২০০৩ সাল। আমি ও অভিজিৎ একসঙ্গে পরিচালনা করলেও, ঋতুপর্ণ ডাক দিলে সব ছেড়ে ওর সঙ্গে কাজ করতে চলে যেতাম। আর এবার তো ‘চোখের বালি’ করবে ঋতু, আমাদের আর ধরে রাখে কে? প্রসেনজিৎ, টোটা, রাইমা, প্রত্যেকেই ঘরের লোক, কিন্তু বিনোদিনীর চরিত্রে চমক আছে। প্রযোজক এসভিএফ-এর সঙ্গে কথা হয়েছে, ঋতু ঠিক করেছে ঐশ্বর্য রাই হবে বিনোদিনী । ঋতুর ততদিনে মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে দারুণ নাম। ওর ছবিতে অভিনয় করলে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এই মর্মে প্রচার ছড়িয়ে পড়েছে। সদ্য ‘বাড়িওয়ালি’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা পেয়েছেন কিরণ খের। যদিও একটা ডাবিং কেলেঙ্কারির অপ্রীতিকর ঘটনা তার পিছনে ছিল। সে যাই হোক, পুরস্কারটা তো পেয়েছেন।
ঐশ্বর্য তত দিনে ‘হম দিল যে চুকে সনম’,’তাল’ ইত্যাদি ছবি করেছে। তার উপর আবার নানা ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে গুজব। ও তখন বড় তারকা। করবে কি বাংলা ছবি?
ঋতুর আত্মবিশ্বাস ও মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি দারুণ ছিল।
ও গিয়ে এমন চিত্রনাট্য ও গল্প বলল যে ঐশ্বর্য এবং তার পুরো পরিবার কুপোকাত। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, ঋতুর পরিচালনা, কলকাতার সবচেয়ে বড় তারকা প্রসেনজিৎ, সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ প্রযোজক সংস্থা, সব মিলিয়ে রাই পরিবার মুগ্ধ।
ডেট দিয়ে দিল বিশ্বসুন্দরী। কলকাতা ও বারাণসী দু’জায়গায়। আবার কলকাতায় দু’বার আসতেও রাজি।
এরপর শুরু হল ওর স্টাইলিস্ট ও ড্রেস ডিজাইনারের সঙ্গে কথোপকথন। ঋতু বলেছিল ডিজাইনার দরকার নেই, কারণ বিনোদিনী পরবে সাদা থান, ব্লাউজ ছাড়া। আর লাগবে একটা ভেলভেটের ব্লাউজ, যার নকশা ঋতু ঠিক করবে। একটা বিয়ের বেনারসী, যা আমরা জোগাড় করেছি, যেটা ওই সময়কার, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ব্যবহৃত। আর একটি লাল পশমিনা শাল, যেটা এক বান্ধবীর কাছ থেকে ধার করা। ঋতু এ ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিল।
পোশাক, গয়না একেবারে অথেন্টিক, খাঁটি হওয়া চাই। ঠিক ওই সময়কার। অঞ্জলি জুয়েলার্স-এর অনন্যার সঙ্গে কথা বলে তৈরি হল গয়না। আবার তা মিলিয়ে নেওয়া হল পুরনো ছবি দেখে। কিছু আবার অনন্যার নিজস্ব ওই সময়কার গয়না, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। মুম্বইয়ের ডিজাইনারের পক্ষে এগুলি জোগাড় করা অসম্ভব, আমাদের সাহায্য ছাড়া । তাই তিনি কিনলেন শুধু রেশমের সাদা থান, আর ফিনফিনে সুতির থান। তা দেখেই নাকচ। এল একেবারে ধবধবে সাদা মোটা থান। কিনে আনলাম আমি ও বিবিদি ( বিবি রায়)। খাদি ভবন থেকে। আর একটা সোনামুগী সিল্কের সাদা থান ।
শুটিং শুরু হল, ঐশ্বর্য আসবে দুদিন পর। আমাকে আর বিবিদিকে ভার দেওয়া হল ঐশ্বর্যর পোশাক ও প্রসাধন তত্ত্বাবধানের। প্রথম দুদিন দারুন রিল্যাক্সড শুটিং হল। তৃতীয় দিন ঐশ্বর্য পৌঁছল। ঋতু আলাপ করিয়ে দিল সবার সঙ্গে। কী অমায়িক ব্যবহার মহিলার। আমরা তো মোহিত।
ঋতু যা বলে, সুবোধ বালিকার মতো মেনে নেয়।সব শেষে ঋতু বলে যায়, লুক নিয়ে আমি আর বিবিদি বলব। প্রথমেই ওকে দিলাম সেই খাদি থান। দেখল, আঙুল দিয়ে মাপল কতটা মোটা, তারপর বার করল ওর ডিজাইনারের দেওয়া থান। ফিনফিনে মিলের শাড়ি। এটাই ও পরবে। কী করি? সব ব্যাপারে ঋতুকে নিয়ে আসা ঠিক নয়। হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। ওর কাপড়টা গায়ে ফেলে বললাম, ‘এটা বড় পাতলা, দ্যাখো, পেটটিকোট ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরবে, শরীর দেখা যাবে। তবে একটা কাজ করতে পারো, আগেকার দিনে অনেক অন্তঃপুরবাসিনী পেটিকোট না পরে আলতা দিয়ে পা ও নিতম্ব রাঙিয়ে নিত। তুমিও তা করতে পারো।’ এত গম্ভীরভাবে কথাটা বললাম যে টোপ খেয়ে গেল। মার সঙ্গে ওর নিজস্ব তুলু ভাষায় কথা বলে রাজি হয়ে গেল মোটা থান পরতে। নিতম্বে আলতার জোর কত!
এরপর শুরু হল প্রসাধন। বললাম যা করবে লুকিয়ে-চুরিয়ে করো, ঋতু কিন্তু চায় নো-মেকআপ লুক। চলল নানা গবেষণা । শুধু ম্যাক কম্প্যাক্ট অথবা হালকা প্যান স্টিক, একটু লিপ গ্লস ন্যাচারাল শেড-এর, চোখে হালকা কাজল, চোখের কোলে কভার স্টিক। ঋতু এল, এসে ওকে দেখে বলল, কাজল তোলো, চোখের কোলে কালি চাই, যদি না থাকে দাও, আর বলেই টিস্যু নিয়ে ওর ঠোঁট আর গাল ঘষে দিল । চলবে না, কোনো প্রসাধন চাই না, তুমি এমনিই সুন্দরী, একেবারে রাশিয়ার সাদা ক্রেন প্রজাতির এলিগ্যান্ট পাখি। আমি সেটাই চাই। ঋতু চলে যাওয়ার পর ও জিজ্ঞেস করল,’ ও কি আমার প্রশংসা করল না কি…’
আমি হাঁইহাঁই করে বললাম, ‘পাখি ঋতুর খুব প্রিয়, ও তোমাকে কত বড় কমপ্লিমেন্ট দিল জানো না।’
শুটিং ভালই চলছে, এর মধ্যে আমরা গেছি বাওয়ালির কাছে একটি গ্রামে। সেখানে প্রথম দিন প্রসেনজিতের শুটিংয়ে লোক উপচে পড়ছে। চারিদিকে ‘পসেনজিৎ ,পসেনজিৎদা, দাদা’ ধ্বনি। আমরা শুটিং করব না লোক সমলাব বুঝছি না। পুলিশ আসায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হল।
ঐশ্বর্য দেখলাম বেশ মুগ্ধ। ‘বেঙ্গলে খুব জনপ্রিয়…অনেকটা অমিতাভ বচ্চনের মতো ওঁর ক্রেজ এখানে!’
আসলে যখন আমরা বারাণসীতে, তখন ঐশ্বর্যকে দেখতে নৌকো করে কাতারে কাতারে লোক এসেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দি ছবির নায়িকার কাটতি ওখানে অনেক। কিন্তু বাওয়ালিতে প্রসেনজিতের দাপট দেখার মতো। পরদিন শুধু ঐশ্বর্যের শুটিং। প্রসেনজিৎ নেই। তাও মা-বোনেরা দেখতে এসেছে তাদের মনের মানুষকে। ভিড় করছে। আর বার বার জিজ্ঞেস করছে, প্রসেনজিৎ কখন আসবে। যত বলি আজ শুধু নায়িকাই আছেন, বিশ্বাসই হয় না। কে গো নায়িকা? ঋতুপর্ণা?
আমরা বলি, না গো না, ঐশ্বর্য।
সে কে গা ?
হিন্দি ছবির নায়িকা।
কে?
এই সময় সাদা থানে বেরিয়ে এল ঐশ্বর্য। একঢাল চুল মাথায়, তন্বী চেহারা….
মহিলারা তাকিয়ে দেখছে।
কে? কে?
ঐশ্বর্য রাই ।
রায়ই হোক আর রাধাই হোক, বড্ড রোগা! শুধু হাড় আর হাড়!
বডি শেমিং তখনও এত জনপ্রিয় কনসেপ্ট হয় ওঠেনি! অবশ্য এখনও গ্রামেগঞ্জে এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।
আরেকজন বলল,ফর্সা বটে।
ধলা মেমসাহেবের মতো, শরীরে নেই কোনো ঢেউ।
মানে?
চেহারায় নেইকো পেলবতা।
ভাগ্যিস ঐশ্বর্য তেমন বাংলা বুঝত না।
কিছুক্ষণ পর প্রসেনজিৎ প্রসেনজিৎ হা-হুতাশ করতে করতে সবাই চলে গেল, আর আমরা নিশ্চিন্তে গলায় কলসি বেঁধে পুকুরে ডুব দিলাম । হ্যাঁ ওই দৃশ্যই সেদিন শুটিং হচ্ছিল।