ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নবম সিম্ফনি, চতুর্থ মুভমেন্ট


    আদিদেব মুখোপাধ্যায় (February 5, 2022)
     

    আমার দাদু কবিতা লিখতেন। তাঁর ডায়েরিটা ট্রাঙ্কে অনেকদিন পড়ে ছিল, কেউ জানত না, আমি আজ বের করে উলটে-পালটে দেখছি। কবিতা, পড়ে দেখছি, দাদু খুব খারাপ লিখতেন না। স্বাধীনতার বছর, ১৯৪৭ সালে দাদু বিয়ে করেন। ডায়েরিতে কিছু ব্যক্তিগত এন্ট্রি আছে, সেখানেই দেখলাম। ১৫ই অগাস্ট দাদু লিখেছেন, ‘আজ পুণ্যদিন।’ পরদিনের এন্ট্রি, ‘নদীর এপার থেকে ওপার বড়ো মনোরম দেখায়। এর কারণ দূরত্ব।’ তার পরের কাগজগুলো ফাঁকা। আমি দাদুর ডায়েরিতে কিছু-কিছু জিনিস নোট করে রাখছি। দুটো আলাদা সময় পাশাপাশি রাখলে কেমন হয়, দেখার একটা ইচ্ছে আছে।

    আমি যখন খুব ছোট, মাত্র ন-বছর বয়স, একটা ঘটনা দেখেছিলাম। সেটা আমি কখনও ভুলব না। তখন দুপুরবেলা, নীচে নেমেছি পেচ্ছাপ করতে। বাথরুম থেকে বেরিয়েই আমার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। গ্রিলের জানলার সামনে ওটা কে? আমি ভয় ও কৌতূহলে সেদিকে এগিয়ে যাই। সামনে গিয়ে দেখি, দাদু চোখ খুলে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। গলায় গামছার প্যাঁচ। জিভটা বেরিয়ে এসেছে, ঠোঁটের কোণে অনেকটা ফেনা। … ‘ছেলেটার খুব সাহস’, পরে আমার সম্পর্কে বলাবলি হয়েছিল, যেহেতু আমি প্যানিক করিনি, চেঁচাইওনি। তা প্রায় পাঁচ বছর, দাদু শারীরিক ও মানসিক ভাবে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন।

    এখন আমি উঠব। দাদুর ডায়েরিতে এই কথাগুলো লিখছি, কথাগুলো বাড়ির লোকে দেখলে মুশকিল আছে। সুতরাং, লেখা লুকিয়ে রাখতে হবে। আচ্ছা, কোথায় লুকোই? ট্রাঙ্কেই কি রেখে দেব? না কি, ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাব? না থাক, ব্যাগ ভারী হয়ে যাবে। এক কাজ করি, আলমারিতে বইয়ের পেছনে রেখে দিই। বই, আমার বাড়িতে, আমি ছাড়া কেউ পড়ে না। দাদু কি পড়তেন? জানি না। দেখিনি কখনও। মা ডাকছে। যাই। 

    ২.
    এখন রাত। আমাকে কিছু কথা এখন লিখতেই হবে। হয়তো কেন, নিশ্চিত, কিছুদিন পর এই লেখা দেখলে গ্লানি জন্মাবে। জন্মাক। এখন রাত। আমি লিখব।

    আজ স্টেশনে, আমি, রক্তমাখা ফ্রাঙ্ককে দেখেছি। ফ্রাঙ্ক, আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফ্রাঙ্ক। হৃদয়ের এত কাছে ফ্রাঙ্ক না এলেই পারত, এও কখনও-কখনও মনে হয়েছে। ফ্রাঙ্ক, গত দু’সপ্তাহ নিরুদ্দেশ। কোনও ট্রেস নেই, কোনও চিঠি নেই, তার পরিবার আতঙ্কিত, পুলিশ খুঁজছে তাকে। আমি যে এভাবে ফ্রাঙ্ককে দেখব, তা ভাবিনি। রক্তমাখা ফ্রাঙ্ক পাথরের চোখে আমার দিকে চেয়েছিল। তখন ব্যান্ডেল-হাওড়া লোকাল ঢুকছে। আমি ফ্রাঙ্কের চোখের থেকে নিজের চোখ ছিঁড়ে নিয়েছি। মাথা ছিঁড়ে পড়ছে, ঢোঁক গিলতে গেলে কষ্ট হচ্ছে। আমি চোখ বুজলে লাল দেখছি মাঝে মাঝে। আমার গা-ও কি গোলাচ্ছে? বুঝতে পারছি না। এটা আর বেশিদিন চলতে পারে না। আমার ব্যাপারটা ভোলা দরকার। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে! দাদুর ডায়েরি আজ আর পড়তে পারব না। স্বাধীনতা… 

    ৩.
    আমি ঠিক দিকেই এগোচ্ছিলাম। সব কিছু জানা যাবে না জেনে, জানা যাবে এমন বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। এভাবে জানতে চেয়ে আমি প্রায় সব কিছুকেই বাতিল করে ফেলছিলাম। কারণ, আমি বুঝেছিলাম, এরা কাজে লাগবে না। আমি জানি বা না জানি, এরা অকাজের, ফালতু। সুতরাং, প্রেম, বিপ্লব, অস্তিত্ব, ঈশ্বর, অসীম— এদের নিয়ে চিন্তা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। বুঝেছিলাম, জানা দরকার অন্য জিনিস। নিজেকে।

    নিজেকে, মানে ঠিক কোনটাকে? নিজের আত্মা, নিজের নার্ভ? নিজের অবচেতনা? আমি বুঝতে পারিনি।

    আজ আমি সেই বোঝার দিকে খানিকটা এগিয়ে গেছি। আমি জানি, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, যদি সবাইকে আমি খুলে বলি কথাটা। সবাইকেও বলতে হবে না, একজনকে বললেও হবে, তারই মারফত সবাই জেনে যাবে। কিন্তু কাকে বলব? ফ্রাঙ্ককে? হায়, ফ্রাঙ্ক তো নেই! সে তো তার রক্তমাখা মুখখানি দেখিয়েই কেটে পড়েছে। আজ তার নিরুদ্দেশের আড়াই সপ্তাহ হয়ে গেল।

    গ্রিলের জানলার সামনে ওটা কে? আমি ভয় ও কৌতূহলে সেদিকে এগিয়ে যাই। সামনে গিয়ে দেখি, দাদু চোখ খুলে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। গলায় গামছার প্যাঁচ। জিভটা বেরিয়ে এসেছে, ঠোঁটের কোণে অনেকটা ফেনা। … ‘ছেলেটার খুব সাহস’, পরে আমার সম্পর্কে বলাবলি হয়েছিল, যেহেতু আমি প্যানিক করিনি, চেঁচাইওনি। তা প্রায় পাঁচ বছর, দাদু শারীরিক ও মানসিক ভাবে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন

    না। আমি বেশি ভনিতা করছি। যা হয়েছে, তা সরাসরি লিখে ফেলাই দরকারি। আজ আমি সোনাগাছি গেছিলাম। আমি অনেক আগেই নিজের সমস্যা শনাক্ত করে ফেলেছিলাম। আমি জানতাম, এতেও আমি নিজেকে সুখী করতে পারব না। তবু একটা শকের দরকার, একটা কিছু ঘটনা ঘটানো দরকার। ফ্রাঙ্ককে ভুলতে হবে। সোনাগাছিতে সেই ঘটনা ঘটুক, আমি চেয়েছিলাম। 

    আমার ভুল হয়েছিল নতুন জুতোটা পরে যাওয়া। ওরা আমাকে চিনতে পেরে গেছিল। কচি মুরগি কাটতে বেশি সময় লাগে না। ওদেরও লাগেনি। কিছুদূর যেতেই আমি চারজনের হাতে পাকড়াও হই। পমেটম মাখা ডাইনির গাম্ভীর্যে আমায় দলনেত্রী বলে: দুশো টাকা। শুনে আমি চমকে যাই। এতটা কম কী ক’রে? নেত্রী পানের পিক ফেলে আরও জানায়: ভাল পাবে। চলো। আশ্চর্য, আমি বিশ্বাসও করে ফেলি। হয়তো রক্তমাখা ফ্রাঙ্ক আমায় নড়বড়ে করে দিয়েছিল। হয়তো প্রবলতম সাক্ষ্যের সামনে এসে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার আর ছিল না। আমি তাদের অনুসরণ করে যাই।

    আবছা আঁধার ঘরে একটি ছেলে জামা ছাড়ছিল, দরজায় আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বেরিয়ে আসে। চলে যায়। নেত্রী ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে। ‘জুতো খুলে ঢোকো’, চারজনের একজন আমায় জানায়। খালি পায়ে ঢুকলে তারা আমায় বসতে বলে। একটি হাতলছাড়া চেয়ারে বসে আমি দেখি, দরজা ভেজিয়ে চারজন আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, চারজনের মুখেই হাসি। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক এইখানে এসে গুলিয়ে যেতে থাকে। অনেক কিছুই আমাকে ছাড়তে হবে; এইখানে এসে, আমি নিজের হৃৎস্পন্দন শোনার মতো করে বুঝতে পারি।

    সত্যি, আমার মাথায় তখন আমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর, যেহেতু, ‘আমি’ মানেই এখানে নিরাপত্তা, রেগে ওঠা বা কোনও কাজ করে ফেলার বদলে, আমার শরীর, অসাড় হয়ে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করে। আমায় থাবড়ে সার্চ ক’রে, তারা এটিএম থেকে তোলা ১২০০ টাকা বের ক’রে আনে এবং এক টাকার কয়েন রেখে ব্যাগটি ফেরত দেয়। আমি বাধাহীন ও স্থির ছিলাম। ‘নাও, কাকে নেবে নাও’, নেত্রী নিজেদের নির্দেশ করে বলে। আমি এই প্রথম তাদের দিকে চাওয়ার মতো করে চাই। চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরি। তারা অপেক্ষা নিয়ে আমার দিকে চেয়েছিল। আমি উঠে দাঁড়াই।    

    ‘কী হল?’ একজন আপত্তি জানায়।

    ‘করবে না?’ নেত্রী অবাক হয়ে জানতে চায়।

    ‘যা করবে করো, তাড়াতাড়ি।’ আমাকে ঠেলে প্রথমজন চেয়ারে বসাতে যাবে, এবার আমি মৃদু বাধা দিই। ‘না, আমি যাব।’ তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

    ‘এটা কী করলে তোমরা!’ নীচু ও শান্ত গলায় আমি বলি। 

    ‘এখানে তুমি ভদ্র ব্যবহার পাবে। কেন, চিকনি মাল ছাড়া কি করা যায় না?’ নেত্রী ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ‘করো বলছি!’

    ‘আমি তোমাদের বিশ্বাস করেছিলাম।’ নীচু ও শান্ত গলায় আমি বলি। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। 

    ‘দ্যাখো ছেলে, এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। করলে আমাদের মধ্যেই করতে হবে।’ নেত্রী শাসানোর সুরে বলে। আমি মাথা নাড়ি। 

    ‘তাহলে বেরোও।’ সে আঙুল দিয়ে দরজা দেখায়।

    ‘অন্তত কিছু টাকা দাও ফেরার।’ অনুনয়ের স্বরে আমি বলি। মুখ তুলে চাই। 

    বুকপকেটে একটা নোট গুঁজে দেয় কেউ। ৫০ টাকা, আমি চেয়ে দেখি। চৌকাঠ ডিঙোলে একজন জল ঢালে মেঝেতে। ঝাঁটা চালায়। জুতোয় পা গলাতে-গলাতে আমি আবার বলি: কিন্তু তোমাদের আমি বিশ্বাস করেছিলাম। তারা গরগর করতে থাকে। আমি চলে আসি।

    কিন্তু না! আমি এভাবে জিততে চাইনি। আমি আজ হারতে চেয়েছিলাম, প্রবলভাবে, হ্যাঁ। শহিদের সামনে ঘাতক যেভাবে হেরে যায়। এই অব্যবহার্য উচ্চতা নিয়ে আমি কী করব, এ তো আমাকে আরও নিঃসঙ্গ, আরও বিচ্ছিন্ন করে দেবে! এই শান্ত স্বর, এই আত্মবিশ্বাস আমি কোথা থেকে পেলাম? আমি নিজের গলাকে নিজে চিনতে পারলাম না কেন? তাহলে কি আমি নিজেকে চেনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? 

    ৪.
    ‘জন্মের আগের আত্মার কথা 
    আমি যখন ছিলাম একা একা— এই মহাকাশে মিশে
    মেলে দিলেম কামনা-রঙ পাখা, এলাম নেমে ধরায় অবশেষে।
    অসীম আকাশ ছিল আমার পথ— করতে ছুটোছুটি
    তারার মাঝে চলত আমার রথ— মেঘের ’পরে উঠি
    নয়ন আমার ছিল স্বপ্ন মাখা 
    বায়ুভ’রে চলি ভেসে ভেসে।’ 

    আমার দাদুর লেখা। আমি এখন নিশ্চিত, দাদু বই পড়তেন। শেষ লাইনে ছন্দ কেটে গেছে, কিন্তু বাকিটুকুও একেবারে আনাড়ি হলে লেখা যাবে না। … প্রথম পর্বের রবীন্দ্রনাথ কি দাদুর প্রিয় পাঠ্য?

    আমি জানি, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, যদি সবাইকে আমি খুলে বলি কথাটা। সবাইকেও বলতে হবে না, একজনকে বললেও হবে, তারই মারফত সবাই জেনে যাবে। কিন্তু কাকে বলব? ফ্রাঙ্ককে? হায়, ফ্রাঙ্ক তো নেই! সে তো তার রক্তমাখা মুখখানি দেখিয়েই কেটে পড়েছে। আজ তার নিরুদ্দেশের আড়াই সপ্তাহ হয়ে গেল।

    দিনটা বেকার কাটছে। ইউনিভার্সিটিতে ছুটি, পরশু কালীপুজো। টিভিতে খবর হচ্ছিল, দেখলাম কিছুক্ষণ। সিরিয়ায় আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কোনও কারণ নেই, এমনিই ফেসবুক খুললাম। কে একজন ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে আবার লিখেছে, সেটা নিউজ ফিডে ফ্লাড হচ্ছে। বন্ধ করে দিলাম।

    আমি একটা টিউশনি করি, আরেকটা করব আজ থেকে। বিকেলে পড়ানো। একটি ক্লাস টেনের মেয়ে, এই পাড়াতেই থাকে, আমার কাছে পড়বে। আমি, ১২০০ টাকা, বাড়িতে জানার আগেই দ্রুত অ্যাকাউন্টে ফেলতে চাই। 

    ডায়েরি বন্ধ করার আগে একটা লাইন দেখলাম। চোখ আটকে গেল, কারণ লেখাটা পেনসিলে। দাদু, দেখছি, খুবই ভক্তিমান মানুষ ছিলেন! নিজের, অবশ্যই দুঃখের, একথা-সেকথার পর তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘হে ঈশ্বর, আমার আনন্দ যেন আমায় পরিত্যাগ না করে।’ এত আনন্দ তখন কোথা থেকে পাচ্ছিলেন? দু’দিন আগে আমার প্রৌঢ়া ঠাকুমা মারা গেছেন লিভার সিরোসিসে। দাদুর এন্ট্রি আছে। ‘মার্গারিটা আমাকে ফেলিয়া আজ প্রাতে পরমপিতার নিকটে…’ 

    খেতে ডাকছে। উঠি।

    ৫.
    আমি ভেবেছিলাম আমি সব বুঝে যাচ্ছি। অথচ আমি কিছুই বুঝিনি। নিজেকে তো নয়ই। আজ বুঝতে পারলাম।

    আজ দীপাবলী। এখন রাত একটা, অনেক বাজি ফাটছে। আমি ঘরের মধ্যে, মেঝেতে বসে এই ডায়েরি লিখছি। কারিন-কে আমি কথাটা বলতে পারব, সত্যিই ভাবিনি।

    কারিন, মানে আমার ছাত্রী। মাত্র একদিন পড়েছে, আজও এসেছিল আমাদের বাড়িতে। প্রতিবারই লক্ষ্মীপুজো হয়, আমার মা ওকে ডেকেছিল। আশ্চর্য, এতদিনেও আমি ওকে ঠিক করে দেখিনি। কারিন গত পরশু এসেছিল। আমি তার সামনে একটা চেয়ারে বসেছিলাম। কারিন নীচু হয়ে ছিল, সরাসরি তাকাচ্ছিল না। মেয়েটি কি খুব লাজুক? আমি ভয় কাটিয়ে দিই। সহজ ভাবে গল্প করতে থাকি। কারিন কিছুক্ষণের মধ্যেই বালিকাসুলভ হাসতে থাকে। আমি চমকে উঠি। কী অদ্ভুত, আমার ঘরে একটা আস্ত বসন্তকাল এভাবে ঝলমল করছে কী করে? এখন তো সবে অক্টোবর, শীতও পড়েনি!

    আজ, কারিন, আমাকে বলেছে। আজ, কারিনকে, আমি বলেছি। আজ, আমি বুঝেছি, নিজেকে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। কিছুই প্রাপ্তমনস্ক আমি হইনি। সময় আমাকে এখনও গাঁট করে দিতে পারেনি। নাহলে, দু’দিনে হত না।

    মাথার ওপরে একটা হাউই ফাটছে, তখন, অল্প আলোলাগা মুখে কারিন আমাকে আলতো স্বরে বলে, ‘তুমি সত্যিই কত জানো!’ আমি ওকে ইতিহাসের একটা গল্প বলছিলাম। বলতে-বলতে, আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল খালি-খালি। ঠোঁট দিয়ে জিভ চেটে নিচ্ছিলাম। আমি কারিনের দিকে তাকালাম। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। একটা তুবড়ি ধরিয়েছে গ্রেগররা, পাশের ছাদে। কারিনের মুখে আলো জ্বলে উঠেছে। সে আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে। আমি একটা মিষ্টি সুর শুনতে পেলাম। চরাচর জুড়ে সেই সুর বেজে উঠছিল, কিন্তু খুব আস্তে…

    ৬.
    আজ যা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা তো দূরের কথা, ঠিকঠাক মনে করতেও আমি পারছি না। হয়তো মাথাটা গড়বড় করছে, হয়তো ডাক্তারই দেখাতে হবে আমাকে। বাস্তবতার ধারণা, আমার, ক্রমেই গুলিয়ে যাচ্ছে। অথবা, বাস্তব কী, এখনও আমি জানি না!

    জোহান দায় নেবেন না, আমি জানি। দায় কেউ নেয় না, দায় সবাই মুহূর্তকে দিয়ে দেয়। মুহূর্ত জমে-জমে তৈরি হয় সময়। সেই সময় একদিন সমস্ত দায় চাপিয়ে দেয় আমাদের। তখন ইতিহাস লেখা, ইতিহাস খোঁড়া, ইতিহাস বিশ্লেষণ— এসব শুরু হয়। 

    ঘটনাটা শুরু হয়েছিল সন্ধেবেলা, চায়ের কেবিনে। জোহান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ছিলেন বসে। আমি আর পেটার ঢুকতে উচ্ছ্বাস দেখান ‘কী খবর’ বলে। আমি আর পেটার সলজ্জ ভাবে হাসি। জোহান, প্রবীণ লেখক, সমান্তরাল সাহিত্য করছেন প্রায় ৪০ বছর। একমাস হল, আমাদের আলাপ হয়েছে। আমি আর পেটার, আমাদের পত্রিকা ‘তৃতীয় বিশ্ব’ জোহানকে পড়তে দিয়েছিলাম। পেটার মূলত কবিতা লেখে, এই সংখ্যাতেও লিখেছিল। আমি একটা প্রবন্ধ লিখি, একটা সাক্ষাৎকার অনুবাদ করি। স্যামুয়েল বলে একটি ছেলে, আমাদের চেয়ে দু’বছরের ছোট, অসামান্য একটা উপন্যাস লিখেছে, আমরা সেটা পত্রিকায় ছেপে দিই। ‘হয়তো আর বেরোবে না’, পেটার আমায় বলেছিল, ‘কিন্তু এই আঁচড়টা অন্তত আমাদের সাহিত্যে থেকে যাবে।’ 

    জোহানকে পত্রিকা দিয়েছিলাম আমরা। পেটার চেয়ারে বসে একথা-সেকথার পর জিগ্যেস করে: দেখলেন পত্রিকা? সাঙ্গপাঙ্গরা জোহানের দিকে চায়। জোহান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটু কাশেন। তারপর গলা খাঁকরান। ‘তোমাদের ভাবনাটাই গোলমেলে’, জোহান অতঃপর বলেন, ‘তৃতীয় বিশ্ব নামে পত্রিকা করে কী প্রমাণ করতে চাও তোমরা? তোমরা কি মনে করো, মানুষ তোমাদের লেখা পড়বে? এই গণশিল্পের অ্যাপ্রোচ তোমরা কেন নিয়েছ?’ আমরা একটু আহত হই। নিজেদের ডিফেন্ড করতে কিছু কথা বলি। ব্রেশট, অ্যান্টিপোয়েট্রি-র প্রসঙ্গ আসে। শুনে মাথা নাড়তে থাকেন জোহান। ‘এগুলো তোমরা বলছ’, জোহান আচমকা সুরটা আক্রমণে নিয়ে যান, ‘কারণ তোমাদের পড়াশোনোটা একদমই নেই। তোমরা সেমিওটিক্স জানো না, সভ্যতার ইতিহাস জানো না, জানলে, ইতিহাস আর সাহিত্যকে মেশাতে যেতে না। এই যে তোমাদের বন্ধু, কী নাম, স্যামুয়েল, সে উপন্যাস লিখেছে, কয়েক পাতার বেশি পড়া যাচ্ছে না, এত সিনট্যাক্সে ভুল। আগে তো বেসিক জিনিসগুলো জানতে হয়!’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে জোহান সাঙ্গপাঙ্গদের দেখিয়ে বলেন, ‘এদেরও বলেছি তোমাদের পত্রিকার কথা। এরাও পড়বে। এদেরই জিগ্যেস কোরো নাহয়।’

    আমরা অপমানে মাথা নীচু করে থাকি। পেটার আমতা-আমতা করে বলতে যায়, ‘কিন্তু দেখুন, আমাদের চিন্তাটাই কি বড় কথা নয়? এত নিখুঁত করার দিকে আমরা যাব কেন, যদি চিন্তাটা জোরালো হয়? রাজনৈতিক শিল্পের ধাঁচাটাই তো অন্যরকম, আমরা…’ পেটারকে বাধা দিয়ে জোহান বলে ওঠেন, ‘রাজনৈতিক শিল্প? বলছ কী, গুছিয়ে প্যাঁদাবে, গুছিয়ে! মার খেতে পারবে? শিল্প একটা নিভৃতির জিনিস, ওটা নিজের কাছে রেখে দাও। পাবলিকের কাছে যাওয়ার দায় তোমাকে কে দিয়েছে? কী চাও তোমরা, খ্যাতি? টাকা?’

    ‘আপনি ভুল করছেন’, আমি এবার কথা বলি, ‘খ্যাতি আমরা চাই না। সেই লোভ আমাদের নেই। আমরা আমাদের চিন্তাটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই, যদি একেবারে নিখুঁত ভাষা না হয়, তাহলেও। এটাকে যদি…’ জোহান মুচকি হাসেন। ‘অদক্ষতাকে মহিমা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া অবশ্য তোমাদের পুরনো রেওয়াজ।’ আমরা চুপ করে যাই। এরপরের আধঘণ্টা জোহান আমাদের তিনকাপ করে চা, দুটো করে টোস্ট খাওয়ান। জোহানের সাঙ্গপাঙ্গরা চকচকে মুখে মজা দেখতে থাকে। জোহান, প্রায় পারফর্ম্যান্সের মতো, পরের পর যুক্তি খাড়া করেন। আমরা যে অসৎ, আমরা যে অশিক্ষিত, আমাদের যে শিল্প করতে আসাই ভুল হয়েছে, তিনি ক্রমে আমাদের বিশ্বাস করিয়ে ফ্যালেন। আমরা মুখ কালো করে বসে থাকি।  

    পেটার হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি একটু আসছি।’ পেটার ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায়। আমি অধোবদনে বসে থাকি। জোহান কাষ্ঠ হেসে বলেন, ‘চলো তাহলে, ওঠা যাক। ট্রামটা বেরিয়ে যাবে নাহলে। তোমাদেরও তো ফিরতে হবে!’ আমি আস্তে-আস্তে মাথা নাড়ি। জোহান বেয়ারাকে ডাকেন ইশারায়। পেটার ঝড়ের গতিতে ঢুকে আসে। ‘আপনি ভেবেছেন, আপনি জিতে গেছেন, তাই না?’ পেটার কথাটা চেঁচিয়েই বলে। কেবিনের সবাই তার দিকে চায়। জোহান অবাক হয়ে তাকান। আমি পেটারকে ধরে ফেলি, কারণ সে জোহানের দিকে হিংস্র ভাবে এগোচ্ছিল। ‘আপনি ভেবেছেন, আপনি সব বুঝে গেছেন, তাই না? আপনার জ্ঞান আপনি নিভৃত শিল্পে রূপ দেবেন, তাই না?’ আমার হাত ছাড়িয়ে পেটার গর্জন করে ওঠে, ‘আমাদের দেখুন। আমরা শিল্প করি নিজের রক্ত দিয়ে। শিল্পের সাদা কুসুম আমাদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে, সেই কুসুম স্বর্গের বাগানে ঝরে পড়লে তবে একটা লেখা জন্মায়!’

    জোহান হেসে ফেলেন। ‘এসব কী হচ্ছে, পেটার’, আমি আবার পেটারকে বাধা দিতে যাই। পেটার ততক্ষণে ক্ষুরটা পকেট থেকে বের করে ফেলেছে। ‘বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? দেখুন তবে।’ বলে পেটার যা করে, আমাদের কল্পনাতেও তা ছিল না। সে, ক্ষুরটা, সরাসরি নিজের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। ধুপ করে শব্দ হয়। একটু গুঙিয়ে পেটার পড়ে যায়। আমি আবার সেই মিষ্টি সুরটা শুনতে পাই। খুব আস্তে, চরাচর জুড়ে বেজে উঠছে। কে বাজাচ্ছে, এখন, এই চায়ের কেবিনে? সবাই স্থির ও চুপ। সবাই মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে থাকা পেটারকে দেখছে। আর আমি, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, সুরটা কোথা থেকে আসছে। কী সুর এটা?

    জোহান অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। জলের ঝাপটা দিয়ে তাঁর হুঁশ আনতে হয়। তখনও তিনি কাঁপছেন।… 

    ৭. 
    সিরিয়ায় যুদ্ধ পুরোদমে চলছে। টেলিভিশন খোলা যাচ্ছে না। ভোরবেলা ফেসবুক খুলেছিলাম, বন্ধ করে দিলাম। ধর্মীয় উস্কানি রোজ-রোজ বেড়ে চলেছে। পাশের রাজ্যে, একটি কালীমন্দিরে ঢুকে, দাঙ্গা লাগানোর জন্যে মূর্তি ভেঙেছে দুজন। হাজার মিম আর ট্রোলে নিউজ ফিড ভরে যাচ্ছে। গত পরশু একটা ঘটনা ঘটেছে, একটি মুসলিম কৃষককে মারা হয়েছে, সেটি ভিডিও করে একদল অনলাইনে তুলে দিয়েছে। ভিডিওটা কয়েক সেকেন্ড দেখতে পারলাম। মরে যাওয়ার আগে লোকটা ভয়ানক, প্রায় পশুর মতো চেঁচিয়েছিল।

    কিছু ভাল লাগছে না, কিছুই না। আজ কারিন ফোন করেছিল। আমি হাঁ-হুঁ করেছি, কী বলছে শুনিওনি। কারিন এক সময় আমার উদাসীনতা বুঝতে পেরে ফোনটা আচমকা কেটে দেয়। জানি না, আজ পড়তে আসবে কি না। না এলে, আমিই একবার ফোন করব। 

    পেটারের ঘটনাটার পর আরও দু’সপ্তাহ কেটে গ্যাছে। শীত পড়ছে অল্প-অল্প। ইউনিভার্সিটিতে দুটো ভিন্ন দলের মিছিল হয়েছে আজ। আমি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, একটা মারামারি লাগছে। জানি না, তারপর কী হয়েছে। বাড়ি ফিরে ফেসবুক দেখিনি। দেখতে চাই না। 

    আমি ডায়েরি লিখছি। লিখতে ইচ্ছে করছে না। জ্বর আসছে।   

    ৮.
    আমার দাদু সাহসী লোক ছিলেন না। তিনি দেশের জন্য কিছু করেননি। দাঙ্গার বছরে তিনি ইংরেজ কোম্পানিতে চাকরি পান। স্বাধীনতার বছরে তিনি সাধারণ মধ্যবিত্তের মতো বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ কাজটার সাহস তিনি কোথা থেকে পেলেন? ডায়েরিতে একটা এন্ট্রি পাচ্ছি, শেষ এন্ট্রি, এরপরের পাতাগুলোয় আর কিছু নেই। ‘হে ঈশ্বর, আমি কেন আর কিছুই বুঝতে পারি না?’ তিনি লিখেছেন। তখন, হিসেব করে দেখছি, আমার তিন বছর বয়স।

    সে, ক্ষুরটা, সরাসরি নিজের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। ধুপ করে শব্দ হয়। একটু গুঙিয়ে পেটার পড়ে যায়। আমি আবার সেই মিষ্টি সুরটা শুনতে পাই। খুব আস্তে, চরাচর জুড়ে বেজে উঠছে। কে বাজাচ্ছে, এখন, এই চায়ের কেবিনে? সবাই স্থির ও চুপ। সবাই মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে থাকা পেটারকে দেখছে। আর আমি, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, সুরটা কোথা থেকে আসছে।

    আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। আমিও খুব একটা সাহসী নই বোধহয়। ছোটবেলায় যতই সাহস দেখাই না কেন, তখন, না চেঁচিয়ে। কই, পেটারের বেলাতেও তো চেঁচাইনি। 

    সিরিয়ার যুদ্ধের বদলা নিতে প্যারিসে আজ আবার হামলা হয়েছে। এবারে ২০০জন মৃত। মাত্র পাঁচজন মিলে হামলা চালিয়েছে, তারপর আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে দুজন শ্বেতাঙ্গ। হামলার দায় আইসিস স্বীকার করেছে।   

    আমি ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি না এক সপ্তাহ হল। বাড়ি থেকেই যেতে বারণ করেছে। সেদিন সত্যিই মারামারি হয়েছিল। এখনও অশান্তি চলছে। দুজন ছাত্র আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি আছে।

    কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। বেরোচ্ছিই না প্রায়। কারিন পড়তে এসেছিল কাল। কথাই বলতে পারিনি। শুকনো মুখে পড়িয়ে গেছি। কারিন চোখের পাতা না ফেলে আমাকে দেখছিল। কিছু বলেনি। 

    ফ্রাঙ্ক এখনও নিখোঁজ। শুনেছি, ফেসবুকে জানানো হয়েছে, কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ওদের বাড়িতে একবারও যাইনি। যাওয়া কি উচিত নয়?

    জানি না কী হয়েছে। চোখ বুজলেই এখন লাল দেখছি। 

    ৯.
    কারিন, আমার কারিন, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, লক্ষ্মীটি, কিছু মনে কোরো না। দু’দিন আমি তোমাকে পড়াতে পারিনি, তুমি আমার ফোন ধরোনি আজ, জানি, তুমি রাগ করেছ। কী করব, আমার মাথাটাই তো ঠিক নেই এখন! তুমি কি বাস্তব, না তোমার না-থাকাটা বাস্তব, সেটাই যে বুঝতে পারছি না। এখন, এই লেখাতে আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। এর আগের এন্ট্রিগুলো ফেলিনি, ইচ্ছে করেই ফেলিনি। এটা আমার দাদুর ডায়েরি, কারিন, এটা অনেক পুরনো ডায়েরি, ১৯৪০ সাল থেকে এখানে এন্ট্রি আছে। খাতাটাও দেখছ, কত জাবদা? এটাকে বলে খেরোর খাতা, জানো? দাদু খুব বেশি লেখেননি, মাঝের ২০ বছর তো একটা লাইনও না, তাই এখনও খানিক ফাঁকা আছে খাতাটা। তুমি চাইলে এই ডায়েরিটা ব্যবহার করতে পারো। এখানে তো আমিও লিখেছি, সুতরাং এটা আমারও ডায়েরি। করবে কি, কারিন? আমি জানি না। তুমি হয়তো আমাকে ঘেন্নাই করবে। তাও সব আমি তোমাকে বলে যাব। কিছু লুকোব না। আজ, সারাদিন, কী হয়েছে জানো? ফ্রাঙ্ককে দেখেছি, হ্যাঁ, আবার! তুমি জিগ্যেস করবে, ফ্রাঙ্ক কে? আমার বন্ধু, কারিন। আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আমি তাকে নিজের থেকে আলাদা করতেই পারিনি। তাও কেন তাকে আমি খুন করেছিলাম? হ্যাঁ, খুন করেছিলাম আমি। না করে যে উপায় ছিল না! ফ্রাঙ্ক, আমাকে না জেনে টর্চার করছিল, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় ছিল তাকে সরিয়ে দেওয়া। ফ্রাঙ্ক কী করেছিল, জানো? সে আমাকে প্লেজিয়ারিস্ট বদনাম দিয়েছিল। বলেছিল, তার আইডিয়া, আমি, তাকে না বলে ঝেড়ে দিয়েছি। একথা অবশ্য বলেছিল ফ্রাঙ্ক, হাসতে-হাসতে। কিন্তু আমার শরীর-মন জ্বলে গেছিল। কেননা, একথা সত্যি, ফ্রাঙ্কের সাথে আমি প্রচুর ভাবনা বিনিময় করেছি। কিন্তু ঝেড়ে দেওয়া? … লেখার সময় আমার থোড়ি মনে থাকে কোনটা ফ্রাঙ্কের, কোনটা পোল্যান্ডের কবির, আর কোনটা আমার নিজের! আমি ভূতগ্রস্তের মতো লিখি, উন্মাদের মতো লিখি, এই যেমন এখন লিখছি! ফ্রাঙ্ক কিন্তু নিষ্ঠুর হয়ে উঠছিল দিনে-দিনে। সে আমার সঙ্গে আর আগের মতো কথা বলত না, আমি জানি কেন বলত না। বা, আমাকে দেখলেই সে পুরনো ঘ্যানঘ্যান শুরু করত। তার আইডিয়া নিয়ে আমি কেন আমার লেখাগুলো লিখেছি, ছাপতে দিয়েছি? আমার শেষ দিকে আর রাগ হত না, ভয় হত! ফ্রাঙ্ককে দেখলেই ভয় হত। মনে হত,ওই, আমার ধ্বংস আসছে। আমার আত্মপরিচয় কেড়ে নিতে আসছে। ওকে এর জন্য, এই হুবহু মিলের জন্য তো মরতেই হত! তুমি দুঃখ পেও না। ভেবে দ্যাখো, আমিও একটা রক্তমাংসের জন্তু। তোমার সঙ্গে যদি এমন হত, তুমি কী করতে? বলতে পারবে না, জানি। বড়দের জটিলতা তোমার বোঝার কথা না। একটা ভূতই পেয়ে বসল আমায়। … ফ্রাঙ্ককে আমি পুকুরধারে নিয়ে গিয়ে থেঁতলে মারি। তারপর একটা পাথর ওর গলায় বেঁধে জলে ডুবিয়ে দিই। বুঝলে, আমি অবিশ্বাস্য আরামে কাটিয়েছিলাম ওই ক’টা দিন! খচখচানি থেকে মুক্তির যে কী আরাম!  জানতাম না, আবার, আবার সেই খচখচ শুরু হবে, ফ্রাঙ্ককে রক্তমাখা অবস্থায় যখন আমি স্টেশনে দেখব! আজ কী হল, তাই বলছি। হাওড়া স্টেশনে, মোটামুটি ফাঁকা ট্রেনে যখন উঠেছি, দেখি, পেছনের সিটে, রক্তমাখা ফ্রাঙ্ক বসে আছে। পাথরের মতো চোখে সে আমার দিকে চেয়ে। আমি পাগল হয়ে উঠলাম। আমার কি তবে স্কিৎজোফ্রেনিয়া হয়ে যাচ্ছে? হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? ট্রেনের আর কেউ ফ্রাঙ্ককে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু আমি?…

    আমি ফ্রাঙ্ককে দেখব না, ঠিক করলাম। ট্রেন ছাড়ল। আমি প্রাণপণে মুখ ফিরিয়ে জানলার দিকে চেয়ে রইলাম। কী সুন্দর একটা সূর্যাস্ত হচ্ছিল তখন! চোখ ঝলসে যাচ্ছিল। সবুজ আর লাল মিলে এত সুন্দর প্রকৃতি… কতদিন এর দিকে তাকাইনি! আমি মুখ ফেরালাম। দেখলাম, পেছনের সিটে রক্তমাখা ফ্রাঙ্ক একভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে। রেহাই নেই, কোথাও আমার রেহাই নেই। … আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। চোখে জল চলে আসছিল। কারিন, আমাকে ভুল বুঝো না। আমার উপায় ছিল না কোনও। কী করে থাকবে? আমি নিজের স্টেশনে নামতে, দেখি, ফ্রাঙ্কও নামল। আমি হেঁটে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি, সে আমার পিছু-পিছু হাঁটছে। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, সে-ই। তার মুখে হাসি নেই, রাগ নেই। মূর্তির মতো সে চেয়ে আছে আমার দিকে, তার পাথরের চোখ। তখন আমি সিদ্ধান্তটা নিলাম। ওভারব্রিজ ক্রস করে আমরা দুজন নেমেছি, দেখি, রাস্তায় একগাড়ি পুলিশ। লোক প্রায় নেই, একজন উত্তেজিত মুখে বলছে, ‘কার্ফু, কার্ফু।’ তারপর সে একটা দোকানের ঝাঁপের আড়ালে চলে গেল। কী হয়েছে? আমি জানি না। আমি তখন মরিয়া। পুলিশ যেদিকে নেই, সেদিকে, সেই পানাপুকুরের দিকে, (হ্যাঁ কারিন, স্টেশনের কাছেই পুকুরটা) এগিয়ে গেলাম। আমি জানি, ফ্রাঙ্ক আসবে। এলও। নির্জনে, মশার কামড়ের ভেতরে, আমরা মুখোমুখি দাঁড়ালাম। আমি হাতের কাছে আর কী পাব, একটা আধলা ইট পড়ে আছে দেখলাম। ওটা মারলাম ফ্রাঙ্কের মাথায়। আশ্চর্য, ও বাধা দিল না। যেন নারকোল, মাথাটা ফেটে গেল। ফট করে শব্দ হল, আরও রক্ত গলগল করে ওর শরীর ভরিয়ে… এহ, এসব কী লিখছি? তুমি পড়ছ কি এখনও? জানি না। আশা করছি পড়ছ। … তারপর যা হল, তাই সংক্ষেপে বলছি। … রক্তমাখা ফ্রাঙ্ক মরে গেল। তার গলায় আবার ইট বেঁধে আমি চুবিয়ে দিলাম পুকুরের জলে। এই পুরো কাজটা করতে আমার কয়েক মিনিট মাত্র লেগেছিল। আমি, আরেকবার, ফ্রাঙ্কের হাত থেকে নিজেকে বাঁচালাম। ফিরে এলাম রাস্তায়। পুলিশ আমাকে ডাকল। জিগ্যেস করল, কোথা থেকে আসছি। আমি বললাম। ছাত্র শুনে পুলিশ যেতে দিল। সাইকেল স্ট্যান্ডে ঝাঁপ পড়ে যাচ্ছিল, আমি ভাগ্যিস ঢুকে পড়লাম তক্ষুনি। সেখানেই শুনলাম কী হয়েছে। তুমিও এখন জানো, কী হয়েছে। স্থানীয় একটা মন্দিরে কারা ভাঙচুর চালিয়েছে, তার জবাব হিসেবে দুজনকে কুপিয়ে দিয়েছে জনতা। কার্ফু নেমে গেছে। রাস্তা এইজন্যে এত ফাঁকা। ‘দাঙ্গাই কি লেগেছে?’ আমি বিহ্বল হয়ে জিগ্যেস করলাম। লোকটি উত্তর দিতে পারল না। কথা বলল না। তারপর, থমথমে শহরের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আমি বাড়ি এলাম। বাড়ি থেকে ফোন আসছিল ঘন-ঘন, কেন, আগে বুঝিনি। কয়েক জায়গায় জটলা দেখলাম। পুলিশ আমাকে আরও দু’জায়গায় চেক করল। ছেড়েও দিল। বাড়ি ফিরতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার নরম, শান্ত মা। আমি… কারিন, আমাকে তুমি ঘৃণা কোরো না। তুমি জানো কি, আমি মা’কে খুবই ভালবাসি? অথচ মা-র সঙ্গে একটা কথাও আমি বলতে পারলাম না। কেন, কারিন?

    এখন রাত দশটা, কারিন, এখন আমি এই ডায়েরিতে লিখছি। এটা অনেক পুরনো ডায়েরি, কারিন, লেখার সাথে-সাথে আমার কেমন রোমাঞ্চ জাগছে, মনে হচ্ছে, এটা একটা ঐতিহাসিক খাতা! এর পাতাগুলো দ্যাখো, কেমন হলুদ! আমার দাদু এখানে ঈশ্বর-বন্দনা করেছেন, ১৫ই অগাস্ট-এ লিখেছেন, ‘আজ পুণ্যদিন।’ এই খাতা প্রথম আমিই পেয়েছি, আমি ছাড়া আর কেউ জানে না এই খাতার কথা, চাইলেই খুঁজে পেত, পায়নি।

    কারিন, আমি টেলিভিশন দেখছি না, নীচে হয়তো আমার বাবা দেখছেন। হয়তো মা-ও। আমি দরজাটা বন্ধ করে এখন লিখছি, তোমাকে, শুধু তোমাকে। টেলিভিশনে হয়তো খবর হচ্ছে, হয়তো দাঙ্গা এখন থেমে গেছে, হয়তো দাঙ্গা আরও অন্য অন্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি জানি না কারিন। শহরের লোকে আজ রাতটা খুব ভয়ে কাটাবে। আমাদের পাড়াটা শান্তিপূর্ণ, তবু, বলা যায় না, ওরা যদি আসে? যদি…

    ওদের ভয় ওরা পাক কারিন, ওদের ভয়ে ওরা মরুক। আমি বাড়ি ফিরে ফেসবুক চালিয়েছিলাম একবার, খুলে দেখি ফ্রান্স সিরিয়ায় একদিনে ২০টা বোমা ফেলেছে, তা নিয়ে নিউজ ফিডে আগুন ছড়িয়ে গেছে। সবাই পক্ষ নিচ্ছে, কেউ আইসিসের, কেউ ফ্রান্সের, সবাই চিৎকার করছে, কারো কথা কেউ শুনছে না। কারিন, আসলে ওরা সবাই ভয় পাচ্ছে, সেই ভয় ঢাকতে ওরা এত কথা বলছে, এত শব্দ করছে…

    কিন্তু কীসের ভয়? ওরা কি ভয়কে জানে?

    আমি তো দাদুকে ছোটোবেলায় ওই অবস্থায় দেখেছিলাম। ভয় পাইনি তো? পেটারের বেলাতেও ভয় করল না। সোনাগাছি গিয়েও… কই, না! তাহলে এখন আমার ভয় হচ্ছে কেন? ভয়, মানে কারিন, বিশ্বাস করবে না, দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে! আমি ফ্রাঙ্ককে আবার দেখতে পেয়েছি, ফ্রাঙ্ক আমার ঘরে, কম্পিউটারের চেয়ারে, চুপ করে বসে আছে। আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে সে, তার পাথরের চোখ। আরও বেশি রক্তে সে ঢেকে গেছে।

    আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি, তুমি বলবে। ফ্রাঙ্ক কে? ফ্রাঙ্ক বলে কেউ ছিল? ও কি কল্পনা? ও কতদিন নিরুদ্দেশ, তিন সপ্তাহ, চার সপ্তাহ? মনে নেই কারিন। আমার কিছুই মনে পড়ছে না, আমার ভয়ও আর করছে না। ভয়ের শেষ সীমায় হয়তো আর ভয় করে না। আমি শান্তভাবে ডায়েরি লিখছি। একটু পরেই আমি ছাদে উঠে যাব। ফ্রাঙ্কও নিশ্চয়ই উঠবে, আমার পিছু-পিছু। আমরা দুজন ছাদে মুখোমুখি দাঁড়াব। না, ফ্রাঙ্ককে আমি আর মারব না। আমি তার বদলে রেলিং-এ উঠে এক পা, তারপর দু’পা শূন্যে ছেড়ে দেব। ফ্রাঙ্ক, আমি জানি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে আমাকে দেখবে।

    আবার মিষ্টি সুরটা শুরু হয়েছে। চরাচর ব্যপ্ত করে সুরটা বেজে উঠছে, আস্তে, খুব আস্তে…

    আমার হালকা লাগছে। ভীষণ হালকা। আঃ কারিন, শুনতে পাচ্ছ, কী অন্তহীন আনন্দ এখন বেজে উঠছে তারায় তারায়? আমি শুনতে পাচ্ছি!…

    কারিন, কারিন! আমার লক্ষ্মীটি, ভয় পেও না। জানবে, সমস্ত ভয়ের শেষে আছে হালকা হয়ে যাওয়া, আছে নির্ভারতা।

    ভাল থেকো খুব।  

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook