ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভিড়ের মধ্যে একক


    পূর্ণিমা দত্ত (February 5, 2022)
     

    বার্লিনের হোটেলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে মুড়িমাখা খাচ্ছি আর আড্ডা দিচ্ছি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে, এ সৌভাগ্যের স্বাদই আলাদা! ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাটি বালির্নের গোল্ডেন বেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিল। গুগাবাবা সিনেমাটি আমাদের প্রোডাকশন হাউস থেকে তৈরি, সেই কারণেই প্রযোজক হিসেবে মানিকদার পরিবার, তপেন, রবি আর আমরা গিয়েছিলাম বার্লিন। সেখানে গিয়ে বিজয়া-বৌদি হোটেলের রুমে গুছিয়েগাছিয়ে বসে একদম কলকাতার মুড়িমাখা খাইয়েছিলেন। সেসব দিন ছিল বটে। সিনেমা আর সিনেমাকে ঘিরে সময়, পুরোটাই ছিল সেলিব্রেশন।

    বার্লিনে দেখেছি, পৃথিবীখ্যাত সব ফিল্ম ডিরেক্টর এবং ফিল্ম-ব্যক্তিত্বরা মানিকদাকে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন। প্রত্যেকে এসে কথা বলছেন, হাত মেলাচ্ছেন, গল্প করছেন। যেন মানিকদার সঙ্গে কথা বলা, দেখা করাটা অবশ্যকর্তব্য। আর মানিকদার টাওয়ারিং পার্সোনালিটি! মানিকদা খুব লম্বা ছিলেন, কিন্তু জার্মানরা বা অন্যান্য ইউরোপীয় পরিচালক বা নায়ক, তাঁরাও তো লম্বা। কিন্তু তার মধ্যেও মানিকদা যেন জ্বলজ্বল করছেন। সবার মধ্যেও একক। আর তখনই দেখেছি ভিড়ের মধ্যে মানিকদা যদি কোনও ভারতীয়কে দেখতে পেতেন, সব ভিড় সরিয়ে আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন। সৌজন্য বিনিময় করতেন।

    বাঘাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়

    আমার সঙ্গে মানিকদার আলাপ আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকে। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (শাঁটুলবাবু) ছিলেন আমার জামাইবাবু। আর মানিকদা ছিলেন জামাইবাবুর খুব বন্ধু। সেই সূত্রে আলাপ। মানিকদা যখন দার্জিলিং-এ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র শুটিং-এ গেছেন, তখন আমরা নিয়ম করে কেভেন্টার্স-এ ব্রেকফাস্ট করতে যেতাম। কেভেন্টার্স-এ খুব পপুলার ছিল কফি উইথ ক্রিম। সবাই তা-ই খেত। আর আমি খেতাম ক্রিম উইথ কফি। মানে প্রায় এক কাপ ক্রিমে দু-চামচ কফি মিশিয়ে। মানিকদা প্রথম-প্রথম অবজার্ভ করে আমায় বললেন, ‘তুমি কফিটা খেতে চাও, না ক্রিমটা?’ বললাম, ‘বাড়িতে তো আমি কফি খেতেই পারি, কিন্তু এই কোয়ালিটির ক্রিম তো বাড়িতে পাব না।’ ওঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাহাহাহা করে হেসে উঠলেন। বোধহয় খুব মনে ধরেছিল যুক্তিটা। তাঁর সঙ্গে পরচয়ের গণ্ডি বাড়ে বিয়ের পর। আমার শ্বশুরবাড়ির ছিল সিনেমা প্রোডাকশন হাউস। এই হাউসের প্রথম ছবি সম্ভবত ‘চন্দ্রশেখর’। খুব নাকি হিট করেছিল। আমার স্বামী অসীম দত্তের সঙ্গেও মানিকদার ভাল বন্ধুত্ব ছিল। প্রায়শই আড্ডা দিতে আসতেন এ-বাড়িতে। এরকমই একদিনের আড্ডায় উনি বললেন, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ নামের একটি সঙ্গীত-নির্ভর ছবি করতে চান। গানগুলো তাঁর সব তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মানিকদার তৎকালীন প্রায় সব সিনেমার প্রযোজক আর ডি বনশল এই ছবিটি প্রযোজনা করতে রাজি হননি। মানিকদা দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘এই ছবিটা করা আমার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু গানগুলো চিরকালই মনে হয় ক্যানড হয়ে থেকে যাবে।’ সেকথা শুনে আমার শ্বশুরমশাই নেপাল দত্ত, আমায় বললেন, ‘তুমি গিয়ে ছবির গল্প এবং গানগুলো শুনে এসো। আমার মনে হয় এই ছবিটা আমাদের অবশ্যই করা উচিত।’ আমি একদিন গিয়ে গানগুলো শুনে তো আত্মহারা হয়ে গেলাম বলা চলে। একরকম ঘোরের মধ্যে বাড়ি এসে বললাম, এ ছবির কোনও তুলনাই হবে না কোনওদিন। এবং স্থির হল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিটি হবে। তার পরেরটা তো ইতিহাস।

    মানিকদার সঙ্গে আমাদের পরের ছবি, গুগাবাবার পরের বছরেই। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। এই ছবিটার আউটডোরে যাওয়ার সময় একটা দারুণ মজার ঘটনা ঘটেছিল। ছবির প্রস্তুতিপর্বের সময় থেকে রিঙ্কু, সিমি, আমি খুব আড্ডা দিতাম। ওরা খুব চেয়েছিল, আমিও আউটডোরে যাই। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা তখন ছোট, কিছুতেই ছাড়তে চাইত না আমায়। তাই রিঙ্কুদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও যেতে পারলাম না। তবে সি-অফ করতে হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলাম। সিমি, রিঙ্কুরা যাচ্ছিল একটা সেলুন-কার’এ। ওরা ন্যাশনাল স্টার তখন, উঠেই পর্দা-টর্দা সব টেনে দিয়েছে। আমি ভেতরে বসে গল্প করছি, ট্রেন ছাড়ার সময় হলে নেমে যাব। হঠাৎ দেখি সিমি আর রিঙ্কুর মুখে একটা দুষ্টু হাসি-হাসি ভাব, কিছু লুকোতে চাইছে। আমি জিজ্ঞেস করছি, ‘কী হল বল তো?’ কিছু বলছে না, মুখ টিপে হাসছে দুজনেই। আমি বেশ কিছু সেকেন্ড পর বুঝলাম, ট্রেনটা দুলছে। মানে স্টেশন থেকে ছাড়ছে! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘তোমরা আমাকে সত্যি সত্যি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিলে!’ দৌড়ে দরজায় গিয়ে লাফ মেরে স্টেশনে নামলাম চলন্ত ট্রেন থেকে। ছবি করতে গিয়ে এমন বন্ধুত্ব পাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার।

    অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির শুটিং-এর সময়

    ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ করার সময়ই মানিকদা আমার স্বামীকে বলেছিলেন, ‘অসীম, আমি কিন্তু এই টালমাটাল সময়টাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে একটা ছবি করার কথা ভাবছি।’ ততদিনে আমরা নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। মানিকদা তৈরি করলেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’— কলকাতা ট্রিলজির প্রথম ছবি। এখন ভাবি, অমন অশান্ত সময়ে ওই ছবি— অথচ, কোথাও বিক্ষোভ, ভাঙচুর, বিরূপ প্রতিক্রিয়া, কিচ্ছু হয়নি। বাঙালি শিক্ষিত দর্শক ছিল সে-সময়। অবশ্য সুন্দর, মানে ধৃতিমান চ্যাটার্জিকে কাস্ট করা নিয়ে বাবুর (সন্দীপ রায়) প্রথম রিঅ্যাকশনটা আমার এখনও মনে আছে। আমরা সবাই সুন্দরকে ছবিতে নেওয়ায় একটু অবাক হয়েছিলাম বটে, কারণ ও খুব বেশি-রকম স্মার্ট ছিল। বাবু বলেছিল, ‘আরে, ও তো পার্কস্ট্রিটে যেসব ছেলেরা ঘুরে বেড়ায়, তাদের মতো। একদম পুরো চার্মার।’ তাতে ধৃতিমানের খুব অভিমান হয়েছিল। অথচ দেখুন, সুন্দর কী অভিনয় করেছিল। আসলে মানিকদা এমন অভিনেতা খুঁজতেন, যে চরিত্রের সঙ্গে মানানসই হবে, স্টার খুঁজতেন না। এখন তো সবাই আগে স্টার নেয়, তারপর ছবির কথা ভাবে। আসল ছবি কি আর সেভাবে বানানো যায়? উনি গুগাবাবার খেরোর খাতায় তো কত আগে গুপীর চরিত্র এঁকেছিলেন, তারপর উনি যে কী করে তপেনকে খুঁজে বার করলেন, সেটা এখনও বিস্ময়! ওঁর অবজার্ভেশন পাওয়ার, ধৈর্য, মনোনিবেশ যে কোন উচ্চতায় পৌঁছত, এই কাজগুলো দেখলে বোঝা যায়।

    প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির শুটিং-এ সত্যজিৎ রায়। পাশে ধৃতিমান চ্যাটার্জি

    সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমরা যে তিনটি ছবি করেছি, সবকটাই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে। এর চেয়ে গর্বের কিছুই হয় না। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি তো আর কেবল সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে নয়। অনেক পরিচালক তখন আমাদের সঙ্গে ছবি করতে চাইতেন। তার একটা কারণও ছিল, আমরা একাধারে প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটর আর এগজিবিটর ছিলাম। এক জায়গায় তিনটে কাজ হয়ে গেলে, পরিচালকেরও সুবিধে হয়। আর তাছাড়া আমাদের সঙ্গে সবারই খুব সুসম্পর্ক ছিল। তখন আমার স্বামী অসীম দত্ত বললেন, ‘মানিকদা, এখন আর আমরা আপনার ছবি প্রযোজনা করতে পারছি না। অন্যান্য পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করতে চাই।’ খুব সরাসরি বলেছিলেন। এবং মানিকদা কিচ্ছু মনে করেননি। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক কখনও একটুও টোল খায়নি। সেই আড্ডা, সেই গল্প, সেই যাতায়াত— সম্পর্ক একই রকম ছিল।

    অনেকে আমায় জিজ্ঞেস করেন, এখনকার প্রজন্মের কাছে সত্যজিৎ রায় প্রাসঙ্গিক কি না। আমি বলি, যদি তিনি প্রাসঙ্গিক না-ই হতেন, তা হলে এতগুলো রে-সোসাইটি তৈরি হত না, এখনও নতুন করে ছেলেমেয়েরা তাঁর সিনেমা দেখে শিখতে চাইত না। আসলে এখন দর্শকরা এবং পরিচালকরা স্পষ্ট দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা দল কেবল বিনোদনের জন্য ছবি দেখে বা বানায়, আর অন্য একটা ঘরানা আছে, যারা শিক্ষিত ছবি বানায় শিক্ষিত দর্শকের জন্য। আগেও এই বিভাজনটা ছিল বটে, কিন্তু তখন কেবল বিনোদনের জন্যও যেসব ছবি তৈরি হত, তার মান ছিল অনেক উঁচুতে বাঁধা। আর একটা কথা তো মানতেই হবে যে, সত্যজিৎ রায় একজন বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক, একজন মাস্টার। অতএব তাঁর কাজের মূল্যায়ন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হতেই থাকবে।

    সিলভার বেয়ার হাতে সত্যজিৎ রায়ের ছবিটি পূর্ণিমা দত্ত-র সৌজন্যে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook