হাল্লা চলেছে যুদ্ধে
বেশ কিছু ব্যাপার আপেক্ষিক নয়। শিশুকে হত্যা খারাপ। এর কোনও ভাল দিক থাকতে পারে না। ধর্ষণ খারাপ। এর কোনও অন্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। তেমন, যুদ্ধ খারাপ। কারণ এতে মানুষ মারা যায়, একটা দেশের চরম ক্ষতি হয়, এবং সবচেয়ে বড় কথা, ঘোষিত হয়: গায়ের জোরে সমস্যার সমাধান করা যায়, কারও কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিলে কোনও ব্যাপারের প্রকৃত মীমাংসা হয়। যুদ্ধ তাই সভ্যতার বিরোধী, সভ্যতার সব শিক্ষার বিরোধী। বহুদিন আগে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল বীরত্বের লক্ষণ, এখন তা গোটা পৃথিবীতেই চূড়ান্ত অন্যায় হিসেবে স্বীকৃত। কিছু লোক বাসেট্রামে বলবেই ‘চল প্রতিবেশী দেশটার মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে আসি’, কিন্তু কোনও সভ্য রাষ্ট্র তা বলবে না, বা মাঝেমধ্যে মুখ ফসকে বলে ফেললেও, সত্যি সত্যি যুদ্ধ করবে না। কিন্তু রাশিয়া, এতবার সারা পৃথিবীর হইহই বারণ সত্ত্বেও, ইউক্রেনকে থেঁতো করতে যুদ্ধ লাগিয়ে দিল। পুতিন লোকটা চিরকাল এই গোছের, অসভ্য, কুঁদুলে, পেশির মহিমায় বিশ্বাসী, সাংঘাতিক উদ্ধত। সংক্ষেপে, মস্তানিকেই মহত্ত্ব ভাবতে অভ্যস্ত। এমন রাষ্ট্রনায়ক এই মুহূর্তে বিশ্বে বেশ কিছু আছেন, যদিও তাঁরা যুদ্ধ শুরু করে দেওয়ার সাহস পাননি। পুতিন হিসেব কষে দেখেছেন এখন রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভাল, বাকি পৃথিবী যে নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়ার ওপর চাপাবে তা বিরাট ক্ষতি করবে না, তাই ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে নেমে পড়েছেন। বলেছেন, কোনও দেশ যদি এই প্রয়াসকে বিঘ্নিত করার সাহস দেখায়, তাহলে সে (বা তারা) এমন শিক্ষা পাবে, যা ইতিহাসে কেউ দেখেনি। গুন্ডারা যখন রাষ্ট্রের হাল ধরে, হুমকিকে যখন আত্মপ্রতিষ্ঠা ভেবে ভুল করে, দুর্বলের প্রতি প্রহার আছড়ে যখন দেশকীর্তন বাতলায়, তার পরিণতি সাধারণত ভয়ানক হয়, শেষমেশ সেই রাষ্ট্রের নিজের ক্ষেত্রেও। কিন্তু করার কিছু নেই, বিশ্বের বহু দেশের বহু নাগরিকেরই, গুন্ডা-নেতা সাংঘাতিক পছন্দ। অশিক্ষা আর ঔদ্ধত্যের যে মিশেল, তার আকর্ষণ প্রবল। মস্তানদাদা আমাদের বাঁচাবেন আর সব শত্তুরকে কিলিয়ে কাঁটাল পাকিয়ে দেবেন, ভাবতে দারুণ লাগে, আঙুলের ডগা থেকে ভোট (বা নিবেদন) গলগলায়।
মস্কোতে তিন-চারজন টিমটিম করে স্কেচপেনে আঁকা কাগজে যুদ্ধবিরোধিতা করছেন বটে, কিন্তু অচিরে তাঁদের পুলিশে ধরে নিচ্ছে। রাশিয়ার সাধারণত প্রতিবাদ এভাবেই শেষ হয়। ইউক্রেনে মানুষ কাঁদছেন, যেদিকে দুচোখ যায় পালাবার চেষ্টা করছেন, বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম, আশেপাশের দেশ শরণার্থীদের জায়গা দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে। কেউ মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন, বোম পড়লে রক্ষা পাওয়ার আশায়। কেউ নিজের ছোট্ট বাচ্চাকে দেখিয়ে কাঁপছেন, বলছেন কোথায় যাব কী করব কেউ জানি না। মিসাইলের অবশেষ পড়ে আছে মাঠে, পার্কে, গেরস্থের বাড়িতে। ইউক্রেনের সরকার টুইট করেছে কার্টুন, যেখানে হিটলার গালে হাত বুলিয়ে পুতিনকে আদর করছেন, আর তলায় লেখা, ‘এটা কোনও মিম নয়, আমার-আপনার বাস্তব।’ পশ্চিমের হোমরাচোমরাগণ প্রাথমিক শক কাটিয়ে (কারণ আধুনিক ইউরোপে কেউ ইতিহাস-বইয়ের বাইরে ন্যাজামুড়োসুদ্ধু পূর্ণ যুদ্ধ দেখবে, অভাবনীয়) প্রকাণ্ড কড়া বিবৃতি দিচ্ছেন, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে তাঁদের দেশ থেকে বিতাড়নের প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করছেন, রাশিয়ার বিমান নিষিদ্ধ করছেন, রাশিয়ার বাছাই কিছু পুতিন-ঘনিষ্ঠ ধনীর বাণিজ্য-নট করছেন, রাশিয়ায় রফতানি বন্ধ করার কথা বলছেন, কিন্তু ইউক্রেনে সেনা পাঠিয়ে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। এদিকে ইউক্রেনের লোকেরা সাংবাদিকদের কাতর প্রশ্ন করছেন, হ্যাঁ দাদা, আমাদের বাঁচাতে কি নেটো আসবে, বা অন্য কোনও সংগঠন? এরকমই হয়, মস্তান যখন বস্তিতে আগুন দেয় বা বাড়িতে ঢুকে ছোটভাইকে খুন করে, পুলিশকে ফোন করা হয়, চেঁচিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের সান্যালদাকে ডাকা হয়, কিন্তু কেউ আসে না, সাড়া দেয় না। পরের দিন বা পরের সপ্তাহে সমবেদনা জানাতে লাইন দেয়। দেশে-দেশে সম্পর্ক-তন্তু এমন গ্যাঁড়াকল-মার্কা জট পাকিয়ে আছে, হুট বলতে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ‘অ্যাই অ্যাই হচ্ছেটা কী’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না, সভ্যতার সঙ্কট নিয়ে বর্ধিষ্ণু বাতেলা মারা যায় কিন্তু সত্যি সত্যি সভ্যতা প্রতিষ্ঠার্থে মাঠে নেমে পড়া আর হয়ে ওঠে না। কেউ বিস্ময়দীর্ণ অশ্রুমথিত কণ্ঠে বলছেন, পুতিন তার মানে ইতিহাসকে পিছিয়ে নিয়ে গেলেন! পুতিন বলছেন, তিনি ইউক্রেনকে নাৎসি-বিহীন করে ছাড়ছেন। কে নাৎসি, কে ফ্যাসিস্ট, কে কোন শব্দ কোন আক্কেলে আওড়ায়, কে জানে। পিতৃলোক হেসে ভাবে কাকে বলে ভান, আর কাকে বলে gun। এক রুশ খবরকাগজের সম্পাদক (যাঁর কাগজ এখনও সরকারের কাছে বিকিয়ে যায়নি) বললেন, পুতিনের এই কাজের এক বিশ্রী ফল: এবার রাশিয়ানরা হয়ে উঠবে সারা পৃথিবীর কাছে ভিলেন। কিছু ভুল নয়, এভাবে সব রুশকে পুতিনপন্থী ভাবাও অন্যায়, কিন্তু এই হল যুদ্ধের বহুমুখো করাত।
পুতিন যে-সে নন, তিনি সেই ১৯৯৯ থেকে নানা কায়দা করে দেশটাকে কব্জায় রেখেছেন, আইনের মারপ্যাঁচ বুঝে এবং তাতে ইস্ক্রুপ মেরে বা ঝালাই করে তিনি কখনও প্রধানমন্ত্রী কখনও রাষ্ট্রপতি, এবং নিজেকে চূড়ান্ত পুরুষ হিসেবে প্রতিভাত করতে নিয়ত ব্যস্ত। তিনি ব্যায়াম করেন, জুডো খেলেন, পাঞ্জা লড়েন, আইস-হকি খেলেন, হ্যাং-গ্লাইডার চড়েন, সাবমেরিন চড়েন, তিমি-শিকার করেন, সাইবেরিয়ায় খালিগায়ে ছুটি কাটান, মেরুভাল্লুক মাপেন, বাঘের গলায় ট্যাগ পরিয়ে দেন, আর এসবের ফোটো যাতে সর্বত্র ছড়িয়ে যায় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখেন। মানে, বুঝিয়ে ছাড়েন, তিনি হচ্ছেন রাফ অ্যান্ড টাফ, করেন না শত্তুরকে মাফ, তাঁর চোখে চোখ রাখা মহাপাফ। তিনি সমকামী বিবাহ নিষিদ্ধ করেন, জেন্ডার-ফ্লুইডিটি বা ‘একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের মানুষ হিসেবে নিজেকে সংজ্ঞায়িত না করা’র প্রবণতাকে করোনাভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করেন এবং সোচি ইউইন্টার অলিম্পিক্সের আগে বলেন, সমকামীরা খেলতে আসতে পারেন কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে যেন নিজেদের কুপ্রভাব ছড়িয়ে না দেন। এই পৌরুষ-হাঁকড়ানো লোক, ‘আমি মাচো, হে ব্রজ, আমার ছায়ায় বাঁচো’ দাবড়ানো লোক, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বৃত্তে বাখারি খুঁচিয়ে দেওয়া লোক, মার্কিন এমব্যাসি থেকে রেনবো ফ্ল্যাগ ওড়ালে তাকে ব্যঙ্গ করা লোক, মুক্তভাবনা ও মানুষ-দরদের শত্রু লোক, একেবারে গোড়া থেকে রাশিয়ায় সেনাবাহিনীকে দুরন্ত করে তুলেছেন পেল্লায় টাকা ঢেলে, আজ এই আক্রমণে তাঁর অ্যাদ্দিনের প্রস্তুতি ও হিংস্র মনফ্যান্টাসি ফলল-ফুলল। ‘গর্বিত বর্বর’ ডিজাইনের অন্য কিছু অধিনায়ক নির্ঘাত ইশইশ নিশপিশ চুলবুল করছেন, কারণ তাঁরাও এইরকম পালিশহীন রক্ষণশীল মারকুটে, তাঁরা সমালোচককে জেলখানায় পাঠান, অ-পেটোয়া মিডিয়াকে নিগ্রহ করেন, নিজপক্ষীয় ঠ্যাঙাড়েদের আশকারা দেন, কিন্তু হাতে বেশ ক’গ্যালন রক্ত মেখে বাথরুমে অট্টহাসির সিন এখনও রচনা করতে পারেননি। তাঁদের তুড়ুক-লাফ ও রিহার্সাল থেকে বসুন্ধরা বেশিদিন ছাড় হয়তো পাবে না, সেক্ষেত্রে এই অনুপ্রেরণা আমাদের গ্রহটিকে কোন আঘাটায় ভেড়ায়, দেখার।
পৃথিবী ক্রমাগত অন্যায় থেকে আরও অন্যায়ে, আদর্শহীনতা থেকে আরও নীতি-রিক্ততায় গড়াবে, এরকমটা অনেকে কল্পনা করতে পারেননি। মহাপুরুষদের থান-গ্রন্থে কোথাও একটা আশাবাদ বা ক্রমবিবর্তনের বিশ্বাস চেটে নেওয়া যায়, তাঁরা সকলেই ভেবেছেন, মানুষ ভুল বুঝতে বুঝতে এবং তা সংশোধন করতে করতে, মানে, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে নিতে এগোবে। কিন্তু মানুষ এগোয় না। মোটে শিক্ষা নেয় না। মানুষের নিয়তি হল একই ভুল অনন্তবার করা, করে চলা। কিছু মানুষ মরে গেল, আর নতুন-সেট মানুষ জন্মাল, তার মানে এই নবাগত গুচ্ছের মাথায় অধিক ঘিলু এবং তাতে অনুপাত মেনে অধিক শুভবোধ— এর চেয়ে গামবাট ধারণা আর হয় না। মানুষের যাত্রা সরলরৈখিক ও এক-অভিমুখী নয়, তা এলোপাথাড়ি ও উদ্দেশ্যহীন। সে পোকার মতো গজিয়ে ওঠে, পোকার মতো বিনষ্ট হয়, মধ্যিখানে কিছু লোক কিছু কার্য-কারণের গিঁট্টু-বিন্যাসে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় এবং অনেকগুলো লোকের সুখদুঃখ নিয়ন্ত্রণ করে। কালেভদ্রে ক্ষমতাধারী লোকগুলো উপকারী হয়, সেই মুহূর্তে সেই এলাকার লোকের পক্ষে তা সৌভাগ্য-সূচক, কিন্তু আদ্ধেক সময়েই ক্ষমতা আনে দুর্বিনয় আর দুর্বিনয় আনে নৃশংসতা, তখন সর্বনাশ। তাই এই পৃথিবীতে কোল্ড ওয়ারের শেষে আবার ওয়ার্ম ওয়ার শুরু হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে, অনেকে বলছেন এই ইউক্রেন-আক্রমণ দিয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লোকে ভোট দিয়েই প্রায়-স্বৈরাচারীকে সিংহাসনে বসাবে, ভয়াবহ ও ন্যক্কারজনক দাঙ্গা একই প্যাটার্ন মেনে বছর দশ-কুড়ি অন্তর ফিরে ফিরে আসবে। শুধু মুসলমান বলে এক বালকের মাথা চৌচির করে দেওয়া হবে, শুধু হিন্দু বলে এক নারীর স্তন কর্তন করে দেওয়া হবে। হয় এ হোমো সেপিয়েনস প্রজাতির সদস্যদের স্মৃতিশক্তি বড় কম, অথবা হিংস্রতার প্রবৃত্তি বড় বেশি, কিংবা অশান্তি চাখতে এ খুব পুলক পায়। জাতটা মূলত ইতর, বা মূর্খ, বা দুই-ই। যে আলতামিরার গুহায় বাইসন এঁকেছিল, সে এই জাতের প্রতিনিধি নয়, বা প্রধান প্রতিনিধি নয়, আসলি সিম্বল হল যে মুগুর নিয়ে তেড়ে গিয়ে প্রতিবেশীর কাছ থেকে বাইসনের মাংস কেড়ে এনেছিল।