘটনার তথ্য ও নিরপেক্ষ যুক্তির প্রতি নিবিষ্ট থাকতে, তাহলে হয়তো একদিন (সে-দিন দ্রুত না-এলেও) অনেকে মিলে এমন ভাবনা-সংস্কৃতিতে প্রবেশ করতে পারব, যা পরিচ্ছন্ন, অ-খেঁকুরে, সত্যাশ্রয়ী। যা শুধু নিজের সুবিধেজনক ভাবনাগুলোকে কোল দেয় না, অপ্রিয় স্রোতেও নজর দেয়, দরকার পড়লে নিজেকেও ব্যবচ্ছেদ করে ও নির্মোহভাবে ওজন করে। যা গুলিয়ে দেওয়া ও গুলিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী নয়, স্পষ্টতার মুখোমুখি দাঁড়ানোয় তৃপ্ত। যা, অন্যকে পুড়িয়ে মেরে সমস্যার সমাধান করতে চায় না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook